- বইয়ের নামঃ ফণি-মনসা
- লেখকের নামঃ কাজী নজরুল ইসলাম
- প্রকাশনাঃ নজরুল ইন্সটিটিউট
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
অন্তর-ন্যাশনাল সঙ্গীত
জাগো–
জাগো অনশন-বন্দী, ওঠ রে যত
জগতের লাঞ্ছিত ভাগ্যহত!
যত অত্যাচারে আজি বজ্র হানি’
হাঁকে নিপীড়িত-জন-মন-মথিত বাণী,
নব জনম লভি’ অভিনব ধরণী
ওরে ওই আগত।।
আদি শৃঙ্খলা সনাতন শাস্ত্র-আচার
মূল সর্বনাশের, এরে ভাঙিব এবার!
ভেদি’ দৈত্য-কারা!
আয় সর্বহারা!
কেহ রহিবে না আর পর-পদ-আনত।।
কোরাস্ :
নব ভিত্তি ’পরে
নব নবীন জগৎ হবে উত্থিত রে!
শোন্ অত্যাচারী! শোন্ রে সঞ্চয়ী!
ছিনু সর্বহারা, হব’ সর্বজয়ী।।
ওরে সর্বশেষের এই সংগ্রাম-মাঝ,
নিজ নিজ অধিকার জুড়ে দাঁড়া সবে আজ!
এই ‘অন্তর-ন্যাশনাল-সংহতি’ রে
হবে নিখিল-মানব-জাতি সমুদ্ধত।।
অশ্বিনীকুমার
আজ যবে প্রভাতের নব যাত্রীদল
ডেকে গেল রাত্রিশেষে, ‘চল আগে চল’, –
‘চল আগে চল’ গাহে ঘুম-জাগা পাখি,
কুয়াশা-মশারি ঠেলে জাগে রক্ত-আঁখি
নবারুণ নব আশা। আজি এই সাথে,
এই নব জাগরণ-আনা নব প্রাতে
তোমারে স্মরিনু বীর প্রাতঃস্মরণীয় !
স্বর্গ হতে এ স্মরণ-প্রীতি অর্ঘ্য নিয়ো !
নিয়ো নিয়ো সপ্তকোটি বাঙালির তব
অশ্রু-জলে স্মৃতি-পূজা অর্ঘ্য অভিনব!
আজও তারা ক্রীতদাস, আজও বদ্ধ-কর
শৃঙ্খল-বন্ধনে দেব ! আজও পরস্পর
করে তারা হানাহানি, ঈর্ষা-অস্ত্রে যুঝি
ছিটায় মনের কালি-নিরস্ত্রের পুঁজি!
মন্দভাষ গাঢ় মসি দিব্য অস্ত্র তার!
‘দুই-সপ্ত কোটি ধৃত খর তরবার’
সে শুধু কেতাবি কথা, আজও সে স্বপন!
সপ্তকোটি তিক্ত জিহ্বা বিষ-রসায়ন
উদ্গারিছে বঙ্গে নিতি, দগ্ধ হল ভূমি!
বঙ্গে আজ পুষ্প নাই, বিষ লহো তুমি!
কে করিবে নমস্কার! হায় যুক্তকর
মুক্ত নাহি হল আজও! বন্ধন-জর্জর
এ কর পারে না দেব ছুঁইতে ললাট!
কে করিবে নমস্কার?
কে করিবে পাঠ
তোমার বন্দনা-গান? রসনা অসাড়!
কথা আছে বাণী নাই ছন্দে নাচে হাড়!
ভাষা আছে আশা নাই, নাই তাহে প্রাণ,
কে করিবে এই জাতিরে নবমন্ত্র দান!
অমৃতের পুত্র কবি অন্নের কাঙাল,
কবি আর ঋষি নয়, প্রাণের অকাল
করিয়াছে হেয় তারে! লেখনী ও কালি
যত না সৃজিছে কাব্য ততোধিক গালি!
