প্রণয় নিবেদন
লো কিশোরী কুমারী!
পিয়াসি মন তোমার ঠোঁটের একটি গোপন চুমারই॥
অফুট তোমার অধর ফুলে
কাঁপন যখন নাচন তুলে
একটু চাওয়ায় একটু ছুঁলে গো!
তখন এ-মন যেমন কেমন-কেমন কোন্ তিয়াসে কোঙারি? –
ওই শরম-নরম গরম ঠোঁটের অধীর মদির ছোঁয়ারই।
বুকের আঁচল মুখের আঁচল বসন-শাসন টুটে
ওই শঙ্কা-আকুল কী কী আশা ভালোবাসা ফুটে সই?
নয়ন-পাতার শয়ন-ঘেঁসা
ফুটচে যে ওই রঙিন নেশা
ভাসা-ভাসা বেদনমেশা গো!
ওই বেদন-বুকে যে সুখ চোঁয়ায় ভাগ দিয়ো তার কোঙারই!
আমার কুমার হিয়া মুক্তি মাগে অধর ছোঁয়ায় তোমারই॥
প্রণয়-ছল
কত ছল করে সে বারেবারে দেখতে আসে আমায়।
কত বিনা-কাজের কাজের ছলে চরণ দুটি আমার দোরেই থামায়॥
জানলা আড়ে চিকের পাশে
দাঁড়ায় এসে কিসের আশে,
আমায় দেখেই সলাজ ত্রাসে,
গাল দুটিকে ঘামায়।
অনামিকায় জড়িয়ে আঁচল
দুরু দুরু বুকে
সবাই যখন ঘুমে মগন তখন আমায় চুপে চুপে
দেখতে এসেই মল বাজিয়ে দৌড়ে পলায়
রঙ খেলিয়ে চিবুক গালের কূপে।
দোর দিয়ে মোর জলকে চলে
কাঁকন মারে কলস-গলে
অমনি চোখোচোখি হলে
চমকে ভুঁয়ে নখটি ফোটায়, চোখ দুটিকে নামায়।
সইরা হাসে দেখে ছুঁড়ির দোর দিয়ে মোর
নিতুই নিতুই কাজ-অকাজে হাঁটা।
করবে কী ও? রোজ যে হারায় আমার পথেই
শিথিল বেণির দুষ্টু মাথার কাঁটা!
একে ওকে ডাকার ভানে
আনমনা মোর মনটি টানে,
চলতে চাদর পরশ হানে
আমারও কী নিতুই পথে তারই বুকের জামায়॥
পিঠ ফিরিয়ে আমার পানে দাঁড়ায় দূরে
উদাসনয়ান যখন এলোকেশে,
জানি, তখন মনে মনে আমার কথাই
ভাবতেছে সে, মরেছে সে আমায় ভালোবেসে।
বই হাতে সে ঘরের কোণে
জানি আমার বাঁশিই শোনে,
ডাকলে রোষে আমার পানে
নয়না হেনেই রক্তকমল-কুঁড়ির সম চিবুকটি তার নামায়॥
ফুল-কুঁড়ি
আর পারিনে সাধতে লো সই এক ফোঁটা এই ছুঁড়িকে।
ফুটবে না যে ফোটাবে কে বলল সে ফুল-কুঁড়িকে।
ঘোমটা-চাঁপা পারুল-কলি,
বৃথাই তারে সাধল অলি
পাশ দিয়ে হায় শ্বাস ফেলে যায় হুতাশ বাতাস ঢলি।
আ মলো ছিঃ! ওর হল কী?
সুতোর গুঁতো শ্রান্ত-শিথিল টানতে ও মন-ঘুড়িকে।
আর শুনেছিস সই?
ও লো হিমের চুমু হার মেনেছে এইটুকু আইবুড়িকে!!
সন্ধে সকাল ছুঁয়ে কপাল রবির যাওয়া-আসাই সার,
ব্যর্থ হল পথিক-কবির গভীর ভালোবাসার হার।
জল ঢেলে যায় জংলা বধু,
মৌমাছি দেয় কমলা মধু,
শরম-চাদর খুলবে না সে আদর শুধু শুধু।
কে জানে বোন পথভোলা কোন্
তরুণ-চোখের করুণ-চাওয়ায় চোখ ঠেরেছে ছুঁড়িকে –
বসে আছে লো
এইলজ্জাবতীর বধির বুকের সিংহ-আসন জুড়ি কে?
