- বইয়ের নামঃ সন্ধ্যা
- লেখকের নামঃ কাজী নজরুল ইসলাম
- প্রকাশনাঃ আগামী প্রকাশনী
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
অন্ধ স্বদেশ – দেবতা
ফাঁসির রশ্মি ধরি
আসিছে অন্ধ স্বদেশ-দেবতা, পলে পলে অনুসরি
মৃত্যু-গহন-যাত্রীদলের লাল পদাঙ্ক-রেখা।
যুগযুগান্ত-নির্জিত-ভালে নীল কলঙ্ক-লেখা!
নীরন্ধ্র মেঘে অন্ধ আকাশ, অন্ধ তিমির রাতি,
কুহেলি-অন্ধ দিগন্তিকার হস্তে নিভেছে বাতি, −
চলে পথহারা অন্ধ দেবতা ধীরে ধীরে এরই মাঝে,
সেই পথে ফেলে চরণ – যে পথে কঙ্কাল পায়ে বাজে!
নির্যাতনের যে যষ্টি দিয়া শত্রু আঘাত হানে
সেই যষ্টিরে দোসর করিয়া অলক্ষ্য পথ-পানে
চলেছে দেবতা – অন্ধ দেবতা – পায়ে পায়ে পলে পলে,
যত ঘিরে আসে পথ-সংকট চলে তত নববলে।
ঢলে পড়ে পথ পরে,
নবীন মৃত্যু-যাত্রী আসিয়া তুলে ধরে বুকে করে!
অন্ধ কারার বন্ধ দুয়ারে যথায় বন্দি জাগে,
যথায় বধ্য-মঞ্চ নিত্য রাঙিছে রক্ত-রাগে,
যথায় পিষ্ট হতেছে আত্মা নিষ্ঠুর মুঠি-তলে,
যথায় অন্ধ গুহায় ফণীর মাথায় মানিক জ্বলে,
যথায় বন্য শ্বাপদের সাথে নখর দন্ত লয়ে
জাগে বিনিদ্র বন্য-তরুণ ক্ষুধার তাড়না সয়ে,
যথা প্রাণ দেয় বলির নারীরা যূপকাষ্ঠের ফাঁদে, −
সেই পথে চলে অন্ধ দেবতা, পথ চলে আর কাঁদে, −
‘ওরে ওঠ ত্বরা করি
তোদের রক্তে-রাঙা উষা আসে, পোহাইছে বিভাবরী!’
তিমির রাত্রি, ছুটেছে যাত্রী নিরুদ্দেশের ডাকে,
জানে না কাথায় কোন পথে কোন ঊর্ধ্বে দেবতা হাঁকে।
শুনিয়াছে ডাক এই শুধু জানে! অপনার অনুরাগে
মাতিয়া উঠেছে অলস চরণ, সম্মুখে পথ জাগে!
জাগে পথ, জাগে ঊর্ধ্বে দেবতা, এই দেখিয়াছে শুধু,
কে দেখে সে পথে চোরা বালুচর, পর্বত, মরু ধুধু!
ছুটেছে পথিক, সাথে চলে পথ, অমানিশি চলে সাথে,
পথে পড়ে ঢলে, মৃত্যুর ছলে ধরে দেবতার হাতে।
চলিতেছে পাশাপাশি –
মৃত্যু, তরুণ, অন্ধ দেবতা, নবীন উষার হাসি!
কালবৈশাখী
বারেবারে যথা কালবৈশাখী ব্যর্থ হল রে পুব-হাওয়ায়,
দধীচি-হাড়ের বজ্র-বহ্নি বারেবারে যথা নিভিয়া যায়,
কে পাগল সেথা যাস হাঁকি –
‘বৈশাখী কালবৈশাখী!’
হেথা বৈশাখী-জ্বালা আছে শুধু, নাই বৈশাখী-ঝড় হেথায়।
সে জ্বালায় শুধু নিজে পুড়ে মরি, পোড়াতে কারেও পারি নে, হায়॥
২
কালবৈশাখী আসিলে হেথায় ভাঙিয়া পড়িত কোন সকাল
ঘুণ-ধরা বাঁশে ঠেকা দেওয়া ওই সনাতন দাওয়া, ভগ্ন চাল।
এলে হেথা কালবৈশাখী
মরা গাঙে যেত বান ডাকি,
বদ্ধ জাঙাল যাইত ভাঙিয়া, দুলিত এ দেশ টালমাটাল।
শ্মশানের বুকে নাচিত তাথই জীবন-রঙ্গে তাল-বেতাল॥
৩
কালবৈশাখী আসেনি হেথায়, আসিলে মোদের তরু-শিরে
সিন্ধু-শকুন বসিত না আসি ভিড় করে আজ নদীতীরে।
জানি না কবে সে আসিবে ঝড়
ধুলায় লুটাবে শত্রুগড়,
আজিও মোদের কাটেনিকো শীত, আসেনি ফাগুন বন ঘিরে।
আজিও বলির কাঁসর-ঘন্টা বাজিয়া ওঠেনি মন্দিরে॥
৪
জাগেনি রুদ্র, জাগিয়াছে শুধু অন্ধকারের প্রমথ-দল,
ললাট-অগ্নি নিবেছে শিবের ঝরিয়া জটার গঙ্গাজল।
জাগেনি শিবানী – জাগিয়াছে শিবা,
আঁধার সৃষ্টি – আসেনিকো দিবা,
এরই মাঝে হায়, কালবৈশাখী স্বপ্ন দেখিলি কে তোরা বল!
আসে যদি ঝড়, আসুক, কুলোর বাতাস কে দিবি অগ্রে চল॥
জাগরণ
জেগে যারা ঘুমিয়ে আছে তাদের দ্বারে আসি
ওরে পাগল, আর কতদিন বাজাবি তোর বাঁশি!