কণ্ঠে যার ভাষা আছে অন্তরে সাহস,
সিংহের বিবরে আজ পড়ে সে অবশ!
গর্দান করিয়া উঁচু যে পারে গাহিতে
নব জীবনের গান, বন্ধন-রশিতে
চেপে আছে টুঁটি তার! জুলুম-জিঞ্জির
মাংস কেটে বসে আছে, হাড়ে খায় চিড়
আর্ত প্রতিধ্বনি তার! কোথা প্রতিকার!
যারা আছে—তারা কিছু না করে নাচার!
নেহারিব তোমারে যে শির উঁচু করি,
তাও নাহি পারি, দেব! আইনের ছড়ি
মারে এসে গুপ্ত চেড়ী। যাইবে কোথায়!
আমার চরণ নহে মম বশে, হায়।
এক ঘর ছাড়ি আর ঘরে যেতে নারি,
মর্দজাতি হয়ে আছে পর্দা-ঘেরা নারী!
এ লাঞ্ছনা, এ পীড়ন, এ আত্মকলহ,
আত্মসুখপরায়ণ পরাবৃত্তি মোহ–
তব বরে দূর হোক! এ জাতির পরে
হে যোগী, তোমার যেন আশীর্বাদ ঝরে !
যে-আত্মচেতনা-বলে যে আত্মবিশ্বাসে
যে-আত্মশ্রদ্ধার জোরে জীবন উচ্ছ্বাসে
উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠে মরা জাতি বাঁচে,
যোগী, তব কাছে জাতি সেই শক্তি যাচে!
স্বর্গে নহে, আমাদের অতি কাছাকাছি
আছ তুমি হে তাপস, তাই মোরা যাচি
তব বর, শক্তি তব! জেনেছিলে তুমি
স্বর্গাদপি গরীয়সী এই বঙ্গভূমি!
দিলে ধর্ম, দিলে কর্ম, দিলে ধ্যান জ্ঞান,
তবু সাধ মিটিল না, দিলে বলিদান
আত্মারে জননি-পদে, হাঁকিলে, “মাভৈঃ!
ভয় নাই, নব দিনমণি ওঠে ওই!
ওরে জড়, ওঠ তোরা!” জাগিল না কেউ,
তোমারে লইয়া গেল পারাপারী ঢেউ।
অগ্রে তুমি জেগেছিলে অগ্রজ শহিদ,
তুমি ঋষি, শুভ প্রাতে টুটেছিল নিদ,
তব পথে যাত্রী যারা রাত্রি-দিবা ধরি
ঘুমাল গভীর ঘুম, আজ তারা মরি
বেলাশেষে জাগিয়াছে! সম্মুখে সবার
অনন্ত তমিস্রাঘোর দুর্গম কান্তার!
পশ্চাতে ‘অতীত’ টানে জড় হিমালয়,
সংশয়ের ‘বর্তমান’ অগ্রে নাহি হয়,
তোমা-হারা দেখে তারা অন্ধ ‘ভবিষ্যৎ’,
যাত্রী ভীরু, রাত্রি গুরু, কে দেখাবে পথ!
হে প্রেমিক, তব প্রেম বরিষায় দেশে
এল ঢল বীরভূমি বরিশাল ভেসে।
সেই ঢল সেই জল বিষম তৃষায়
যাচিছে ঊষর বঙ্গ তব কাছে হায়!
পীড়িত এ বঙ্গ তব কাছে হায়!
পীড়িত এ বঙ্গ পথ চাহিছে তোমার,
অসুর নিধনে কবে আসিবে আবার!
