- বইয়ের নামঃ পুবের হাওয়া
- লেখকের নামঃ কাজী নজরুল ইসলাম
- প্রকাশনাঃ তরিকতে আহ্লে বাইত বাংলাদেশ
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
অবসর
লক্ষ্মী আমার! তোমার পথে আজকে অভিসার,
অনেক দিনের পর পেয়েছি মুক্তি-রবিবার।
দিনের পর দিন গিয়েছে হয়নি আমার ছুটি,
বুকের ভিতর ব্যর্থ কাঁদন পড়ত বৃথাই লুটি
বসে ঢুলত আঁখি দুটি!
আহা আজ পেয়েছি মুক্ত হাওয়া
লাগল চোখে তোমার চাওয়া
তাইতো প্রাণে বাঁধ টুটেছে রুদ্ধ কবিতার।
তোমার তরে বুকের তলায় অনেক দিনের অনেক কথা জমা,
কানের কাছে মুখটি থুয়ে গোপন সে-সব কইব প্রিয়তমা!
এবার শুধু কথায় গানে রাত্রি হবে ভোর
শুকতারাতে কাঁপবে তোমার নয়ন-পাতার লোর
অভি-মানিনীরে মোর!
যখন তোমায় সেধে ডাকবে বাঁশি
মলিন মুখে ফুটবে হাসি,
হিম-মুকুরে উঠবে ভাসি
অরুণ ছবি তার।
আশা
মহান তুমি প্রিয়
এই কথাটির গৌরবে মোর চিত্ত ভরে দিয়ো।
অনেক আশায় বসে আছি যাত্রা-শেষের পর
তোমায় নিয়েই পথের পারে বাঁধব আমার ঘর –
হে চির-সুন্দর!
পথ শেষ সেই তোমায় যেন করতে পারি ক্ষমা,
হে মোর কলঙ্কিনী প্রিয়তমা!
সেদিন যেন বলতে পারি, ‘এসো এসো প্রিয়,
বক্ষে এসো এসো আমার পূত কমনীয়!’
হায় হারানো লক্ষ্মী আমার! পথ ভুলেছ বলে
চির-সাথি যাবে তোমার মুখ ফিরিয়ে চলে?
জান ওঠে হায় মোচড় খেয়ে চলতে পড়ি টলে –
অনেক জ্বালায় জ্বলে প্রিয় অনেক ব্যথায় গলে!
বারে বারে নানান রূপে ছলতে আমায় শেষে,
কলঙ্কিনী! হাতছানি দাও সকল পথে এসে
কুটিল হাসি হেসে?
ব্যথায় আরো ব্যথা হানাই যে সে!
তুমি কি চাও তোমার মতোই কলঙ্কী হই আমি?
তখন তুমি সুদূর হতে আসবে ঘরে নামি –
হে মোর প্রিয়, হে মোর বিপথগামী!
পথের আজও অনেক বাকি,
তাই যদি হয় প্রিয় –
পথের শেষে তোমায় পাওয়ার যোগ্য করেই নিয়ো॥
নিকটে
বাদলা-কালো স্নিগ্ধা আমার কান্ত এল রিমঝিমিয়ে,
বৃষ্টিতে তার বাজল নুপূর পায়জোরেরই শিঞ্জিনী যে।
ফুটল উষার মুখটি অরুণ, ছাইল বাদল তাম্বু ধরায়;
জমল আসর বর্ষা-বাসর, লাও সাকি লাও ভর-পিয়ালায়।
ভিজল কুঁড়ির বক্ষ-পরাগ হিম-শিশিরের আমেজ পেয়ে
হমদম! হরদম দাও মদ, মস্ত্ করো গজল গেয়ে!
ফেরদৌসের ঝরকা বেয়ে গুল-বাগিচায় চলচে হাওয়া,
এই তো রে ভাই ওক্ত খুশির, দ্রাক্ষারসে দিলকে নাওয়া।
কুঞ্জে জরীন ফারসি ফরাস বিছিয়েচে আজ ফুলবালারা,
আজ চাই-ই চাই লাল-শিরাজি স্বচ্ছ-সরস খোর্মা-পারা!
মুক্তকেশী ঘোর-নয়না আজ হবে গো কান্তা সাকি,
চুম্বন এবং মিষ্টি হাতের মদ পেতে তাই ভরসা রাখি!