ঘুমায় যারা মখমলের ওই কোমল শয়ন পাতি
অনেক আগেই ভোর হয়েছে তাদের দুখের রাতি।
আরাম-সুখের নিদ্রা তাদের; তোর এ জাগার গান
ছোঁবে নাকো প্রাণ রে তাদের, যদিই বা ছোঁয় কান!
নির্ভয়ের ওই সুখের কূলে বাঁধলযারা বাড়ি,
আবার তারা দেবে না রে ভয়ের সাগর পাড়ি।
ভিতর হতে যাদের আগল শক্ত করে আঁটা
‘দ্বার খোলো গো’ বলে তাদের দ্বারে মিথ্যা হাঁটা।
ভোল রে এ পথ ভোল,
শান্তিপুরে শুনবে কে তোর জাগর-ডঙ্কা-রোল!
ব্যাথাতুরের কান্না পাছে শান্তি ভাঙে এসে
তাইতে যারা খাইয়ে ঘুমের আফিম সর্বনেশে
ঘুম পাড়িয়ে রাখছে নিতুই, সে ঘুম-পুরে আসি
নতুন করে বাজা রে তোর নতুন সুরের বাঁশি!
নেশার ঘোরে জানে না হায়, এরা কোথায় পড়ে,
গলায় তাদের চালায় ছুরি কেই বা বুকে চড়ে,
এদের কানে মন্ত্র দে রে, এদের তোরা বোঝা,
এরাই আবার করতে পারে বাঁকা কপাল সোজা।
কর্ষণে যার পাতাল হতে অনুর্বর এই ধরা
ফুল-ফসলের অর্ঘ্য নিয়ে আসে আঁচল-ভরা,
কোন সে দানব হরণ করে সে দেব-পূজার ফুল –
জানিয়ে দে তুই মন্ত্র-ঋষি, ভাঙ রে তাদের ভুল!
বর্বরদের অনুর্বর ওই হৃদয়-মরু চষে
ফল ফলাতে পারে এরাই আবার ঘরে বসে।
বাঘ-ভালুকের বাথান তেড়ে নগর বসায় যারা
রসাতলে পশবে মানুষ-পশুর ভয়ে তারা?
তাদেরই ওই বিতাড়িত বন্যপশু আজি
মানুষ-মুখো হয়েছে রে সভ্যসাজে সাজি।
টান মেরে ফেল মুখোশ তাদের, নখর কন্ত লয়ে
বেরিয়ে আসুক মনের পশু বনের পশু হয়ে!
তারাই দানব অত্যাচারী – যারা মানুষ মারে,
সভ্যবেশী ভণ্ড পশু মারতে ডরাস কারে?
এতদিন যে হাজার পাপের বীজ হয়েছে বোনা
আজ তা কাটার এল সময়, এই সে বাণী শোনা!
নতুন যুগের নতুন নকিব, বাজা নতুন বাঁশি,
স্বর্গ-রানি হবে এবার মাটির মায়ের দাসী!
জীবন-বন্দনা
গাহি তাহাদের গান – ধরণির হাতে দিল যারা আনি ফসলের ফরমান। শ্রম-কিণাঙ্ক-কঠিন যাদের নির্দয় মুঠি-তলে ত্রস্তা ধরণি নজরানা দেয় ডালি ভরে ফুলে ফলে। বন্য-শ্বাপদ-সংকুল জরা-মৃত্যু-ভীষণা ধরা যাদের শাসনে হল সুন্দর কুসুমিতা মনোহরা। যারা বর্বর হেথা বাঁধে ঘর পরম অকুতোভয়ে বনের ব্যাঘ্র মরুর সিংহ বিবরের ফণী লয়ে। এল দুর্জয় গতিবেগ সম যারা যাযাবর-শিশু – তারাই গাহিল নব প্রেমগান ধরণি-মেরির জিশু – যাহাদের চলা লেগে উল্কার মতো ঘুরিছে ধরণি শূন্যে অমিত বেগে !
খেয়াল খুশিতে কাটি অরণ্য রচিয়া অমরাবতী
যাহারা করিল ধ্বংসসাধন পুন চঞ্চলমতি,
জীবন-আবেগ রুধিতে না পারি যারা উদ্ধত-শির
লঙ্ঘিতে গেল হিমালয়, গেল শুষিতে সিন্ধু-নীর।
নবীন জগৎ সন্ধানে যারা ছুটে মেরু-অভিযানে,
পক্ষ বাঁধিয়া উড়িয়া চলেছে যাহারা ঊর্ধ্বপানে।
তবুও থামে না যৌবন-বেগ, জীবনের উল্লাসে
চলেছে চন্দ্র-মঙ্গল-গ্রহে স্বর্গে অসীমাকাশে।
যারা জীবনের পসরা বহিয়া মৃত্যুর দ্বারে দ্বারে
করিতেছে ফিরি, ভীম রণভূমে প্রাণ বাজি রেখে হারে।
আমি মর-কবি – গাহি সেই বেদে-বেদুইনদের গান,
যুগে যুগে যারা করে অকারণ বিপ্লব-অভিযান।
জীবনের আতিশয্যে যাহারা দারুণ উগ্রসুখে
সাধ করে নিল গরল-পিয়ালা, বর্শা হানিল বুকে !
আষাঢ়ের গিরি-নিঃস্রাবসম কোনো বাধা মানিল না,
বর্বর বলি যাহাদের গালি পাড়িল ক্ষুদ্রমনা,
কূপমণ্ডূক ‘অসংযমী’র আখ্যা দিয়াছে যারে,
তারই তরে ভাই গান রচে যাই, বন্দনা করি তারে !