- বইয়ের নামঃ প্রলয়শিখা
- লেখকের নামঃ কাজী নজরুল ইসলাম
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
খেয়ালি
আয় রে পাগল আপন-বিভোল খুশির খেয়ালি
হাতে নিয়ে রবাব-বেণু রঙিন পেয়ালি!
ভোজপুরিদের প্রমত্ততায়
মাতুক ওরা রাজার সভায়
আঙিনাতে জ্বালরে তোরা অরুণ-দেয়ালি
স্বপনলোকের পথিক তোরা ধরার হেঁয়ালি।
চাষার গান
আমাদের জমির মাটি ঘরের বেটি, সমান রে ভাই।
কে রাবণ করে হরণ দেখব রে তাই॥
আমাদের ঘরের বেটির কেশের মুঠি ধরে নে যায় সাগরপারে,
দিয়ে হাত মাথায় শুধু ঘরে বসে রইব না রে।
যে লাঙল ফলা দিয়ে শস্য ফলাই মরুর বুকে,
আছে সে লাঙল আজও রুখব তাতেই রাজার সেপাই॥
পাঁচনির আশীর্বাদে মানুষ করি ঠেঙিয়ে বলদ,
সে পাঁচন আছে আজও ভাঙব তাতেই ওদের গলদ।
যে-জলে ভাসছি মোরা চল সে-জলে ওদের ভাসাই॥
পাথুরে পাহাড় কেটে নিঙাড়ি নীরস ধরা,
আনি রে ঝরনাধারা এ নিখিল শীতল করা।
আজি সে গাঁইতি শাবল কোথায় গেল, হাতে কি নাই॥
খেতেছে ফসল নিতুই ডিঙিয়ে বেড়ার কাঁটা,
এবারের পুজোয় নতুন বলি দে সে-সব পাঁঠা।
দেখিবি আসবে ফিরে শক্তিময়ী আবার হেথাই॥
নব-ভারতের হলদিঘাট
বালাশোর – বুড়িবালামের তীর –
নব-ভারতের হলদিঘাট,
উদয়-গোধূলি-রঙে রাঙা হয়ে
উঠেছিল যথা অস্তপাট।
আ-নীল গগন-গম্বুজ-ছোঁয়া
কাঁপিয়া উঠিল নীল অচল,
অস্তরবিরে ঝুঁটি ধরে আনে
মধ্য গগনে কোন পাগল!
আপন বুকের রক্তঝলকে
পাংশু রবিরে করে লোহিত,
বিমনানে বিমানে বাজে দুন্দুভি,
থরথর কাঁপে স্বর্গ-ভিত।
দেবকী মাতার বুকের পাথর
নড়িল কারায় অকস্মাৎ
বিনা মেঘে হল দৈত্যপুরীর
প্রাসাদে সেদিন বজ্রপাত।
নাচে ভৈরব, শিবানী, প্রমথ
জুড়িয়া শ্মশান মৃত্যুনাট, –
বালাশোর – বুড়িবালামের তীর –
নব ভারতের হলদিঘাট।
অভিমন্যুর দেখেছিস রণ?
যদি দেখিসনি, দেখিবি আয়,
আধা-পৃথিবীর রাজার হাজার
সৈনিকে চারি তরুণ হটায়।
ভাবী ভারতের না-চাহিতে আসা
নবীন প্রতাপ, নেপোলিয়ন,
ওই ‘যতীন্দ্র’ রণোন্মত্ত –
শনির সহিত অশনি-রণ।
দুই বাহু আর পশ্চাতে তার
রুষিছে তিনটি বালক শের,
‘চিত্তপ্রিয়’, ‘মনোরঞ্জন’,
‘নীরেন’ – ত্রিশূল ভৈরবের!
বাঙালির রণ দেখে যা রে তোরা
রাজপুত, শিখ, মারাঠি, জাঠ!
বালাশোর – বুড়িবালামের তীর –
নব-ভারতের হলদিঘাট।
চার হাতিয়ারে – দেখে যা কেমনে
বধিতে হয় রে চার হাজার,
মহাকাল করে কেমনে নাকাল
নিতাই গোরার লালবাজার!
অস্ত্রের রণ দেখেছিস তোরা,
দেখ নিরস্ত্র প্রাণের রণ;
প্রাণ যদি থাকে – কেমনে সাহসী
করে সহস্র প্রাণ হরণ!
হিংস-বুদ্ধ-মহিমা দেখিবি
আয় অহিংস-বুদ্ধগণ
হেসে যারা প্রাণ নিতে জানে, প্রাণ
দিতে পারে তারা হেসে কেমন!
অধীন ভারত করিল প্রথম
স্বাধীন-ভারত মন্ত্রপাঠ,
বালাশোর – বুড়িবালামের তীর –
নব-ভারতের হলদিঘাট।
সে মহিমা হেরি ঝুঁকিয়া পড়েছে
অসীম আকাশ, স্বর্গদ্বার,
ভারতের পূজা-অঞ্জলি যেন
দেয় শিরে খাড়া নীল পাহাড়!
গগনচুম্বী গিরিশের হতে
ইঙ্গিত দিল বীরের দল,
‘মোরা স্বর্গের পাইয়াছি পথ –
তোরা যাবি যদি, এ পথে চল!
স্বর্গ-সোপানে রাখিনু চিহ্ন
মোদের বুকের রক্ত-ছাপ,
ওই সে রক্ত-সোপানে আরোহি
মোছ রে পরাধীনতার পাপ!
