ইন্দু-প্রয়াণ
(কবি শরদিন্দু রায়ের অকালমৃত্যু উপলক্ষ্যে)
বাঁশির দেবতা! লভিয়াছ তুমি হাসির অমর-লোক,
হেথা মর-লোকে দুঃখী মানব করিতেছি মোরা শোক!
অমৃত-পাথারে ডুব দিলে তুমি ক্ষীরোদ-শয়ন লভি,
অনৃতের শিশু মোরা কেঁদে বলি, মরিয়াছ তুমি কবি!
হাসির ঝঞ্ঝা লুটায়ে পড়েছে নিদাঘের হাহাকারে,
মোরা কেঁদে বলি, কবি খোয়া গেছে অস্ত-খেয়ার পারে!
আগুন-শিখায় মিশেছে তোমার ফাগুন-জাগানো হাসি,
চিতার আগুনে পুড়ে গেছ ভেবে মোরা আঁখি-জলে ভাসি।
অনৃত তোমার যাহা কিছু কবি তাই হয়ে গেছে ছাই,
অমৃত তোমার অবিনাশী যাহা আগুনে তা পুড়ে নাই।
চির-অতৃপ্ত তবু কাঁদি মোরা, ভরে না তাহাতে বুক,
আজ তব বাণী আন্-মুখে শুনি, তুমি নাই, তুমি মূক।
অতি-লোভী মোরা পাই না তৃপ্তি সুরভিতে শুধু ভাই,
সুরভির সাথে রূপ-ক্ষুধাতুর ফুলেরও পরশ চাই।
আমরা অনৃত তাই তো অমৃতে ভরে ওঠে নাকো প্রাণ,
চোখে জল আসে দেখিয়া ত্যাগীর আপনা-বিলানো দান।
তরুণের বুকে হে চির-অরুণ ছড়ায়েছ যত লালি,
সেই লালি আজ লালে লাল হয়ে কাঁদে, খালি সব খালি!
কাঁদায়ে গিয়াছ, নবরূপ ধরে হয়তো আসিবে ফিরে,
আসিয়া আবার আধ-গাওয়া গান গাবে গঙ্গারই তীরে,
হয়তো তোমায় চিনিব না, কবি, চিনিব তোমার বাঁশি,
চিনিব তোমার ওই সুর আর চল-চঞ্চল হাসি।
প্রাণের আলাপ আধ-চেনাচেনি দূরে থেকে শুধু সুরে,
এবার হে কবি, করিব পূর্ণ ওই চির-কবি-পুরে।…
ভালোই করেছ ডিঙিয়া গিয়াছ নিত্য এ কারাগার,
সত্য যেখানে যায় নাকো বলা, গৃহ নয় সে তোমার।
গিয়াছ যেখানে শাসনে সেখানে নহে নিরুদ্ধ বাণী,
ভক্তের তরে রাখিয়ো সেখানে আধেক আসনখানি।
বন্দী যেখানে শুনিবে তোমার মুক্তবদ্ধ সুর, –
গঙ্গার কূলে চাই আর ভাবি কোথা সেই থসুর-পুর!
গণ্ডির বেড়ি কাটিয়া নিয়াছ অনন্তরূপ টানি,
কারও বুকে আছ মূর্তি ধরিয়া, কারও বুকে আছ বাণী।
সে কি মরিবার? ভাঙি অনিত্যে নিত্য নিয়াছ বরি,
ক্ষমা করো কবি, তবু লোভী মোরা শোক করি, কেঁদে মরি।
না-দেখা ভেলায় চড়িয়া হয়তো আজিও সন্ধ্যাবেলা
গঙ্গার কুলে আসিয়া হাসিছ দেখে আমাদের খেলা!
হউক মিথ্যা মায়ার খেলা এ তবুও করিব শোক,
‘শান্তি হউক’ বলি যুগে যুগে ব্যথায় মুছিব চোখ!
আসিবে আবারও নিদাঘ-শেষের বিদায়ের হাহাকার,
শাঙনের ধারা আনিবে স্মরণে ব্যাথা-অভিষেক তার।
হাসি নিষ্ঠুর যুগে যুগে মোরা স্নিগ্ধ অশ্রু দিয়া,
হাসির কবিরে ডাকিব গভীরে শোক-ক্রন্দন নিয়া।
বহরমপুর জেল,
শ্রাবণ, ১৩৩০
জাগর-তূর্য
ওরে ও শ্রমিক, সব মহিমার উত্তর-অধিকারী!
অলিখিত যত গল্প-কাহিনি তোরা যে নায়ক তারই॥
শক্তিময়ী সে এক জননির
স্নেহ-সুত সব তোরা যে রে বীর,
পরস্পরের আশা যে রে তোরা, মার সন্তাপ-হারী॥
নিদ্রোত্থিত কেশরীর মতো
ওঠ ঘুম ছাড়ি নব জাগ্রত!
আয় রে অজেয় আয় অগণিত দলে দলে মরুচারী॥
ঘুমঘোরে ওরে যত শৃঙ্খল
দেহ মন বেঁধে করেছে বিকল,
ঝেড়ে ফেল সব, সমীরে যেমন ঝরায় শিশির বারি।
উহারা কজন? তোরা অগণন সকল শক্তি-ধারী॥
কলিকাতা,
১ বৈশাখ, ১৩৩৪
দিল-দরদি
(কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের ‘খাঁচার পাখি’ শীর্ষক করুণ কবিতাটি পড়িয়া)
কে ভাই তুমি সজল গলায়
গাইলে গজল আপশোশের?
