প্রলয়শিখা
বিশ্ব জুড়িয়া প্রলয়-নাচন লেগেছে ওই
নাচে নটনাথ কাল-ভৈরব তাথই থই।
সে নৃত্যবেগে ললাট-অগ্নি প্রলয়-শিখ
ছড়ায়ে পড়িল হেরো রে আজিকে দিগ্বিদিক ।
সহস্র-ফণা বাসুকির সম বহ্নি সে
শ্বসিয়া ফিরিছে, জরজর ধরা সেই বিষে।
নবীন রুদ্র আমাদের তনুমনে জাগে
সে প্রলয়শিখা রক্ত-উদয়ারুণ-রাগে।
ভরার মেয়ের সম ধরা হয়ে অপহৃতা
দৈত্য-আগারে চলিতে কাঁদিয়া মরে বৃথা;
আমরা শুনেছি লাঞ্ছিতার সে পথ-বিলাপ,
সজল আকাশে উঠিয়াছি তাই বত্র-শায়ক ইন্দ্রচাপ
মুক্ত ধরণি হইয়াছে আজি বন্দিবাস,
নহে কো তাহার অধীন তাহার থল-জল-বায়ু নীল আকাশ।
মুক্তি দানিতে এসেছি আমরা দেব-অভিশাপ দৈত্যত্রাস,
দশ দিক জুড়ি জ্বলিয়া উঠেছে প্রলয়-বহ্নি সর্বনাশ!
ঊর্ধ্ব হইতে এসেছি আমরা প্রলয়ের শিখা অনির্বান,
জতুগৃহদাহ-অন্তে করিব জ্যোতির স্বর্গে মহাপ্রয়াণ।
বিংশ শতাব্দী
হইল প্রভাত বিংশ শতাব্দীর,
নব-চেতনায় জাগো, জাগো, ওঠো বীর!
নব ধ্যান নব ধারণায় জাগো
নব প্রাণ নব প্রেরণায় জাগো,
সকল কালের উচ্চে তোলো গো শির,
সর্ব-বন্ধ-মুক্ত জাগো গে বীর!
নূতন কন্ঠে গাহো নূতনের জয়,
আমরা ছাড়ায়ে উঠেছি সর্বভয়!
সর্বকালের সব মোহ টুটি
বালারুণ-সম উঠিয়াছি ফুটি,
আজিকে সর্ব-পরাধীনতার লয়,
নতুন জগতে আমরা সর্বময়!
আমরা ভেঙেছি রাজার সিংহাসন,
করিয়াছি নরে আমরা গো নারায়ণ।
পায়ের তলার মানুষে টানিয়া
বসায়েছি দেব-বেদিতে আনিয়া,
টুটায়েছি সব দেশের সব বাঁধন
নিখিল মানব-জাতি এক-দেহ-মন।
পুবে, পশ্চিমে, উত্তরে, দক্ষিণে,
য়ুরোপ, রাশিয়া, আরব, মিশর, চীনে,
আমরা আজিকে এক-প্রাণ এক-দেহ,
এক বাণী – ‘কারো অধীন রবে না কেহ!’
চলি একে একে দৈত্য-প্রাসাদ জিনে।
পারি নাই যাহা, পারিব দু-এক দিনে।
কাটায়ে উঠেছি ধর্ম-আফিম-নেশা,
ধ্বংস করেছি ধর্মযাজকী পেশা!
ভাঙি মন্দির, ভাঙি মসজিদ,
ভাঙিয়া গির্জা গাহি সংগীত –
এক মানবের একই রক্ত মেশা।
কে শুনিবে আর ভজনালয়ের হ্রেষা!
আদিম সৃষ্টি-দিবস হইতে ক্রমে
প্রাচীরের পর প্রাচীর উঠেছে জমে।
সে প্রাচীর মোরা ভাঙিয়া চলেছি,
যতই চলেছি ততই দলেছি,
জ্বালায়ে চলেছি পুঞ্জিভূত সে ভ্রমে।
শ্রমণের চেয়ে পূজ্য ভেবেছি শ্রমে।
সংস্কারের জগদ্দল পাষাণ
তুলিয়া বিশ্বে আমরা করেচি ত্রাণ।
সর্ব আচার-বিচার-পঙ্ক হতে
তুলিয়া জগতে এনেছি মুক্ত স্রোতে।
অচলায়তনের বাতায়ন খুলি – প্রাণ
এনেছি, গেয়েছি নব-আলোকের গান।
নচিকেতা-সম আমরা মৃত্যুপুরী
বারে বারে যাই বারে বারে আসি ঘুরি।
মৃত্যুরে মোরে মুখোমুখি দেখিয়াছি,
মোদের জীবনে মরণ আছে গো বাঁচি।
স্বর্গ এনেছি মর্ত্যে করিয়া চুরি;
চাহিছে মর্ত্য দেবতা বাদলে ঝুরি।
সার্থক হল আজিকে ভৃগু-সাধন,
আমরা করেছি সৃজন নব-ভুবন।
এক আদমের মোরা সন্তান,
নাহি দেশ কাল ধর্মাভিমান,
নাহি ব্যবধান, উচ্চ, নীচ, সুজন;
নিখিলের মাঝে আমরা এক জীবন!