তোরা ছুটে আয় অগণিত সেনা,
খুলে দিনু দুর্গের কবাট!’
বালাশোর – বুড়িবালামের তীর –
নব-ভারতের হলদিঘাট।
নমস্কার
তোমারে নমস্কার –
যাহার উদয়-আশায় জাগিছে রাতের অন্ধকার।
বিহগ-কণ্ঠে জাগে অকারণ পুলক আশায় যার
স্তব্ধ পাখায় লাগে গতিবেগ চপল দুর্নিবার।
ঘুম ভেঙে যায় নয়নসীমায় লাগিয়া যার আভাস
কমলের বুকে অজানিতে জাগে মধুর গন্ধবাস।
জাগে সহস্র শিশির-মুকুরে সহস্র মুখ যার
না-আসা দিনের সূর্যট সে তুমি, তোমারে নমস্কার।
নমো দেবী নমো নম,
ছুটিয়া চলেছ স্রোত-তরঙ্গ লপাহাড়ি হরিণীসম!
অটল পাষাণ অচপল গিরিরাজের চপল মিয়ে
চলেছে তটিনী তটে তটে নট-মল্লারে গান গেয়ে!
কূলে কূলে হাসো পল্লবে ফুলে ফল-ফসলের রানি,
বধির ধরারে শোনাও নিত্য কলকলকল বাণী।
তব কলভাষে খলখল হাসে বোবা ধরণির শিশু,
ওগো পবিত্রা, কূলে কূলে তব কোলে দোলে নব জিশু।
তব স্রোতোবেগে জাগে আনন্দ জাগিছে জীবন নিতি,
চিরপুরাতন পাষাণে বহাও চিরনূতনের গীতি!
জড়েরে জড়ায়ে নাচিছ প্রাণদা, দাও নব প্রাণ তার,
শ্মশানের পাশে ভাগীরথী তুমি, তোমারে নমস্কার।
পূজা অভিনয়
মানুষের পদ-পূত মাটি দিয়া
দেবতা রচিছে পূজারিদল।
সে দেবতা গেল স্বর্গে, মানুষ
রহিল আঁকড়ি মর্ত্যতল।
দেবতারে যারা করেছে সৃজন,
সৃজিতে পারে না আপনারে,
আসে না শক্তি, পায় না আশিস,
ব্যর্থ সে পূজা বারে বারে।
মাটির প্রতিমা মাটিই রহিল,
হায় কারে দিবে শক্তিবর,
দেবতার বর নিতে পারে হাতে
হেথা কোথা সেই শক্তিধর!
বিগ্রহ-চালে হাসে বুড়োশিব,
বলে, ‘দেখো দেখো দশভুজা,
নেংটি পরিয়া নেংটে ইঁদুর –
ভক্তরা এল দিতে পূজা;
গণেশ-ভক্ত ইঁদুরে-বুদ্ধি
হস্তীকর্ণ লম্বোদর,
কার্তিকে মোর সাজায়েছে দেখো,
যেন উহাদের মিয়ের বর!
উহাদের দেব-সেনাপতি পরে
ছেঁড়া কটিবাস আধ-হাতি,
সেনাদল হল চরকাবুড়ি গো,
তরুণেরা হল জোলা তাঁতি!
মাথা কেটে আর অস্ত্র হেনেও
হয় না স্বাধীন আর সকল,
সূতা কেটে আর বস্ত্র বুনিয়া
কেল্লা করিবে ওরা দখল!
বলি দেয় ওরা কুমড়ো ছাগল
বড়ো জোর দুটো পোষা মহিষ,
মহিষাসুরেরে বলি দিতে নারে,
বলে, ‘মাগো ওটা তুই বধিস।’
লক্ষ্মীর হাতে অমৃতভাণ্ড,
লক্ষ্মী ছেলেরা তাহাই চায়,
তাই পূজা করে ওরা বণিকেরে –
লক্ষ্মীবাহন কালপ্যাঁচায়!
অমৃত চাহিছে, ওরা তো চাহে না
মোর কণ্ঠের বিষের ভাগ,
ওদেরই মরুতে জঙ্গলে চরে
তোমার বাহন সিংহ-বাঘ!
দেখিয়া তরাসে পলায় উহারা;
বাহন দেখিয়া যাদের ভয়,
সিংহবাহিনী! পূজিয়া তোমায়
তারাই করিবে অসুর জয়?
সেথা তব হাতে টিনের খড়গ,
সারা গায়ে মোড়া ঝালতা রাং,
দেখে হাসে আর ঘুমাই শ্মশানে,
ভক্তের দল জোগায় ভাং।
কোন রূপ তব ধ্যান করে ওরা,
শুনিবে? শুনিয়া যাও ঘুমোও,
শ্বশুর-বাড়ির ফেরত যেন গো,
অসুর-বাড়ির ফেরত নও!
বাণী-মেয়ে মোর বোবা হয়ে বসে,
ভাঙা বীণা কোলে বসিয়া রয়,
কথায় কথায় সেথা সিডিসন,
কী জানি কখন জেলের ভয়।
নিজেরা বন্দি, তাই দেখো ওরা
ধরিয়া ও কোন কন্যারে
কলা-বউ করে রেখেছে তাদের
হীন কামনার কারাগারে!
ভূতো ছেলেগুলো কলেজেতে পড়ে,
কে জানে ক-ল্যাজ পায় হোথায়,
কেহ শাখামৃগ হইয়াছে উঠি
আধ্যাত্মিক উঁচু শাখায়!’
