নগদ কথা
দুন্দুভি তোর বাজল অনেক
অনেক শঙ্খ ঘন্টা কাঁসর,
মুখস্থ তোর মন্ত্ররোলে
মুখর আজি পূজার আসর, −
কুম্ভকর্ণ দেবতা ঠাকুর
জাগবে কখন সেই ভরসায়
যুদ্ধভূমি ত্যাগ করে সব
ধন্না দিলি দেব-দরজায়।
দেবতা-ঠাকুর স্বর্গবাসী
নাক ডাকিয়া ঘুমান সুখে,
সুখের মালিক শোনে কি – কে
কাঁদছে নীচে গভীর দুখে।
হত্যা দিয়ে রইলি পড়ে
শত্রু-হাতে হত্যা-ভয়ে,
করবি কী তুই ঠুঁটো ঠাকুর
জগন্নাথের আশিস লয়ে।
দোহাই তোদের! রেহাই দে ভাই
উঁচুর ঠাকুর দেবতাদেরে,
শিব চেয়েছিস – শিব দিয়েছেন
তোদের ঘরে ষণ্ড ছেড়ে।
শিবের জটার গঙ্গাদেবী
বয়ে বেড়ান ওদের তরি,
ব্রহ্মা তোদের রম্ভা দিলেন
ওদের দিয়ে সোনার জরি!
পূজার থালা বয়ে বয়ে
যে-হাত তোদের হল ঠুঁটো,
সে-হাত এবার নিচু করে
টান না পায়ের শিকল দুটো!
ফুটো তোর ওই ঢক্কা-নিনাদ
পলিটিক্সের বারোয়ারিতে –
দোহাই থামা! পারিস যদি
পড় নেমে ওই লাল-নদীতে।
শ্রীপাদপদ্ম লাভ করিতে
গয়া সবাই পেলি ক্রমে,
একটু দূরেই যমের দুয়ার
সেথাই গিয়ে দেখ না ভ্রমে!
না–আসা দিনের কবির প্রতি
জবা-কুসুম-সংকাশ রাঙা অরুণ রবি
তোমরা উঠিছ; না-আসা দিনের তোমরা কবি।
যে-রাঙা প্রভাত দেখিবার আশে আমরা জাগি
তোমরা জাগিছ দলে দলে পাখি তারই-র লাগি।
স্তব-গান গাই আমি তোমাদেরই আসার আশে,
তোমরা উদিবে আমার রচিত নীল আকাশে।
আমি রেখে যাই আমার নমস্কারের স্মৃতি –
আমার বীণায় গাহিয়ো নতুন দিনের গীতি!
নিশীথ অন্ধকারে
(গান)
এ কী বেদনার উঠিয়াছে ঢেউ দূর সিন্ধুর পারে,
নিশীথ-অন্ধকারে।
পুরবের রবি ডুবিল গভীর বাদল-অশ্রু-ধারে,
নিশীথ-অন্ধকারে॥
ঘিরিয়াছে দিক ঘন ঘোর মেঘে,
পুবালি বাতাস বহিতেছে বেগে,
বন্দিনি মাতা একাকিনী জেগে কাঁদিতেছে কারাগারে,
শিয়রের দীপ যত সে জ্বালায় নিভে যায় বারে বারে।
নিশীথ-অন্ধকারে॥
মুয়াজ্জিনের কণ্ঠ নীরব আজিকে মিনার-চূড়ে,
বহে না শিরাজ-বাগের নহর , বুলবুল গেছে উড়ে।
ছিল শুধু চাঁদ, গেছে তরবার,
সে চাঁদও আঁধারে ডুবিল এবার,
শিরতাজ-হারা কাঁদে মুসলিম অস্ত-তোরণ-দ্বারে।
উঠিতেছে সুর বিদায়-বিধুর পারাবার-পরপারে।
নিশীথ-অন্ধকারে॥
ছিল না সে রাজা – কেঁপেছে বিশ্ব তবু গো প্রতাপে তার,
শত্রু-দুর্গে বন্দি থাকিয়া খোলেনি সে তরবার।
ছিল এ ভারত তারই পথ চাহি,
বুকে বুকে ছিল তারই বাদশাহি,
ছিল তার তরে ধুলার তখ্ত্ মানুষের দরবারে।
আজি বরষায় তারই তরবার ঝলসিছে বারে বারে।
পাথেয়
দরদ দিয়ে দেখল না কেউ যাদের জীবন যাদের হিয়া,
তাদের তরে ঝড়ের রথে আয় রে পাগল দরদিয়া।
শূণ্য তোদের ঝোলা-ঝুলি, তারই তোরা দর্প নিয়ে
দর্পীদের ওই প্রাসাদ-চূড়ে রক্ত-নিশান যা টাঙিয়ে।
মৃত্যু তোদের হাতের মুঠায়, সেই তো তোদের পরশ-মণি,
রবির আলোক ঢের সয়েছি, এবার তোরা আয় রে শনি!
বহ্নিশিখা
মেলি শতদিকে শতলেলিহান রসনা
জাগো বহ্নিশিখা স্বাহা দিগ্-বসনা!