ফাগুন-বনের নিবল আগুন,
লাগল সেথা ছাপ পোষের।
দরদ-ভেজা কান্না-কাতর
ছিন্ন তোমার স্বর শুনে
ইরান মুলুক বিরান হল
এমন বাহার-মরশুমে।
সিস্তানের ওই গুল-বাগিচা
গুলিস্তান আর বোস্তানে
সোস্ত হয়ে দখিন হাওয়া
কাঁদল সে আপশোশ-তানে।
এ কোন যিগর -পস্তানি সুর?
মস্তানি সব ফুল-বালা
ঝুরল, তাদের নাজুক বুকে
বাজল ব্যথার শূল-জ্বালা।
আবছা মনে পড়ছে, যে দিন
শিরাজ -বাগের গুল ভুলি
শ্যামল মেয়ের সোহাগ-শ্যামার
শ্যাম হলে ভাই বুলবুলি, –
কালো মেয়ের কাজল চোখের
পাগল চাওয়ার ইঙ্গিতে
মস্ত্ হয়ে কাঁকন চুড়ির
কিঙ্কিণি রিন ঝিন গীতে।
নাচলে দেদার দাদরা তালে,
কারফাতে, সরফর্দাতে, –
হাঠাৎ তোমার কাঁপল গলা
‘খাঁচার পাখি’ ‘গর্বাতে’।
চৈতালিতে বৈকালি সুর
গাইলে, “নিজের নই মালিক,
আফ্সে মরি আপশোশে আহ্,
আপ-সে বন্দী বৈতালিক।
কাঁদায় সদাই ঘেরা-টোপের
আঁধার ধাঁধায়, তায় একা,
ব্যথার ডালি একলা সাজাই,
সাথির আমার নাই দেখা।
অসাড় জীবন, ঝাপসা দুচোখ
খাঁচার জীবন একটানা।”
অশ্রু আসে, আর কেন ভাই,
ব্যথার ঘায়ে ঘা হানা?
খুব জানি ভাই, ব্যর্থ জীবন
ডুবায় যারা সংগীতেই,
মরম-ব্যথা বুঝতে তাদের
দিল-দরদি সঙ্গী নেই।
জানতে কে চায় গানের পাখি
বিপুল ব্যথার বুক ভরাট,
সবার যখন নওরাতি, হায়,
মোদের তখন দুঃখ-রাত!
ওদের সাথি, মোদের রাতি
শয়ন আনে নয়ন-জল;
গান গেয়ে ভাই ঘামলে কপাল
মুছতে সে ঘাম নাই অঞ্চল।
তাই ভাবি আজ কোন দরদে
পিষছে তোমার কলজে-তল?
কার অভাব আজ বাজছে বুকে,
কলজে চুঁয়ে গলছে জল!
কাতর হয়ে পাথর-বুকে
বয় যবে ক্ষীর-সুরধুনী,
হোক তা সুধা, খুব জানি ভাই,
সে সুধা ভরপুর-খুনই।
আজ যে তোমার আঁকা-আঁশু
কণ্ঠ ছিঁড়ে উছলে যায় –
কতই ব্যথায়, ভাবতে যে তা
জান ওঠে ভাই কচলে হায়!
বসন্ত তো কতই এল,
গেল খাঁচার পাশ দিয়ে,
এল অনেক আশ নিয়ে, শেষ
গেল দীঘল-শ্বাস নিয়ে।
অনেক শারাব খারাব হল,
অনেক সাকির ভাঙল বুক!
আজ এল কোন দীপান্বিতা?
কার শরমে রাঙল মুখ?
কোন দরদি ফিরল? পেলে
কোন হারা-বুক আলিঙ্গন?
আজ যে তোমার হিয়ার রঙে
উঠল রেঙে ডালিম-বন!
যিগর-ছেঁড়া দিগর তোমার
আজ কি এল ঘর ফিরে?
তাই কি এমন কাশ ফুটেছে
তোমার ব্যথার চর ফিরে?
নীড়ের পাখি ম্লান চোখে চায়,
শুনছে তোমার ছিন্ন সুর;
বেলা-শেষের তান ধরেছে
যখন তোমার দিন দুপুর!
মুক্ত আমি পথিক-পাখি
আনন্দ-গান গাই পথের,
কান্না-হাসির বহ্নি-ঘাতের
বক্ষে আমার চিহ্ন ঢের ;
বীণ ছাড়া মোর একলা পথের
প্রাণের দোসর অধিক নাই,
কান্না শুনে হাসি আমি,
আঘাত আমার পথিক-ভাই।
বেদনা-ব্যথা নিত্য সাথি, –
তবু ভাই ওই সিক্ত সুর,
দুচোখ পুরে অশ্রু আনে
উদাস করে চিত্ত-পুর!
ঝাপসা তোমার দুচোখ শুনে
সুরাখ হল কলজেতে,
নীল পাথারের সাঁতার পানি
লাখ চোখে ভাই গলছে যে!
বাদশা-কবি! সালাম জানায়
ভক্ত তোমার অ-কবি,
কইতে গিয়ে অশ্রুতে মোর
কথা ডুবে যায় সবই!
কলিকাতা,
আশ্বিন, ১৩২৮