- বইয়ের নামঃ খন্ডিত গৌরব
- লেখকের নামঃ শামসুর রাহমান
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
খন্ডিত গৌরব
অভিশপ্ত নগরের ঠোঁট, শিরদাঁড়া, বুক ছুঁয়ে
হাওয়া বয়, কোট নড়ে। তপ্ত দু’টি চায়ের পেয়ালা
গেইশা নারীর মতো, কাকাতুয়া-ঝুটি কাঁপে, কালো
টেবিলে চামচ কথা বলে পিরিচের সঙ্গে, দূরে
গণিকার আলো-নেভা আস্তানায় বিষণ্ন নাবিক
অতিশয় ব্যবহৃত স্তনে হাত রেখে ঘন ঘন
নাক ডাকে, কুকুরের ক্রন্দন, পাড়ায় চৌদিদারি
হাঁকডাক ঝিমধরা নৈঃশব্দ্যকে ভীষণ অসুস্থ ক’রে তোলে।
শব্দের গলিত শবে ব’সে টলমল
আকণ্ঠ করছে পান স্মৃতির কারণ-জল কোনো
পোড়-খাওয়া কাপালিক কবি। রাত্রি তাকে
কোন্ ফাঁকে বানায় আধার লেহনের? ফুল্কি ওড়ে দিগ্ধিদিক।
দশদিকে ঢাকঢোল, খোল কর্তাল, ট্রাম্পেট, বাঁশি;
সমর্থিত রূপসীর মাথায় কাঁটার তাজ কিছু রঙ বাজ
পরিয়ে দিয়েছে, মাথা হেঁট। বিজ্ঞাপিত
সৌন্দর্যে গ্রহণ লাগে বুঝি,
পরমায়ু-পুঁজি কমে। টনক নড়ে না,
তার অঙ্কুশে কাতর জনকের ফসফুস-চেরা
রক্তের ঝলক পিকদানে ঘন ঘন,
ভগ্নীর আগুনে ঝাঁপ বিদেশ বিভুঁইয়ে; লগ্নহীন দিন যায়।
হঠাৎ পুঁতির মালা দুলে ওঠে কিশোরীর,পুঁথিপাঠ, কবে
ঘাসফুলে বুলিয়ে আঙুল আর আঁচলে লুকিয়ে
কিছু কুল ঘরে ফেরে। ইদানীং রূপের খাঁচায় হাঁসফাঁস,
চন্দ্রকর অগ্নিকণা; কে তাকে বাঁচায় ডামাডোলে?
টেকে না অস্থির মন ঘরে সারা দিনমান, সাঁঝ
আজকাল প্রায়শই শ্মশানের পুড়ন্ত শবের
উৎকট গন্ধের মতো, রাত্রির করুণ অপচয়।
কোনো কোনো রাতে লোকপ্রসিদ্ধ বোবায়
ধরে তাকে, মধ্যরাতে শিশু
জননীর বুকে
লগ্ন হ’তে ভয় পায়। সত্তায় কাঁপুনি, ব’সে থাকে
সারারাত; জেগে উঠে বিবাগী শয্যায় শুনি কার
কণ্ঠস্বর? জানালার কাছে
নারকেল গাছে হাওয়া ঢ’লে পড়ে সখীর ধরনে।
একটি রোরুদ্যমান মুখ
যেন কুয়াশার ফ্রেমে আঁটা।
কোথায় হলুদ বাটা? কুকারে চাপানো লাল মাংস?
মাঝে মাঝে উৎসবের আগে
বিউটি পার্লারে রূপচর্চা, কখনো বা মুখ্য কাজে
ধৈর্যচ্যুত, পাশা খেলে, পরাজিত দ্বন্দের সহিত
বারবার তামাশার বিপন্ন শিকার
হ’য়ে আত্মহননের আবৃত্তিতে মাতে। তার সাথে উতস্তত
পুরুষের খচরামি; যামিনী না যেতে চোরাবালি
ডাকে তাকে, বুঝি বা সৌন্দর্য ডোবে পরিত্রানহীন।
প্রচণ্ড কর্কশ কবি ছুঁড়ে দ্যায় জোরদার লতা প্রাণপণে,
ব্যর্থতা সাপের মতো জড়ায় কেবলি
মহাক্রোশে তাকে, চেয়ে থাকে অসহায়;
ফোঁসে ক্রুর বালি; তবু হ্যাজাক নেভে না। ঝাঁক ঝাঁক
পাখি ডানা ঝাপ্টায়, চ্যাঁচায় মাঠ জুড়ে
উড়ে, আবার উঠুক ভেসে মাথা, হিলহিলে
সাপ দিক ঝাঁপ, গল্পগাথা সৃজনবিদিত হোক;
ক্লান্তকণ্ঠ, নাছোড় সাগ্নিক কবি পাক নব্য বাকের বিভূতি।
১৩।৩।৯০
অলীক আশার বাণী
অলীক আশার বাণী শোনাতে আসি নি। গেছি ভুলে
সেই মায়াবৃক্ষ, আশা যার নাম; টুপ টাপ ফল
পড়বে না, যত ইচ্ছে ঝাঁকি দাও। যা-কিছু সম্বল
জমেছিল পুরুষানুক্রমে গ্যাছে সবই, মর্মমূলে
দুর্মর কীটের বাসা; আত্মা বন্দী কুহকিনী-চুলে।
সঙ্গীরা খোঁয়াড়ে তৃপ্ত; ড্রাগ-অয়াডিক্টের আচরণ
কী ক’রে দখল করে সবাইকে? কোথায় শরণ
নেব আজ? থাকবো কি হরদম শূন্যতায় ঝুলে?
সবখানে চন্দ্রবোড়া, শঙ্খিণী, দাঁড়াশ; পথ নেই
পালাবার; পক্ষীরাজ ঘোড়ায় সওয়ার হ’য়ে মেঘে
উড়ে যাবে? রূপকথা শুয়োরের ক্লিন্ন চোয়ালেই
জীর্ণ হচ্ছে ক্রমাগত। দিনরাত্রি চরম উদ্বেগে
কন্টকিত; দশদিকে শুধু মধ্যযুগের বিস্তার,
এরকম ব্যাপক সংকটে নেই কারুরই নিস্তার।
আগুনে রেখেছো হাত
‘আগুনে রেখেছো হাত, পুড়ে যাবে আপাদমস্তক’
ব’লে সে সাগ্নিকা কাঁপে ক্রমাগত দার্পিত আক্রোশে;
ঝরায় আগুন, মণিহারা সর্পিণীর মতো ফোঁসে।
দিইনি উত্তর কোনো, বোবা হ’য়ে ছিলাম নিছক।
এ কেমন রূপ মোহিনীর দেখে ফেলি আচানক?
অমন মধুর হাসি যার ঠোঁটে ক্ষণে ক্ষণে খেলা
করে, যাকে মমতার প্রতিমূর্তি ভাবি সারাবেলা
সে কেন উগরে দ্যায় কালকূট আজ অনর্থক?
আসলে আমি কি ভন্ড, প্রতারক, অত্যন্ত পতিত?
কী এক বিভ্রমে ম’জে নিজেকেই করেছি শিকার
খেলাচ্ছলে; বুঝি তাই সময়ের কাছে প্রতারিত
এই আমি অকস্মাৎ হারিয়ে ফেলেছি স্বাধিকার।
সে-ও কি আমাকে ফেলে রক্তচক্ষু শক্রর দঙ্গলে
যাবে চ’লে নিতম্ব দুলিয়ে দূর গহীন জঙ্গলে?
২২।২।৯০
আমি কি এমনই নষ্ট
আমি কি এমনই নষ্ট? পুঁজ ঝরে নাসারন্ধ্র থেকে,
কষ বেয়ে রক্ত পড়ে সারাক্ষণ? সমস্ত শরীরে
দগদগে ক্ষত আর কিল্বিলে পোকা, ভাবো তুমি?
আমাকে উগরে দিয়ে মৃত্যু কিয়দ্দূরে ব’সে আছে
ফুলবাবু, ভুল ক’রে আনাড়ি তস্কর-প্রায় নিয়ে
গিয়েছিলো শুইয়ে দিতে পুরানো কবরে। আমি কথা
বল্লে বুঝি শ্মশানের ধোঁয়া তোমার দু’চোখে জ্বালা
ধরায়, গড়ায় মেঝেময় পশুর গলিত শব।
তা’ না হ’লে কেন তুমি থাকতে পারো না বেশিক্ষণ
সান্নিধ্যে আমার? কাছে গেলে হঠাৎ ইলেকট্রিক
শক্-খাওয়া ধরনে কেমন ছিট্কে দূরে স’রে যাও।
নরকের ফুটন্ত গন্ধক-গন্ধ পাও? মুখ থেকে
অম্লজল বেরোয়, ফোরায়া যেন; সে পানিতে খাই
হাবুডুবু, ভেসে যাই, চলে হাঙরের স্বৈরাচার।
১৭।২।৯০
আসলে তা’ নয়
ছিঃ। লোকটা কি আহাম্মকরে বাবা,
‘সোজা আঙুলে ঘি ওঠে না’ বাক্যটি সেই ছেলেবেলা থেকে
শুনে শুনেও পড়ন্ত বেলায়
তার কোনো আক্কেল হলো না। হিঃ হিঃ হিঃ।
ভেবেছিলো, সবকিছুই চলে সরল রেখায়; আসলে যে তা’ নয়, এটা বুঝতে বুঝতে
ওর জীবন এলিয়ে পড়েছে
গোধূলি আকাশে। কিন্তু, বুঝলে কি হবে?
এই এখনো পথে বেরুলে সে চমকে ওঠে ক্ষণে ক্ষণে,
ভড়কে যায়। কী মুশকিল, ডান দিকের রাস্তা সবাইকে
ভানুমতির খেল দেখিয়ে বাঁ, দিকে
মোড় নেয়, বাঁ দিকের পথ সাপের মতো
এঁকে বেঁকে ডানে মিশে যায়। ব্যাপারটা এরকম,
এদিক-ওদিক এবং ওদিক-সেদিকে
জড়িয়ে যেতে থাকে, যেন মাতালের প্রলাপ।
ঢাকঢোল পিটিয়ে জানানো হলো-
কাল বিকালে এক বিরাট
জমায়েত রাজধানীতে। বাচাল মাইক্রোফোন দশদিক কাঁপিয়ে
রটিয়ে গেলো, ‘দলে দলে যোগ দিন’। তা ধিন তা’ ধিন।
সেই থেকে মধ্যবয়সী লোকটা
ভাবতে শুরু করলো, দ্রোপদীর শাড়ি। এক ফোঁটে
ঘুম হলো না রাতে। চোখ থেকে অবিরল
পানি গড়িয়ে পুড়ে দু’ গালে।
সারাটা দিন কাটে কাজ-থামানো
অস্থিরতা আর দপদপে উদ্দীপনায়। বিকেল হ’তেই
রত্ত্বয়ানা হয় জমায়েতের উদ্দেশে।
অবাক কান্ড, যেখানে হাজার হাজার লোক
জড়ো হবার কথা, সেখানে শূন্যতা
গেঁয়ো মোড়লের মতো পায়ের ওপর তুলে
হুকো টানছে
আর বেশ দূরে দাঁড়িয়ে কিছু লোক
হেসে লুটোপুটি খাচ্ছে, যেন মস্ত তামাশা
চলছে একটা। সেই ভিড়ে
ওর মিত্রদের দেখতে পেয়ে লোকটায়
পিলে যায় চমকে; বজের মতো হাঁক দিতে গিয়ে
তার মনে হলো, খুবই মিহি গলার
আহত এক পাখি ভর করেছে কণ্ঠে, সে
নিজের চুল নিজে ছিঁড়তে থাকে
এবং চতুর্দিকে হিঃ। হিঃ। হিঃ।
ছিঃ লোকটা কী আহাম্মকরে বাবা।
ভেবেছিলো, দেশটার
চোখ গেছে খুলে, চুয়ান্ন হাজার বর্গ মাইল এখন
গনগনে লোহা। এবার
সত্যি সত্যি হবে লড়াই।
এখন সে ডন কিহোতের মতো একাই লড়ুক
উইন্ডমিলের সঙ্গে। ছিঃ। কী বুরবকরে বাবা,
হিঃ। হিঃ। হিঃ!