কান্তা সাথে বাঁচতে জনম চাও যদি কওসর-অমিয়,
সুর বেঁধে বীণ সারেঙ্গিতে খুবসে শিরীন শরাব পিয়ো!
খুঁজবে যেদিন সিকান্দারের বাঞ্ছিত আব্-হায়াত কুঁয়ায়,
সন্ধান তার মিলবে আশেক দিল-পিয়ারার ওষ্ঠ চুমায়!
খামখা তুমি মরছ কাজী শুষ্ক তোমার শাস্ত্র ঘেঁটে,
মুক্তি পাবে মদখোরের এই আল-কিমিয়ার পাত্র চেটে!
নিরুদ্দেশের যাত্রী
নিরুদ্দেশের পথে যেদিন প্রথম আমার যাত্রা হল শুরু
নিবিড় সে কোন্ বেদনাতে ভয়-আতুর এ বুক কাঁপল দুরু দুরু।
মিটল না ভাই চেনার দেনা, অমনি মুহুর্মুহু
ঘর-ছাড়া ডাক করলে শুরু অথির বিদায়-কুহু –
উহু উহু উহু!
হাতছানি দেয় রাতের শাঙন,
অমনি বাঁধে ধরল ভাঙন,
ফেলিয়ে বিয়ের হাতের কাঙন –
আমি খুঁজি কোন্ আঙনে কাঁকন বাজে গো!
বেরিয়ে দেখি, ছুটছে কেঁদে বাদলি হাওয়া হু হু,
মাথার ওপর দৌড়ে টাঙন, ঝড়ের মাতন,
দেয়ার গুরু গুরু।
পথ হারিয়ে কেঁদে ফিরি, ‘আর বাঁচিনে!
কোথায় প্রিয় কোথায় নিরুদ্দেশ?’
কেউ আসে না, মুখে শুধু ঝাপটা মারে
নিশীথ-মেঘের আকুল চাঁচর কেশ!
‘তালবনা’তে ঝঞ্ঝা তাথই হাততালি দেয়, বজ্রে বাজে তূরী,
মেখলা ছিঁড়ি পাগলি মেয়ে বিজলি-বালা নাচায় হিরের চুড়ি
ঘুরি ঘুরি ঘুরি
(ও সে) সকল আকাশ জুড়ি!
থামল বাদল রাতের কাঁদা,
ভোরের তারা কনক-গাঁদা,
ফুটল, ও মোর টুটল ধাঁধা –
হঠাৎ ও কার নূপুর শুনি গো?
থামল নূপুর, ভোরের তারাও বিদায় নিল ঝুরি!
এখন চলি সাঁঝের বধূ সন্ধ্যাতারার চলার পথে গো!
আজ অস্তপারের শীতের বায়ু কানের কাছে বইছে ঝুরু ঝুরু॥
পথিক বঁধু
আজ নলিন-নয়ান মলিন কেন বলো সখী বলো বলো!
পড়ল মনে কোন্ পথিকের বিদায়-চাওয়া ছলছল?
বলো সখী বলো বলো!!
মেঘের পানে চেয়ে চেয়ে বুক ভিজালে চোখের জলে,
ওই সুদূরের পথ বেয়ে কি চেনা-পথিক গেছে চলে
ফিরে আবার আসব বলে গো?
স্বর শুনে কার চমকে ওঠ (আহা),
ওগো ওযে বিহগ-বেহাগ, নির্ঝরিণীর কলকল।
ও নয় গো তার পায়ের ভাষা (আহা)
শীতের শেষের শুকনো পাতার ঝরে পড়ার বিদায়-ধ্বনি ও;
কোন্ কালোরে কোন্ ভালোরে
বাসলে ভালো (আহা)
পরদেশি কোন্ শ্যামল বঁধুর শুনচ বাঁশি সারাক্ষণই গো?
চুমচো কারে? ও নয় তোমার পথিক-বধুঁর চপল হাসি হা-হা,
তরুণ ঝাউয়ের কচি পাতায় করুণ অরুণ কিরণ ও যে (আ-হা)!
দূরের পথিক ফিরে নাকো আর (আহা আ-হা)
ও সে সবুজ দেশের অবুঝ পাখি
কখন এসে যাচবে বাঁধন, চলো সখী ঘরকে চলো!
