রঙিন খাতা
রেঙে উঠুক রঙিন খাতা
নতুন হাতের নতুন লেখায়
মুখর হউক নিথর কানন
নিত্য নূতন কুহু-কেকায়।
নিটোল আকাশ টোল খেয়ে যাক
হাজার পাখির গানের দোলে,
লেখার কুসুম ফুটে উঠুক
খাতার পাতার কোলে কোলে।
হাজার দেশের গানের পাখির
হাজার রাঙা পালক ঝরে
রচে তুলুক অমর ঝাঁপি,
দুলুক বীণাপাণির করে।
শূদ্রের মাঝে জাগিছে রুদ্র
শূদ্রের মাঝে জাগিছে রুদ্র
ব্যথা-অনিদ্র দেবতা।
শুনি নির্জিত কোটি দীন-মুখে
বজ্র-ঘোষ বারতা।
এ কী মহা দীন রূপ ধরি ফের
পথে পথে ভাঙা কুটিরে,
সবারে অন্ন বিলায়ে আপনি
মাগিছ ভিক্ষা-মুঠিরে॥
কৃষক হইয়া কর্ষিছ ভূমি
জলে ভিজে রোদে পুড়িয়া,
পরবাসে তুলি হরের লক্ষ্মী
আঁধারে মরিছ ঝুরিয়া।
শ্রমিক হইয়া খুঁড়িতেছ মাটি,
হীরক মানিক আহরি
রাজার ভাঁড়ার করিছ পূর্ণ
নিজে নিরন্ন বিহরি।
আপনার গায়ে লাগাইয়া ধূলি
নির্মল রাখ ধরণি,
সকলের বোঝা বহিবার লাগি
মুটে কুলি হলে আপনি।
সকলের তরে রচিয়া প্রাসাদ,
নগর বসায়ে কাননে,
রাজমিস্ত্রির রূপে ফের সাঁঝে
চুন-বালি মাখা আননে।
কুটিরে তোমার জলে না প্রদীপ,
কাঁদে নিরন্ন পরিজন,
সকলের তরে রচি শুচি-বাস
নিজে হলে তাঁতি বিবসন।
আপনি হইয়া অশুচি মেথর
রাখিতেছ শুচি ভুবনে,
না হতে প্রভাত রাজপথ-ধূলি
মার্জনা কর গোপনে!
সকল রুচি ও শুচিতা তেয়াগি
আবিলতা কাঁধে বহিয়া,
ফিরিছ দেবতা হাড়ি ডোম হয়ে
সকলের ঘৃণা সহিয়া।
দ্বারবান হয়ে রক্ষিছ দ্বার,
সেব পদ হয়ে সেবাদাস,
দেবতা হইয়া মানুষের সেবা
করিতেছ তুমি বারো মাস।
ভেবেছিলে বুঝি, ছলের ঠাকুর,
মর্ত্যের অধিবাসী সব
তোমারে চিনিয়া এই রূপে রূপে
পূজিয়া করিবে পরাভব।
যত সেবা দাও, তত করে ঘৃণা,
দেখিতে দেখিতে চারি কাল।
হইল অন্ত, ধূর্জটি তাই
খেপিয়ে উঠেছে জটাজাল?
ছিলে শূদ্রের শ্মশানে-মশানে
রুদ্ররূপী হে মহাকাল,
খুলিয়া পড়েছে রাজার পুরীতে
নাগ-বন্ধন বাঘছাল!
যমের বাহন মহিষ, তোমার
বাহন বৃষভ লইয়া
প্রমথের দল ছিল এতদিন
শান্ত কৃষক হইয়া;
তব ইঙ্গিতে খেপিয়া উঠেছে
আজি কি সকলে নিখিলে?
তোমার ললাট-অগ্নি দিয়া কি
রাজার শাস্তি লিখিলে?
নমো নমো নমঃ শূদ্ররূপী হে
রুদ্র ভীষণ ভৈরব!
পূর্ণ করো গো পাপ ধরণির,
মহাপ্রলয়ের উৎসব।
সৃষ্টির কথা তুমি জান, দেব!
এ ভীষণ পাপ-ধরাতে
পারি না বাঁচিতে; এর চেয়ে ঢের
ভালো তব হাতে মরাতে।
হবে জয়
আবার কি আঁধি এসেছে হানিতে
ফুলবনে লাঞ্ছনা?
দু-হাত ভরিয়া ছিটাইছে পথে
মলিন আবর্জনা?
করিয়ো না ভয়, হবে হবে লয়
আপনি এ উৎপাত,
আঙনের দুটো খড়কুটো লয়ে
লুকোবে অকস্মাৎ!