২৫।১।৯০
আড়িপাতা নয়
আড়ি পাতা স্বভাব নয়
তবু শুনে ফেলি ফিসফিসে কিছু কথা
পাখি গাছকে বললো
সংটাকুল বিশ্বে অসংখ্য উদ্বাস্তুর কালে
সবুজ টোপরপরা বর তুমিই
আমার নিখরচার ঘর
চেয়ার টেবিলকে বললো
দিন নেই রাত নেই আমরা সকল সময়
মুখোমুখি অদৃশ্য স্পন্দিত হৃদয়ে
চুড়ান্ত চুম্বনের জন্য অপেক্ষমাণ
তোশক খাটকে বললো
তোমার আমার যুগ্মতা সমাজে
ন্যায্যত শয্যা ব’লে খ্যাত
অথচ আমাদের মিলন চিরন্তন ফুলশয্যা
বই শেলফকে বললো
তাক-লাগানো তোমার ঔদার্য
কর্কশ বিবাপুর্ণ খন্ড প্রলয়ময় দুনিয়ায়
বৈপরীত্যের চমৎকার সহাবস্থান তোমার তাকগুলো
কলম খাতাকে বললো
রোদপোড়া বৃষ্টিভেজা পরিশ্রমী চাষীর মতো
তোমাকে চাষ করি নিয়ত
আমাদের তন্নিষ্ঠ সঙ্গমে ফসলের কী বাহার
প্রজাপতি সর্ষে ক্ষেতকে বললো
ঢেউ বললো নৌকাকে
ফুটপাত দোকানকে বললো চুপিসাড়ে
নক্ষত্র বললো আকাশকে
আড়বাঁশি ঠোঁটকে ঠোঁট বয়ে-যাওয়া সুরকে
গ্রীষ্মের গেলাস টলমলে আবেহায়াতকে
মৌমাছি শূন্য পাতাকে বললো
শূন্যতা বললো শব্দহীনতায় চিরন্তন শূন্যতাকে
২২।৪।৯০
এ কাকে দেখতে গিয়ে
লি্ফট বড় দেরি করে, কতক্ষণ এখানে এভাবে
এক ঠায় একাকী দাঁড়িয়ে থাকা যায়? বার বার ঘড়ি পড়ি,
ছটফট করি, পাঁচতলা সিঁড়ি বেয়ে উঠে যাবো? সহজ তো নয় আর,
এদিকে সময় বড় কম। দীর্ঘ করিডোর
স্তব্ধতায় কেমন ঝিমিয়ে-পড়া, প্রায়
দৌড়ে যাই কেবিনের দিকে, দরজায় মৃদু টোকা।
এ কাকে দেখতে গিয়ে দেখে ফেলি কাকে? ঠান্ডা রোদে
ছিলেন চেয়ারে ব’সে বারান্দায়, খাড়া শিরদাঁড়া
গায়ে ডোরাকাটা
শোবার পোশাক; মনে হলো,
নাৎসী বন্দী শিবিরের অতিশয় বিশীর্ণ বাসিন্দা, অত্যাচারী
পাহারাদারের পশুকেও লজ্জা-দেওয়া নির্যাতনে
ক্লিষ্ট, জব্দ, অথচ নালিশ
নেই কোনো, স’য়ে যাওয়া, শুধু স’য়ে যাওয়া
মুখ বুঁজে প্রতিক্ষণ, এমনকি কাতরানি নেই
এতটুক; বুক তার ধুক-পুক করছে কি? কোথায় উধাও ছন্দোজ্ঞান।
ইনিই কি একদা ফাইল থেকে চোখ তুলে দেখতেন কিছু
নৃত্যপরায়ণ পাখি, ঝুঁকে-পড়া কোনো রক্তজবা,
মাঝে-মধ্যে জিপসি মেঘের শোভা, কৌতুকমিশ্রিত
ভঙ্গিময় জনস্রোত, যান প্রবাহ কখনো? হেঁটে
যেতে যেতে ছায়াচ্ছন্ন পথে ভাবতেন কতকিছু। কোনো কোনো
মুখ, টুকরো কথা কিংবা কারো
হাসির ফোয়ারা, টেলিফোনে বলা গীতবিতানের
কোনো পংক্তি; ওষুধের গন্ধে ইদানীং
কোথায় মিলিয়ে গেছে মৃগনাভি শব্দের সৌরভ।
অসহায়, অন্তর্গত নৈঃসঙ্গ্য কুপিয়ে
কুপিয়ে মারছে তাকে ক্রামগত। ঝুঁকে, ধুঁকে ধুঁকে
জীবনের করুণা কুড়ানো
একমাত্র কাজ তার আজ। বরাবর সৌন্দর্য আরাধ্য তার,
অথচ এখন নির্বাসিত সুন্দরের
মায়াকাননের কুঞ্জ থেকে। অনেক অষ্ফুট কথা
শুনে যাই-বাল্যকাল, যৌবন, বার্ধক্য ভাসমান।
যার সঙ্গে এতকাল অন্তরঙ্গ পরিচয়, তাঁকে
একটি অদ্ভুত ছায়া ভেবে ব’সে থাকি ব্যথিত, স্তম্ভিত। দুপুরেই
সন্ধ্যা নামছে কি? বাড়ি ফেরার সময়
হয়ে এলো বুঝি, যাই? যেতে যেতে শুধু
মনে পড়ে, ছায়াময় ঘরে
শুষ্ক মাঠে ঈষৎ গজিয়ে-ওঠা শাদা
শিশু ধান চারার মতন চুল মাথা জোড়া, মাথার তিনটি
ফুটো দ্রুত ভরাট হবার পথে, কম্পমান ঠোঁট।
১৬।১।৯০
ওরা চায়
কত কিছু চায়, ওদের চাওয়ার অন্ত নেই।
ওরা চায় তুমি ধুলায় গড়াও রাত্রিদিন,
নিজেকে পোড়াও, থুতু চেটে খাও, এখুনি মরো;
ওরা চায় তুমি চেকের বদলে আত্মা বেচো।
ওরা চায় তুমি হাত কচলাও, ভিক্ষা করো;
ওরা চায় তুমি নিমেষে হারাও সকল খেই,
দু’হাতে কেবল ভায়ের বোনের রক্ত সেচো,
দুঃখের জমি বাড়তেই থাক সীমানাহীন।
ওরা চায় তুমি নতজানু হও সর্বদাই,
ওরা চায় আজ তোমার কলমে ধরুক ঘুণ,
তোমার এমন প্রেমিক- হৃদয় ছিন্ন হোক,
শকুন-শোভিত ভাগাড় তোমার হোক ঠিকানা।
ওরা চায় তুমি এক লহমায় হারাও চোখ,
তোমার ডেরায় দিন দুপুরেই চলুক হানা,
কারো ইঙ্গিতে ঘাতক তোমাকে করুক খুন,
তোমার করোটি শেয়াল পাড়ায় পাক গে ঠাই।
এত দূর এসে সত্যি বলোতো কী চাও তুমি?
যায় যাক সব, তবুও কখনো হবো না নত।
কোদালকে আজো বলবো কোদাল, অকম্পিত;
দেখাবোই শাদা আলখাল্লার নোংরাগুলো।
আমার কবিতা প্রজাপতি হয়ে উড়বে প্রীত
কারো গাল ছুঁয়ে, জখমি মনের সারাবে ক্ষত;
আমার কবিতা এইতো দেখছি নীলিমা ছুঁলো,
হোক সে সকল দুঃখীর প্রিয় মাতৃভূমি।
১৯।১।৯০
কবি এবং ঘোড়া
অজানা তোড়ে, কিসের ঘোরে মেঝেতে টগবগানো ঘোড়া, কেশর
কালো মেঘ, ফাঁপানো, শ্যাম্পু- করা চুল, খুরের ধাক্কায়
কফিন স’রে যায় এক কোণে, বুনো নিঃশ্বাস।
হকচকানো কবি চেয়ার-ছাড়া, পাণ্ডুলিপির বিকিরণ।
কী ক’রে ঘোড়টা ঘরে? কে পাঠালো? কবির চোখে
তখনও স্বপ্নের আঠালো রেশ। অন্যমনস্কতায়
ওষুধের শিশি কাটা মুণ্ডুর মতো
গড়ায়; হস্তধৃত পাণ্ডুলিপি থেকে সদ্য কবিতার উকিঝুঁকি।
কবিতা কৌতূহলী শিশু, এরকম তাকায় ঘোড়ার
দিকে; কফিনের উদ্দেশে
অশ্ব-দৃষ্টি, ঝুঁকে থাকা। কবির বুকে তোলপাড়। এ কেমন
কাণ্ড কারখানা? কফিন কে এনেছে এখানে? কেন?
খেলনা তো নয়, জীবনের উষ্ণতা টান টান চকচকে
চামড়ায়। কী খাদ্য দেবো তাকে, দণ্ডায়মান
কবিকে নিজেরই প্রশ্ন। ভাঁড়ারে
অনেক কিছুর মতোই ছোলা নেই, খড় বিচালি অবান্তর।
‘তোকে খাবো’ ঘোড়া বলে। কবি ভড়কানো,
পেছনে হটে, দেয়ালে পিঠ। চির্হি হাসি, জ্যোৎস্নার
জোয়ার ঘরে অকস্মাৎ; চক্রাকার নাচ, ভীত
কবির পায়ের নিচে এখন মাটি; ঘোড়ার কফিন ভক্ষণ।
কোথাকার ঘোড়া তুই? এ কেমন রুচি তোর, কফিন চিবিয়ে
খাচ্ছিস? চিৎপটাং চাঁদটাকে করবি কি
সাবাড় শেষ অব্দি? স্তম্ভিত, প্রশ্নাতুর কবিকে
কিছু না ব’লে পাণ্ডুলিপির ভেতর ঘোড়ার প্রবেশ।
১৭।২।৯০
কবিতাকে কেউ
কবিতাকে কেউ ভাবে জুঁই বেলী গোলাপ
কিংবা সেরকম কোনো ফুল
ডালে সাজানো
কবিতা কারো চিন্তায় আপেল আলুবোখারা
নাশপাতি কামরাঙা সুগন্ধি আম
কিংবা এ ধরনের কোনো ফল
সাফ সাফ বলেই ফেলি
এমন ভাবনা আমাকে পারে না বানাতে বশম্বদ
কবিতাকে কেউ দোয়েল বুলবুল কোকিল
ইত্যাদি ভেবে সুখী হয়
কেউ কেউ ধরে নেয় কবিতা
রূপালি মাছ ছাড়া কিছু নয়
আহা শোনোই না
এমন কোনো ধারণার মোসাহেব আমাকে ভেবো না
কেউ কবিতাকে এয়ারপোর্টের লাউঞ্জে বসে-থাকা রূপসীর আদলে
ভাবতে পারলেই খুশীতে ডগমগ
জ্বি হ্যাঁ একথা সত্যি
এমন ভাবনা আমার মাথায় উপর ছড়ি ঘোরাতে অক্ষম
কবিতাকে কেউ রসকদম কাঁচাগোল্লা
কেউ জিলিপি অথবা বাতাসা মনে করে
কেউ কেউ মুর্গীর রোষ্ট নুডলস শুটকির ভর্তা ভাবে
কেউ কেউ ঠাউরে নেয় কৌটোর সার্ডিন
কবুল করি এরকম কোনো কিছু
বিলকুল না- পছন্দ আমার
কবিতায় গল্প বলার ধরন অথবা
উপমা চিত্রকল্পের চর্বিতচর্বণ নারকেলের ছিবড়ের মতো
বিষয় স্যাঁতসেঁতে আধ্যাত্মিকতা ন্যাকা ছলাকলা
ভড়কে-দেওয়া আঙ্গিকের বুজরুকি কঙ্কে পায় না আমার কাছে
কবিতা আমার হৃৎপিন্ড ছিঁড়ে চাঁদি ফুঁড়ে
বেরিয়ে আসা লাভাপ্রতিম কিছু
বলা যেতে পারে উত্তরবঙ্গের গোরুর গাড়ির চাকা
যার গায়ে বহু দূরত্ব ধুলো কাদা গাড়িয়াল ভাইয়ের ঘামের দাগ
বলেতো ফেললাম পষ্টাপষ্টি
কিন্তু মাছের কাঁটায় মতো কী একটা বিঁধছে মনে
আসলে কবিতা লোহার খাঁচায় আটকানো এক জলকন্যা
সমুদ্রে প্রত্যাবর্তনের জন্য লেজ আছড়াচ্ছে লাগাতার
২৫।৪।৯০
করোনি কসুর
করোনি কসুর দিতে রক্তাক্ত গঞ্জনা খামোকাই
নিত্যদিন; এ শহরে বসবাস হয়েছে কঠিন
আজকাল, গায়ে এসে পড়ে কত বেহুদা কমিন
ক্রমাগত; যেদিকেই যাই ইট পাটকেল খাই
অহর্নিশ, তুমিও বলোনি ছেড়ে কথা বেরহম।
তোমার রসনা থেকে বয়ে যায় শহদের ধারা,
এরকম ধারণার রঙধনু ছিলো চমৎকারা;
ভাবতে অবাক লাগে, এতটুকু পাওনি শরম।
সম্প্রতি কী এক আলো সিনায় বেড়ায় নেচে, ফলে
লানতের ভাষা আর অঙ্গারের মতো ধ্বক ধ্বক
করে না আমার ঠোঁটে। খ্যাপা, পোড়া আত্মা ধুয়ে জলে
ধারণ করেছি মুদ্রা ক্ষমার; কুঠার আহাম্মক,
এরকম আচরণে তূণ শূন্য ক’রে দুলদুল
বানালে আমাকে, তবু শ্রীচরণে রেখে যাই ফুল।
২৭।৪।৯০
কাঁটার মুকুট
অসুস্থ, অসুখী একজন বহুকাল
বিষাদের বুকে বুক চেপে স্তব্ধতার কানে কানে
ফিস্ফিসে স্বরে কথা বলে। বাচাল সে
নয় কোনোকালে; আঁধারকে জব্দ করবার সাধ
অন্তরীণ আর দুর্ভাবনার মক্ষিকা
তাড়াতে নারাজ। মাঝে-মাঝে মুঠো থেকে
ছেড়ে দ্যায় একটি কি দু’টি পাখি আর
রঙধনু মেখে নেয় বয়েসী শরীরে।
মাথার ভেতর তার ধোঁয়াটে আকাশ,
পাগলাটে চাঁদ, বুকে সপ্তর্ষিমণ্ডল চেতনায়
পূর্বপুরুষের স্বপ্ন, কলরব, অপরাধ,
আহ্লাদ, বিমর্ষ নৈঃশব্দ্যের গাঢ় শৈলী।
সে জানে গোখরো তাকে ছোবল দেবেই,
তবু ওরা বিষধর সর্পকেই গলায় জড়িয়ে
নিতে বলে; মাথা তার শোণিতের ছোপে
রঙিন স্থাপত্য যেন, তবু কাঁটার মুকুট পরানোর খেলা।
১৩।১২।৯০
কাঁহাতক
দু’টুকরো, তিন টুকরো, চার টুকরো পাঁচ টুকরো
বহু টুকরো দিনভর রাতভর। এভাবেই কৈ মাছের নাচ
নেচে, নিজের রক্ত নিজে ছেঁচে বেশ কিছু গড়বড়
ক’রে বেঁচে আছে। ওর কাছে
কীসের যে কী দাম;
বিষের নাকি লোকশ্রুত অমৃতের, বোঝা দায়। কাম ওকে প্রায়শই
গনগনে লোহা বানায়; অথচ
তেমন সরোবর কই, যেখানে মনোমুগ্ধকর শীতলতা?
আসলে ওসব বাজে কথা, আকাট মূর্খের
বুজরুকি। জানে না, কোন্ কাজে কোন্ ঝুঁকি, শরীর
টরীর সব নয়। অন্য কিছু অবশ্যই আছে। গাছে
বাকল থাকে, ফল মূলও লভ্য। ডালই একমাত্র, বাকি
সব ফক্কিকার, এমন ভাবার সুযোগ নেই সভ্য
মানুষের। শীঘ্র চ’লে যাবে ভেবে দীর্ঘ জীবনের আকাংক্ষা
দোলায় মাথা, ভোলায় নশ্বরতা। ‘যা’ কিছু
পেলাম সীমিত এ জীবনে তাকেই সেলাম’
বলে সে প্রীত, মাটির ঢেলা ছুঁড়ে দেয় দূরে সূর্য ডুবুডুবু
বেলায়। বয়স ফুরোচ্ছে, কালের বায়স কর্কশ সুরে
দেয় জানান। তাতে কী? দুধে-ভাতে নাই বা গেলো
থাকা। একেবারে ভূখা নয়, রুখা সুখা খাচ্ছে দু’বেলা।
এরও বেশি কিছু চাই ওর। কীসের জন্যে হাহাকার সত্তা জুড়ে?
আগুন রঙের অশ্বক্ষুরে উঠুক বেজে
জমিন; খাল শুকোলে কী করে থাকবে মীন? নতুন কাল
ডেকে আনার ইন্দ্রজাল কোথায়? কোনো মন্ত্র কেউ কি
জানে না? যন্ত্রণা, সাপ-কামড়ানো যন্ত্রণা আপাদমস্তক।
চামড়া ফুঁড়ে গল গল বেরোয় বিষ। কাঁহাতক আর সইবে সে?