ও কী? চোখে নামল কেন মেঘের ছায়া ঢল ঢল॥
পথিক শিশু
নাম-হারা তুই পথিক শিশু এলি অচিন দেশ পারায়ে।
কোন নামের আজ পরলি কাঁকন? বাঁধনহারার কোন্ কারা এ?
আবার মনের মতন করে
কোন নামে বল ডাকব তোরে?
পথভোলা তুই এই সে ঘরে
ছিলি ওরে, এলি ওরে বারে বারে নাম হারায়ে।
ওরে জাদু, ওরে মানিক, আঁধার ঘরের রতন-মণি!
ক্ষুধিত ঘর ভরলি এনে ছোট্ট হাতের একটু ননী।
আজ কেন রে নিবিড় মুখে
কান্না-সায়র উথলে বুকে?
নতুন নামে ডাকতে তোকে
ওরে কে কণ্ঠ রুখে? পাঁচ-ফাগুনের জুঁই-চারা এ!
আজ মন-পাখি ধায় মধুরতম নাম আশিসের শেষ ছাড়ায়ে।
প্রণয় নিবেদন
লো কিশোরী কুমারী!
পিয়াসি মন তোমার ঠোঁটের একটি গোপন চুমারই॥
অফুট তোমার অধর ফুলে
কাঁপন যখন নাচন তুলে
একটু চাওয়ায় একটু ছুঁলে গো!
তখন এ-মন যেমন কেমন-কেমন কোন্ তিয়াসে কোঙারি? –
ওই শরম-নরম গরম ঠোঁটের অধীর মদির ছোঁয়ারই।
বুকের আঁচল মুখের আঁচল বসন-শাসন টুটে
ওই শঙ্কা-আকুল কী কী আশা ভালোবাসা ফুটে সই?
নয়ন-পাতার শয়ন-ঘেঁসা
ফুটচে যে ওই রঙিন নেশা
ভাসা-ভাসা বেদনমেশা গো!
ওই বেদন-বুকে যে সুখ চোঁয়ায় ভাগ দিয়ো তার কোঙারই!
আমার কুমার হিয়া মুক্তি মাগে অধর ছোঁয়ায় তোমারই॥
প্রণয়-ছল
কত ছল করে সে বারেবারে দেখতে আসে আমায়।
কত বিনা-কাজের কাজের ছলে চরণ দুটি আমার দোরেই থামায়॥
জানলা আড়ে চিকের পাশে
দাঁড়ায় এসে কিসের আশে,
আমায় দেখেই সলাজ ত্রাসে,
গাল দুটিকে ঘামায়।
অনামিকায় জড়িয়ে আঁচল
দুরু দুরু বুকে
সবাই যখন ঘুমে মগন তখন আমায় চুপে চুপে
দেখতে এসেই মল বাজিয়ে দৌড়ে পলায়
রঙ খেলিয়ে চিবুক গালের কূপে।
দোর দিয়ে মোর জলকে চলে
কাঁকন মারে কলস-গলে
অমনি চোখোচোখি হলে
চমকে ভুঁয়ে নখটি ফোটায়, চোখ দুটিকে নামায়।
সইরা হাসে দেখে ছুঁড়ির দোর দিয়ে মোর
নিতুই নিতুই কাজ-অকাজে হাঁটা।
করবে কী ও? রোজ যে হারায় আমার পথেই
শিথিল বেণির দুষ্টু মাথার কাঁটা!
একে ওকে ডাকার ভানে
আনমনা মোর মনটি টানে,
চলতে চাদর পরশ হানে
আমারও কী নিতুই পথে তারই বুকের জামায়॥
পিঠ ফিরিয়ে আমার পানে দাঁড়ায় দূরে
উদাসনয়ান যখন এলোকেশে,
জানি, তখন মনে মনে আমার কথাই
ভাবতেছে সে, মরেছে সে আমায় ভালোবেসে।
বই হাতে সে ঘরের কোণে
জানি আমার বাঁশিই শোনে,
ডাকলে রোষে আমার পানে
নয়না হেনেই রক্তকমল-কুঁড়ির সম চিবুকটি তার নামায়॥
ফুল-কুঁড়ি
আর পারিনে সাধতে লো সই এক ফোঁটা এই ছুঁড়িকে।
ফুটবে না যে ফোটাবে কে বলল সে ফুল-কুঁড়িকে।
ঘোমটা-চাঁপা পারুল-কলি,
বৃথাই তারে সাধল অলি
পাশ দিয়ে হায় শ্বাস ফেলে যায় হুতাশ বাতাস ঢলি।
আ মলো ছিঃ! ওর হল কী?
