বাংলার মহাত্মা
(গান)
আজ না-চাওয়া পথ দিয়ে কে এলে
ওই কংস-কারার দ্বার ঠেলে।
আজ শব-শ্মশানে শিব নাচে ওই ফুল-ফুটানো পা ফেলে॥
আজ প্রেম-দ্বারকায় ডেকেছে বান
মরুভূমে জাগল তুফান,
দিগ্বিদিকে উপচে পড়ে প্রাণ রে!
তুমি জীবন-দুলাল সব লালে-লাল করলে প্রাণের রং ঢেলে॥
ওই শ্রাবস্তি-ঢল আসল নেমে
আজ ভারতের জেরুজালেমে
মুক্তি-পাগল এই প্রেমিকের প্রেমে রে!
ওরে আজ নদীয়ার শ্যাম নিকুঞ্জে রক্ষ-অরি রাম খেলে॥
ওই চরকা-চাকায় ঘর্ঘরঘর
শুনি কাহার আসার খবর,
ঢেউ-দোলাতে দোলে সপ্ত সাগর রে!
ওই পথের ধুলা ডেকেছে আজ সপ্ত কোটি প্রাণ মেলে।
আজ জাত-বিজাতের বিভেদ ঘুচি,
এক হল ভাই বামুন-মুচি,
প্রেম-গঙ্গায় সবাই হল শুচি রে!
আয় এই যমুনায় ঝাঁপ দিবি কে বন্দেমাতরম বলে–
ওরে সব মায়ায় আগুন জ্বেলে॥
হুগলি,
জ্যৈষ্ঠ, ১৩৩১
বিদায়-মাভৈঃ
বিদায়-রবির করুণিমায় অবিশ্বাসীর ভয়,
বিশ্বাসী! বলো আসবে আবার প্রভাত-রবির জয়!
খণ্ড করে দেখছে যারা অসীম জীবনটাই,
দুঃখ তারাই করুক বসে, দুঃখ মোদের নাই।
আমরা জানি, অস্ত-খেয়ায় আসছে রে উদয়।
বিদায়-রবির করুণিমায় অবিশ্বাসীর ভয়।
হারাই-হারাই ভয় করেই না হারিয়ে দিলি সব!
মরার দলই আগলে মড়া করছে কলরব।
ঘরবাড়িটাই সত্য শুধু নয় কিছুতেই নয়।
বিদায়-রবির করুণিমায় অবিশ্বাসীর ভয়।
দৃষ্টি-অচিন দেশের পরেও আছে চিনা দেশ,
এক নিমেষের নিমেষ-শেষটা নয়কো অশেষ শেষ।
ঘরের প্রদীপ নিবলে বিধির আলোক-প্রদীপ রয়।
বিদায়-রবির করুণিমায় অবিশ্বাসীর ভয়।
জয়ধ্বনি উঠবে প্রাচীন চিনের প্রাচীরে,
অস্ত-ঘাটে বসে আমি তাই তো নাচি রে।
বিদায়-পাতা আনবে ডেকে নবীন কিশলয়,
বিশ্বাসী! বল আসবে আবার প্রভাত-রবির জয় ।
কলিকাতা
চৈত্র, ১৩৩০
মুক্তিকাম
স্বাগত বঙ্গে মুক্তিকাম!
সুপ্ত বঙ্গে জাগুক আবার লুপ্ত স্বাধীন সপ্তগ্রাম!
শোনাও সাগর-জাগর সিন্ধু-ভৈরবী গান ভয়-হরণ, –
এ যে রে তন্দ্রা, জেগে ওঠ তোরা, জেগে ঘুম দেওয়া নয় মরণ!
সপ্ত-কোটি কু-সন্তান তোরা রাখিতে নারিলি সপ্তগ্রাম?
খাসনি মায়ের বুকের রুধির? হালাল খাইয়া হলি হারাম !
মৃত্যু-ভূতকে দেখিলি রে শুধু, দেখিলি না তোরা ভবিষ্যৎ,
অস্ত-আঁধার পার হয়ে আসে নিত্য প্রভাতে রবির রথ!
অহোরাত্রিকে দেখেছে যাহারা সন্ধ্যাকে তারা করে না ভয়,
তারা সোজা জানে রাত্রির পরে আবার প্রভাত হবে উদয়।
দিন-কানা তোরা আঁধারের প্যাঁচা, দেখেছিস শুধু মৃত্যু-রাত,
ওরে আঁখি খোল, দেখ তোরও দ্বারে এসেছে জীবন নব-প্রভাত!
মৃত্যুর ‘ভয়’ মেরেছে তোদেরে, মৃত্যু তোদেরে মারেনি, ভাই!
তোরা মরে তাই হয়েছিস ভূত, আলোকের দূত হলিনে তাই!
জীবন থাকিতে ‘মরে আছি’ বলে পড়িয়া আছিস মড়া-ঘাটে,
সিন্ধু-শকুন নেমেছে রে তাই তোদের প্রাণের রাজ-পাটে!