এমনই শরৎ সৌরাশ্বিনে
অকাল-বোধনে মহামায়ার
যে পূজা করিল বধিতে রাবণে
ত্রেতায় স্বয়ং রামাবতার,
আজিও আমরা সে দেবী-পূজার
অভিনয় করে চলিয়াছি!
লঙ্কা-সায়রী রাবণ ধরিয়া
টুঁটিতে ফাঁসায়ে দেয় কাছি।
দুঃসাহসীরা দুর্গা বলিয়া
হয়তো কাছিতে পড়ে ঝুলে,
দেবীর আসন তেমনই অটল,
হয়তো ঈষৎ ওঠে দুলে।
কে ঘুচাবে এই পূজা-অভিনয়,
কোথায় দূর্বাদলশ্যাম
ধরণি-কন্যা শস্য-সীতারে
উদ্ধারিবে যে নবীন রাম!
দশমুখো ওই ধনিক রাবণ
দশ দিকে আছে মেলিয়া মুখ,
বিশ হাতে করে লুণ্ঠন তবু
ভরে নাকো ওর ক্ষুধিত বুক।
হয়তো গোকুলে বাড়িছে সে আজ,
উহারে কল্য বধিবে যে,
গোয়ালার গরে খেঁটে-লাঠি-করে
হলধর-রূপী রাম সেজে!
প্রলয়শিখা
বিশ্ব জুড়িয়া প্রলয়-নাচন লেগেছে ওই
নাচে নটনাথ কাল-ভৈরব তাথই থই।
সে নৃত্যবেগে ললাট-অগ্নি প্রলয়-শিখ
ছড়ায়ে পড়িল হেরো রে আজিকে দিগ্বিদিক ।
সহস্র-ফণা বাসুকির সম বহ্নি সে
শ্বসিয়া ফিরিছে, জরজর ধরা সেই বিষে।
নবীন রুদ্র আমাদের তনুমনে জাগে
সে প্রলয়শিখা রক্ত-উদয়ারুণ-রাগে।
ভরার মেয়ের সম ধরা হয়ে অপহৃতা
দৈত্য-আগারে চলিতে কাঁদিয়া মরে বৃথা;
আমরা শুনেছি লাঞ্ছিতার সে পথ-বিলাপ,
সজল আকাশে উঠিয়াছি তাই বত্র-শায়ক ইন্দ্রচাপ
মুক্ত ধরণি হইয়াছে আজি বন্দিবাস,
নহে কো তাহার অধীন তাহার থল-জল-বায়ু নীল আকাশ।
মুক্তি দানিতে এসেছি আমরা দেব-অভিশাপ দৈত্যত্রাস,
দশ দিক জুড়ি জ্বলিয়া উঠেছে প্রলয়-বহ্নি সর্বনাশ!
ঊর্ধ্ব হইতে এসেছি আমরা প্রলয়ের শিখা অনির্বান,
জতুগৃহদাহ-অন্তে করিব জ্যোতির স্বর্গে মহাপ্রয়াণ।
বিংশ শতাব্দী
হইল প্রভাত বিংশ শতাব্দীর,
নব-চেতনায় জাগো, জাগো, ওঠো বীর!
নব ধ্যান নব ধারণায় জাগো
নব প্রাণ নব প্রেরণায় জাগো,
সকল কালের উচ্চে তোলো গো শির,
সর্ব-বন্ধ-মুক্ত জাগো গে বীর!
নূতন কন্ঠে গাহো নূতনের জয়,
আমরা ছাড়ায়ে উঠেছি সর্বভয়!
সর্বকালের সব মোহ টুটি
বালারুণ-সম উঠিয়াছি ফুটি,
আজিকে সর্ব-পরাধীনতার লয়,
নতুন জগতে আমরা সর্বময়!
আমরা ভেঙেছি রাজার সিংহাসন,
করিয়াছি নরে আমরা গো নারায়ণ।
পায়ের তলার মানুষে টানিয়া
বসায়েছি দেব-বেদিতে আনিয়া,
টুটায়েছি সব দেশের সব বাঁধন
নিখিল মানব-জাতি এক-দেহ-মন।
পুবে, পশ্চিমে, উত্তরে, দক্ষিণে,
য়ুরোপ, রাশিয়া, আরব, মিশর, চীনে,
আমরা আজিকে এক-প্রাণ এক-দেহ,
এক বাণী – ‘কারো অধীন রবে না কেহ!’
চলি একে একে দৈত্য-প্রাসাদ জিনে।
পারি নাই যাহা, পারিব দু-এক দিনে।
কাটায়ে উঠেছি ধর্ম-আফিম-নেশা,
ধ্বংস করেছি ধর্মযাজকী পেশা!
ভাঙি মন্দির, ভাঙি মসজিদ,
ভাঙিয়া গির্জা গাহি সংগীত –
এক মানবের একই রক্ত মেশা।
কে শুনিবে আর ভজনালয়ের হ্রেষা!