হুগলি,
মাঘ, ১৩৩২
আশীর্বাদ
কল্যাণীয়া শামসুন নাহার খাতুন
জয়যুক্তাসু
শত নিষেধের সিন্ধুর মাঝে অন্তরালের অন্তরীপ
তারই বুকে নারী বসে আছে জ্বালি বিপদ-বাতির সিন্ধু-দীপ।
শাশ্বত সেই দীপান্বিতার দীপ হতে আঁখি-দীপ ভরি
আসিয়াছ তুমি অরুণিমা-আলো প্রভাতি তারার টিপ পরি।
আপনার তুমি জান পরিচয় – তুমি কল্যাণী তুমি নারী –
আনিয়াছ তাই ভরি হেম-ঝারি মরু-বুকে জমজম-বারি।
অন্তরিকার আঁধার চিরিয়া প্রকাশিলে তব সত্য-রূপ –
তুমি আছ, আছে তোমারও দেবার, তব গেহ নহে অন্ধ-কূপ।
তুমি আলোকের – তুমি সত্যের – ধরার ধুলায় তাজমহল, –
রৌদ্র-তপ্ত আকাশের চোখে পরালে স্নিগ্ধ নীল কাজল!
আপনারে তুমি চিনিয়াছ যবে, শুধিয়াছ ঋণ, টুটেছে ঘুম,
অন্ধকারের কুঁড়িতে ফুটেছ আলোকের শতদল-কুসুম।
বদ্ধ কারার প্রকারে তুলেছ বন্দিনীদের জয়-নিশান –
অবরোধ রোধ করিয়াছে দেহ, পারেনি রুধিতে কণ্ঠে গান।
লহো স্নেহাশিস – তোমার ‘পুণ্যময়ী’র ‘শাম্স’ পুণ্যালোক
শাশ্বত হোক! সুন্দর হোক! প্রতি ঘরে চির-দীপ্ত রোক।
হুগলি,
১৯ মাঘ, ১৩৩১
ইন্দু-প্রয়াণ
(কবি শরদিন্দু রায়ের অকালমৃত্যু উপলক্ষ্যে)
বাঁশির দেবতা! লভিয়াছ তুমি হাসির অমর-লোক,
হেথা মর-লোকে দুঃখী মানব করিতেছি মোরা শোক!
অমৃত-পাথারে ডুব দিলে তুমি ক্ষীরোদ-শয়ন লভি,
অনৃতের শিশু মোরা কেঁদে বলি, মরিয়াছ তুমি কবি!
হাসির ঝঞ্ঝা লুটায়ে পড়েছে নিদাঘের হাহাকারে,
মোরা কেঁদে বলি, কবি খোয়া গেছে অস্ত-খেয়ার পারে!
আগুন-শিখায় মিশেছে তোমার ফাগুন-জাগানো হাসি,
চিতার আগুনে পুড়ে গেছ ভেবে মোরা আঁখি-জলে ভাসি।
অনৃত তোমার যাহা কিছু কবি তাই হয়ে গেছে ছাই,
অমৃত তোমার অবিনাশী যাহা আগুনে তা পুড়ে নাই।
চির-অতৃপ্ত তবু কাঁদি মোরা, ভরে না তাহাতে বুক,
আজ তব বাণী আন্-মুখে শুনি, তুমি নাই, তুমি মূক।
অতি-লোভী মোরা পাই না তৃপ্তি সুরভিতে শুধু ভাই,
সুরভির সাথে রূপ-ক্ষুধাতুর ফুলেরও পরশ চাই।
আমরা অনৃত তাই তো অমৃতে ভরে ওঠে নাকো প্রাণ,
চোখে জল আসে দেখিয়া ত্যাগীর আপনা-বিলানো দান।
তরুণের বুকে হে চির-অরুণ ছড়ায়েছ যত লালি,
সেই লালি আজ লালে লাল হয়ে কাঁদে, খালি সব খালি!
