- বইয়ের নামঃ প্রলয়শিখা
- লেখকের নামঃ কাজী নজরুল ইসলাম
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
খেয়ালি
আয় রে পাগল আপন-বিভোল খুশির খেয়ালি
হাতে নিয়ে রবাব-বেণু রঙিন পেয়ালি!
ভোজপুরিদের প্রমত্ততায়
মাতুক ওরা রাজার সভায়
আঙিনাতে জ্বালরে তোরা অরুণ-দেয়ালি
স্বপনলোকের পথিক তোরা ধরার হেঁয়ালি।
চাষার গান
আমাদের জমির মাটি ঘরের বেটি, সমান রে ভাই।
কে রাবণ করে হরণ দেখব রে তাই॥
আমাদের ঘরের বেটির কেশের মুঠি ধরে নে যায় সাগরপারে,
দিয়ে হাত মাথায় শুধু ঘরে বসে রইব না রে।
যে লাঙল ফলা দিয়ে শস্য ফলাই মরুর বুকে,
আছে সে লাঙল আজও রুখব তাতেই রাজার সেপাই॥
পাঁচনির আশীর্বাদে মানুষ করি ঠেঙিয়ে বলদ,
সে পাঁচন আছে আজও ভাঙব তাতেই ওদের গলদ।
যে-জলে ভাসছি মোরা চল সে-জলে ওদের ভাসাই॥
পাথুরে পাহাড় কেটে নিঙাড়ি নীরস ধরা,
আনি রে ঝরনাধারা এ নিখিল শীতল করা।
আজি সে গাঁইতি শাবল কোথায় গেল, হাতে কি নাই॥
খেতেছে ফসল নিতুই ডিঙিয়ে বেড়ার কাঁটা,
এবারের পুজোয় নতুন বলি দে সে-সব পাঁঠা।
দেখিবি আসবে ফিরে শক্তিময়ী আবার হেথাই॥
নব-ভারতের হলদিঘাট
বালাশোর – বুড়িবালামের তীর –
নব-ভারতের হলদিঘাট,
উদয়-গোধূলি-রঙে রাঙা হয়ে
উঠেছিল যথা অস্তপাট।
আ-নীল গগন-গম্বুজ-ছোঁয়া
কাঁপিয়া উঠিল নীল অচল,
অস্তরবিরে ঝুঁটি ধরে আনে
মধ্য গগনে কোন পাগল!
আপন বুকের রক্তঝলকে
পাংশু রবিরে করে লোহিত,
বিমনানে বিমানে বাজে দুন্দুভি,
থরথর কাঁপে স্বর্গ-ভিত।
দেবকী মাতার বুকের পাথর
নড়িল কারায় অকস্মাৎ
বিনা মেঘে হল দৈত্যপুরীর
প্রাসাদে সেদিন বজ্রপাত।
নাচে ভৈরব, শিবানী, প্রমথ
জুড়িয়া শ্মশান মৃত্যুনাট, –
বালাশোর – বুড়িবালামের তীর –
নব ভারতের হলদিঘাট।
অভিমন্যুর দেখেছিস রণ?
যদি দেখিসনি, দেখিবি আয়,
আধা-পৃথিবীর রাজার হাজার
সৈনিকে চারি তরুণ হটায়।
ভাবী ভারতের না-চাহিতে আসা
নবীন প্রতাপ, নেপোলিয়ন,
ওই ‘যতীন্দ্র’ রণোন্মত্ত –
শনির সহিত অশনি-রণ।
দুই বাহু আর পশ্চাতে তার
রুষিছে তিনটি বালক শের,
‘চিত্তপ্রিয়’, ‘মনোরঞ্জন’,
‘নীরেন’ – ত্রিশূল ভৈরবের!
বাঙালির রণ দেখে যা রে তোরা
রাজপুত, শিখ, মারাঠি, জাঠ!
বালাশোর – বুড়িবালামের তীর –
নব-ভারতের হলদিঘাট।
চার হাতিয়ারে – দেখে যা কেমনে
বধিতে হয় রে চার হাজার,
মহাকাল করে কেমনে নাকাল
নিতাই গোরার লালবাজার!