আদিম সৃষ্টি-দিবস হইতে ক্রমে
প্রাচীরের পর প্রাচীর উঠেছে জমে।
সে প্রাচীর মোরা ভাঙিয়া চলেছি,
যতই চলেছি ততই দলেছি,
জ্বালায়ে চলেছি পুঞ্জিভূত সে ভ্রমে।
শ্রমণের চেয়ে পূজ্য ভেবেছি শ্রমে।
সংস্কারের জগদ্দল পাষাণ
তুলিয়া বিশ্বে আমরা করেচি ত্রাণ।
সর্ব আচার-বিচার-পঙ্ক হতে
তুলিয়া জগতে এনেছি মুক্ত স্রোতে।
অচলায়তনের বাতায়ন খুলি – প্রাণ
এনেছি, গেয়েছি নব-আলোকের গান।
নচিকেতা-সম আমরা মৃত্যুপুরী
বারে বারে যাই বারে বারে আসি ঘুরি।
মৃত্যুরে মোরে মুখোমুখি দেখিয়াছি,
মোদের জীবনে মরণ আছে গো বাঁচি।
স্বর্গ এনেছি মর্ত্যে করিয়া চুরি;
চাহিছে মর্ত্য দেবতা বাদলে ঝুরি।
সার্থক হল আজিকে ভৃগু-সাধন,
আমরা করেছি সৃজন নব-ভুবন।
এক আদমের মোরা সন্তান,
নাহি দেশ কাল ধর্মাভিমান,
নাহি ব্যবধান, উচ্চ, নীচ, সুজন;
নিখিলের মাঝে আমরা এক জীবন!
আমরা সহিয়া সকল অত্যাচার
অত্যাচারের করিতেছি সংহার।
ধ্বংসের আগে এই পৃথিবীরে
হাসাইতে মোরা আসিয়াছি ফিরে,
শেষের আশিস আমরা নিয়ন্তার;
খুলিতে এসেছি সকল বন্ধ দ্বার।
আমরা বাহিনী বিংশ শতাব্দীর
মন্থন-শেষ-অমৃত জলধির
কল্কি-দেবের আগে-চলা দূত,
কভু ঝড়, কভু মলয়-মারুত,
কভু ভয়, কভু ভরসা লক্ষ্মীশ্রীর।
জীবন-মরণ পায়ে বাজে মঞ্জীর!
আমরা বাহিনী বিংশ শতাব্দীর।
বৈতালিক
অসুরের খল-কোলাহলে এসো সুরের বৈতালিক!
বেতালের যতি-ভঙ্গে তোমার নৃত্য ছন্দ দিক।
অকুণ্ঠিত ও-কন্ঠে তোমার আনো উদাত্ত বাণী,
সুরের সভায় রাত্রিপারের উষসীরে আনো টানি।
তোমার কন্ঠ বিহগ-কণ্ঠে ছড়াক দিগ্বিদিক॥
তন্দ্রা-অলস নয়নে বুলাও জাগর-সুরের স্পর্শ,
গত নিশীথের মুকুলে ফোটাও বিকশিত-প্রাণ হর্ষ!
মৃতের নয়নে দাও দাও তব চপল আঁখি নিমিখ॥
ভারতী – আরতি
জয় ভারতী শ্বেতশতদলবাসিনী,
বিষ্ণু-শরণ-চরণ আদি বাণী।
কণ্ঠ-লীলা বাজিছে বীণা
বিশ্ব ঘুরে গাহে সে সুরে
জয় জয় বীণাপাণি॥
শুনি সে সুর অন্ধ নভে
উদিল গ্রহ তারকা সবে,
মাতিল আলো-মহোৎসবে মা
বিশ্বরানি॥
আদি সৃজন-দিনে অন্ধ ভুবনে
তোমার জ্যোতি আলো দিল মা নয়নে।
জ্ঞান-প্রদায়িনী হৃদয়ে আলো দিলে,
ধেয়ান-সুন্দর করিলে সব নিখিলে।
ঊরো মা ঊরো আঁধার-পুরে আলো দানি॥
মণীন্দ্র-প্রয়াণ
দানবীর, এতদিনে নিঃশেষে
করিলে নিজেরে দান।
মৃত্যুরে দিলে অঞ্জলি ভরি
তোমার অমৃত প্রাণ।
অমৃতলোকের যাত্রী তোমরা
পথ ভুলে আস, তাই
তোমাদের ছুঁয়ে অমর মৃত্যু
আজিও সে মরে নাই।
স্বর্গলোকের ইঙ্গিত – আস
ছল করে ধরাতল,
তোমাদেরে চাহি ফোটে ধরণিতে
ধেয়ানের শতদল।
রৌদ্র-মলিন নয়নে বুলাও
স্বপনলোকের মায়া,
তৃষিত আর্ত ধরায় ঘনাও
সজল মেঘের ছায়া।
ইন্দ্রকান্তমণি ছিলে তুমি
শ্যাম ধরণির বুকে,
সুন্দরতর লোকের আভাস
এনেছিলে চোখে-মুখে।
ঐশ্বর্যের বুকে বসে বলে –
-ছিলে শিব বৈরাগী,
বিভব রতন ইঙ্গিত শুধু
ত্যাগের মহিমা লাগি।
ইন্দ্র, কুবের, লক্ষ্মী, আশিস
ঢেলেছিল যত শিরে,
দু-হাত ভরিয়া ক্ষুধিত মানবে
দিলে তাহা ফিরে ফিরে।
যে ঐশ্বর্য লয়ে এসেছিলে,
তাহারই গর্ব লয়ে
করেছ প্রয়াণ, পুরুষশেষ্ঠ,
উঁচু শিরে নির্ভয়ে!