২০।২।৯০
কিছু না কিছু নিয়ে
কিছু না কিছু নিয়ে ভাবনা থেকেই যায় শেষ তক
করুরি কাজে যখন নিমজ্জিত
মনে হয় কিছু ভাবার নেই অথচ
তখনও মগজে চিন্তা-ভ্রমরের গুঞ্জরণ
কখন ভোকাট্রা চাকরির প্রবঞ্চক ঘুড়ি
ভিসা অফিসে লাইনে দাঁড়ানোর ঝুট ঝামেলা
প্রবাসে কন্যার সুবিধা-অসুবিধার জটাজাল
কনিষ্ঠার বিয়ের ফুল ফুটেও ফুটছে না
বাইয়োস্ফিয়ারে আমরা পরস্পর জড়ানো
পরিবেশের উপর লাগাতার বলাৎকার কি সমীচীন
সূর্যের আয়ু ফুরিয়ে যাবে কোন সুদূরে
কবে শিঙ-ভাস্কর্যকে দোলাবে গণতন্ত্রের সোনার হরিণ
পথ চলতে রেস্তোরাঁয় চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে
বন্ধুর সৌহার্দ্যের ঘ্রাণ নেওয়ার সময়
বই পড়ার ফাঁকে ঘামেভেজা ব্রা শোঁকাকালীন
কিছু না কিছু ভেবেই চলি
আকাঙক্ষার ছায়ায় তার মুখোমুখি ব’সে থাকার লগ্নে
ঘুমাতে যাবার আগে জেগে ওঠার পরে
জনৈক বিদেশী যুবক আত্মহত্যার প্রাক্ মুহুর্তে কী-যেন লিখেছিলো
খাতার শেষ পাতায় দীর্ঘশ্বাসের হরফে
ভাঙাচোরা পূর্ব ইউরোপকে কি সারানো যাবে রাংঝালে
কবিতার স্বায়ত্তশাসন কি প্রতিষ্ঠিত মুল্যবোধের পোড়াবাড়িতে
পরাবাস্তবতার মৃত্যুঘন্টা কি বাজলো
বনকপোতের ডাক কবে শুনবো আবার
স্বৈরতন্ত্রের কটমটে পাহারা আর কতকাল
ক’জন পুতুল মন্ত্রী নিলেন শপথ দবিজ কার্পের দাঁড়িয়ে
যে ডোরাকাটা শার্দুলের সওয়ার গর্বাচভ
সেই কি খাবে তাঁকে আখেরে
বুদ্বুদের উপর দাঁড়িয়ে সটান
পায়রা ওড়ানো কতটা সম্ভবপর
নিঃসঙ্গতার বুদোয়ারে ছায়াবৃতা গ্রেটা গার্বোর প্রয়াণ
রবীন্দ্রনাথ মূঢ় ময়রাদের হস্তাবলেপে নিদারুণ চটচটে
সুরম্য দালান থেকে বেরিয়ে আসে ভেড়ার পাল
কালো চুলের জালে আটকে-পড়া মাথা
কয়েকটি ভুতুড়ে তারা হাসে নিপস্টিক-হাসি
চুমু খেতে না পারার বাস্তুহারা ডুকরানো
ভাবছি গরহাজির-তুমি কেন ঘুমোতে দাও না আমাকে
শেকড়হীন চাঁদের পায়ে মিলিটারি বুট
হিস্পানি ঘাগরায় দ্রাক্ষাবনের স্বপ্ন
জ্যোৎস্নার নাগরদোলায় তুমি
যেদিন মৃত্যু হবে আমার তুমি কি আসবে ছুটে
প্রসাধন উপেক্ষা ক’রে
মাঝিবিহীন ফাঁকা নৌকা চলেছে ঢেউ ছুঁয়ে ছুঁয়ে
এরপরও থাকে কিছু না কিছু ভাবার
২২।৪।৯০
কী ক’রে আমরা
কী ক’রে আমরা হয়েছি দুপুর বেলা
পরস্পরের এরকম মুখোমুখি?
নষ্ট তারার ভস্ম কণার কাছে
ঋণী হ’য়ে আজ তোমার দিকেই ঝুঁকি।
কখনো হয়তো ব্যাপ্তির দূর টানে
সূর্যের মুখ, লাল দৈত্যের মুখ,
কাছের সকল গ্রহকেই গিলে খাবে;
হবে সে বামন ভীষণ শৈত্যভুক।
সুপার নোভার হঠাৎ বিষ্ফোরণ
প্রাচীন স্মৃতিতে কখনো বাঁধেনি বাসা;
ভাবি না কী হবে পৃথিবীর পরিণতি;
মনের কোটরে বাঁচবার প্রত্যাশা।
আমরা দু’জন যেন দু’ট উপগ্রহ,
দিনরাত্তির ঘুরি শুধু ছায়াপথে।
তীব্র আবেগে চেয়ে থাকি অসহায়,
কিছুতেই, হায়, পারি না লগ্ন হ’তে।
দু’চার ঘন্টা কেটে গেলে অবশেষে
ড্রইং রুমের কথোপকথনে ছেদ,
সোফার কাছেই শজারু, শূকর-ছানা;
শিরায় শিরায়া জমে বিদায়ের খেদ।
এভাবে দাঁড়াও যদি দরজার কাছে,
তাহ’লে কী ক’রে বলবো, ‘বিদায় দাও?’
তোমার দু’চোখ, সোনালি শরীর বলে-
‘হে কবি আমাকে মাত্রাবৃত্তে নাও’।
বইছে সময়, বয়েস উর্ধ্বগামী,
তোমার শরীরে জ্যোৎস্না-জোয়ার আজো
রয়েছে অটুট; মনে মনে আওড়াই,
সময়ের মাঝে সময়হীনতা বাজো।
উন্মাদনায় মেতে আছি কিছুকাল;
নিশ্চিত জানি, অচিরে আমার লয়।
পরের পর্বে কোন্ ঘাটে ব’সে তুমি
হবে উজ্জ্বল, গ্রাস করে সেই ভয়।
নভোমণ্ডলে কালো গর্তের ভিড়ে
অস্তিত্বের এতটুকু নেই ঠাঁই।
মহাশূন্যের আলো-তরঙ্গে প্রেম
এক লহমায় জ্বলে পুড়ে হবে ছাই।
জ্যোতিশ্চক্র থামবে ভবিষ্যতে,-
এই জ্ঞানে আছে বিষবৃক্ষের বীজ।
নশ্বরতার আতঙ্কছুট ক্ষণে
হৃদয়ে আসন পেতেছেন মনসিজ।
২।৪।৯০
কী-যে হয়
অনেকগুলো ছোট ছেলেমেয়ে জুল জুল তাকিয়ে আছে
ফলহীন ফলের গাছের দিকে
ইচ্ছে হয় এক লহমায় প্রতিটি ডালে
বসিয়ে দিই রাঙা টস টসে ফল
প্রতিবেশীনী তরুণীর বয়েস উদাস প্রান্তরে
ছুটছে শাহাজাদার ঘোড়ার মতো
জ্যোৎস্না ওর তৃষ্ণাতুর ঠোঁটে নিরপেক্ষ চুমু খায়
চাঁদ ওকে স্বপু দেখায়
দুধরঙ সরোবরকে কাটছে ছুরি
যে ওর যৌবনে অবগাহন ক’রে হবে
মোরগ ফুলের মৃর্তি
তাকেই খুঁজছি অষ্টপ্রহর
অলৌকিক সূর্যমুখীর স্বপ্নে বিভোর এক যুবা
হাতে চিবুক ঠেকিয়ে
বসে আছে ডালিম গাছের তলায়
বার বার তার হৃদয়ের সূর্য হয়ে যাচ্ছে কালো
আর পূথিপত্র থেকে আহরিত চিন্তার ভারে
সে ভীষণ কৃশকায় প্রায় মুমুর্ষু
এক্ষুণি ওর অঙ্গ প্রত্যঙ্গে অনেকগুলো
সূর্যমুখী ফুটিয়ে দিলে হতাম ঝর্ণাধারা
কী-যে হয় আমার বিকলাঙ্গ হিরোশিরা
আমাকে কেবলই দিচ্ছে ঠেলে
দেয়ালের দিকে আমার উপরে ধাবমান ট্রেন
ঠাসঠাসি শবের মধ্যে নির্কণ্ঠ হাহাকার
জীবন্মৃত আমি সুন্দরতম উদ্যানের কাছে
পৌঁছতে গিয়ে ঢুকে পড়ি শ্বাসরোধকারী অস্ত্রাগারে
যদি বিশ্বের যাবতীয় অস্ত্রাগার
আমার ইচ্ছে দোলায়
হতো ঝকঝকে ডিপার্টমেন্টাল স্টোর
অথবা শস্যভান্ডার
তাহলে আমাকে ঘিরে তারাবাতির ফোয়ারা
প্রেমের কবিতার ষ্ফুরণ শ্যামা পাখির গান
১৯।৪।৯০
কৃষ্ণপক্ষে
ওরা কাকে
শূলে চড়াবে কৃষ্ণপক্ষে? রক্ষে নেই,
রক্ষে নেই তোর, ধেই ধেই নাচছে
মাটি কাঁপিয়ে মুখোশ মুখে রাক্ষসের দল। ছল চাতুরী
ওদের তুই বুঝবি নে। মাথায় হাতুড়ি মারলো
কারা? ওরা, যারা গাছের পাতায়
ফড়িং আর প্রজাপতির ঝাঁকে, নদীর বাঁকে বাঁকে
ধরালো জাহাঁবাজ আগুন আজ।
রক্ষে নেই, রক্ষে নেই তোর। বক্ষে দ্যাখ তুলেছে ফণা
চক্র-আঁকা সাপ। নড়বি নে, নড়লে তোর
অন্তরসুদ্ধ হয়ে যাবে নীল, খাবে তোকে জলবিছুটি,
অন্তর্ভেদী কাঁকড়া। ওরে, ঝাঁকড়াচুলো ডাকাতগুলো
আসছে ধেয়ে সড়কি হাতে। থামা ওদের
থামা, থাকিস নে মুখ চেয়ে থর থর উঠবে কেঁপে
ঘরদোর, কাঁদবে ছেলেমেয়ে নারীর সন্ত্রম
ভাসবে মান্দাসে।
রক্ষে নেই, রক্ষে নেই তোর। চক্ষে
অগ্নিদগ্ধ বিভ্রম; নাড়া, হাত-পা নাড়া,
বাজা কাড়া নাকাড়া, দে বল্লমে তুই ধার। আঘাত
আসছে ধেয়ে, খুঁজিস নে গর্ত
এই শর্তহীন যুদ্ধে, লুকোস নে মুখ কারো
বক্ষে, সারা জনম দুধ খেয়েছিস যার, তাকে একটু সুখ দে।
ভাবিস নে গেলো সব চুকে বুকে,
রক্ষে নেই, রক্ষে নেই তোর,
যদি না রুখে দাঁড়াস। দ্যাখ চেয়ে স্বচক্ষে
তোর দোরগোড়ায় তিনটি দাঁড়াশ।
১৯।২।৯০
কোকিল
এমন নিঃশব্দে কে দাঁড়ায় দরজায়
ভোরবেলা স্মিত দশটায়
গজলের মদির আঙ্গিকে? বলপেন
খাতার পাতায় সমর্পিত; বলি, ‘এখুনি এলেন?’
নিরুত্তর; বুঝতে হয় না কষ্ট, খাতা থেকে উঠে
এখানে ব্যাকের পাশে রয়েছে সে স্বতঃষ্ফুর্ত ফুটে।
এই জ্ঞান হৃদয়ে ঝরায় অশ্রুকণা, এরকম
পুনর্জন্ম ক্ষণিকের, তুব কল্পনার সেবাশ্রম
আঁকড়ে থাকতে চাই। তার এই আসা-যাওয়া থাকবে অটুট,
যতদিন মুঠোয় আমার লগ্ন চাদরের খুঁটি
হায়াতের; ধু ধু ফাঁকা পথ,
গাছের নোয়ানো ডালে দোয়েল, নৈরাশ্য যযুগপৎ।
মনোনীতা অস্তরালে, ডেকেই চলেছি এতকাল,
ডেকে-ডেকে আমার দু’চোখে আজ শিমুলের লাল।
১১।৪।৯০
খণ্ডিত গৌরব
মেঘের কাঁথায় মুখ লুকায় দুঃখী চাঁদ,
মধ্যরাতের নির্বাক রাস্তায়
অভাজনের কাতর প্রার্থনা;
ভাঙা কবরের পাশে দাঁড়িয়ে
রুটির টুকরোর মতো সৃষ্টিকণা
ভিক্ষা চাইছি নিয়ত।
সঙ্গীতচিহ্নিত জ্বলজ্বলে আকাশ থেকে
হঠাৎ কে আমাকে ছুঁড়ে দিলো
স্তব্ধ ধূসরতায়?
ঝর্ণা আমার আঙুলে,
এই বিশ্বাসের শেকড় ছিলো মজবুত,
অথচ সম্প্রতি তুষারিত সেই প্রস্রবণ।
আমার হাতে একলব্যের রিক্ততার হাহাকার;
কে আমাকে বলে দেবে
কোন দ্রোণাচার্যের পায়ের তলায়
লুটোচ্ছে আমার খণ্ডিত গৌরব?