কাঁদায়ে গিয়াছ, নবরূপ ধরে হয়তো আসিবে ফিরে,
আসিয়া আবার আধ-গাওয়া গান গাবে গঙ্গারই তীরে,
হয়তো তোমায় চিনিব না, কবি, চিনিব তোমার বাঁশি,
চিনিব তোমার ওই সুর আর চল-চঞ্চল হাসি।
প্রাণের আলাপ আধ-চেনাচেনি দূরে থেকে শুধু সুরে,
এবার হে কবি, করিব পূর্ণ ওই চির-কবি-পুরে।…
ভালোই করেছ ডিঙিয়া গিয়াছ নিত্য এ কারাগার,
সত্য যেখানে যায় নাকো বলা, গৃহ নয় সে তোমার।
গিয়াছ যেখানে শাসনে সেখানে নহে নিরুদ্ধ বাণী,
ভক্তের তরে রাখিয়ো সেখানে আধেক আসনখানি।
বন্দী যেখানে শুনিবে তোমার মুক্তবদ্ধ সুর, –
গঙ্গার কূলে চাই আর ভাবি কোথা সেই থসুর-পুর!
গণ্ডির বেড়ি কাটিয়া নিয়াছ অনন্তরূপ টানি,
কারও বুকে আছ মূর্তি ধরিয়া, কারও বুকে আছ বাণী।
সে কি মরিবার? ভাঙি অনিত্যে নিত্য নিয়াছ বরি,
ক্ষমা করো কবি, তবু লোভী মোরা শোক করি, কেঁদে মরি।
না-দেখা ভেলায় চড়িয়া হয়তো আজিও সন্ধ্যাবেলা
গঙ্গার কুলে আসিয়া হাসিছ দেখে আমাদের খেলা!
হউক মিথ্যা মায়ার খেলা এ তবুও করিব শোক,
‘শান্তি হউক’ বলি যুগে যুগে ব্যথায় মুছিব চোখ!
আসিবে আবারও নিদাঘ-শেষের বিদায়ের হাহাকার,
শাঙনের ধারা আনিবে স্মরণে ব্যাথা-অভিষেক তার।
হাসি নিষ্ঠুর যুগে যুগে মোরা স্নিগ্ধ অশ্রু দিয়া,
হাসির কবিরে ডাকিব গভীরে শোক-ক্রন্দন নিয়া।
বহরমপুর জেল,
শ্রাবণ, ১৩৩০
জাগর-তূর্য
ওরে ও শ্রমিক, সব মহিমার উত্তর-অধিকারী!
অলিখিত যত গল্প-কাহিনি তোরা যে নায়ক তারই॥
শক্তিময়ী সে এক জননির
স্নেহ-সুত সব তোরা যে রে বীর,
পরস্পরের আশা যে রে তোরা, মার সন্তাপ-হারী॥
নিদ্রোত্থিত কেশরীর মতো
ওঠ ঘুম ছাড়ি নব জাগ্রত!
আয় রে অজেয় আয় অগণিত দলে দলে মরুচারী॥
ঘুমঘোরে ওরে যত শৃঙ্খল
দেহ মন বেঁধে করেছে বিকল,
ঝেড়ে ফেল সব, সমীরে যেমন ঝরায় শিশির বারি।
উহারা কজন? তোরা অগণন সকল শক্তি-ধারী॥
কলিকাতা,
১ বৈশাখ, ১৩৩৪
দিল-দরদি
(কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের ‘খাঁচার পাখি’ শীর্ষক করুণ কবিতাটি পড়িয়া)
কে ভাই তুমি সজল গলায়
গাইলে গজল আপশোশের?
ফাগুন-বনের নিবল আগুন,
লাগল সেথা ছাপ পোষের।
দরদ-ভেজা কান্না-কাতর
ছিন্ন তোমার স্বর শুনে
ইরান মুলুক বিরান হল
এমন বাহার-মরশুমে।
সিস্তানের ওই গুল-বাগিচা
গুলিস্তান আর বোস্তানে
সোস্ত হয়ে দখিন হাওয়া
কাঁদল সে আপশোশ-তানে।
এ কোন যিগর -পস্তানি সুর?