তব দান-ভারে টলমল ধরা
চাহে বিহ্বল-আঁখি,
অঞ্জলি পুরি দিয়া মহাদান,
চক্ষেরে দিলে ফাঁকি।
যতীন দাস
আসিল শরৎ সৌরাশ্বিন
দেবদেবী যবে ঘুমায়ে রয়
পাষাণ-স্বর্গ হিমালয়-চূড়ে
শুভ্র মৌলি তুষারময়।
ধরার অশ্রু – সাত সাগরের
লোনা জল উঠি রাত্রিদিন
ধোঁয়াইয়া ওঠে স্বর্গের পানে,
অভিমানে জমে হয় তু্হিন।
পাষাণ স্বর্গ, পাষাণ দেবতা,
কোথা দুর্গতিনাশিনী মা,
বলির রক্তে রাঙিয়া উঠেছে
যুগে যুগে দশ দিক-সীমা।
খড়ের মাটির দুর্গা গড়িয়া
দুর্গে বন্দি পূজারিদল
করে অভিনয়! দেবী-বিগ্রহ
জড় গতিহীন চির-অচল।
দেবতা ঘুমান, ঘুমায় মানুষ,
এরই মাঝে নিজ তপোবলে
জোর করে নেয় দেবতার বর
দৈত্য-দানব দলে দলে।
মোরা পূজা করি, পূজা শেষে চাই
পায়ের পদ্ম শুভ-আশিস,
ওরা চেয়ে নেয় কালীর খড়গ,
বিষ্ণুর গদা, শিবের বিষ।
তপস্যা নাই, ঢাকঢোল পিটে
দেবতা জাগাতে করি পূজা,
দশপ্রহরণধারিণী এল না
দশশো বছরে দশভুজা।….
এমনই শরৎ সৌরাশ্বিনে
অকাল-বোধনে মহামায়ার
যে পূজা করিল লঙ্কেশ্বরে
বধিতে ত্রেতায় রাম-অবতার,
আজিও আমরা সে দেবীপূজার
অভিনয় করে চলিয়াছি,
লঙ্কা-সায়রি রাবণ মোদেরে
ধরিয়া গলায় দেয় কাছি!
দুঃসাহসীরা দুর্গা বলিয়া
হয়তো কাছিতে পড়ে ঝুলে,
দেবীর আসন তেমনই অটল,
শুধু নিমেষের তরে দুলে।
বলি দিয়া মোরা পূজেছি দেবীরে
নব-ভারতের পূজারিদল
গিয়াছিনু ভুলি – দেবীরে জাগাতে
দিতে হল আঁখি-নীলোৎপল।
মহিষ-অসুর-মর্দিনী মা গো,
জাগো এইবার, খড়গ ধরো।
দিয়াছি ‘যতীন’ অঞ্জলি নব –
ভারতের আঁখি-ইন্দিবর।
টুটে তপস্যা, ওঠে জাগি ওই
পূজারত অভিনব ভারত,
ভারত-সিন্ধু গর্জি উঠিল
নিযুত শঙ্খ মন্ত্রবৎ।
‘উলু উলু’ বোলে পুরনারী, দোলে
হিম-কৈলাস টালমাটাল,
কারাগারে টুটে অর্গল, ওঠে
রাঙিয়া আশার পূর্বভাল।
ছুটে বিমুক্ত-পিঞ্জর, পায়ে
লুটে শৃঙ্খল ছিন্ন ওই,
নাচে ভৈরব, ভৈরবী নাচে
ছিন্নমস্তা তাথই থই।
আকাশে আকাশে বৃংহিত – নাদ
করে কোটি মেঘ ঐরাবত,
সাগর শুষিয়া ছিটাইছে বারি,
ও কী ফুল হানে পুষ্পরথ।
এ কী এ শ্মশান-উল্লাস নাচে
ধূর্জটি-শিরে ভাগীরথী,
অকূল তিমিরে সহসা ভাতিল
নব-উদিচীর নব জ্যোতি।
বিস্ময়ে আঁখি মেলিয়া চাহিনু,
দেখা যায় শুধু দেবীচরণ,
মৃত্যুঞ্জয় মহাকাল শিব
যে চরণ-তলে মাগে মরণ!
ভৈরব নাচে ঊর্ধ্বে, নিম্নে
খণ্ডিত শির মহিষাসুর,
দুলিছে রক্ত-সিক্ত খড়গ,
কাঁপিছে তরাসে অসুর-পুর।
চিৎকারি ওঠে উল্লাসে
নব-ভারতের নব-পূজারিদল,
‘চাই না মা তোর শুভদ আশিস,
চাই শুধু ওই চরণতল –
যে চরণে তোর বাহন সিংহ,
মহিষ-অসুর মথিয়া যাস।
যদি বর দিস, দিয়ে যা বরদা,
দিয়ে যা শক্তি দৈত্য-ত্রাস’ ।
শুধু দেখা যায় দেবীর রক্ত –
চরণ, খড়গ, মহিষাসুর, –
ওকে ও চরণ-নিম্নে ঘুমায়
সমর-শয়নে বিজয়ী শূর?
কে যতী-ইন্দ্র তরুণ তাপস
দিয়া গেলে তুমি এ কী এ দান?
শবে শবে গেলে প্রাণ সঞ্চারি –
কেশব, বিলায়ে তোমার প্রাণ!
তিলে তিলে ক্ষয় করি আপনারে
তিলোত্তমারে সৃজিলে, হায়!
সুন্দ ও উপসুন্দ অসুর
বিনাশিতে তব তপ-প্রভায়!
হাতে ছিল তব চক্র ও গদা,
গ্রহণ করনি হেলায়, বীর!