রক্ত মাংস খেয়েছে তোদের, কঙ্কাল শুধু আছে বাকি,
ওই হাড় নিয়ে উঠে দাঁড়া তোরা ‘আজও বেঁচে আছি’ বল ডাকি!
জীবনের সাড়া যেই পাবে, ভয়ে সিন্ধু-শকুন পালাবে দূর,
ওই হাড়ে হবে ইন্দ্র-বজ্র, দগ্ধ হবে রে বৃত্রাসুর!
এ মৃতের দেশে, অমৃত-পুত্র, আনিবে কি সেই অমৃত-ঢল –
যাতে প্রাণ পেয়ে মৃত সগরের দেশ এ বঙ্গ হবে সচল?
জ্যান্তে-মরা এ ভীরুর ভারতে চাই নাকো মৃত-সঞ্জীবন,
ক্লীবের জীবন-সুধা আনো, করো ভূতের ভবিষ্যৎ সৃজন!
হুগলি
২০ পৌষ, ১৩৩১
যা শত্রু পরে পরে
রাজ্যে যাদের সূর্য অস্ত যায় না কখনও, শুনিস হায়,
মেরে মেরে যারা ভাবিছে অমর, মরিবে না কভু মৃত্যু-ঘায়,
তাদের সন্ধ্যা ওই ঘনায়!
চেয়ে দেখ ওই ধূম্র-চূড়
অসন্তোষের মেঘ-গরুড়
সূর্য তাদের গ্রাসিল প্রায়!
ডুবেছে যে পথে রোম গ্রিক প্যারি – সেই পথে যায় অস্ত যায়
ওদের সূর্য! – দেখবি আয়!
২
অর্ধ পৃথিবী জুড়ে হাহাকার, মড়ক, বন্যা, মৃত্যুত্রাস,
বিপ্লব, পাপ, অসূয়া, হিংসা, যুদ্ধ, শোষণ-রজ্জুপাশ,
অনিল যাদের ক্ষুধিত গ্রাস –
তাদের সে লোভ-বহ্নি-শিখ
জ্বালায়ে জগৎ, দিগ্বিদিক,
ঘিরেছে তাদেরই গৃহ, সাবাস!
যে আগুনে তারা জ্বালাল ধরা তা এনেছে তাদেরই সর্বনাশ!
আপনার গলে আপন ফাঁস!
৩
এবার মাথায় দংশেছে সাপে, তাগা আর কোথা বাঁধবে বল?
আপনার পোষা নাগিনি তাহার আপনার শিরে দিল ছোবল।
ওঝা ডেকে আর বল কী ফল?
ঘরে আজ তার লেগেছে আগুন,
ভাগাড়ে তাহার পড়েছে শকুন,
রে ভারতবাসী, চল রে চল!
এই বেলা সবে ঘর ছেয়ে নেয়, তোরাই বসে কি রবি কেবল?
আসে ঘনঘটা ঝড়-বাদল!
৪
ঘর সামলে নে এই বেলা তোরা ওরে ও হিন্দু-মুসলেমিন!
আল্লা ও হরি পালিয়ে যাবে না, সুযোগ পালালে মেলা কঠিন!
ধর্ম-কলহ রাখ দুদিন!
নখ ও দন্ত থাকুক বাঁচিয়া,
গণ্ডূষ ফের করিবি কাঁচিয়া,
আসিবে না ফিরে এই সুদিন!
বদনা-গাড়ুতে কেন ঠোকাঠুকি, কাছা কোঁচা টেনে শক্তি ক্ষীণ,
সিংহ যখন পঙ্ক-লীন।
৫
ভায়ে ভায়ে আজ হাতাহাতি করে কাঁচা হাত যদি পাকিয়েছিস
শত্রু যখন যায় পরে পরে – নিজের গণ্ডা বাগিয়ে নিস!
ভুলে যা ঘরোয়া দ্বন্দ্ব-রিষ।
কলহ করার পাইবি সময়,
এ সুযোগ দাদা হারাবার নয়!
হাতে হাত রাখ, ফেল হাতিয়ার, ফেলে দে বুকের হিংসা-বিষ!
নব-ভারতের এই আশিষ!
৬
নারদ নারদ! জুতো উলটে দে! ঝগড়েটে ফল খুঁজিয়া আন।
নখে নখ বাজা! এক চোখ দেখা! দুকাটি বাজিয়ে লাগাও গান!
শত্রুর ঘরে ঢুকেছে বান!
ঘরে ঘরে তার লেগেছে কাজিয়া,
রথ টেনে আন আনরে তাজিয়া,
পূজা দেরে তোরা, দেরে কোরবান!
শত্রুর গোরে গলাগলি কর আবার হিন্দু-মুসলমান!
বাজাও শঙ্খ, দাও আজান!
কৃষ্ণনগর,
আশ্বিন, ১৩৩৩