১৮।৯।৯০
খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে
খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে তুমি নিজেকেই করছো আহত
অবিরত; বারণ করেছি তবু শোনো নি নিষেধ,
হিমাঙ্কের বহু ডিগ্রী নিচে জমে থাকে নানা খেদ।
নিজে দায়ী; অথচ আমাকে দিচ্ছো ঠেলে ক্রমাগত
দ্রুত ফ্যাসিবাদী ফুটোহীন গ্যাস চেম্বারের মতো
কুঠরিতে; পারছি না নিতে আর সহজে নিঃশ্বাস।
ফর্সেপ উপড়ে নিচ্ছে একে একে সকল বিশ্বাস,
অথচ হৃদয় জুড়ে জেগে আছে প্রণয়ের ক্ষত।
আমি কি বুলেটপ্রুফ দেয়াল ভেবেছো? ঝাঁক ঝাঁক
গুলি এসে ঝরে যাবে, লাগবে না গায়ে কিছুতেই
একটি আঁচরও? হয়তো ভাবো লাস্যময়ী অবসরে
লোকটার হতচ্ছাড়া বুকে এক ফোঁটা রক্ত নেই;
ধুরন্ধর সাপ ভেবে কেবলি পিছিয়ে যাও। থাক
অবান্তর কথা, শেষে যাবোইতো অখ্যাত কবরে।
২৬।২।৯০
গুঢ় সহবতে
বেলী আর কনকচাঁপার গুঢ় সহবতে থাকি,
বেশ আছি সর্ষে ক্ষেত, প্রজাপতি, শালুক, শামুক,
দোয়েল ঘুঘুর সঙ্গে। কোকিলের সঙ্গে কুহু ডাকি
নির্জন নেপথ্যেঃ কত বলাবলি-লোকটা কী সুখ
পায় এতে? চুল খায় রূপালি আদর, রাতে ভালো
ঘুম নেই, থাকি না কখনো হুজরায়। খোলা মাঠ,
জোনাকির দাওয়াত কবুল করি, চাঁদের আলোয়
ওজু সারি বারংবার। মধ্যরাতে পুকুরের ঘাট
ডেকে নেয় চুপিসাড়ে, দেখবো পরীর নাচ আর
ঝিঁঝি পোকাদের সঙ্গে মাতবো জিকিরে সারা রাত।
হরফের তসবি হাতে ঘুরি, প্রায় অলৌকিক বাজনার
তালে নেচে উঠে দেখি অকস্মাৎ কী সুন্দর হাত
আমার কপালে দেয় আলগোছে চন্দনের ফোঁটা;
ফলত দিগন্তপানে একা ছোটা, নিরন্তর ছোটা।
২৭।৪।৯০
ঘুরে দাঁড়াও
আর নয়, অন্য কিছু নয়, এবার দাঁড়াও ঘুরে,
জুতে নাও ধনুকে অব্যর্থতীর। দেখছো না ধেয়ে
আসছে চৌদিক থেকে হন্তারক দল? রক্তপায়ী
বাদুড়ের ঝাঁক ঝুলে আছে ভরসন্ধেবেলা, চোখ
পুড়ে যায়, মিত্র ভেবে শক্রকেই ধরেছো জড়িয়ে
বার বার, মৈত্রীর সহজপাঠী ভুলে বসে আছো।
পদতল থেকে দ্রুত মাটি স’রে যাবার আগেই
পূর্ণ বেগে ছোটাও দূরন্ত অশ্ব, হানো শত বাণ।
যুদ্ধে ক্লান্তি আছে, ব্যেপে-আসা বিষাদ, শূন্যতা,
বুকফাটা ক্রন্দনের রোল শুনে হাত থেকে খ’সে
পড়বে ধনুক হয়তো, এবং ফেরাতে পারো মুখ
রক্তঝরা গোধূলি-আকাশ থেকে। যারা মৃত বহু
আগে, তারা যদি আজ তোমার হাতেই মৃত্যু পায়,
তাহ’লে কোরো না খেদ, শুধু ঘুরে দাঁড়াও এবার।
১৭।৩।৯০
জনপথ লেখে
ঝেড়ে ফেলে দিতে দেশজোড়া
অনড় পাথর
শুধু রাজধানী নয়, আমাদের প্রতিটি শহর
এবং শহরতলী গ্রাম
ক্রুদ্ধ মানুষের কপালের
শিরার ধরনে করে দপ দপ। কখনো দেখিনি,
তবু তোমাদের কথা ভেবে
আমাদের হৃদয়ের চোখে অশ্রধারা বয়,
স্ফীত হয় বুক। তোমাদের বুক থেকে
রক্তের ঝলক এই মানচিত্রটিকে
আরো বেশি রক্তজবাময় করে তোলে।
এবং শহরতলী, গ্রাম
অধিক পবিত্র হয় তোমাদের অন্তিম নিঃশ্বাসে।
দুপুর কী এক সুর দিয়েছিলো বুনে
তোমাদের বুকে, সে সুরের সম্মোহনে
বুক দিলে পেতে দ্বিধাহীন শয়তানের হাতের
মতো বন্দুকের মুখে। ব্যারিকেডে, তেতে-ওঠা পিচে,
দেয়ালে, দিগন্তে যেন পুনরায় লাগে
মুক্তিযোদ্ধাদের তাজা শোণিতের ছাপ।
তোমরা যখন শীতদুপুরে রাস্তায়
মৃত্যুর গহ্বরে, হায়, হচ্ছিলে বিলীন,
তখনই তোমরা আরো বেশি উঠলে বেঁচে
স্বদেশের স্পন্দিত হৃদয়ে। তোমাদের জীবনের
শেষ সুর্যাস্তের আভা, দ্যাখো,
আনে আজকের সূর্যোদয়।
কবির কলম নয়, রঙধনু দিয়ে
জনপথ লেখে তোমাদের এপিটাফ;
সূর্যরশ্মি দিয়ে
জনপথ লেখে তোমাদের স্মৃতিময় জয়গাথা।
২।১২।৯০
জমিনের বুক চিরে
জমিনের বুক চিরে লাঙলের পৌরুষে কৃষক
শস্য তোলে কায়ক্লেশে; রকমারি রঙিন আনাজে
ঋদ্ধ করে গৃহকোণ। মাঠ ছেড়ে চ’লে আসে সাঁঝে;
কোনো কোনো জ্যোৎস্নারাতে কী ব্যাকুল করে সে পরখ,
শোঁকে ফসলের ডগা। কিছুতেই ভাবে না নরক
নিজের কুটিরটিকে, বিবির পাশেই শোয়, মাঝে
উদোম বাচ্চার ঘুম, সারাদিন হাড়ভাঙা কাজে
কাটে, রাতে স্বপ্ন দ্যাখে পঙ্গপাল নামে বেধড়ক।
কবিও কর্মিষ্ঠ চাষী, রোজ চষে হরফের ক্ষেত
নুয়ে-নুয়ে, কখনো কখনো খুব আতশি খরায়
জলসেচে মগ্ন হয়, বোনে কিছু বীজ অলৌকিক।
মাটি ফুঁড়ে চারা জাগে, তখলিফে আগাছা নিড়ায়
কতদিন, ঘ্রাণ নেয় স্তবকের উপমাসমেত;
কখনো কখনো পোকা শায়েরকে সাজা দেয় ঠিক।
২৭।৪।৯০
জানা নেই
জানি না এরকম কিছু আছে কি নেই
মৌতের আগেই প্রত্যহ সয়ে চলেছি গোরের আজাব
প্রায়শ চোখে অমাবস্যা
মগজে বৃশ্চিক হাঁটে আঁচড়ে কাটে পাগলা কুকুর
কিছু থাক না থাক এপারে ওপারে
ধুক ধুক আছে হামেশা কলিজায়
এদিকেও বাড়ায় হাত বিদ্রোহী রোবট
কম্পিউটার-নির্ভর জীবনে এ কেমন কহর
কে তুলে দেয় জহরভরা পেয়ালা আমার হাতে
দন্ত-নখর বের করা সন্ধেবেলা
আমাকে ঘানিতে পিষছে সর্ষের মতো
সকালে সূর্যোদয়ের ইনাম রাতে খওফের সাজা
বন্দনা-লিপ্সা কাউকেই সাজে না কস্মিনকালে
তবে কেন মেষপালে এমন তোলপাড়
বিগ ব্যাঙের পরে অযুত অযুত বছর কেটেছে
গ্যালাক্সিতে ঘুরছে গ্রহ-উপগ্রহ
একদিন সূর্য অপরাহ্নের উনুন হবে
ফৌত হবে তামাম প্রাণিকুল
শীতার্ত শূন্যতাকে ওম দিতে ব্যর্থ শূন্যতা
ভাবলেই শিরদাঁড়ায় হিমপ্রবাহ
বলবো না মাফ করে দিও শত নাফরমানী আমার
হে রহস্যাবৃত ওগো অনির্বচনীয়
এতকাল করেছি তাজিম ফুল নারী এবং মনীষাকে
নানা রাগ-রাগিনীর প্রলম্বিত জিকিরে
সবই কি নাকাম আখেরে
পাই না নিশ্চিত জবাব দানেশমন্দ কোনো কেতাবে
২৭।৪।৯০
ঝুঁটি দোলানো নাচ
আমার মুঠোয় তোমার স্তন বেহেশতের দ্যুতিময় বিষিদ্ধ ফল
আমার ওষ্ঠঁ তোমার ঠোঁট থেকে
শুষে নেয় আবেহায়াত
আদ্যোপান্ত পাঠ করি তোমাকে জ্ঞানার্থীর নিষ্ঠায়
তোমার চোখের পাখির পাখা আলতো গোটানো
বুকে ঝড়ের আগে মেঘনা নদীর তোলপাড়
দ্রুত সরিয়ে নাও নিজেকে
হয়তো শুনতে পেলে পদশব্দ কাপড়ের খসখসানি
আমার হৃদয় পূর্ণিমা হতে হতে অমাবস্যা
অদৃশ্য ফেরেশতা ঝুঁকে চুমু খেলেন তোমার মাথায়
কালো চুলে নক্ষত্রের মতো দোয়ার ঝলসানি
সম্বিৎ এবং স্থৈর্যের প্রতিমা তুমি
কী করে পারো এভাবে বিচ্ছিন্ন করতে পারো
নিজের শরীর এক ঝটকায়
কী ভাবে করেছো রপ্ত এমন প্রশান্তির মুদ্রা
কুকুরের কানের মতো ঝুলতে থাকে আমার অবসন্ন আবেগ
তোমার আঙুলে প্রজাপতির পাখনার কম্পন
মনে হয় বসে আছো পরীস্তানে আলসেমির গালিচায়
সোফার হাতলে তোমার হাত গুণীর সোনালি বাদ্য
উঠে দাঁড়াও শাড়ির আঁচল সামলে সুমলে
উৎসবরাতে রঙিন বাতিখচিত গাছের যৌবনের উত্থান
তাকাও আমার দিকে জ্যোৎস্নাঝলসিত
নহরের মতো গভীর দৃষ্টিতে
যেন ভালোবাসা এই প্রথম চোখ মেললো
যদি তুমি মুখের উপর দড়াম বন্ধ করে দাও দরজা
কখনো শঙ্খিনী আক্রোশে
আমার হৃদয় গুঁড়িয়ে যাবে পথে ছড়ানো
দুর্ঘটনাকবলিত মোটর কারের কাচের মতো
সেদিন আফ্রিকার অরণ্যে আমার পথ হারানো
রাসায়নিক বৃষ্টিতে ঝলসে-যাওয়া
আমার মুঠোয় আবার তোমার গরবিনী স্তন
পুনরায় ক্ষণকালীন চুম্বন প্রায় বিটিভির
বিদেশী ছবির চুম্বন-দৃশ্যের ধরনে
বিচ্ছেদের সুরমা রঙের ছায়া অস্তিত্বে
দখলীস্বত্ব লিখে দেয়া যন্ত্রণার অনাড়ম্বর হরফে
প্রেতের পদহীন পদশব্দে অন্ধকার-খরগশ উৎকর্ণ
অজ্ঞাত ভয় দেয় না ঘুমোতে
গৃহকোণের টেবিলে বইয়ের স্তূপ কখনো বৌদ্ধবিহার
কখনো রেড ইন্ডিয়ান গোষ্ঠীপতি ক্রেজি হর্সের তেজী মাথা
অপ্রেমের শয্যায় শুয়ে থাকি কাঁটাবন্দী
আগামীকাল সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে চায়ের কাপে চুমুক
ভালোবাসার ঝুঁটি-দোলানো নাচ
২৬।৪।৯০
ডালকুত্তা
ডাকাবুকো লোকগুলো কেবল নিজেরাই
তেড়ে আসছে তা’ নয়
আমার পেছনে লেলিয়ে দিয়েছে ডালকুত্তাদেরও
কী হিংস্র আষ্ফালন
শিকারী কুকুরগুলোকে রোখার মতো
মন্ত্রপূত মাংসখন্ড আমার হাতে নেই
নক্ষত্রের নীড়ে লতাগুল্মের দূর্ভেদ্য নিবাসে
মাছের রূপালি ডেরায় ঠাঁই পাবো কী ক’রে
ট্রাফিকচর্চিত রাস্তায় জমে-থাকা পানি হুক্কাহুয়া
ফুটপাত প্রগলভ মাইফ্রোফোন হুক্কাহুয়া হুক্কাহুয়া
রেডিও টেলিভিশন সংবাদপত্র হুক্কাহুয়া
উঙ্কি-আঁকা সন্ধেবেলায় রেস্তোরাঁ হুক্কাহুয়া হুক্কাহুয়া
ডালকুত্তাদের তপ্ত নিঃশ্বাস
আমার গ্রীবার পড়শী সারাক্ষণ
স্বপ্নের ভেতরও
ওদের ক্ষমাহীন কর্কশ আঁচড় আমার আত্মায়
পিপাসায় বুক খরার জমির মতো চৌচির
তবু ছুটছি
কাঁটায় কাঁকরে পা দুটো ক্ষতবিক্ষত
তবু ছুটছি
ওরা কারা আসছে উল্টো দিক থেকে
কণ্ঠে বরাভয়ের গান
প্রায় বেরিয়ে-পড়া আমার চোখ
এখন জ্বলজ্বলে বাঁচার তীব্রতায়
আমার চোখে নিসর্গের চুল ওষ্ঠ স্তন নাভিমূল
আর নিতম্ব বেহেশতের বিকল্প
২২।৪।৯০
তবু তাকেই
কে আমাকে দিন দুপুরে রাত দুপুরে
কাপড় কাচার মতো ক’রে নিঃড়ে নিচ্ছে?
আমার মেদ আমার মজ্জা শুষে নিচ্ছে?
কে আমাকে এভাবে রোজ কষ্ট দিচ্ছে?
কে আমাকে পাগল-করা নিঝুম সুরে
ঘর ছড়িয়ে পথের ধারে দিচ্ছে ঠেলে?
মাথার ভেতর পিঁপড়ে শত দিচ্ছে পুরে?
হাত-পা বেঁধে যখন তখন শাস্তি দিচ্ছে?
যখন কিছু লিখতে বসি, মত্ত পাখি
ডাকাডাকি করতে থাকে শিরায় শিরায়,
কলম ছেড়ে দাঁড়িয়ে পড়ি, মাথা টলে।
কে রোজানা সকল কিছু ভেস্তে দিচ্ছে?
চায় না সেতো রাত্রিবেলা ঘুমিয়ে থাকি,
আমার দিকে হাজার বাদুড় দিচ্ছে ছুঁড়ে,
আমাকে সে নিজের কবর খুঁড়তে বলে;
কে আমাকে এভাবে রোজ দন্ড দিচ্ছে?
কে আমাকে ব্যস্ত রাখি অস্থিরতায়?
হাতে গুঁজে দিচ্ছে দীর্ঘ ফাসির দড়ি,
কখনো বা রেললাইনে বলছে শুতে,
আজকে আমি ফাঁদে-পড়া জখমি জন্তু।
কে আমাকে সব প্রহরে কেবল ভোগায়,
মুঠোয় পুরে দিচ্ছে অঢেল ঘুমের বড়ি?