বুকে ছিল প্রাণ, তাই দিয়ে রণ
জিনে গেলে প্রাণহীন জাতির।
তোমার হাতের শ্বেত-শতদল,
শুভ্র মহাপ্রাণ তোমার,
দিয়া গেলে তব জাতিরে আশিস,
তোমার হাতের নমস্কার!
লইবে কে বীর উন্নত-শির
দেবতার দান সে শতদল,
টলিয়া উঠেছে বিস্ময়ে ত্রাসে
বিন্ধ্য হইতে হিম-অচল।
নামিয়া আসিল এতদিনে বুঝি
হিমগিরি হতে পাষাণী মা,
কে জানে কাঘার রক্তে রাঙিয়া
উঠিতেছে দশদিক-সীমা!
দেখালে মায়ের রক্তচরণ,
কে দেখাবি দেবীমূর্তি মা-র,
ভারত চাহিয়া আছে তার পানে,
কে করিবে প্রতি-নমস্কার!
যৌবন
ওরে ও শীর্ণা নদী,
দু-তীরে নিরাশা বালুচর লয়ে জাগিবি কি নিরবধি?
নব-যৌবনজলতরঙ্গ জোয়ারে কি দুলিবি না?
নাচিবে জোয়ারে পদ্মা গঙ্গা, তুই রবি চির-ক্ষীণা?
ভরা-ভাদরের বরিষন এসে বারে বারে তোর কূলে
জানাবে রে তোরে সজল মিনতি, তুই চাহিবি না ভুলে?
দুই কূলে বাঁধি প্রস্তর-বাঁধ কূল ভাঙিবার ভয়ে
আকাশের পানে চেয়ে রবি তুই শুধু আপনারে লয়ে?
ভেঙে ফেল বাঁধ, আশেপাশে তোর বহে যে জীবন-ঢল
তারে বুকে লয়ে দুলে ওঠ তুই যৌবন-টলমল।
প্রস্তর-ভরা দুই কূল তোর ভেসে যাক বন্যায়,
হোক উর্বর, হাসিয়া উঠুক ফুলে ফলে সুষমায়।
একবার পথ ভোল,
দূর সিন্ধুর লাগি তোর বুকে জাগুক মরণ-দোল!
ভাঙ ভাঙ কারা, ফুলিয়া ফাঁপিয়া ওঠ নব যৌবনে!
বাঁচিতে চাহিয়া মরুপথে তুই মরিলি হীন মরণে।
সকল দুয়ার খুলে দে রে তোর, ভাসা এ মরু-সাহারা,
দু-কুল প্লাবিয়া আয় আয় ছুটে ভাঙ এ মৃত্যু-কারা।
রক্ত-তিলক
শত্রু-রক্তে রক্ত-তিলক পরিবে কারা?
ভিড় লাগিয়াছে – ছুটে দিকে দিকে সর্বহারা।
বিহগী মাতার পক্ষপুটের আড়াল ছিঁড়ে
শূন্যে উড়েছে আলোক-পিয়াসি শাবক কি রে!
নীড়ের বাঁধন বাঁধিয়া রাখিতে পারে না আর,
গগনে গগনে শুনেছে কাহার হুহুংকার!
কাঁদিতেছে বসি জনক-জননী শূন্য নীড়ে,
চঞ্চল-পাখা চলেছে শাবক অজানা তীরে।
সপ্ত-সারথি-রবির অশ্ব বল্গা-হারা
পশ্চিমে ঢলি পড়িছে; যথায় সন্ধ্যাতারা
ম্লান মুখে কাঁদে হৃত-গৌরব ভারত-সম,
ফিরাবে রবিরে – আজি প্রতিজ্ঞা দারুণতম।
দেখাইছে পথ বজ্র জ্বালিয়া অনল-শিখা,
বিজয়-শঙ্খ বাজায় স্বর্গে জয়ন্তিকা।
পশ্চিম হতে আনিবে পূর্বে রবির চাকা,
বিধুনিত করে বিপুল শূন্যে চপল পাখা।
কণ্ঠে ধ্বনিছে মারণ-মণ্ত্র শত্রুজয়ী,
পার্শ্বে নাচিছে দানব-দলনী শক্তিময়ী।
রিক্ত-ললাট চলেছে মৃত্যু-তোরণ-দ্বারে,
রাঙাবে ললাট শত্রু-রক্তে মরণ-পারে।
শত্রুরক্তে-চর্চিতভালে তিলকরেখা,
পরাধীনতার অমা-যামিনীতে চন্দ্রলেখা।
সাত্ত্বিক ঋষি বৃথা হোমানলে আহুতি ঢালে,
যত মরে তত বাঁচে গো দৈত্য সর্বকালে।
দধীচির হাড়ে লাগিয়াছে ঘুণ অনেক আগে,
বজ্রে কেবলই সৃষ্টি-কাঁদন-শব্দ জাগে!
ইন্দ্র, চন্দ্র, বরুণাদি দেব বীর্যহারা,
তেমনই কাঁদিছে দৈত্য-প্রহরী বিশ্ব-কারা।
শ্মশান আগুলি জাগে একা শিব নির্নিমিখ,
আঁধার শ্মশান, শবে শবে ছেয়ে দিগ্বিদিক।
কোথা কাপালিক, ভীমা ভৈরবী-চক্র কই,
নাচাও শ্মশানে পাগলা মহেশ তাথই থই!
মহাতান্ত্রিক! রক্ততিলক পরাও ভালে,
কী হবে লইয়া জ্ঞান-যোগী-ঋষি ফেরুর পালে!