আমরা সহিয়া সকল অত্যাচার
অত্যাচারের করিতেছি সংহার।
ধ্বংসের আগে এই পৃথিবীরে
হাসাইতে মোরা আসিয়াছি ফিরে,
শেষের আশিস আমরা নিয়ন্তার;
খুলিতে এসেছি সকল বন্ধ দ্বার।
আমরা বাহিনী বিংশ শতাব্দীর
মন্থন-শেষ-অমৃত জলধির
কল্কি-দেবের আগে-চলা দূত,
কভু ঝড়, কভু মলয়-মারুত,
কভু ভয়, কভু ভরসা লক্ষ্মীশ্রীর।
জীবন-মরণ পায়ে বাজে মঞ্জীর!
আমরা বাহিনী বিংশ শতাব্দীর।
বৈতালিক
অসুরের খল-কোলাহলে এসো সুরের বৈতালিক!
বেতালের যতি-ভঙ্গে তোমার নৃত্য ছন্দ দিক।
অকুণ্ঠিত ও-কন্ঠে তোমার আনো উদাত্ত বাণী,
সুরের সভায় রাত্রিপারের উষসীরে আনো টানি।
তোমার কন্ঠ বিহগ-কণ্ঠে ছড়াক দিগ্বিদিক॥
তন্দ্রা-অলস নয়নে বুলাও জাগর-সুরের স্পর্শ,
গত নিশীথের মুকুলে ফোটাও বিকশিত-প্রাণ হর্ষ!
মৃতের নয়নে দাও দাও তব চপল আঁখি নিমিখ॥
ভারতী – আরতি
জয় ভারতী শ্বেতশতদলবাসিনী,
বিষ্ণু-শরণ-চরণ আদি বাণী।
কণ্ঠ-লীলা বাজিছে বীণা
বিশ্ব ঘুরে গাহে সে সুরে
জয় জয় বীণাপাণি॥
শুনি সে সুর অন্ধ নভে
উদিল গ্রহ তারকা সবে,
মাতিল আলো-মহোৎসবে মা
বিশ্বরানি॥
আদি সৃজন-দিনে অন্ধ ভুবনে
তোমার জ্যোতি আলো দিল মা নয়নে।
জ্ঞান-প্রদায়িনী হৃদয়ে আলো দিলে,
ধেয়ান-সুন্দর করিলে সব নিখিলে।
ঊরো মা ঊরো আঁধার-পুরে আলো দানি॥
মণীন্দ্র-প্রয়াণ
দানবীর, এতদিনে নিঃশেষে
করিলে নিজেরে দান।
মৃত্যুরে দিলে অঞ্জলি ভরি
তোমার অমৃত প্রাণ।
অমৃতলোকের যাত্রী তোমরা
পথ ভুলে আস, তাই
তোমাদের ছুঁয়ে অমর মৃত্যু
আজিও সে মরে নাই।
স্বর্গলোকের ইঙ্গিত – আস
ছল করে ধরাতল,
তোমাদেরে চাহি ফোটে ধরণিতে
ধেয়ানের শতদল।
রৌদ্র-মলিন নয়নে বুলাও
স্বপনলোকের মায়া,
তৃষিত আর্ত ধরায় ঘনাও
সজল মেঘের ছায়া।
ইন্দ্রকান্তমণি ছিলে তুমি
শ্যাম ধরণির বুকে,
সুন্দরতর লোকের আভাস
এনেছিলে চোখে-মুখে।
ঐশ্বর্যের বুকে বসে বলে –
-ছিলে শিব বৈরাগী,
বিভব রতন ইঙ্গিত শুধু
ত্যাগের মহিমা লাগি।
ইন্দ্র, কুবের, লক্ষ্মী, আশিস
ঢেলেছিল যত শিরে,
দু-হাত ভরিয়া ক্ষুধিত মানবে
দিলে তাহা ফিরে ফিরে।
যে ঐশ্বর্য লয়ে এসেছিলে,
তাহারই গর্ব লয়ে
করেছ প্রয়াণ, পুরুষশেষ্ঠ,
উঁচু শিরে নির্ভয়ে!
তব দান-ভারে টলমল ধরা
চাহে বিহ্বল-আঁখি,
অঞ্জলি পুরি দিয়া মহাদান,
চক্ষেরে দিলে ফাঁকি।