প্রতি পদেই খাচ্ছি হোঁচট, মুষড়ে পড়ি;
তবু তাকেই চাই যে কাছে অধিকন্তু।
৪।২।৯০
তোমার নির্মিত নক্ষত্রেরা
তোমার নির্মিত নক্ষত্রেরা তোমাকে ভেংচি কাটে
চিরম্ভনতার প্রসঙ্গ টেনে
রাতদুপুরে
ওদের নিরস্ত করার কারিকুরি
আজ অব্দি রপ্ত করোনি
ওরা হয়ে ওঠে নাছোড় বিরক্তিকর বিদুষক
লতাপাতাঢাকা কোঠ বাড়ি প্যাঁচানো ধোঁয়া
বমি করে কী সব আবছা শব্দ প্রায়শ
চুপিসাড়ে হেঁটে আসে কাজ সারে ডোবার ধারে
সেখানে যারা থাকে
তাদের নামগোত্র কেউ জানে না
উপস্থিত থেকেও অনুপস্থিত
গুজব আকাশের কাছ থেকে
তারার কাছ থেকে
গাছগাছালি পাখপাখালির কাছ থেকে চুপি চুপি
অনেক কথা এনে ওরা
উনুনে চাপায় খুব গনগনে হ’লে
ছড়িয়ে দেয় এখানে সেখানে
সবসময় ওরা আত্মবিলোপী ক’জন পরস্পরের দিকে
তাকিয়ে থাকে
গুজব ভীষণ বিপজ্জনক ওরা শিশুদের
ভাজে কড়াইতে নরনারীর গায়ের চামড়া
তুলে ডুগডুগি বানায়
উপড়ে নেয় বৃদ্ধ বৃদ্ধার চোখ
আতঙ্কবাদীদের ডেরা একদিন
ঘেরাও করে সেপাই সান্ত্রীরা হাত উপরে তুলে
সুবোধ ভঙ্গিতে বেরিয়ে আসার হুকুম
লাউডস্পীকারে ধ্বনিত ঘন ঘন
কোঠাবাড়ি থেকে একটি পিপঁড়েও নড়ে না
ওরা নিজেরাই উড়িয়ে দেয় ডেরা
এই সঙ্গে তোমার নির্মিত নক্ষত্রেরা পাঁচিল ঘেরা
বাড়িটাও মাটিতে
মুথ থুবড়ে পড়ে
উর্ধ্বগামী বারুদগন্ধী ব্যাঙের ছাতা
১৯।৪।৯০
থমকে থেকো না
থমকে থেকো না; আর কতকাল এভাবে দাঁড়িয়ে
থাকবে? এগিয়ে যাও। পেছনে হটতে
চাও বুঝি? এখন সে পথ বন্ধ; প্রখর দুপুর
বিকেলের সঙ্গে ঢলাঢলি শুরু করে
দিয়েছে সে কবে, দেখতেই পাচ্ছো। এবার ঝাড়া
দিয়ে ওঠো, নয়তো অন্ধকার
অচিরে করবে গ্রাস তোমাকেই। তখন অরণ্যে একা-একা
কেঁদে বেড়ালেও কেউ করবে না খোঁজ।
যদি ভাবো, সময় তোমার
মুঠোয় থাকবে বন্দী সারাক্ষণ, তবে ভয়ঙ্কর
ভুল হয়ে যাবে হিসেবের
হিজিবিজি খাতার পাতায়। পা বাড়াও তাড়াতাড়ি;
তোমাকে ছাড়াই সব কিছু ঠিকঠাক
চলবে, একথা মনে ঠাঁই দিতে পারো অবশ্যই। তবু বলি,
যতদিন আছো
প্রবল আবেগ নিয়ে বাঁচো, শক্রর ব্যুহের দিকে
এগোতে করো না দ্বিধা। অভিমন্যু হলেও তোমার
খেদ থাকা অনুচিত; কেউ কেউ এভাবেই যায়,
যেতে হয়, পরিণাম ছায়া হয়ে অদূরে দাঁড়িয়ে থাকে, যেন
মেফিস্টোফিলিস, মুখে হিংস্র হাসি। তোমাকে পাতালে
নিয়ে যাবে, সাধ্য কার? নিজের পাহারাদার তুমি।
সবারই কিছু না কিছু পিছুটান থাকে। পুরাকালে
নাবিকেরা গভীর সমুদ্রে নাকি কখনো সখনো
কুহকিনী মোহিনীর গান শুনে চৈতন্যরহিত
দ্রুত ভ্রমে হারাতো জীবন নিরুদ্দেশে। যতদূর
জানা আছে, তুমি নও তেমন নৌজীবী। সামনের
দিকে পা চালাও, দাও ডাক দশদিকে
এমন জোড়ালো কণ্ঠে যাতে
বজেরও লজ্জায় মুখ বন্ধ হয়ে থাকে।
১২।২।৯০
দণ্ড
‘নত হও, নত হও’ ব’লে নির্বাপিত এজলাসে
পরচুলা-পরা বিজ্ঞ বিচারক খাগের কলমে
লিখলেন রায়, কাঠগড়ায় দাঁড়ানো লোকটার
ভাবলেশহীন মুখ। অন্তর্ভেদী দৃষ্টি, ছন্নছাড়া,
তার বুক-চেরা পথে কুহকের অচিন সঙ্গীত
তোলে ঢেউ, কেউ ডেকে-ডেকে ঘুমিয়ে পড়েছে; সে-তো
বোবা-কালা নয়, তবু মৌনের নিঃস্পৃহ তাঁবেদার
সর্বক্ষণ, পোকা-খাওয়া ফলের মতোই স্তব্ধ মুখ।
মনে-মনে বলে, ‘ছাগ দেবতার কাছে নত হওয়া
কী ক’রে সম্ভব?’ নইলে অনিবার্য বলি যূপকাঠে,
মন্ত্রপাঠে প্রস্তুত পুরুত, ঠেলাঠেলি অবান্তর
ঠেকে তার; কৌতূহলী জনতার কোলাহল ভেঁপু
বাজায় কিশোর, নারীদের কারো কারো কাঁখে শিশু;
অবশেষে বিচারক, অপরাধী দু’জনই দণ্ডিত।
১৪।৪।৯০
দাবানল
জাহান্নাম নাকি? নিষ্ঠুরতা বশম্বদ ভয়ানক
উৎপীড়কের, লন্ডভন্ড চতুর্দিক, পশুপাখি
ফুড়িং, মৌমাছি পোড়ে দাবানলে, অসুরের নখ
মাটি আঁচড়াচ্ছে জোরে, এখন উদ্ধারকল্পে ডাকি
কাকে? দাউ দাউ বনভূমি। ডান দিকে সাপ ছোটে,
বাম দিকে সন্ত্রস্ত নেউল, নেকড়েরা অকস্মাৎ
মেষপাল, বৃক্ষগুলি জ্বলন্ত পাথরে মাথা কোটে।
পালাতে চাই না, শাপশান্ত স্থগিত থাক আজ,
আমাকে চাটছে তপ্ত লকলকে জিভ, যাচ্ছে পুড়ে
সমস্ত শরীর, চর্ম ফাটে, চর্বি গলে, এ কেমন কারুকাজ?
শিরদাঁড়া খাড়া, হাসি মুখে অগ্নিশুদ্ধ হবো ভোরে,
শামুক আত্মা-জুড়ানো পানি ভস্মময় ওষ্ঠ জুড়ে;
আমাকে শুইয়ে দাও কবিতার নালাম্বরী ক্রোড়ে।
২০।১২।৮৯
দুঃখভোগ
যাবে যদি চ’লে যাও, কোরো না খামোকা কালক্ষেপ।
অতীত ফেলতে চাও মুছে ইরেজার দিয়ে ঘ’ষে
সাত তাড়াতাড়ি? এত বিরূপতা শুনি, কার দোষে?
আমাকে সাজালে মস্ত অপরাধী করবো না আক্ষেপ
কোনো দিন। এই যে ভুগছি নিত্য, তোমার ভ্রুক্ষেপ
নেই তাতে কিছুমাত্র। তীরে এসে নৌকা ডুবে যায়
বার বার, বিষ্ফারিত চোখে চেয়ে থাকি অসহায়;
করি না প্রার্থনা আর কার্বাঙ্কলে কৃপার প্রলেপ।
কী ক’রে ফেলবে মুছে ওষ্ঠ থেকে চুম্বনের দাগ
এত শীঘ্র? রাত্রিবেলা একা যখন ঘুমাতে যাবে
নিস্তাপ বালিশে মাথা রেখে, ঝেড়ে-ফেলা অনুরাগ
আগুনের হল্কা হ’য়ে রাতভর তোমাকে পোড়াবে।
তোমার বিরুদ্ধে নেই ধিক্কার অথবা অনুযোগ,
আমার জন্যেই থাক মনস্তাপ আর দুঃখভোগ।
নখ
নিজের হাতের দিকে হঠাৎ তাকাই, নখগুলো
অতিশয় তাড়াতাড়ি বর্ধমান রিরংসার মতো
অহর্নিশ; আমি কি দূরের কোনো অসভ্য মানব,
ক্ষৌরর্কম জানা নেই যার? এইসব নখ নিয়ে
বড়ই বিব্রত থাকি। শহরের প্রধান সুন্দরী
কাছে এলে তার স্তনে, তলপেটে দাগ ক’রে দিই,
এরকম ইচ্ছে বাঁদরের মতো চুলকোচ্ছে মাথা
কিছুকাল ধ’রে; আপাতত কবিতাকে খুঁটে-খুঁটে
মর্ষকামী সুখ পাই। দেখি তার চতুর্দিকে ঘাস
গজিয়ে উঠেছে দীর্ঘ ছাঁদে, ফড়িং গভীর ক্ষতে
দ্যায় সুড়সুড়ি; তার চেয়ে ভালো নিজেকেই আজ
খাম্চে-খুম্চে ছিঁড়ে খুঁড়ে খুব খুঁতময় মুখ নিয়ে
ব’সে থাকা পেকামাকড়ের মাঝে, লোভী ভ্যাম্পায়ার
মহানন্দে শুষে নেয় প্রতারিত কবির প্রতিভা।
২৬।৩।৯০
নব্বইয়ের একজন শহীদের স্ত্রীকে দেখে
শামিয়ানার নিচে তাকে দেখলাম বিষাদাবৃতা
দুপুরবারোটায়,
যার হাতে এখন মেহেদির রঙের বদলে
জীবনসঙ্গীর বুকের জমাট রক্তের অদৃশ্য ছোপ।
তার শোকস্তব্ধ মুখ থেকে বারবার
সরিয়ে নিচ্ছিলাম দৃষ্টি;
অসম্ভব এই শোকের দিকে
নিষ্পলক চেয়ে থাকা। আমার ভেতরে রাগী এক বাজপাখির
ডানা ঝাপটানি, সেই পাখির চঞ্চু আর নখর
প্রসারিত হস্তারকদের প্রতি, যারা হেনেছে
সংকল্পের মতো একটি সতেজ মানুষকে।
লোক থই থই এই সড়ক দ্বীপে
বিষাদাবৃতা নারীর আঁচলের খুঁট ধরে দাঁড়ানো
তার তিন বছরের কন্যা,যার খেলাঘরে
এখন মহররমের মর্সিয়া।
ওদের দু’জনের পায়ে বঙ্গোপসাগরের ঢেউয়ের মতো
গড়িয়ে পড়ছে চারদিকের জয়োল্লাস আর
আমার হৃদয়ের স্পন্দিত হাত
ওদের জানায় অভিবাদন
দুপুর বারোটায়।
ইচ্ছে হলো এক্ষুনি রঙধনু পুরে দিই শিশুর মুঠোয়,
যার পিতার বুকে বুলেট ফুটিয়েছে রক্তগোলাপ,
যিনি আলো ছিনিয়ে আনার ব্রত নিয়ে
কবরের অন্ধকারে নিদ্রিত,
যার মৃত্যু দুঃসময়ে লক্ষ লক্ষ মানুষের ত্বকে লিখে গ্যাছে
প্রতিবাদী গাথা,
যার মৃত্যু ঘোষণা করেছে স্বৈরাচারের মৃত্যু
যার মৃত্যু দুরাত্মাদের বুকে ধরিয়েছে ফাটল,
যার মৃত্যু এ মাটিতে পুঁতে দিয়েছে বিজয় নিশান।
এই নারী কার কাছে জানাবেন অভিযোগ?
রৌদ্র-জ্যোৎস্নার কাছে? বাতাসের কাছে?
বৃক্ষরাজি কিংবা আকাশের কাছে?
যারা ভরদুপুরে তার সত্তায় ছুঁড়ে দিয়েছে বৈধব্যের ধুধু শাদা,
তারা কি ক্ষমার ছায়ায় কাটাবে প্রহর?
যারা তার যৌবনের স্বপ্নমালাকে কুটি কুটি ছিঁড়ে
ফেলে দিয়েছে ধুলায়
তারা কি সুখস্বপ্নে থাকবে বিভোর?
যারা তার সংসারকে করেছে ক্রূশবিদ্ধ,
তারা কি হেঁটে যাবে নিষ্কন্টক পথে?
এইতো সেদিনও শোকাচ্ছন্ন নারীর শরীর
ভিজে উঠতো সুখী বৃষ্টিতে,
আজ শামিয়ানার নিচে বসে তিনি বারবার আঁচলে ঢাকছেন মুখ
দুপুর বারোটায়,
যেন দুঃখিনী বাংলাদেশ চোখ থেকে
অবিরত মুছে ফেলছে অশ্রুধারা।
১০।১২।৯০
নিশিডাক
নিশীথে আমাকে নিশিতে পেয়েছে ফের,
এ কার হস্তে বন্দী আমার ঘাড়?