শবে ছেয়ে দেশ, শব-সাধনার মন্ত্র দাও,
তামসী নিশায়, জামসিক বীর, পথ দেখাও!
কাটুক রাত্রি, আসুক আলোক, হবে তখন
নতুন করিয়া নতুন স্বর্গ-সৃষ্টি-পণ।
তামসী নিশার ওরে শ্মশানের শিবার দল!
শব লয়ে তোর কাটিল জনম; বল কী ফল
ঝিমায়ে ঝিমায়ে ভবিষ্যতের হেরি স্বপন?
আজ যদি নাহি বাঁচিলি, বাঁচিবি বল কখন?
আজ যদি বাঁচি, কী ফল আমার স্বর্গে কাল?
আজের মর্ত্য সেই সে স্বর্গ সর্বকাল!
আহত মায়ের রক্ত মাখিয়া লভি জনম
পুণ্যের লোভে হবি বকধার্মিক পরম?
রক্তের ঋণ শুধিব রক্তে, মন্ত্র হোক!
হস যদি জয়ী, পূজিবে রে তোরে সর্বলোক।
না দেয় দেবতা আশিস, না দিক, ভয় কী তোর?
কী হবে পূজিয়া পাষাণ-দেবতা পুণ্য-চোর?
জন্মেছি মোরা পাপ-যুগে এই পাপ-দেশে,
করিবি ক্ষালন এ মহাপাপেরে ভালোবেসে?
আঁধার-কৃষ্ণ-মহিষ-অসুর বধিতে কৃষ্ণ খড়গ ধরো,
শবের-শ্মশানে হয়তো উদিবে সেদিন শুভ্র গৌরী-হর!
রঙিন খাতা
রেঙে উঠুক রঙিন খাতা
নতুন হাতের নতুন লেখায়
মুখর হউক নিথর কানন
নিত্য নূতন কুহু-কেকায়।
নিটোল আকাশ টোল খেয়ে যাক
হাজার পাখির গানের দোলে,
লেখার কুসুম ফুটে উঠুক
খাতার পাতার কোলে কোলে।
হাজার দেশের গানের পাখির
হাজার রাঙা পালক ঝরে
রচে তুলুক অমর ঝাঁপি,
দুলুক বীণাপাণির করে।
শূদ্রের মাঝে জাগিছে রুদ্র
শূদ্রের মাঝে জাগিছে রুদ্র
ব্যথা-অনিদ্র দেবতা।
শুনি নির্জিত কোটি দীন-মুখে
বজ্র-ঘোষ বারতা।
এ কী মহা দীন রূপ ধরি ফের
পথে পথে ভাঙা কুটিরে,
সবারে অন্ন বিলায়ে আপনি
মাগিছ ভিক্ষা-মুঠিরে॥
কৃষক হইয়া কর্ষিছ ভূমি
জলে ভিজে রোদে পুড়িয়া,
পরবাসে তুলি হরের লক্ষ্মী
আঁধারে মরিছ ঝুরিয়া।
শ্রমিক হইয়া খুঁড়িতেছ মাটি,
হীরক মানিক আহরি
রাজার ভাঁড়ার করিছ পূর্ণ
নিজে নিরন্ন বিহরি।
আপনার গায়ে লাগাইয়া ধূলি
নির্মল রাখ ধরণি,
সকলের বোঝা বহিবার লাগি
মুটে কুলি হলে আপনি।
সকলের তরে রচিয়া প্রাসাদ,
নগর বসায়ে কাননে,
রাজমিস্ত্রির রূপে ফের সাঁঝে
চুন-বালি মাখা আননে।
কুটিরে তোমার জলে না প্রদীপ,
কাঁদে নিরন্ন পরিজন,
সকলের তরে রচি শুচি-বাস
নিজে হলে তাঁতি বিবসন।
আপনি হইয়া অশুচি মেথর
রাখিতেছ শুচি ভুবনে,
না হতে প্রভাত রাজপথ-ধূলি
মার্জনা কর গোপনে!
সকল রুচি ও শুচিতা তেয়াগি
আবিলতা কাঁধে বহিয়া,
ফিরিছ দেবতা হাড়ি ডোম হয়ে
সকলের ঘৃণা সহিয়া।
দ্বারবান হয়ে রক্ষিছ দ্বার,
সেব পদ হয়ে সেবাদাস,
দেবতা হইয়া মানুষের সেবা
করিতেছ তুমি বারো মাস।
ভেবেছিলে বুঝি, ছলের ঠাকুর,
মর্ত্যের অধিবাসী সব
তোমারে চিনিয়া এই রূপে রূপে
পূজিয়া করিবে পরাভব।
যত সেবা দাও, তত করে ঘৃণা,
দেখিতে দেখিতে চারি কাল।
হইল অন্ত, ধূর্জটি তাই
খেপিয়ে উঠেছে জটাজাল?
ছিলে শূদ্রের শ্মশানে-মশানে
রুদ্ররূপী হে মহাকাল,
খুলিয়া পড়েছে রাজার পুরীতে
নাগ-বন্ধন বাঘছাল!
যমের বাহন মহিষ, তোমার
বাহন বৃষভ লইয়া
প্রমথের দল ছিল এতদিন
শান্ত কৃষক হইয়া;
তব ইঙ্গিতে খেপিয়া উঠেছে
আজি কি সকলে নিখিলে?
তোমার ললাট-অগ্নি দিয়া কি
রাজার শাস্তি লিখিলে?
নমো নমো নমঃ শূদ্ররূপী হে
রুদ্র ভীষণ ভৈরব!