সুতোর গুঁতো শ্রান্ত-শিথিল টানতে ও মন-ঘুড়িকে।
আর শুনেছিস সই?
ও লো হিমের চুমু হার মেনেছে এইটুকু আইবুড়িকে!!
সন্ধে সকাল ছুঁয়ে কপাল রবির যাওয়া-আসাই সার,
ব্যর্থ হল পথিক-কবির গভীর ভালোবাসার হার।
জল ঢেলে যায় জংলা বধু,
মৌমাছি দেয় কমলা মধু,
শরম-চাদর খুলবে না সে আদর শুধু শুধু।
কে জানে বোন পথভোলা কোন্
তরুণ-চোখের করুণ-চাওয়ায় চোখ ঠেরেছে ছুঁড়িকে –
বসে আছে লো
এইলজ্জাবতীর বধির বুকের সিংহ-আসন জুড়ি কে?
বরষায়
আদর গর-গর
বাদর দর-দর
এ-তনু ডর-ডর
কাঁপিছে থর-থর॥
নয়ন ঢল-ঢল
[সজল ছল-ছল]
কাজল-কালো-জল
ঝরে লো ঝর ঝর॥
ব্যাকুল বনরাজি শ্বসিছে ক্ষণে ক্ষণে
সজনী! মন আজি গুমরে মনে মনে।
বিদরে হিয়া মম
বিদেশে প্রিয়তম
এ-জনু পাখিসম
বরিষা জর-জর॥
[বিজুরি হানে ছুরি চমকি রহি রহি
বিধুরা একা ঝুরি বেদনা কারে কহি।]
সুরভি কেয়া-ফুলে
এ হৃদি বেয়াকুলে
কাঁদিছে দুলে দুলে
বনানী মর মর॥
নদীর কলকল ঝাউ-এর ঝলমল
দামিনী জ্বল জ্বল কামিনী টলমল।
আজি লো বনে বনে
শুধানু জনে জনে
কাঁদিল বায়ুসনে
তটিনী তরতর॥
আদুরি দাদুরি লো কহো লো কহো দেখি
এমন বাদরি লো ডুবিয়া মরিব কি?
একাকী এলোকেশে
কাঁদিব ভালোবেসে?
মরিব লেখা-শেষে
সজনি সরো সরো।
বিজয়িনী
হে মোর রানি! তোমার কাছে হার মানি আজ শেষে
আমার বিজয়-কেতন লুটায় তোমার চরণতলে এসে।
আমার সমর-জয়ী অমর তরবারি
ক্লান্তি আনে, দিনে দিনে হয়ে ওঠে ভারী,
এখনএ ভার আমার তোমায় দিয়ে হারি
এই হার-মানা-হার পরাই তোমার কেশে।
ওগো দেবী!
আমায় দেখে কখন তুমি ফেললে চোখের জল,
আজ বিশ্ব-জয়ীর বিপুল দেউল তাইতে টল-মল!
আজ বিদ্রোহীর এই রক্ত-রথের চূড়ে
বিজয়িনী! নীলাম্বরীর আঁচল তোমার উড়ে,
যত তূণ আমার আজ তোমার মালায় পুরে,
আমি বিজয়ী আজ নয়ন-জলে ভেসে।
বিরহ-বিধুরা
কার তরে? ছাই এ পোড়ামুখ আয়নাতে আর দেখব না;
সুর্মা-রেখার কাজল-হরফ নয়নাতে আর লেখব না!
লাল-রঙিলা করব না কর মেহেদি-হেনার ছাপ ঘষে;
গুলফ চুমি কাঁদবে গো কেশ চিরুণ-চুমার আপশোশে!
কপোল-শয়ান অলক-শিশুর উদাস ঘুম আর ভাঙবে না;
চুমহারা ঠোঁট পানের পিকের হিঙুল রঙে রাঙবে না!
কার তরে ফুলশয্যা বাসর, সজ্জা নিজেই লজ্জা পায়;
পীতম আমার দূর প্রবাসে, দেখবে কে সাজ-সজ্জা হায়!