মুণ্ডু চিবিয়ে খাবে টিবিটায় ব’সে;
পালাতে পারি না, এমন শক্তি তার।
গিলে খায় রাতে, দিবসে উগরে দ্যায়;
জারক রসের পিচ্ছিল কিছু দাগ
সত্তায় আঁকা, কশে তার হলাহল;
শয্যায় আজ উদ্যত কালনাগ।
অন্ধের মতো হেঁটে যাই অজ্ঞাতে,
ডাইনীর কটু পাচনের মতো নিশা।
রক্তে হাজার ঝিঁঝিঁ পোকা ডেকে যায়,
অমবস্যায় পাই না কোথাও দিশা।
মাটি ফুঁড়ে যেন বেরোয়া ঘুর্ণিঝড়,
ঝাঁকুনি ধরায় দেহের দেয়ালে চিড়।
ভেঙে চৌচির দিগন্ত- দর্পণ,
আকাশে আকাশে লাল সর্পের ভিড়।
মনে হয় কেউ সীমাহীন আক্রোশে
মাথাটা আমার কাদায় ফেলছে পুঁতে;
পাঁজরের খাঁচা ভাঙছে শাবল ঠুকে,
হাঁস ফাঁস শুধু, ভাসি বিচ্ছিরি মুতে।
চৌদিকে চলে ধ্বস্তাধ্বস্তি খুব,
কৌলীণ্যের ল্যাঠা গ্যাছে কবে চুকে;
বিলাসী ডিভানে গৌরী শায়িত একা,
পাহাড়ি শকুন চঞ্চু শানায় বুকে।
আমার আয়ুর মেয়াদ বৃদ্ধি হ’লে
ক্ষতি নেই শত নিশিডাক শুনলেও;
তার উদ্দেশে যাত্রা অব্যাহত,
আমার নিকটে কখনো আসবে সে-ও।
অদূরে মৃত্যু চাটছে নিজের ছায়া,
আঁধারে হীরক চির-ক্ষুধার্ত চোখ;
দীপ নেভানোর প্রতিভা মজ্জাগত,
সবার প্রাণেই গেঁথে দ্যায় গাঢ় শোক।
শহর ঘুমায়, কবির স্বস্তি নেই;
নিশীথে আমাকে পেয়েছে নিশিতে ফের,
রক্ত শোষণে মত্ত বাদুড় ঝোলে,
আমার শিরায় উৎপীড়নের জের।
৪।৩।৯০
নিয়ত স্পন্দিত
আমাকে টপ্কে তুমি যাও হে কোথায়? খাও টক
কুল ভর সন্ধ্যেবেলা। বই মেলায় যাবে বুঝি আজ
বাসন্তী রঙের শাড়ি প’রে? চায়ের দোকানে ব’সে
গল্মগুজবের স্রোতে ভেসে-যাওয়া, ফুচ্কা খাওয়া,
কখনও একটি দু’টি বই কেনা ফিরতি পথে, তুমি
জানবে না একজন কবি তোমাকে না দেখে দুঃখে
একা ঘরে কাটায় সময় বোদলেয়ারের সঙ্গে,
কখনও বা উদাস তাকিয়ে থাকে নক্ষত্রের দিকে,
বুকে তার এক রাশ অন্ধকার, সেখানে ফোটে না
এমুহূর্তে কিছুতেই ফুল কিংবা তারা। দাঁড়াশের
ছোবলে কাতর তার বিবাগী অন্তর; ঘরে ফিরে
জামা টামা খুলবে যখন পড়বে কি মনে তাকে,
যে তোমাকে হৃদয়ে রেখেছে ভ’রে অত্যন্ত গোপনে,
প্রতিটি নিঃশ্বাসে যার তুমি নিয়ত স্পন্দিত, মেয়ে।
১৯।২।৯০
নিয়ন্ত্রণ
সন্ত্রাসে বসন্ত কম্পমান; হনুমান লম্ফ ঝম্প দিয়ে
নিমেষে বাগান লন্ড ভন্ড করে, সন্ত ভীত, ম্ফীত
অন্ডকোষে পড়ে চাপ। প্রাণ যায়, মুত্রাশয় ফেটে
যাবে বুঝি পাইপের মতো; আকাঙ্খারা ছাই হ’য়ে
ওড়ে চতুর্দিকে, পুনরায় জড়ো করা অসম্ভব।
এখন কবন্ধদের গুঁতো খেতে খেতে কাঁটাবনে
হাঁটা ছাড়া উপায় কি আর? অন্ধকার দশদিক,
হাড়মাস গলে, চঞ্চু-নখরের ঘায়ে জব্দ চোখ।
স্ববশে কিছুই নেই। নিয়ন্ত্রণ, শুধু নিয়ন্ত্রণ
যত্রতত্র, বাল্যকাল, যৌবন, প্রৌঢ়ত্ব কন্টকিত
নিয়ন্ত্রণে। হাত মুষ্টিবদ্ধ করা, মুখ খুলে, হায়,
স্পর্ধিত এগিয়ে যাওয়া প্রবল বারণ। জিভ টেনে
ছিঁড়ে ফেলে দেয়ার উদ্দেশ্যে কত সান্ত্রী মোতায়েন।
নিয়ন্ত্রিত কত কিছু, এমনকি স্বপ্নও নিয়ন্ত্রিত।
১৭।২।৯০
নেকড়ের পালে একজন
অত্যস্ত নিঃসঙ্গ, নগ্ন; কম্পমান, কবচকুণ্ডল
হারিয়ে ফেলবে নাকি, দেখছে সে দন্ত-নখরের
অব্যাহত আঘাতে নিজের শরীরের খন্ডগুলি
এখানে সেখানে, দরদর রক্তপাত। শক্ত হাতে
মাটি আঁকড়ে রোখে ক্রমাগত হিংস্রতার স্বেচ্ছাচার,
দাঁড়বার জায়গা খোঁজে, উদ্ভাসিত নতুন স্ট্বাটেজি
অকস্মাৎ; নেকড়ের পাল যত পারে লাফ ঝাঁপ
দিক, দাঁত ভেঙে যাবে, চুর্ণ হবে সকল নখর।
নশ্বরতা চোখে নিয়ে বর্মহীন কোথায় সে যায়
ক্লান্ত নয়; যন্ত্রণা কর্পূর, একরত্তি ভয় নেই
বুকে, শুধু একটি চিবুক, ছলছলে দু’টি চোখ
ধ্যান ক’রে পথ চলে। দ্যাখে ধুলি ওড়ে, ইতস্তত
ছাগ-খুরে নাচে কত প্রতিভাবানের খুলি আর
সে প্রত্যহ বৈঠা বায় খরশান গহন নদীতে।
২৭।৩।৯০
পাখি
একটি পাখিকে খুঁজছি সেই কবে খেকে
শহরের গালিঘুঁজিতে আনাচে কানাচে সবখানে
তন্ন তন্ন করে খুঁজছি
কী সুন্দর দেখতে সেই পাখি আর গলায় স্বর্গীয় গান
পাখিটাকে খুঁজতে খুঁজতে আমার মাথায়
আলাস্কার এক স্তূপ বরফ
একটা নেকড়ে বরফ চিবিয়ে চিবিয়ে
খাওয়ার জন্য খাটিয়ে দেয় হিংস্রতার পাল
শহুরে গাছের পাতায় পাতায় রাখি কড়া নজর
প্রতিটি জানলায় বুলাই চোখ
দীর্ঘ ঘাস সরিয়ে দেখতে চাই সেই পাখির নাচানাচি
হায় আমার মনেই পড়েনি সে মৃত অনেক আগেই
১৫।১২।৮৯
বুদোয়ারে
আর কত করবো আমি নিভৃতে তোমার ইস্তেজার
সারাবেলা প্রতিদিন? এখন তোমাকে খুঁজে ফিরি
প্রষ্ফুটিত গোলাপ এবং গন্ধরাজে, ঝিরিঝিরি
হাওয়ার হেরেমে মেঘে নদীবক্ষে বেকারার
হৃদয়ে প্রকৃত পক্ষে। তবু আজো তোমার দিদার
স্থগিত, অথচ দেখি তোমাকেই বাসের ভিতরে
বসে-থাকা, দুপুরে রিকশায় অপরাহ্নে স্মিত ঘরে
ক্ষণিকের জন্য লুপ্ত মাতলামি সকল দ্বিধার।
এ-তুমি প্রকৃত তুমি নও কিছুতেই, যদি হতে
তাহলে হৃদয় পরবাসে কাটতো না এতকাল
বিভ্রমবশত সত্যি। যে হাত আমার দুষ্ট ক্ষতে
নিরাময় ছড়াবে রেণুর মতো, সে-হাত নাকাল
কেন হবে মারীবৎ স্বেচ্ছাচারে? প্রতিক্ষণ যাকে
চাই একাকিনী শান্ত বুদোয়ারে, সে কোথায় থাকে?
২৭।৪।৯০
বড়দিনের গাছ
কাঠ ছুঁয়ে রাখাই ভালো
প্রথমবারের মতো এই বিরতিহীন ষ্ফূরণ
নয় চকমকি ঠোকা প্রজাপতির অনুসরণও নয়
আমার ভেতর থেকে অজস্র পুঁতি আর
হীরের ঠিকরে-পড়া যেন মাটিতে লেগে বৃষ্টির লাফ
তাক-লাগানো রশ্মির বিচ্ছুরণ
আমি কি রঙিন কোনো ফোয়ারা
দিনরাত্তির জ্যোৎস্নাকণার মতো উৎক্ষিপ্ত
জলধারার উৎস নীল রঙের পাখি
আর জলকপোত চমৎকার স্নাত
সুস্থ সবল যুবক খঞ্জ প্রৌঢ় ঘাটের মড়া সবাই
অঞ্জলি পেতে নিচ্ছে তো নিচ্ছেই
যে দানোর দখলে আমি সে কখন এক ঝটকায়
আমার ঘাড় মটকায়
এই দুর্ভাবনার ফেউ আমার সঙ্গ ছাড়ে না
পবিত্রতার ঝলকময় মৌমাছিদের প্রশ্রয় চারপাশে
চিরন্তনতার মঞ্জীর ঝনঝনিয়ে
আমাকে বানায় ঘূর্ণ্যমান দরবেশ
হাওয়ায় হাত বাড়ালেই পাওয়া
পেয়ে যাই গাছের পাতা ছুঁলে
ঝিলে আলগোছে পা ভিজিয়ে নিলে
নিঃশ্বাস নিলে জানালার দিকে মুখ রেখে
দরজা খুলে দাঁড়ালে তার কথা ভাবলে
ক্যালেন্ডারের দোলখাওয়া পাতা থেকে পেয়ে যাই
এ কেমন ষ্ফূরণ তখন
সত্তা থেকে জ্যোতির্ময় নিঃসরণে বিস্মিত
নিজেই পারি না চোখ ফেরাতে
আমার চোখ থেকে দোয়েল পাঁজর থেকে বুলবুল এবং কান থেকে মুঠো মুঠো নক্ষত্র নিঃসৃত
এখন আমি বড়দিনের ঝলমলে গাছ
২২।৪।৯০
ভয় হয়
মনে হয়, কতকাল প্রেরণার আলোড়ন নেই
মনের গহনে, স্থবিরতা বসে আছে
মুখোমুখি, শব্দেরা গুঞ্জন তুলে চকিতে উধাও। কবিতার
খাতার উম্মুখ পাতা বিধবার শাদা
থানের মতোই থাকে। হঠাৎ তোমার মুখ জেগে
ওঠে, যেন তুমি এলে হৃদয়ে তরঙ্গ তুলে অলৌকিক কোন
হেমবর্ণ দ্বার খুলে। কী আশ্চর্য আমার সম্মুখে
উম্মোচিত কবিতার স্তন, নাভিমূল। ভয় হয়,
যদি সে হারিয়ে যায় কুয়াশায় তবে
কাকে খুঁজে বেড়াবো সর্বদা?
১৪।১২।৮৯
মিলনের মুখ
গুলিবিদ্ধ শহর করছে অশ্রুপাত অবিরত,
কেননা মিলন নেই। দিন দুপুরেই নরকের
শিকারী কুকুর তার বুকে বসিয়েছে দাঁত, বড়
নিঝুম স্থাপত্য আজ মিলনের প্রতিবাদী মুখ।
মিছিলে আসার আগে মায়ের স্নেহের ছায়া থেকে
তাড়াতাড়ি সরে এসে, স্ত্রীর প্রতি হাত নেড়ে, চুমো
খেয়ে শিশুকন্যাটিকে নেমেছিল পথে শুভ্রতায়
শহরের বন্দীদশা ঘোচাবার দুর্নিবার টানে।
এ শহর ছিল শৃঙ্খলিত, ভয়ংকর শৃঙ্খলিত
প্রতিটি মানুষ, ঘরদোর, গাছপালা পশুপাখি;
শেকল ভাঙার গানে কণ্ঠ মেলাতে মিলন নিজে
আগুন-ঝরানো গান হয়েছিল তপ্তজনপথে।
অকস্মাৎ আকাশে কে যেন দিল ঢেলে কালো কালি,
দুপুর সন্ধ্যার সাজ প’রে বিধবার মতো চোখ
মেলে চেয়ে থাকে আর আঁচলে সংগ্রামী স্মৃতি জ্বলে,
মিলনের মুখে বৃষ্টি নয়, বাংলার অশ্রু ঝরে।
১৪।১২।৯০
ম্যাগাজিনে আমার স্ত্রীর সাক্ষাৎকার প’ড়ে
ভাবতেই পারিনি, এমন গুছিয়ে-গাছিয়ে
বলতে পারবেন তিনি
এত কথা, যেন হাতের চেটোয়
মেহেদীর নক্শা। আমার বিষয়ে যা-যা
বলেছেন তাতে মনে হ’তে পারে
আমি প্রায় ফেরেশ্তা আর
যে-সারল্য আরোপ করা হ’য়েছে এই
বান্দার ওপর তা-ও
ষোলআনা ঠিক নয়। যুগ-সংকটের
জটিলতা আমার দোসর।
কোনো কিছু লেখার সময, গদ্য পদ্য যাই হোক,
আমি বার বার কাগজ দলামোচা ক’রে
ছুঁড়ে ফেলি বাজে কাগজের
ঝুড়িতে, তিনি বলেছেন। কী ক’রে অস্বীকার
করি, বলুন? কিন্তু এটাই
সব নয়, এ খবর যদি তিনি রাখতেন। তখন,
মানে, যখন টেবিলে ঝুঁকে
লিখি, আমার ভেতরে কত হাওয়াই সেতু
গুঁড়িয়ে যায়, টগবগানো লাভা
ক্রমাগত পোড়াতে থাকে আমাকে,
কেউ এই হতচ্ছাড়াকেই ব্যর্থ কাগজের মতো
দলামোচা করে প্রহরে প্রহরে।
আমার গৃহিণীর কি কখনো মনে হয় যে,
রতিবিহারের কালে ওর মুখে
অন্য কারো মুখ স্থাপন ক’রে সুখের সরোবরে
ডুবে যাই? না, ফেরেশতা টেরেশতা
আমি নই, পাক্কা শয়তানের শিরোপাও
আমার লভ্যনয়।
আমি নিজের মধ্যে এক দাউ দাউ মশাল
ব’য়ে বেড়াচ্ছি দিনরাত্রি, এ-ও
তার অজানা। জায়নামাজে ব’সে তিনি আমার
মঙ্গল কামনা করেন প্রত্যহ দু’হাত তুলে,
তখন ওর কাপড়-ঢাকা মাথা
নীলিমাকে স্পর্শ করার স্পর্ধা রাখে। আমি কি
তার এই নিষ্কলুষ ভঙ্গির যোগ্য? তিনি
প্রকৃত আমাকে পুরোপুরি চেনেন না আজো।
আমাকে নিয়ে নানা মুনির নানা মত,
কত জল্পনা কল্পনা। ওদের
প্রত্যেকের বলাবলি উপেক্ষা ক’রে, ব্যাঙআচিদের
অগুণতি লাথি অগ্রাহ্য ক’রে
আমার অস্তিত্ব বিদ্যমান হাই-রাইজ
দালানের ধরনে। সবার আন্দাজের বাইরে আমি।
এতকাল অন্তর্গত দ্রোহ, ক্ষোভ, বিষাদ,
আনন্দ আর ভালোবাসার
সান্নিধ্যে বেঁচে-বর্তে আছি গেরিলার মতো,
অথচ নিজেই সবচেয়ে কম জানি নিজেকে।
২৩।৩।৯০
যুদ্ধ সংবাদ
কখনো মৃত্যুই শ্রেয় মনে হয়; এই বেঁচে থাকা
বুকে পেসমেকার বসানো প্রৌঢ়বৎ নিরর্থক।
নিজেকে প্রত্যহ দেখি তীক্ষ্ণতায় আপাদমস্তক
ঝানু রেফারির মতো; ঘেন্না ধরে, সবকিছু ফাঁকা,
ফাঁপা, ঢোলা, যেন বালিশের ওয়ার বেঢপ; বাঁকা
চোখে দ্যাখে অনেকেই। বুঝি বা দ্রাবিড় যুগে ত্বক
ছেড়ে যৌবনের ঝাঁ ঝাঁ রোদ্দুরময়তা পলাতক;
মৃত্যু তার ন্যায্য অধিকার ক্রমশ করছে পাকা।
এখনো রয়েছি লিপ্ত যুদ্ধে অনিচ্ছায়। শক্তিধর
শক্ররা ছুঁড়ছে নানাবিধ অস্ত্রশস্ত্র অবিরত,
আমার নিজস্ব অবস্থান জেনো তবুও অনড়।
কী আশ্চর্য, কখনো খড়িশ শক্র, কখনো বা চেনা
বান্ধব সাজায় ব্যুহ একযোগে। বিভ্রমবশত
ভাবি হয়তো এই রক্তপায়ী যুদ্ধ আর চলবে না।
২৮।৩।৯০
যেখানেই হাত রাখি
যেখানেই হাত রাখি, হাত পুড়ে যায়
একটু বাড়ালে মুখ, মুখ ঝলসে যায়।
এমনকি লেখার টেবিল যেন গলানো
লোহার গনগনে পাত।
এখন কোথাও হাত রেখে স্বস্তি নেই। শহরের
গাছপালা ভীষণ উগরে দিচ্ছে তাপ,
জনপথ ফুটন্ত কড়াই, বাড়িগুলি
ড্রাগনের মতো দশদিকে
কেবলি ছড়িয়ে দিচ্ছে তরল আগুন।
তবে আমি কোন দিকে যাবো আজ?