অস্ত্রের রণ দেখেছিস তোরা,
দেখ নিরস্ত্র প্রাণের রণ;
প্রাণ যদি থাকে – কেমনে সাহসী
করে সহস্র প্রাণ হরণ!
হিংস-বুদ্ধ-মহিমা দেখিবি
আয় অহিংস-বুদ্ধগণ
হেসে যারা প্রাণ নিতে জানে, প্রাণ
দিতে পারে তারা হেসে কেমন!
অধীন ভারত করিল প্রথম
স্বাধীন-ভারত মন্ত্রপাঠ,
বালাশোর – বুড়িবালামের তীর –
নব-ভারতের হলদিঘাট।
সে মহিমা হেরি ঝুঁকিয়া পড়েছে
অসীম আকাশ, স্বর্গদ্বার,
ভারতের পূজা-অঞ্জলি যেন
দেয় শিরে খাড়া নীল পাহাড়!
গগনচুম্বী গিরিশের হতে
ইঙ্গিত দিল বীরের দল,
‘মোরা স্বর্গের পাইয়াছি পথ –
তোরা যাবি যদি, এ পথে চল!
স্বর্গ-সোপানে রাখিনু চিহ্ন
মোদের বুকের রক্ত-ছাপ,
ওই সে রক্ত-সোপানে আরোহি
মোছ রে পরাধীনতার পাপ!
তোরা ছুটে আয় অগণিত সেনা,
খুলে দিনু দুর্গের কবাট!’
বালাশোর – বুড়িবালামের তীর –
নব-ভারতের হলদিঘাট।
নমস্কার
তোমারে নমস্কার –
যাহার উদয়-আশায় জাগিছে রাতের অন্ধকার।
বিহগ-কণ্ঠে জাগে অকারণ পুলক আশায় যার
স্তব্ধ পাখায় লাগে গতিবেগ চপল দুর্নিবার।
ঘুম ভেঙে যায় নয়নসীমায় লাগিয়া যার আভাস
কমলের বুকে অজানিতে জাগে মধুর গন্ধবাস।
জাগে সহস্র শিশির-মুকুরে সহস্র মুখ যার
না-আসা দিনের সূর্যট সে তুমি, তোমারে নমস্কার।
নমো দেবী নমো নম,
ছুটিয়া চলেছ স্রোত-তরঙ্গ লপাহাড়ি হরিণীসম!
অটল পাষাণ অচপল গিরিরাজের চপল মিয়ে
চলেছে তটিনী তটে তটে নট-মল্লারে গান গেয়ে!
কূলে কূলে হাসো পল্লবে ফুলে ফল-ফসলের রানি,
বধির ধরারে শোনাও নিত্য কলকলকল বাণী।
তব কলভাষে খলখল হাসে বোবা ধরণির শিশু,
ওগো পবিত্রা, কূলে কূলে তব কোলে দোলে নব জিশু।
তব স্রোতোবেগে জাগে আনন্দ জাগিছে জীবন নিতি,
চিরপুরাতন পাষাণে বহাও চিরনূতনের গীতি!
জড়েরে জড়ায়ে নাচিছ প্রাণদা, দাও নব প্রাণ তার,
শ্মশানের পাশে ভাগীরথী তুমি, তোমারে নমস্কার।
পূজা অভিনয়
মানুষের পদ-পূত মাটি দিয়া
দেবতা রচিছে পূজারিদল।
সে দেবতা গেল স্বর্গে, মানুষ
রহিল আঁকড়ি মর্ত্যতল।
দেবতারে যারা করেছে সৃজন,
সৃজিতে পারে না আপনারে,
আসে না শক্তি, পায় না আশিস,
ব্যর্থ সে পূজা বারে বারে।
মাটির প্রতিমা মাটিই রহিল,
হায় কারে দিবে শক্তিবর,
দেবতার বর নিতে পারে হাতে
হেথা কোথা সেই শক্তিধর!