মস্তানি সব ফুল-বালা
ঝুরল, তাদের নাজুক বুকে
বাজল ব্যথার শূল-জ্বালা।
আবছা মনে পড়ছে, যে দিন
শিরাজ -বাগের গুল ভুলি
শ্যামল মেয়ের সোহাগ-শ্যামার
শ্যাম হলে ভাই বুলবুলি, –
কালো মেয়ের কাজল চোখের
পাগল চাওয়ার ইঙ্গিতে
মস্ত্ হয়ে কাঁকন চুড়ির
কিঙ্কিণি রিন ঝিন গীতে।
নাচলে দেদার দাদরা তালে,
কারফাতে, সরফর্দাতে, –
হাঠাৎ তোমার কাঁপল গলা
‘খাঁচার পাখি’ ‘গর্বাতে’।
চৈতালিতে বৈকালি সুর
গাইলে, “নিজের নই মালিক,
আফ্সে মরি আপশোশে আহ্,
আপ-সে বন্দী বৈতালিক।
কাঁদায় সদাই ঘেরা-টোপের
আঁধার ধাঁধায়, তায় একা,
ব্যথার ডালি একলা সাজাই,
সাথির আমার নাই দেখা।
অসাড় জীবন, ঝাপসা দুচোখ
খাঁচার জীবন একটানা।”
অশ্রু আসে, আর কেন ভাই,
ব্যথার ঘায়ে ঘা হানা?
খুব জানি ভাই, ব্যর্থ জীবন
ডুবায় যারা সংগীতেই,
মরম-ব্যথা বুঝতে তাদের
দিল-দরদি সঙ্গী নেই।
জানতে কে চায় গানের পাখি
বিপুল ব্যথার বুক ভরাট,
সবার যখন নওরাতি, হায়,
মোদের তখন দুঃখ-রাত!
ওদের সাথি, মোদের রাতি
শয়ন আনে নয়ন-জল;
গান গেয়ে ভাই ঘামলে কপাল
মুছতে সে ঘাম নাই অঞ্চল।
তাই ভাবি আজ কোন দরদে
পিষছে তোমার কলজে-তল?
কার অভাব আজ বাজছে বুকে,
কলজে চুঁয়ে গলছে জল!
কাতর হয়ে পাথর-বুকে
বয় যবে ক্ষীর-সুরধুনী,
হোক তা সুধা, খুব জানি ভাই,
সে সুধা ভরপুর-খুনই।
আজ যে তোমার আঁকা-আঁশু
কণ্ঠ ছিঁড়ে উছলে যায় –
কতই ব্যথায়, ভাবতে যে তা
জান ওঠে ভাই কচলে হায়!
বসন্ত তো কতই এল,
গেল খাঁচার পাশ দিয়ে,
এল অনেক আশ নিয়ে, শেষ
গেল দীঘল-শ্বাস নিয়ে।
অনেক শারাব খারাব হল,
অনেক সাকির ভাঙল বুক!
আজ এল কোন দীপান্বিতা?
কার শরমে রাঙল মুখ?
কোন দরদি ফিরল? পেলে
কোন হারা-বুক আলিঙ্গন?
আজ যে তোমার হিয়ার রঙে
উঠল রেঙে ডালিম-বন!
যিগর-ছেঁড়া দিগর তোমার
আজ কি এল ঘর ফিরে?
তাই কি এমন কাশ ফুটেছে
তোমার ব্যথার চর ফিরে?
নীড়ের পাখি ম্লান চোখে চায়,
শুনছে তোমার ছিন্ন সুর;
বেলা-শেষের তান ধরেছে
যখন তোমার দিন দুপুর!
মুক্ত আমি পথিক-পাখি
আনন্দ-গান গাই পথের,
কান্না-হাসির বহ্নি-ঘাতের
বক্ষে আমার চিহ্ন ঢের ;
বীণ ছাড়া মোর একলা পথের
প্রাণের দোসর অধিক নাই,
কান্না শুনে হাসি আমি,
আঘাত আমার পথিক-ভাই।
বেদনা-ব্যথা নিত্য সাথি, –
তবু ভাই ওই সিক্ত সুর,
দুচোখ পুরে অশ্রু আনে
উদাস করে চিত্ত-পুর!
ঝাপসা তোমার দুচোখ শুনে
সুরাখ হল কলজেতে,
নীল পাথারের সাঁতার পানি
লাখ চোখে ভাই গলছে যে!