জাগো রুদ্রের ললাটের রক্ত-অনল,
জাগো বজ্র-জ্বালা বিদ্যুৎ-ঝলমল!
জাগো মহেন্দ্র-তপোভঙ্গের অভিশাপ,
জাগো অনঙ্গ-দাহন নয়নের তাপ।
জাগো ভাগীরথী-কূলে-কূলে চুল্লি-শ্মশান,
জাগো অস্ত-গোধূলি-বেলা দিবা-অবসান!
জাগো উদয়প্রাতের ঊষা রক্তশিখা,
জাগো সূর্যের টিপ পরি জয়ন্তিকা!
জাগো ক্রোধাগ্নি অবমানিতের বক্ষে,
জাগো শোকাগ্নি নিরশ্রু রাঙা চক্ষে!
জাগো নিশ্চুপ সয়ে-থাকা ধূমায়িত রোষ,
জাগো বাণী-মূক কন্ঠে অশনি-নির্ঘোষ!
জাগো খান্ডব-দাহন ভীমা দাহিকা,
মরু বিদ্রুপ-হাসি জাগো হে মরীচিকা।
জাগো বাড়ব-অনল জ্বলে, বনে দাবানল,
জাগো অগ্নি-সিন্ধু-মন্থন হলাহল!
জাগো বহ্নিরুপী তরু-শুষ্ক-জ্বালা,
জাগো তরলিত অগ্নি গো সুরা-পেয়ালা।
জাগো প্রতিশোধরূপে উৎপীড়িত বুকে,
নামো স্বর্গে অভিশাপ উল্কা-মুখে!
এসো ধূমকেতু-ঝাঁটা হাতে ধূমাবতী,
এসো ভস্মের টিপ পরি অশ্রুমতী,
জাগো আলো হয়ে রবি-শশী-তারকা-চাঁদে,
এসো অনুরাগ-রাঙা হয়ে নয়ন-ফাঁদে।
জাগো কন্টকে জ্বালা হয়ে, নাগ-মুখে বিষ,
এসো আলেয়ার আলো হয়ে, নিশি-ডাক শিস্।
এসো ক্ষুধা হয়ে নিরন্ন রিক্ত ঘরে,
লুটো লক্ষ্মীর ভান্ডার হাহাস্বরে
জাগো ভীমা-ভয়ংকরী উন্মাদিনী,
রাঙা দীপক আগুন সুরে বীণাবাদিনী!
বাংলার “আজীজ”
পোহয়নি রাত, আজান তখনও দেয়নি মুয়াজ্জিন ,
মুসলমানের রাত্রি তখন আর-সকলের দিন।
অঘোর ঘুমে ঘুমায় যখন বঙ্গ-মুসলমান,
সবার আগে জাগলে তুমি গাইলে জাগার গান!
ফজর বেলার নজর ওগো উঠলে মিনার পর,
ঘুম-টুটানো আজান দিলে – ‘আল্লাহো আকবর!’
কোরান শুধু পড়ল সবাই বুঝলে তুমি একা,
লেখার যত ইসলামি জোশ তোমায় দিল দেখা।
খাপে রেখে অসি যখন খাচ্ছিল সব মার,
আলোয় তোমার উঠল নেচে দু-ধারী তল্য়ার!
চমকে সবাই উঠল জেগে, ঝলসে গেল চোখ,
নৌজোয়ানীর খুন-জোশিতে মস্ত্ হল সব লোক!
আঁধার রাতের যাত্রী যত উঠল গেয়ে গান,
তোমার চোখে দেখল তারা আলোর অভিযান।
বেরিয়ে এল বিবর হতে সিংহশাবক দল,
যাদের প্রাতাপ-দাপে আজি বাংলা টলমল!
এলে নিশান-বরদার বীর, দুশমন পর্দার,
লায়লা চিরে আনলে নাহার , রাতের তারা-হার!
সাম্যবাদী! নর-নারীরে করতে অভেদ-জ্ঞান,
বন্দিনিদের গোরস্থানে রচলে গুলিস্তান!
শীতের জরা দূর হয়েছে ফুটছে বাহার-গুল,
গুলশনে গুল ফুটল যখন – নাই তুমি বুলবুল!
মশালবাহী বিশাল পুরুষ! কোথায় তুমি আজ?
অন্ধকারে হাতড়ে মরে অন্ধ এ-সমাজ।
নাইকো সতুন , পড়ছে খসে ইসলামের আজ ছাদ;
অত্যাচারের বিরুদ্ধে আর ঘোষবে কে জেহাদ?
যেমনি তুমি হালকা হলে আপনা করি দান,
শুনলে হঠাৎ – আলোর পাখি – কাজ-হারানো গান!
ফুরিয়েছে কাজ, জাকছে তবু হিন্দু-মুসলমান,
সবার ‘আজীজ’, সবার প্রিয়, আবার গাহো গান!
আবার এসো সবার মাঝে শক্তিরূপে বীর,
হিন্দু-সবার গুরু ওগো, মুসলমানের পির!*