চাঁচর চুলে ধূম্র ওড়ে, অঙ্গ রাঙায় আগুন-রাগ,
যেমনি ফোটে মন-নিকষে পিয়ার ফাগুন-স্মৃতির দাগ।
সবাই বলে, চিনির চেয়েও শিরিন জীবন, – হায় কপাল!
পীতম-হারা নিম-তেতো প্রাণ কেঁদেই কাটায় সাঁঝ সকাল।
যেথায় থাকো খোশহালে রও, বন্ধু আমার – শোকের বল!
তুমি তোমার সুখ নিয়ে রও, – থাকুক আমার চোখের জল!
বে-শরম
আরে আরে সখী বারবার ছি ছি
ঠারত চঞ্চল আঁখিয়া সাঁবলিয়া।
দুরু দুরু গুরু গুরু কাঁপত হিয়া উরু
হাথসে গির যায় কুঙ্কুম-থালিয়া।
আর না হোরি খেলব গোরি
আবির ফাগ দে পানি মে ডারি
হা প্যারি –
শ্যাম কী ফাগুয়া
লাল কী লুগুয়া
ছি ছি মোরি শরম ধরম সব হারি
মারে ছাতিয়া মে কুঙ্কুম বে-শরম বানিয়া।
মানিনী
মূক করে ওই মুখর মুখে লুকিয়ে রেখো না,
ওগো কুঁড়ি, ফোটার আগেই শুকিয়ে থেকো না!
নলিন নয়ান ফুলের বয়ান মলিন এদিনে
রাখতে পারে কোন সে কাফের আশেক বেদীনে?
রুচির চারু পারুল বনে কাঁদচ একা জুঁই,
বনের মনের এ বেদনা কোথায় বলো থুই?
হাসির রাশির একটি ফোঁটা অশ্রু অকরুণ,
হাজার তারা মাঝে যেন একটি কেঁদে খুন!
বেহেশতে কে আনলে এমন আবছা বেথার রেশ,
হিমের শিশির ছুঁয়ে গেছে হুরপরিদের দেশ!
বরষ পরের দরশনের কই সে হরষণ,
মিলবে না কি শিথিল তোমার বাহুর পরশন?
শরম টুটে ফুটুক কলি শিশির-পরশে
ঘোমটা ঠেলে কুণ্ঠা ফেলে সলাজ হরষে।
শরাবন তহুরা
নার্গিস-বাগমে বাহার কী আগমে ভরা দিল দাগমে –
কাঁহা মেরি পিয়ারা, আও আও পিয়ারা।
দুরু দুরু ছাতিয়া ক্যায়সে এ রাতিয়া কাটুঁ বিনু সাথিয়া
ঘাবরায়ে জিয়ারা, তড়পত জিয়ারা।
দরদে দিল জোর, রঙিলা কওসর
শরাবন তহুরা লাও সাকি লাও ভর,
পিয়ালা তু ধর দে, মস্তানা কর দে, সব দিল ভর দে
দরদ মে ইয়ারা – সঙ্গ দিল ইয়ারা।
জিগর কা খুন নেহি, ডরো মত সাকিয়া,
আঙ্গুরী-লোহুয়ো, – ক্যাঁও ভিঙ্গা আঁখিয়া?
গিয়া পিয়া আতা নেহি মত কহো সহেলি,
ছোড়ো হাত – পিয়ালা য়ো ভর দে তু পহেলি!
মত মাচা গওগা, বসন্তমে বাহবা ম্যায় সে ক্যা তৌবা?