বাদশা-কবি! সালাম জানায়
ভক্ত তোমার অ-কবি,
কইতে গিয়ে অশ্রুতে মোর
কথা ডুবে যায় সবই!
কলিকাতা,
আশ্বিন, ১৩২৮
দ্বীপান্তরের বন্দিনী
আসে নাই ফিরে ভারত-ভারতী
মা’র কতদিন দ্বীপান্তর?
পুণ্য বেদীর শূন্যে ধ্বনিল
ক্রন্দন-‘দেড় শত বছর।’….
সপ্ত সিন্ধু তের নদী পার
দ্বীপান্তরের আন্দামান,
রূপের কমল রূপার কাঠির
কঠিন স্পর্শে যেখানে ম্লান,
শতদল যেথা শতধা ভিন্ন
শস্ত্র-পাণির অস্ত্র-ঘাস,
যস্ত্রী যেখানে সাস্ত্রী বসায়ে
বীনার তন্ত্রী কাটিছে হায়,
সেখানে হ’তে কি বেতার-সেতার
এসেছে মুক্ত-বন্ধ সুরা?
মুক্ত কি আজ বন্দিনী বাণী?
ধ্বংস হ’ল কি বক্ষ-পুর?
যক্ষপুরীর রৌপ্য-পঙ্কে
ফুটিল কি তবে রূপ-কমল?
কামান গোলার সীসা-স্তুপে কি
উঠেছে বাণীর শিশ-মহল?
শান্তি-শুচিতে শুভ্র হ’ল কি
রক্ত সোঁদাল খুন-খারাব?
তবে এ কিসের আর্ত আরতি,
কিসের তরে এ শঙ্কারাব?…
সাত সমুদ্র তের নদী পার
দ্বীপান্তরের আন্দামান,
বাণী যেথা ঘানি টানে নিশিদিন,
বন্দী সত্য ভানিছে ধান,
জীবন চুয়ানো সেই ঘানি হ’তে
আরতির তেল এনেছ কি?
হোমানল হ’তে বাণীর রক্ষী
বীর ছেলেদের চর্বি ঘি?
হায় শৌখিন পূজারী, বৃথাই
দেবীর শঙ্খে দিতেছ ফুঁ,
পুণ্য বেদীর শূন্য ভেদিয়া
ক্রন্দন উঠিতেছে শুধু!
পূজারী, কাহারে দাও অঞ্জলি?
মুক্ত ভারতী ভারতে কই?
আইন যেখানে ন্যায়ের শাসক,
সত্য বলিলে বন্দী হই,
অত্যাচারিত হইয়া যেখানে
বলিতে পারি না অত্যাচার,
যথা বন্দিনী সীতা সম বাণী
সহিছে বিচার-চেড়ীর মার
বাণীর মুক্ত শতদল যথা
আখ্যা লভিল বিদ্রোহী,
পূজারী, সেখানে এসেছ কি তুমি
বাণী পূজা-উপচার বহি?
সিংহেরে ভয়ে রাখে পিঞ্জরে,
ব্যাঘ্রেরে হানে অগ্নি-শেল,
কে জানিত কালে বীণা খাবে গুলি,
বাণীর কমল খাটিবে জেল!
তবে কি বিধির বেতার-মন্ত্র
বেজেছে বাণীর সেতারে আজ,
পদ্মে রেখেছে চরণ-পদ্ম
যুগান্তরের ধর্মরাজ?
তবে তাই হোক। ঢাক অঞ্জলি,
বাজাও পাঞ্চজন্য শাঁখ!
দ্বীপান্তরের ঘানিতে লেগেছে
যুগান্তরের ঘুর্ণিপাক!
পথের দিশা
চারিদিকে এই গুণ্ডা এবং বদমায়েসির আখ্ড়া দিয়ে
রে অগ্রদূত, চ’লতে কি তুই পারবি আপন প্রাণ বাঁচিয়ে?