উৎপাতে তার যদি সখা তব
ফুলবনে ফুল ঝরে,
নব-বসন্তে নব ফুলদল
আসিবে কানন ভরে।
অসুন্দরের প্রতীক উহারা,
ফুল-ছেঁড়া শুধু জানে,
আগে যে চলিবে উহারা টানিবে
কেবলই পিছন পানে।
বন্ধু, ওদের উহাই ধর্ম,
তাই বলে তুমি আগে
চলিবে না ভয়ে? ফুটাবে না ফুল
তোমার কুসুম-বাগে?
অভিশাপ-শ্বাস দমকা বাতাস
প্রদীপ নিবায় বলে
আলো না জ্বালায়ে রহিবে বসিয়া
আঁধার আঙিনাতলে?
সূর্যে ঢাকিতে ছুটে যায় নভে
পায়ের তলার ধূলি,
সূর্য কি তাই লুকাবে আকাশে
আপনার পথ ভুলি?
তড়িৎ-প্রদীপ জ্বালাইয়া আস
তোমরা বরষা-ধারা,
তোমাদের জলে সব ধুলো-মাটি
নিমেষে হইবে হারা।
যে অন্তরের দীপ্তিতে তব
হাতের মশাল জ্বলে,
ফুৎকারে তাহা নিভিবে না চলো,
আগে চলো নব বলে!
পথ ভুলাইতে আসিয়াছে যারা
চাহিবে ভুলাতে পথ,
লঙ্ঘিতে হবে উহাদের রচা
মরু, নদী, পর্বত।
পিছনের যারা রহিবে পিছনে,
উহদের চিৎকারে
তুমি কি বন্দি হইয়া রহিবে
আঁধারের কারাগারে?
মাথার ওপরে শত বাজপাখি
তবু পারাবত দল
আলোক-পিয়াসি চঞ্চল-পাখা
লুণ্ঠিছে নভতলে।
বন্ধু গো, তোলো শির!
তোমারে দিয়াছি বৈজয়ন্তী
বিংশ শতাব্দীর।
মোরা যুবাদল, সকল আগল
ভাঙিতে চলেছি ছুটি,
তোমারে দিয়াছি মোদের পতাকা
তুমি পড়িয়ো না লুটি।
চাহি না জানিতে – বাঁচিবে অথবা
মরিবে তুমি এ পথে,
এ পতাকা বয়ে চলিতে হইবে
বিপুল ভবিষ্যতে।
তাজা জীবন্ত যৌবন-অভিযান –
সেনা মোরা আছি,
ভূমিকম্পের সাগরের মতো
সুখে প্রাণ ওঠে নাচি;
চাহ বা না চাহ, মোরা যুবাদল
তোমারে চালাব আগে,
ব্যগ্র-চরণ চলিবে অগ্রে
আমাদের অনুরাগে!
মৃত্যুর হাতে মরে তো সবাই,
সেই শুধু বেঁচে থাকে –
মানুষের লাগি যে চির-বিরাগী,
মানুষ মেরেছে যাকে।
বিধাতার পরিহাস –
রচেছে মানুষ যুগে যুগে তার
অমানুষী ইতিহাস।
সবচেয়ে বড়ো কল্যাণ তার
করিয়াছে যে মানুষ,
তারেই পাথরে পিষিয়া মেরেছে
মেরেছে বিঁধিয়া ক্রুশ!
যে-হাতে করিয়া এনেছে মানুষ
স্বর্গ-অমৃত-বারি,
সে-হাত কাটিয়া ধরার মানুষ
প্রতিদান দিল তারই!
দেয় ফুল ফল ছায়া সুশীতল –
তরুরে আমরা তাই,
ঢিল ছুঁড়ে মারি, ফুল ছিঁড়ি তার
শেষে শাখা ভেঙে যাই।
সেই অভিমানে ফুটিবে না ফুল?
ফলিবে না তরু-শাখে
সু-রসাল ফল? দিবে না সে ছায়া
যে আঘাত করে তাকে?
চন্দ্রে যাহারা বলে কলঙ্কী
চন্দ্রালোকেই বসি,
করুণার হাসি দেখে তাহাদেরে,
দিই না গলায় রশি!
অসম সাহসে আমরা অসীম
সম্ভাবনার পথে
ছুটিয়া চলেছি, সময় কোথায়
পিছে চাব কোন মতে!
নীচের যাহারা রহিবে নীচেই,
ঊর্ধ্বে ছিটাবে কালি,
আপনার অনুরাগে চলে যাব
আমরা মশাল জ্বালি।
যৌবন-সেনাদল তব সখা,
বন্ধু গো নাহি ভয়,
পোহাবে রাত্রি, গাহিবে যাত্রী
নব আলোকের জয়!