কোথায় রাখবো হাত? মুখ
কী ক’রে বাঁচাবো আগুনের হল্কা থেকে?
তোমার হাতের নীড় খুঁজে পেলে, মেয়ে,
তোমার সুন্দর মুখ ঝুঁকে এলে মুখের উপর,
যোজন যোজনব্যাপী আগুনের দারুন আজাব
থেকে রক্ষা পেয়ে যাবো।
১২।২।৯০
লোকগুলোর কী হয়েছে
লোকগুলোর কী হয়েছে বলোতো
মুখে কুচকুচে অথবা ধবধবে দাড়ি দেখলেই
অথর্ব মোল্লা ঠাউরে নেয় আর
উশকো খুশকো চুল ময়লা ট্রাউজার
হলুদ উদাসীনতা-ছাওয়া
চোখ দেখলেই ছন্নছাড়া পদ্যলিখিয়ে
কী যে বোঝাতে চায় এই নিদ্রাচারীরা
ওরা নিজেরাই তার মর্মেদ্ধার
করতে পারবে কি না তা’ নিয়ে
বিস্তর জল্পনা কল্পনা করা যেতে পারে
ঘুমের জঠরে ক্ষণিক বসবাসকালীন সময়ে কী কী বলা হয়
জেগে ওঠার পর অবোধ্য তন্ত্র মন্ত্র
ওরা বলছে সমাজতন্ত্র কফিনে শায়িত
শেষ পেরেক ঠোকা খতম হয়ে এলো ব’লে
গির্জার পথেই মুক্তি হতে পারে সাবলীল
আমি বলি ব্যান্ডেজবাঁধা মাথা নিয়ে মার্কস এবং লেনিন
আকিদা আর মমতায় আগলে রাখছেন সমাজতন্ত্রকে
কবরের উপর সূর্যমুখী আশ্বাসের আভা
যা বলে বলুক লোকগুলো
ওদের কথামালাকে পাথর চাপা দেওয়া নিরর্থক
এক ঝটকায় সুন্দরের ঘাড় মটকে দেওয়া
সত্য-শিবের পশ্চাদ্দেশে কালি মেখে উদ্বাহু নৃত্য
কুবাক্যসমূহকে সুসমাচারের আদলে
পেশ ক’রে হাওয়ায় ছড়িয়ে দেওয়া ওদের পেশা
ওদের প্রত্যেকের হাতে বিষঝরানো তীরধনুক
আমি কি ক্ষমা করতে পারবো ওদের
যাদের বাক্যশলাকায়
আমার কবিতা জর্জরিত ছটফটানো দুলদুল
যেভাবে হোক আগলে রাখা চাই
কবিতা আর পবিত্র সব লক্ষ্যবস্তুকে
লোকগুলোর যে কী হয়েছে
সূর্যের মুখে ওরা আলকাতরা লেপে দিতে উদ্যত
নক্ষত্রগুলো উপড়ে ফেললে ওরা হৈ হৈ মরদ
লোকগুলোর মুদ্রা আমি ওদেরই ফিরিয়ে দেবো
অসম্ভব নিশ্চুপ থাকা এই কালবেলায়
আমার কণ্ঠস্বর আজ ঈগলের উড়াল সবখানে
২৪।৪।৯০
শাশ্বতীর আঁচল
শাশ্বতীর আঁচল মুঠোয় আনার ব্যাকুলতা নিজিনস্কি-নাচ
আকাশ কালপুরুষ আর মাটি
গাছপালা নদীনালা পালতোলা নৌকা
আলোজ্বলা ফ্ল্যাট ক্ষয় রোগীর পাঁজরবৎ
পুরানো বাড়ি শ্যামা পাখি বিখ্যাত গ্রন্থমালা কবিতা
এবং কয়েকটি প্রিয় মুখ আমার নিজস্ব জগৎ
আমার হাত আর শাশ্বতীর আঁচলের মাঝে
আছে-কি নেই সেতু কম্পমান ঝালর
আকাশ বলে এমন একদিন আসবে
আমি তোমার থাকবো না
তলোয়ার-উঁচানো কালপুরুষ বলে মুছে যাবো
তোমার দৃষ্টি থেকে
গাছ-গাছালি নদীর ঢেউ নৌকার দোলা
পুরানো বাড়ির খিলান শ্যামা পাখির গান
গ্রন্থরাজি আর কবিতার কোরাস
রঙিন বুদ্বুদের উপর দাঁড়িয়ে
আমার কানে ঢালে প্রত্যাখ্যানের
উচ্ছের রসের মতো সুর
এমন দিন আসবে যেসব মুখ
এক মুহুর্ত না দেখলে
আমার বুক ভ্রুকম্পন
এমন দিন আসবে সেদিন আমার চিরন্তন অন্ধতা
এবং তাদের উপস্থিতির মধ্যে
অস্তহীন বিচ্ছেদ
মাটির মাতৃত্বময় মেঘমেদুর উচ্চারণ
আমার গভীর তোমার নাড়ি
তোমার জন্য আমার বুক প্রতীক্ষার ঘর
অথচ শাশ্বতীর ছলনার শাড়ির দিকে
পৌষ সংক্রান্তির দিনে কাটা ঘুড়ি ধরতে যাওয়া বালকের হাতের
মতো বাড়ানো আমার ব্যাকুলতা
২১।৪।৯০
শ্বাস-প্রশ্বাস
কোথাও একটা কিছু গলদ রয়েছে সুনিশ্চিত,
নইলে কেন এত ছটফটানি এবং কাতরানি আশেপাশে?
না, না, কারারুদ্ধ নই; এ শহরে যখন যেখানে খুশি
হেঁটে যেতে পারি, ইচ্ছে হ’লে
প্রত্যহ সকালবেলা ভ্রমণে বেরিয়ে পড়া যায়
যথারীতি, সন্ধ্যেবেলা স্ন্যাকবারে, রাত্তিরে কোথাও
রেস্তোরায়ঁ ব’সে থাকা অসম্ভব নয়। মাঝে-মাঝে
ফুলের সুঘ্রাণ পেলে ভালো লাগে আর
টেলিফোনে মানোমুগ্ধকর
কথোপকথনে বেলা ব’য়ে গেলে খুশি।
অথচ কেন যে প্রায়শই অস্বস্তির কাঁটাগুলি
বেড়ালের নখরের মতো
ক্রমাগত ভীষণ আঁচড় কাটে অস্তিত্বে আমার। সন্ত্রাসের
কী ব্যাপক বিদঘুটে থাবার তলায়
দিন যায়, রাত কাটে। হায়েনারা মানচিত্র নিয়ে
স্বেচ্ছাচারী, নেকড়ের পালের কামড়ে
ফালা ফালা স্বপ্নের পতাকা। কখন যে
নিজেই নিজের বমি হাভাতের মতো গিলি খেয়াল থাকে না।
কয়েদখানায় নয়, বাইরেই আছি। তবু কেন স্বাভাবিক
প্রক্রিয়ায় অক্সিজেন টেনে নিতে পারি না সম্প্রতি
প্রহরে প্রহরে আর? দম বন্ধ হ’য়ে আসে, শুধু
হাঁসফাঁস; কারা যেন মুখের উপর
খুব জোরে চেপে ধরে নিরেট বালিশ,
যেমন সুদক্ষ খুনী কাজ সারে অবলীলাক্রমে। প্রাণপণ
চিৎকার করতে গিয়ে দেখি
সকল আওয়াজ স্তব্ধ, বুক ফেটে যায়।
১৮।২।৯০
সত্যি-বলতে
সত্যি-বলতে আজকাল যে যার মর্জিমাফিক
আমার কবিতার গালে ঠিক গুনে গুনে
ঠাস ঠাস চড় চাপড় লাগিয়ে দ্যায়। কেউ পানের
পিক ছোঁড়ে মুখে, গলা ধাক্কা, গুঁতো,
পাক্কারদ্দা আছে লেগে। কেউ
মোড়লী চালে কান মুচড়ে নিজের তপ্ত মেজাজে
ঢালে ঠাণ্ডা পানি। কেউবা ফেউ লেলিয়ে
পরখ করে, কান্না জুড়ে দ্যায় কিনা অভিমানী
আমার পংক্তিমালা। মাতব্বর
সেই লোক, হ্যাঁ, হ্যাঁ, যে রাষ্ট্বপতিকে নিজের বাপের চেয়েও
কদর করে বেশি, ঘাসের সাপের ধরনের
সেই লোক, আমার কবিতার
একটি হাত খসিয়ে র্যা কেট বানিয়ে টেনিস
খেলতে শুরুকরে।
অন্যজন পাঁজরের হাড় খুলে নিয়ে
পগার পার, পাঁড়মাতাল
এক মুরগীচোর আমার নগ্ন কবিতার ঠ্যাঙ ধ’রে
করে টানাটানি, মারে ল্যাঙ। এক লেজযুক্ত
সজ্জন সাফ সাফ ব’লে দিলো আমার সদ্য-লেখা
পংক্তিমালাকে, ‘এই যে শুনছিস, যার
হাত থেকে উৎসারিত তোরা, সেই উজবুক
খাসির গোশ্তের মতো মৃত
এক দশক আগে। বিশ্বাস হচ্ছে না বুঝি? দাঁড়া
বেকুবের দল, কে আছিস তাড়াতাড়ি
আলমারি থেকে বের ক’রে আন ওর ম্রিয়মাণ কংকাল।
এরই ফাঁকে বেশ্যালয়-ফেরত এক মাস্তান
বেলফুল জড়ানো হাতে
আমার কবিতার মুণ্ডু লোফালুফি
ক’রে চিবুতে থাকে, যেন কচকচ খাচ্ছে টোমাটো।
পাড়ার পাঁচজনের এই কাণ্ড কারখানা দেখে
কবিতা আমার বেদম হাসে, হেসেই খুন, যেন সার্কাসে
কয়েকটি বেবুন জবর লাফাচ্ছে, দিচ্ছে সুড়সুড়ি,
কাতুকুতু, থুতু ছিটোচ্ছে যেখানে সেখানে,
ভেংচি কাটছে, ইত্যাদি।
ব্যপারটা এরকম, দেখে-শুনে কিন্তু মনেই
হয় না পিলে চমকে-দেওয়া এক জন্তু আমাদের গিলে
খেতে এগিয়ে আসছে হেলে দুলে,
লেজ আছড়ে কাঁপাচ্ছে মাটি।
২১।২।৯০
সৌন্দর্যের স্পর্ধা নিয়ে
অগ্রসরমান, অগ্রসরমান, অগ্রসরমান, অতি দ্রুত
চতুর্দিক থেকে
নিরেট দেয়াল, সত্তা-চেপে-ধরা, দম-বন্ধ করা;
দেয়ালের গায়ে সংখ্যাহীন
সনাতনী উদ্যত তর্জনী, নিত্যদিন তার হাসি মুছে-ফেলা।
কেউ কেউ ঢেলা ছুঁড়ে মজা লোটে, কেউবা শাসায়
সর্বক্ষণ নানা ছলছুতোয়, সে নারী মাথা কোটে
বিরূপ বাসায়, ছেঁড়া সুতোয় সেলাই করে পীড়িত যৌবন।
কপালে, কোমরে, বুকে, হাতের চেটোয়, দু’টি পায়ে
জন্মান্ধ পেরেক ঠুকে দিচ্ছে বর্বরেরা; অট্রহাসি,
উপহাস অবিরত, থুতু এবং দেয়ালঘেরা
জীবন হাঁপায় জীর্ণ হাপরের মতো,
তৃতীয় প্রহরে
তার ফোঁপানিতে
উনিশ শো নব্বই সালের ধুকপুক, বুকফাটা
আওয়াজ, দূরন্ত বাজপাখি
চক্রাকারে উড়ে
ঠুকরে ঠুকরে খায় তার আর্ত হৃৎপিণ্ড অবেলায়।
অলৌকিক কিছু ঘটবে না। ‘ধিক তোকে, এই ধ্বনি
অন্ধকার থেকে
উথিত, সে ত্রস্ত ভীত, ক্লান্ত, মূক মুখ
হাতে ঢাকতেও পারছে না। গলগল
রক্তবৃষ্টি, বিফল গোধূলি, বিচ্ছিন্নতা মহাগ্রাস;
এক্ষুনি থামাও নারকীয় ক্রিয়াকর্ম, আলগোছে
নামাও তোমরা ওকে পীড়নের মঞ্চ থেকে, ঢেকে
দাও ওর কান্নায় উথলে-ওঠা ক্ষত
জ্যোৎস্না-চন্দ্রনের মসলিনে কতকাল
যন্ত্রণা পাঁজর খুলে নিয়ে
সাজাবে কংকালকীর্ণ উদগ্র উদ্যান? ধ্যান তার
প্রখর অঙ্কুশে বিদ্ধ, কবিতার ভ্রূণাবস্থা কাটে
কালেভদ্রে এ দারুণ জন্মের খরায়। আছড়ায়
অস্তিত্বকে শুধু ড্রাগ ত্র্যাডিক্টের মতো।
কোথাও প্রহরী নেই, তবু
সতর্ক পাহারাদার সবদিকে। সন্ধিগ্ধ, খণ্ডিত আসমান,
অবিরত লাঠি ঠোকা, চোখা, একরোখা বল্লমের অন্ধ ক্রোধ;
উনুনের পোড়া দাগ কাঁটার্ত চোখের
নিচে, আপাতত শায়িতা সে,
আহত সৌন্দর্য নিয়ে বিপন্ন, বিব্রত; স্নায়ুগুলো
ছটফটে, যেন বাইপাস সার্জারির
সুঁচোলো অপেক্ষা, ঝুঁকে-থাকা কিছু পাহাড়ি শকুন,
পক্ষীতত্ত্ববিদের বিষয়ে উদাসীন,
ছড়ায় আগ্রাসী ছায়া চঞ্চু নেড়ে নেড়ে। মুহূর্তেরা
চূর্ণ কাচ, ছেঁড়া-খোঁড়া স্বপ্ন, ভূলুণ্ঠিত
সৌন্দর্যের স্পর্ধা নিয়ে সে কি টান টান উঠে
দাঁড়াবে আবার?