পারবি যেতে ভেদ ক’রে এই বক্র-পথের চক্রব্যুহ?
উঠবি কি তুই পাষাণ ফুঁড়ে বনস্পতি মহীরুহ?
আজকে প্রাণের গো-ভাগাড়ে উড়ছে শুধু চিল-শকুনি,
এর মাঝে তুই আলোকে-শিশু কোন্ অভিযান ক’রবি, শুনি?
ছুঁড়ছে পাথর, ছিটায় কাদা, কদর্যের এই হোরি-খেলায়
শুভ্র মুখে মাখিয়ে কালি ভোজপুরীদের হট্ট-মেলায়
বাঙলা দেশও মাত্ল কি রে? তপস্যা তার ভুললো অরুণ?
তাড়িখানার চীৎকারে কি নাম্ল ধুলায় ইন্দ্র বরুণ?
ব্যগ্র-পরান অগ্রপথিক,কোন্ বাণী তোর শুনাতে সাধ?
মন্ত্র কি তোর শুন্তে দেবে নিন্দাবাদীর ঢক্কা-নিনাদ?
নর-নারী আজ কন্ঠ ছেড়ে কুৎসা-গানের কোরাস্ ধ’রে
ভাবছে তা’রা সুন্দরেরই জয়ধ্বনি ক’রছে জোরে?
এর মাঝে কি খবর পেলি নব-বিপ্লব-ঘোড়সাওয়ারী
আসছে কেহ? টুট্ল তিমির, খুল্ল দুয়ার পুব-দয়ারী?
ভগবান আজ ভূত হ’ল যে প’ড়ে দশ-চক্র ফেরে,
যবন এবং কাফের মিলে হায় বেচারায় ফিরছে তেড়ে!
বাঁচাতে তায় আসছে কি রে নতুন যুগের মানুষ কেহ?
ধুলায় মলিন, রিক্তাভরণ, সিক্ত আঁখি, রক্ত দেহ?
মসজিদ আর মন্দির ঐ শয়তানদের মন্ত্রণাগার,
রে অগ্রদূত, ভাঙতে এবার আসছে কি জাঠ কালাপাহাড়?
জানিস যদি, খবর শোনা বন্ধ খাঁচার ঘেরাটোপে,
উড়ছে আজো ধর্ম-ধ্বজা টিকির গিঁঠে দাড়ির ঝোপে!
নিন্দাবাদের বৃন্দাবনে ভেবেছিলাম গাইব না গান,
থাকতে নারি দেখে শুনে সুন্দরের এই হীন অপমান।
ক্রুদ্ধ রোষে রুদ্ধ ব্যথায় ফোঁপায় প্রাণে ক্ষুদ্ধ বাণী,
মাতালদের ঐ ভাঁটিশালায় নটিনী আজ বীণাপাণি!
জাতির পারণ-সিন্ধু মথি’ স্বার্থ-লোভী পিশাচ যারা
সুধার পাত্র লক্ষ্মীলাভের ক’রতেছে ভাগ-বাঁটোয়ারা,
বিষ যখন আজ উঠল শেষে তখন কারুর পাইনে দিশা,
বিষের জ্বালায় বিশ্ব পুড়ে, স্বর্গে তাঁরা মেটান তৃষা!
শ্মাশন-শবের ছাইয়ের গাদায় আজকে রে তাই বেড়াই খুঁজে,
ভাঙন-দেব আজ ভাঙের নেশায় কোথায় আছে চক্ষু বুঁজে!
রে অগ্রদূত, তরুণ মনের গহন বনের রে সন্ধানী,
আনিস্ খবর, কোথায় আমার যুগান্তরের খড়্পপাণি!
প্রবর্তকের ঘুর-চাকায়
যায় মহাকাল মূর্ছা যায়
প্রবর্তকের ঘুর-চাকায়
যায় অতীত
কৃষ্ণ-কায়
যায় অতীত
রক্ত-পায়—
যায় মহাকাল মূর্ছা যায়
প্রবর্তকের ঘুর-চাকায়!