আহা গোলনিয়ারা সখি গোলনিয়ারা –
শরাব কা নূর সে রৌশন কর দে দুনিয়া আঁধিয়ারা
দুনিয়া আঁধিয়ারা দুনিয়া আঁধিয়ারা।
শেষের ডাক
মরণ-রথের চাকার ধ্বনি ওই রে আমার কানে আসে।
পুবের হাওয়া তাই নেমেছে পারুল বনে দীঘল শ্বাসে।
ব্যথার কুসুম গুলঞ্চ ফুল
মালঞ্চে আজ তাই শোকাকুল,
গোরস্থানের মাটির বাসে তাই আমার আজ প্রাণ উদাসে।
অঙ্গ আসে অবশ হয়ে নেতিয়ে-পড়া অলস ঘুমে
সাগর-পারের বিদেশিনীর হিম-ছোঁওয়া যার নয়ন চুমে।
হৃদয়-কাঁদা নিদয় কথা
আকাশ-ভেজা বিদায়-ব্যথা
লুটায় গো মোর ভুবন ভরি বাঁধন ছেঁড়ার কাঁদন ত্রাসে।
মোর কাফনের কর্পূর-বাস ভরপুর আজ দিগবলয়ে,
বনের শাখা লুটিয়ে কাঁদে হরিণটি তার হারার ভয়ে।
ফিরে-পাওয়া লক্ষ্মী বৃথাই
নয়ন-জলে বক্ষ তিতায়
ওগো এ কোন্ জাদুর মায়ায় আমার দু-চোখ শুধু জলে ভাসে।
আজ আকাশ-সীমায় শব্দ শুনি অচিন কাদের আসা যাওয়ার,
তাই মনে হয় এই যেন শেষ আমার সকল দাবি দাওয়ার।
আজ কেহ নাই পথের সাথি,
সামনে শুধু নিবিড় রাতি
আমায় দূরের মানুষ ডাক দিয়েছে রাখবে কে আর বাঁধন পাশে।
সোহাগ
গুলশন কো চুম চুম কহতে বুলবুল,
রুখসারা সে বে-দরদি বোরকা খুল!
হাঁসতি হ্যায় বোস্তাঁ,
মস্ত্ হো যা দোস্তাঁ,
শিরি শিরাজি সে যা বেহোশ জাঁ।
সব কুছ আজ রঙিন হ্যায় সব কুছ মশগুল,
হাঁস্তি হ্যায় গুল হো কর দোজখ বিলকুল
হা রে আশেক
মাশুক কি চমনোঁ মে ফুলতা নেই দোবারা ফুল
ফুল ফুল ফুল॥
স্নেহ-পরশ
আমি এদেশ হতে বিদায় যেদিন নেব প্রিয়তম,
কাঁদবে এ বুক সঙ্গীহারা কপোতিনী সম –
তখন মুকুরপাশে একলা গেহে
আমারই এই সকল দেহে
চুমব আমি চুমব নিজেই অসীম স্নেহে গো!
আহা পরশ তোমার জাগছে যে গো এই সে দেহে মম,
কম সরস-হরষ সম।
তখন তুমি নাইবা – প্রিয় – নাইবা রলে কাছে,
জানব আমার এই সে দেহে এই সে দেহে গো
তোমার বাহুর বুকের শরম-ছোঁয়ার আকুল কাঁপন আছে –
মদির অধীর পুলক নাচে!
তখন নাইবা আমার রইল মনে
কোনখানে মোর দেহের বনে
জড়িয়েছিলে লতার মতন আলিঙ্গনে গো!
আমি চুমোয় চুমোয় ডুবাব এই সকল দেহ মম –
ওগো শ্রাবণ-প্লাবন সম।
স্মরণে
আজ নতুন করে পড়ল মনে মনের মতনে
এই শাঙন সাঁঝের ভেজা হাওয়ায়, বারির পতনে।
কার কথা আজ তড়িৎ-শিখায়
জাগিয়ে গেল আগুন লিখায়,
ভোলা যে মোর দায় হল হায়
বুকের রতনে।
এই শাঙন সাঁঝের ভেজা হাওয়ায়, বারির পতনে।
আজ উতল ঝড়ের কাতরানিতে গুমরে ওঠে বুক
নিবিড় ব্যথায় মূক হয়ে যায় মুখর আমার মুখ।
জলো হাওয়ার ঝাপটা লেগে
অনেক কথা উঠল জেগে
পরান আমার বেড়ায় মেগে
একটু যতনে।
এই শাঙন সাঁঝের ভেজা হাওয়ায়, বারির পতনে।
হোলি
আয় লো সই খেলব খেলা
ফাগের ফাজিল পিচকিরিতে।
আজ শ্যামে জোর করব ঘায়েল
হোরির সুরের গিটকিরিতে।
বসন ভূষণ ফেল লো খুলে,
দে দোল দে দোদুল দুলে,
কর লালে লাল কালার কালো
আবির হাসির টিটকিরিতে॥