বরষায়
আদর গর-গর
বাদর দর-দর
এ-তনু ডর-ডর
কাঁপিছে থর-থর॥
নয়ন ঢল-ঢল
[সজল ছল-ছল]
কাজল-কালো-জল
ঝরে লো ঝর ঝর॥
ব্যাকুল বনরাজি শ্বসিছে ক্ষণে ক্ষণে
সজনী! মন আজি গুমরে মনে মনে।
বিদরে হিয়া মম
বিদেশে প্রিয়তম
এ-জনু পাখিসম
বরিষা জর-জর॥
[বিজুরি হানে ছুরি চমকি রহি রহি
বিধুরা একা ঝুরি বেদনা কারে কহি।]
সুরভি কেয়া-ফুলে
এ হৃদি বেয়াকুলে
কাঁদিছে দুলে দুলে
বনানী মর মর॥
নদীর কলকল ঝাউ-এর ঝলমল
দামিনী জ্বল জ্বল কামিনী টলমল।
আজি লো বনে বনে
শুধানু জনে জনে
কাঁদিল বায়ুসনে
তটিনী তরতর॥
আদুরি দাদুরি লো কহো লো কহো দেখি
এমন বাদরি লো ডুবিয়া মরিব কি?
একাকী এলোকেশে
কাঁদিব ভালোবেসে?
মরিব লেখা-শেষে
সজনি সরো সরো।
বিজয়িনী
হে মোর রানি! তোমার কাছে হার মানি আজ শেষে
আমার বিজয়-কেতন লুটায় তোমার চরণতলে এসে।
আমার সমর-জয়ী অমর তরবারি
ক্লান্তি আনে, দিনে দিনে হয়ে ওঠে ভারী,
এখনএ ভার আমার তোমায় দিয়ে হারি
এই হার-মানা-হার পরাই তোমার কেশে।
ওগো দেবী!
আমায় দেখে কখন তুমি ফেললে চোখের জল,
আজ বিশ্ব-জয়ীর বিপুল দেউল তাইতে টল-মল!
আজ বিদ্রোহীর এই রক্ত-রথের চূড়ে
বিজয়িনী! নীলাম্বরীর আঁচল তোমার উড়ে,
যত তূণ আমার আজ তোমার মালায় পুরে,
আমি বিজয়ী আজ নয়ন-জলে ভেসে।
বিরহ-বিধুরা
কার তরে? ছাই এ পোড়ামুখ আয়নাতে আর দেখব না;
সুর্মা-রেখার কাজল-হরফ নয়নাতে আর লেখব না!
লাল-রঙিলা করব না কর মেহেদি-হেনার ছাপ ঘষে;
গুলফ চুমি কাঁদবে গো কেশ চিরুণ-চুমার আপশোশে!
কপোল-শয়ান অলক-শিশুর উদাস ঘুম আর ভাঙবে না;
চুমহারা ঠোঁট পানের পিকের হিঙুল রঙে রাঙবে না!
কার তরে ফুলশয্যা বাসর, সজ্জা নিজেই লজ্জা পায়;
পীতম আমার দূর প্রবাসে, দেখবে কে সাজ-সজ্জা হায়!
চাঁচর চুলে ধূম্র ওড়ে, অঙ্গ রাঙায় আগুন-রাগ,
যেমনি ফোটে মন-নিকষে পিয়ার ফাগুন-স্মৃতির দাগ।
সবাই বলে, চিনির চেয়েও শিরিন জীবন, – হায় কপাল!
পীতম-হারা নিম-তেতো প্রাণ কেঁদেই কাটায় সাঁঝ সকাল।
যেথায় থাকো খোশহালে রও, বন্ধু আমার – শোকের বল!
তুমি তোমার সুখ নিয়ে রও, – থাকুক আমার চোখের জল!
বে-শরম
আরে আরে সখী বারবার ছি ছি
ঠারত চঞ্চল আঁখিয়া সাঁবলিয়া।
দুরু দুরু গুরু গুরু কাঁপত হিয়া উরু
হাথসে গির যায় কুঙ্কুম-থালিয়া।
আর না হোরি খেলব গোরি
আবির ফাগ দে পানি মে ডারি
হা প্যারি –
শ্যাম কী ফাগুয়া
লাল কী লুগুয়া
ছি ছি মোরি শরম ধরম সব হারি
মারে ছাতিয়া মে কুঙ্কুম বে-শরম বানিয়া।
মানিনী
মূক করে ওই মুখর মুখে লুকিয়ে রেখো না,
ওগো কুঁড়ি, ফোটার আগেই শুকিয়ে থেকো না!
নলিন নয়ান ফুলের বয়ান মলিন এদিনে
রাখতে পারে কোন সে কাফের আশেক বেদীনে?
রুচির চারু পারুল বনে কাঁদচ একা জুঁই,
বনের মনের এ বেদনা কোথায় বলো থুই?
হাসির রাশির একটি ফোঁটা অশ্রু অকরুণ,
হাজার তারা মাঝে যেন একটি কেঁদে খুন!
বেহেশতে কে আনলে এমন আবছা বেথার রেশ,
হিমের শিশির ছুঁয়ে গেছে হুরপরিদের দেশ!
বরষ পরের দরশনের কই সে হরষণ,
মিলবে না কি শিথিল তোমার বাহুর পরশন?
শরম টুটে ফুটুক কলি শিশির-পরশে
ঘোমটা ঠেলে কুণ্ঠা ফেলে সলাজ হরষে।