পূর্ণ করো গো পাপ ধরণির,
মহাপ্রলয়ের উৎসব।
সৃষ্টির কথা তুমি জান, দেব!
এ ভীষণ পাপ-ধরাতে
পারি না বাঁচিতে; এর চেয়ে ঢের
ভালো তব হাতে মরাতে।
হবে জয়
আবার কি আঁধি এসেছে হানিতে
ফুলবনে লাঞ্ছনা?
দু-হাত ভরিয়া ছিটাইছে পথে
মলিন আবর্জনা?
করিয়ো না ভয়, হবে হবে লয়
আপনি এ উৎপাত,
আঙনের দুটো খড়কুটো লয়ে
লুকোবে অকস্মাৎ!
উৎপাতে তার যদি সখা তব
ফুলবনে ফুল ঝরে,
নব-বসন্তে নব ফুলদল
আসিবে কানন ভরে।
অসুন্দরের প্রতীক উহারা,
ফুল-ছেঁড়া শুধু জানে,
আগে যে চলিবে উহারা টানিবে
কেবলই পিছন পানে।
বন্ধু, ওদের উহাই ধর্ম,
তাই বলে তুমি আগে
চলিবে না ভয়ে? ফুটাবে না ফুল
তোমার কুসুম-বাগে?
অভিশাপ-শ্বাস দমকা বাতাস
প্রদীপ নিবায় বলে
আলো না জ্বালায়ে রহিবে বসিয়া
আঁধার আঙিনাতলে?
সূর্যে ঢাকিতে ছুটে যায় নভে
পায়ের তলার ধূলি,
সূর্য কি তাই লুকাবে আকাশে
আপনার পথ ভুলি?
তড়িৎ-প্রদীপ জ্বালাইয়া আস
তোমরা বরষা-ধারা,
তোমাদের জলে সব ধুলো-মাটি
নিমেষে হইবে হারা।
যে অন্তরের দীপ্তিতে তব
হাতের মশাল জ্বলে,
ফুৎকারে তাহা নিভিবে না চলো,
আগে চলো নব বলে!
পথ ভুলাইতে আসিয়াছে যারা
চাহিবে ভুলাতে পথ,
লঙ্ঘিতে হবে উহাদের রচা
মরু, নদী, পর্বত।
পিছনের যারা রহিবে পিছনে,
উহদের চিৎকারে
তুমি কি বন্দি হইয়া রহিবে
আঁধারের কারাগারে?
মাথার ওপরে শত বাজপাখি
তবু পারাবত দল
আলোক-পিয়াসি চঞ্চল-পাখা
লুণ্ঠিছে নভতলে।
বন্ধু গো, তোলো শির!
তোমারে দিয়াছি বৈজয়ন্তী
বিংশ শতাব্দীর।
মোরা যুবাদল, সকল আগল
ভাঙিতে চলেছি ছুটি,
তোমারে দিয়াছি মোদের পতাকা
তুমি পড়িয়ো না লুটি।
চাহি না জানিতে – বাঁচিবে অথবা
মরিবে তুমি এ পথে,
এ পতাকা বয়ে চলিতে হইবে
বিপুল ভবিষ্যতে।
তাজা জীবন্ত যৌবন-অভিযান –
সেনা মোরা আছি,
ভূমিকম্পের সাগরের মতো
সুখে প্রাণ ওঠে নাচি;
চাহ বা না চাহ, মোরা যুবাদল
তোমারে চালাব আগে,
ব্যগ্র-চরণ চলিবে অগ্রে
আমাদের অনুরাগে!
মৃত্যুর হাতে মরে তো সবাই,
সেই শুধু বেঁচে থাকে –
মানুষের লাগি যে চির-বিরাগী,
মানুষ মেরেছে যাকে।
বিধাতার পরিহাস –
রচেছে মানুষ যুগে যুগে তার
অমানুষী ইতিহাস।
সবচেয়ে বড়ো কল্যাণ তার
করিয়াছে যে মানুষ,
তারেই পাথরে পিষিয়া মেরেছে
মেরেছে বিঁধিয়া ক্রুশ!
যে-হাতে করিয়া এনেছে মানুষ
স্বর্গ-অমৃত-বারি,
সে-হাত কাটিয়া ধরার মানুষ
প্রতিদান দিল তারই!
দেয় ফুল ফল ছায়া সুশীতল –
তরুরে আমরা তাই,
ঢিল ছুঁড়ে মারি, ফুল ছিঁড়ি তার
শেষে শাখা ভেঙে যাই।
সেই অভিমানে ফুটিবে না ফুল?
ফলিবে না তরু-শাখে
সু-রসাল ফল? দিবে না সে ছায়া
যে আঘাত করে তাকে?
চন্দ্রে যাহারা বলে কলঙ্কী
চন্দ্রালোকেই বসি,
করুণার হাসি দেখে তাহাদেরে,
দিই না গলায় রশি!
অসম সাহসে আমরা অসীম
সম্ভাবনার পথে
ছুটিয়া চলেছি, সময় কোথায়
পিছে চাব কোন মতে!
নীচের যাহারা রহিবে নীচেই,
ঊর্ধ্বে ছিটাবে কালি,
আপনার অনুরাগে চলে যাব
আমরা মশাল জ্বালি।
যৌবন-সেনাদল তব সখা,
বন্ধু গো নাহি ভয়,
পোহাবে রাত্রি, গাহিবে যাত্রী
নব আলোকের জয়!