বিগ্রহ-চালে হাসে বুড়োশিব,
বলে, ‘দেখো দেখো দশভুজা,
নেংটি পরিয়া নেংটে ইঁদুর –
ভক্তরা এল দিতে পূজা;
গণেশ-ভক্ত ইঁদুরে-বুদ্ধি
হস্তীকর্ণ লম্বোদর,
কার্তিকে মোর সাজায়েছে দেখো,
যেন উহাদের মিয়ের বর!
উহাদের দেব-সেনাপতি পরে
ছেঁড়া কটিবাস আধ-হাতি,
সেনাদল হল চরকাবুড়ি গো,
তরুণেরা হল জোলা তাঁতি!
মাথা কেটে আর অস্ত্র হেনেও
হয় না স্বাধীন আর সকল,
সূতা কেটে আর বস্ত্র বুনিয়া
কেল্লা করিবে ওরা দখল!
বলি দেয় ওরা কুমড়ো ছাগল
বড়ো জোর দুটো পোষা মহিষ,
মহিষাসুরেরে বলি দিতে নারে,
বলে, ‘মাগো ওটা তুই বধিস।’
লক্ষ্মীর হাতে অমৃতভাণ্ড,
লক্ষ্মী ছেলেরা তাহাই চায়,
তাই পূজা করে ওরা বণিকেরে –
লক্ষ্মীবাহন কালপ্যাঁচায়!
অমৃত চাহিছে, ওরা তো চাহে না
মোর কণ্ঠের বিষের ভাগ,
ওদেরই মরুতে জঙ্গলে চরে
তোমার বাহন সিংহ-বাঘ!
দেখিয়া তরাসে পলায় উহারা;
বাহন দেখিয়া যাদের ভয়,
সিংহবাহিনী! পূজিয়া তোমায়
তারাই করিবে অসুর জয়?
সেথা তব হাতে টিনের খড়গ,
সারা গায়ে মোড়া ঝালতা রাং,
দেখে হাসে আর ঘুমাই শ্মশানে,
ভক্তের দল জোগায় ভাং।
কোন রূপ তব ধ্যান করে ওরা,
শুনিবে? শুনিয়া যাও ঘুমোও,
শ্বশুর-বাড়ির ফেরত যেন গো,
অসুর-বাড়ির ফেরত নও!
বাণী-মেয়ে মোর বোবা হয়ে বসে,
ভাঙা বীণা কোলে বসিয়া রয়,
কথায় কথায় সেথা সিডিসন,
কী জানি কখন জেলের ভয়।
নিজেরা বন্দি, তাই দেখো ওরা
ধরিয়া ও কোন কন্যারে
কলা-বউ করে রেখেছে তাদের
হীন কামনার কারাগারে!
ভূতো ছেলেগুলো কলেজেতে পড়ে,
কে জানে ক-ল্যাজ পায় হোথায়,
কেহ শাখামৃগ হইয়াছে উঠি
আধ্যাত্মিক উঁচু শাখায়!’
এমনই শরৎ সৌরাশ্বিনে
অকাল-বোধনে মহামায়ার
যে পূজা করিল বধিতে রাবণে
ত্রেতায় স্বয়ং রামাবতার,
আজিও আমরা সে দেবী-পূজার
অভিনয় করে চলিয়াছি!
লঙ্কা-সায়রী রাবণ ধরিয়া
টুঁটিতে ফাঁসায়ে দেয় কাছি।
দুঃসাহসীরা দুর্গা বলিয়া
হয়তো কাছিতে পড়ে ঝুলে,
দেবীর আসন তেমনই অটল,
হয়তো ঈষৎ ওঠে দুলে।
কে ঘুচাবে এই পূজা-অভিনয়,
কোথায় দূর্বাদলশ্যাম
ধরণি-কন্যা শস্য-সীতারে
উদ্ধারিবে যে নবীন রাম!
দশমুখো ওই ধনিক রাবণ
দশ দিকে আছে মেলিয়া মুখ,
বিশ হাতে করে লুণ্ঠন তবু
ভরে নাকো ওর ক্ষুধিত বুক।
হয়তো গোকুলে বাড়িছে সে আজ,
উহারে কল্য বধিবে যে,
গোয়ালার গরে খেঁটে-লাঠি-করে
হলধর-রূপী রাম সেজে!