১৫।৩।৯০
স্বপ্নচারিতায়
খুব ফিকে গাঁদা রঙের বিকেল। চোখ চোলা,
মন ডুবুরীর আঁটো পোশাক পরেছে
নিরিবিলি; আমাকে কি মানায় এখন জেগে
স্বপ্ন দেখা? দেখি অকস্মাৎ ঘরে এসে, হে নবীনা,
তুমি একগুচ্ছ ফুল তুলে দিতে হাতে
ঋজু স্মিত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে। কিছুক্ষণ ছিলে বসে
দূরে টুকরো টাকরা কথা, আমার গতায়ু
যৌবনের শুশ্রুষায় নিজেকে নিয়োগ
করেছিলে বুঝি, নয়তো কী ক’রে আবার
আমার ভেতর যুবা বয়সের দিনগুলি
আড়মোড়া ভাঙে? কখন যে বাড়াই তোমার দিকে হাত,
শুধু রিক্ত পাঁচটি আঙুল স্পর্শ করে শূন্যতাকে।
তুমি চ’লে যাবার পরেও বসে থাকো
সম্মুখ চেয়ারে
আমার মুখস্থ-করা সেই ভঙ্গিমায়। হেঁটে যাই
তোমার ভেতর দিয়ে স্বপ্নচারিতায়
কোনো এক বেনামি নগরে। কেউ দেখে না, শোনে না
কিছু, শুধু নিজে জানি, তুমিহীনতায়
তুমি থাকো পবিত্র সৌরভ হয়ে এবং তোমার করতলে
লোর্কার কমলালেবু, ঠোঁটে নেরুদার প্রজাপতি।
আমার পাঁজর ফুঁড়ে রক্তের ফোয়ারা টেবিলের
গোলাপকে আরো বেশি লাল ক’রে তোলে আর দেয়ালের সাদা
থেকে পেরেকের ক্ষতচিহ্নসহ
নিঃশব্দে ওঠেন জেগে যীশু,
তর্জনী উচিয়ে
আমাকে দেখিয়ে দেন ক্রূশকাঠ, উচ্চারিত হয়
‘বও, বয়ে যাও তুমি বিরামবিহীন। গলগোথা
গন্ধে ভরে যায় ঘর, লাল জোব্বা, হায়,
প’ড়ে আছে পুরোনো মেঝেতে, বুড়ো সুড়ো
কারো খুব কুষ্ণিত ললাটরেখা, কে এক নারীর
দু’গালে গড়িয়ে পড়ে কী করুণ পানি; কারা যেন
জুয়ো খেলে চ’লে গেছে, দিব্যকান্তি গাঁথা ক্রূশকাঠে।
কখনো তোমাকে শুনি, শোনাই তোমাকে
কখনো-বা, তোমার মধুর কণ্ঠস্বরে মুছে যায়
আমার অতীত আর তোমার নীরব ফুলগুলি
কী বাঙ্ময় ঝুঁকে থাকে আমার উদ্দেশে। তোমারও কি
এমন ধরন? কিছুকাল
পরে কথাচ্ছলে প্রশ্ন করি, ‘সেদিন বিকেলবেলা
এসেছিলে নাকি? স্মিত ঠোঁটে
বললে তুমি, ‘কই, না তো। কে খবর দিলো মিছেমিছি?’
বেজে ওঠে যেন স্যাল্ডেলিয়ার কোথাও
এবং তোমাকে ঘিরে থাকে গীতবিতানের বিভিন্ন মুর্চ্ছনা।
১৪।২।৯০
স্বপ্নজীবী
নিদ্রার জরায় ছিঁড়ে বেরোয় স্বপ্ন
কানকো উন্টিয়ে মাছ পরখ করার মতো
স্বপ্নের বিশ্লেষণে মনোযোগী হই
অস্পষ্টস্মৃত ভগ্মংগুলো পিছলে যায় মাছেরই ধরনে
তারা- ঝোপের ভেতর থেকে লাফিয়ে পড়ে বেড়াল
রাত্রি আর বেড়ালের এমন ফষ্টিনষ্টি কখনো দেখিনি
অবশ্য স্বপ্নজীবী
জাগরণের পরেও মাথা ফাঁকা দেখলে
সিঁধেল চোর স্বপ্ন আবার ঢুকে পড়ে হঠাৎ
চোখের পশ্চাদ্দেশে হাত বুলোয় নাক ঘষে
তখন বিশ্ব এবং আমার পরিচয়ের উপর
যবনিকা পতন
বালিশ চুমো খায় মাথাকে
মাথা হাওয়াকে আর হাওয়া আমার চুল
চোখ কান নাক পাঁজর নখ
বুকের রোমরাজি আর নিদ্রাতুর শিশ্নকে
শিশ্ন স্বপ্নের ছ্যাঁদায় সুড়সুড়ি দেয়
এবং স্বপ্ন এখন রজস্বলা
২১।৪।৯০
স্বাতন্ত্র্য
আমি কি স্বতন্ত্র্য কেউ? নাকি আগাগোড়া একই ছাঁচে
গড়াপেটা? আ দশজনের প্রতিভু? নিয়ন্ত্রিত
নড়া চড়া, দমদেওয়া বিবর্ণ পুতুল? বুলবুল
ভুলক্রমে জানালার গ্রিলে এস বুকের রেশম
মেলে দিলে আমার নিজের বুক বেশি ধুক ধুক
করবে না? অগোচরে থেকে যাবে সংবাদপত্রের
অন্তরালে জলকন্যা? কবিতা আমাকে অবহেলা
ছুঁড়ে দিয়ে নিছক কর্পূর, তুব উঠবো না কেঁপে?
অকাম্য এমন পরিণাম; ঠিক ঠাক দাগ মেপে
ওষুধ খাওয়ার মতো জীবন যাপন খাক হোক
চুল্লীতে, আমার চাই খাদের কিনারে ঝুলে-থাকা
অত্যন্ত বিপজ্জানকভাবে কিংবা দ্রোহী সমুদ্রের
মধ্যখানে,বড় একা, ক্ষুধার করাতে ফালা ফালা,
মৃত্যুর চোয়ালে ব’সে ঝটকায় পাখি টেনে আনা।
১৩।৪।৯০
হতাশার ঘরে
ধুর্তামি, ভণ্ডামি আজ প্রবল বিগ্রহ। অবেলায়
কাদায় ডুবেছে চাকা। একে একে অনেকে স্খলিত,
দিশেহারা; অবশেষে তুমিও কি হবে নিমজ্জিত,
হায়, চোরাবালিতেই? খুঁজবে আশ্রয় সাহারায়?
এখন অপ্রতিরোধ্য ধ্বংসের বিপুল কিনারায়
ছুটছে লেমিং গুলো; সুচতুর শিকারী হারপুন
দিচ্ছে গেঁথে মুক্তিকামী ভেসে-ওঠা পিঠে কী নিপুণ;
ডোবে দেশ ক্রমশ কৃত্রিম আধ্যাত্মিক ধোঁয়াশায়।
কফিন কবর ডাকে প্রতিদিন কোকিলের স্বরে,
অথচ এগুতে হবে ঝেড়ে ফেলে সব পিছুটান।
খ্যাতির বাইজী খুব লাস্যময়ী ঢঙে টানে আর
মূর্খের বন্দনা ফিঙে হ’য়ে নাচে, মস্তির দোকান
হৈহুল্লোড়ে ভরপুর। দুর্বিষহ হতাশার ঘরে
ঠাঁই পাই; গোলক ধাধাঁয় চোখে দেখি অন্ধকার।
২২।৩।৯০
হরিণী-কবিতা
সুন্দরবনের রোদ-চকচকে হিরণ পয়েন্টে যে হরিণী
জলপানে মগ্ন সেই কবে, পুনরায়
যেন সে বিদ্যচ্চমক কবিতার রাজধানীতে সকালবেলা;
এ-ও এক খেলা তার শহরকে জড়িয়ে শরীরে।
অনির্বচনীয় রূপ নিয়ে একগা হরিণী যায়
কবি সম্মেলনে হেঁটে যায় সাবলীল, মহিমার
ছটা তার সত্তা থেকে বিচ্ছুরিত; হঠাৎ উধাও।
এদিক ওদিক খুঁজি, বুক চিরে ট্রেন দূরগামী, চতুর্দিকে
সুচতুর শিকারীর ফাঁদ পাতে বন্দুকের ট্রিগারে আঙুল
রেখে ঘোরে ইতস্ততঃ। হরিণীর কোথায় তেমন বর্ম যাতে
সহজে পিছলে যাবে ঝাঁক গুলী?
ওদের সকল তাক যাক ফস্কে যাক।
অকস্মাৎ হরিণীকে দেখি উত্তাপ উপেক্ষা ক’রে
চলেছে ব্যানার ছুঁয়ে কবির মিছিলে, গায়ে তার
বাংলার মখমলী গাঢ় সবুজিমা, এমন সুন্দর টিপ
কোথায় সে পেলো? কাঁচপোকা
ব’সে আছে মসৃণ কপালে?
গলায় নিবিড় লগ্ন নক্ষত্রের মালা,
দু’চোখে বিলীয়মান স্বপ্নের অস্পষ্ট দীর্ঘশ্বাস,
যেন সে লাফিয়ে ওঠা শিখা, প্রতিবাদে
স্পন্দিত সৌন্দর্য ক্ষণে ক্ষণে,
চম্কে তাকায় রৌদ্রে স্নাতা। অদূরে দাঁড়িয়ে দেখি
তাকে, দেখে সে-ও, পরস্পর চোখাচোখি, বুঝি এক
মধুর মালিন্যহীন গোপন দাঁতাত।
জানি আজ প্রকৃতির অভিষেক হবে তার হাতে
আবার নতুন ক’রে। চলায় ছিলো না দ্বিধা, পথে
পুলিশের ভ্যান,
তবু দৃক্পাতহীন চলেছি সম্মুখে, তার গায়ে
আঁচড় লাগলে কোনো আমার হৃদয়
বিষম আহত হবে, অশ্রু হ’য়ে ঝরবে শোণিত
সারাক্ষণ, চাই না কখনো তার সৌন্দর্য ভুলেও
অন্ধকার মর্গে যাক। সে থাকুক বেঁচে রোদবৃষ্টি বুকে নিয়ে
দীর্ঘজীবী কবিতার মতো সজীব, নিটোল। নিত্যদিন
আমার জীবদ্দশায় হোক সে অধিক বন্দনীয়।
হরিণী অক্ষরবৃত্তে এগোয় মঞ্চের দিকে, মাইক্রোফোনের
মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কবিতা পড়ে। শব্দাবলী থেকে
যন্ত্রনা গিয়েছে ঝ’রে, পথকষ্ট মুছে গেছে, লুপ্ত স্বেদমুক্তো;
কবিতা পাঠের কালে নিজেই কবিতা হ’য়ে জ্বলে
সুবিশাল সমাবেশে পিন-পড়া স্তব্ধতায়। হ্রদের পানির
মতো স্বচ্ছ বাক্য রাত্তিরে লতিয়ে ওঠে, আখেরে চকিতে
কখন যে নেমে আসে, চ’লে যায়, ‘হরিণী-কবিতা’
ব’লে আর্তনাদ করি, তাকায় না ফিরে। আমি কুকুরের মতো
কী ব্যাকুল চুমো খাই চিহ্নহীন পদাচিহ্নে তার। একা-একা
যতি, ছেদ, পর্বসহ তাকেই মুখস্থ করা নিয়তি আমার।
কে ডাকে আমাকে মধ্যরাতে? কে এক অকালমৃত কবি
লেখার টেবিল থেকে ওঠে এস যেন
শয্যা ত্যাগ করার নির্দেশ দিয়ে ডেকে নেন কাছে।
মুখ তাঁর, মনে পড়ে, ‘ক্লেদজ কুসুম’ গ্রন্থটির
অন্তর্গত; ব্যথিত ফ্যাকাশে। স্থির হও, বসো তুমি
এখানে চেয়ারে, লেখো একটি সনেট
নিষাদে, নির্বেদে ভরপুর। যাকে চাও
সে হরিণী নাকি অমল কবিতা, সে তোমার
কোনোদিন হবে কিনা ভেবে কষ্টে বিবর্ণ হয়ো না।
আমার মতোই, হাতে তুলে নাও এখুনি কলম;
থাকবো না বেশিক্ষণ, ঢুকবো কফিনে পুনরায়,
‘বিদায়, বিদায়’ ব’লে তিনি ঘন কুয়াশায় ট’লে ট’লে
মিশে যান। নির্ঘুম, স্তম্ভিত ব’সে থাকি
কিছুক্ষণ বড় একা। কবিতা-হরিণী ধরা দিয়ে চ’লে যায়।
১৭।২।৯০