প্রবর্তকের ঘুর-চাকায়!
যায় প্রবীণ
চৈতি-বায়
আয় নবীন-
শক্তি আয়!
যায় অতীত
যায় পতিত,
‘আয় অতিথ,
আয় রে আয় –’
বৈশাখী-ঝড় সুর হাঁকায় –
প্রবর্তকের ঘুর-চাকায়
প্রবর্তকের ঘুর-চাকায়!
ওই রে দিক্-
চক্রে কার
বক্রপথ
ঘুর-চাকার!
ছুটছে রথ,
চক্র-ঘায়
দিগ্বিদিক
মূর্ছা যায়!
কোটি রবি শশী ঘুর-পাকায়
প্রবর্তকের ঘুর-চাকায়
প্রবর্তকের ঘুর-চাকায়!
ঘোরে গ্রহ তারা পথ-বিভোল, –
‘কাল’-কোলে ‘আজ’খায় রে দোল!
আজ প্রভাত
আনছে কায়,
দূর পাহাড়-
চূড় তাকায়।
জয়-কেতন
উড়ছে কার
কিংশুকের
ফুল-শাখায়।
ঘুরছে রথ,
রথ-চাকায়
রক্ত-লাল
পথ আঁকায়।
জয়-তোরণ
রচছে কার
ওই উষার
লাল আভায়,
প্রবর্তকের ঘুর-চাকায়
প্রবর্তকের ঘুর-চাকায়।
গর্জে ঘোর
ঝড় তুফান
আয় কঠোর
বর্তমান।
আয় তরুণ
আয় অরুণ
আয় দারুণ,
দৈন্যতায়!
দৈন্যতায়!
ওই মা অভয়-হাত দেখায়
রামধনুর
লাল শাঁখায়!
প্রবর্তকের ঘুর-চাকায়
প্রবর্তকের ঘুর-চাকায়!
বর্ষ-সতী-স্কন্ধে ওই
নাচছে কাল
থই তা থই
কই সে কই
চক্রধর,
ওই মায়ায়
খণ্ড কর।
শব-মায়ায়
শিব যে যায়
ছিন্ন কর
ওই মায়ায় —
প্রবর্তকের ঘুর-চাকায়
প্রবর্তকের ঘুর-চাকায়!
কৃষ্ণনগর,
৩০ চৈত্র, ১৩৩২
বাংলার মহাত্মা
(গান)
আজ না-চাওয়া পথ দিয়ে কে এলে
ওই কংস-কারার দ্বার ঠেলে।
আজ শব-শ্মশানে শিব নাচে ওই ফুল-ফুটানো পা ফেলে॥
আজ প্রেম-দ্বারকায় ডেকেছে বান
মরুভূমে জাগল তুফান,
দিগ্বিদিকে উপচে পড়ে প্রাণ রে!
তুমি জীবন-দুলাল সব লালে-লাল করলে প্রাণের রং ঢেলে॥
ওই শ্রাবস্তি-ঢল আসল নেমে
আজ ভারতের জেরুজালেমে
মুক্তি-পাগল এই প্রেমিকের প্রেমে রে!
ওরে আজ নদীয়ার শ্যাম নিকুঞ্জে রক্ষ-অরি রাম খেলে॥
ওই চরকা-চাকায় ঘর্ঘরঘর
শুনি কাহার আসার খবর,
ঢেউ-দোলাতে দোলে সপ্ত সাগর রে!
ওই পথের ধুলা ডেকেছে আজ সপ্ত কোটি প্রাণ মেলে।
আজ জাত-বিজাতের বিভেদ ঘুচি,
এক হল ভাই বামুন-মুচি,
প্রেম-গঙ্গায় সবাই হল শুচি রে!
আয় এই যমুনায় ঝাঁপ দিবি কে বন্দেমাতরম বলে–
ওরে সব মায়ায় আগুন জ্বেলে॥
হুগলি,
জ্যৈষ্ঠ, ১৩৩১