- বইয়ের নামঃ পুবের হাওয়া
- লেখকের নামঃ কাজী নজরুল ইসলাম
- প্রকাশনাঃ তরিকতে আহ্লে বাইত বাংলাদেশ
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
অবসর
লক্ষ্মী আমার! তোমার পথে আজকে অভিসার,
অনেক দিনের পর পেয়েছি মুক্তি-রবিবার।
দিনের পর দিন গিয়েছে হয়নি আমার ছুটি,
বুকের ভিতর ব্যর্থ কাঁদন পড়ত বৃথাই লুটি
বসে ঢুলত আঁখি দুটি!
আহা আজ পেয়েছি মুক্ত হাওয়া
লাগল চোখে তোমার চাওয়া
তাইতো প্রাণে বাঁধ টুটেছে রুদ্ধ কবিতার।
তোমার তরে বুকের তলায় অনেক দিনের অনেক কথা জমা,
কানের কাছে মুখটি থুয়ে গোপন সে-সব কইব প্রিয়তমা!
এবার শুধু কথায় গানে রাত্রি হবে ভোর
শুকতারাতে কাঁপবে তোমার নয়ন-পাতার লোর
অভি-মানিনীরে মোর!
যখন তোমায় সেধে ডাকবে বাঁশি
মলিন মুখে ফুটবে হাসি,
হিম-মুকুরে উঠবে ভাসি
অরুণ ছবি তার।
আশা
মহান তুমি প্রিয়
এই কথাটির গৌরবে মোর চিত্ত ভরে দিয়ো।
অনেক আশায় বসে আছি যাত্রা-শেষের পর
তোমায় নিয়েই পথের পারে বাঁধব আমার ঘর –
হে চির-সুন্দর!
পথ শেষ সেই তোমায় যেন করতে পারি ক্ষমা,
হে মোর কলঙ্কিনী প্রিয়তমা!
সেদিন যেন বলতে পারি, ‘এসো এসো প্রিয়,
বক্ষে এসো এসো আমার পূত কমনীয়!’
হায় হারানো লক্ষ্মী আমার! পথ ভুলেছ বলে
চির-সাথি যাবে তোমার মুখ ফিরিয়ে চলে?
জান ওঠে হায় মোচড় খেয়ে চলতে পড়ি টলে –
অনেক জ্বালায় জ্বলে প্রিয় অনেক ব্যথায় গলে!
বারে বারে নানান রূপে ছলতে আমায় শেষে,
কলঙ্কিনী! হাতছানি দাও সকল পথে এসে
কুটিল হাসি হেসে?
ব্যথায় আরো ব্যথা হানাই যে সে!
তুমি কি চাও তোমার মতোই কলঙ্কী হই আমি?
তখন তুমি সুদূর হতে আসবে ঘরে নামি –
হে মোর প্রিয়, হে মোর বিপথগামী!
পথের আজও অনেক বাকি,
তাই যদি হয় প্রিয় –
পথের শেষে তোমায় পাওয়ার যোগ্য করেই নিয়ো॥
নিকটে
বাদলা-কালো স্নিগ্ধা আমার কান্ত এল রিমঝিমিয়ে,
বৃষ্টিতে তার বাজল নুপূর পায়জোরেরই শিঞ্জিনী যে।
ফুটল উষার মুখটি অরুণ, ছাইল বাদল তাম্বু ধরায়;
জমল আসর বর্ষা-বাসর, লাও সাকি লাও ভর-পিয়ালায়।
ভিজল কুঁড়ির বক্ষ-পরাগ হিম-শিশিরের আমেজ পেয়ে
হমদম! হরদম দাও মদ, মস্ত্ করো গজল গেয়ে!
ফেরদৌসের ঝরকা বেয়ে গুল-বাগিচায় চলচে হাওয়া,
এই তো রে ভাই ওক্ত খুশির, দ্রাক্ষারসে দিলকে নাওয়া।
কুঞ্জে জরীন ফারসি ফরাস বিছিয়েচে আজ ফুলবালারা,
আজ চাই-ই চাই লাল-শিরাজি স্বচ্ছ-সরস খোর্মা-পারা!
মুক্তকেশী ঘোর-নয়না আজ হবে গো কান্তা সাকি,
চুম্বন এবং মিষ্টি হাতের মদ পেতে তাই ভরসা রাখি!
কান্তা সাথে বাঁচতে জনম চাও যদি কওসর-অমিয়,
সুর বেঁধে বীণ সারেঙ্গিতে খুবসে শিরীন শরাব পিয়ো!
খুঁজবে যেদিন সিকান্দারের বাঞ্ছিত আব্-হায়াত কুঁয়ায়,
সন্ধান তার মিলবে আশেক দিল-পিয়ারার ওষ্ঠ চুমায়!
খামখা তুমি মরছ কাজী শুষ্ক তোমার শাস্ত্র ঘেঁটে,
মুক্তি পাবে মদখোরের এই আল-কিমিয়ার পাত্র চেটে!
নিরুদ্দেশের যাত্রী
নিরুদ্দেশের পথে যেদিন প্রথম আমার যাত্রা হল শুরু
নিবিড় সে কোন্ বেদনাতে ভয়-আতুর এ বুক কাঁপল দুরু দুরু।
মিটল না ভাই চেনার দেনা, অমনি মুহুর্মুহু
ঘর-ছাড়া ডাক করলে শুরু অথির বিদায়-কুহু –
উহু উহু উহু!
হাতছানি দেয় রাতের শাঙন,
অমনি বাঁধে ধরল ভাঙন,
ফেলিয়ে বিয়ের হাতের কাঙন –
আমি খুঁজি কোন্ আঙনে কাঁকন বাজে গো!
বেরিয়ে দেখি, ছুটছে কেঁদে বাদলি হাওয়া হু হু,
মাথার ওপর দৌড়ে টাঙন, ঝড়ের মাতন,
দেয়ার গুরু গুরু।
পথ হারিয়ে কেঁদে ফিরি, ‘আর বাঁচিনে!
কোথায় প্রিয় কোথায় নিরুদ্দেশ?’
কেউ আসে না, মুখে শুধু ঝাপটা মারে
নিশীথ-মেঘের আকুল চাঁচর কেশ!
‘তালবনা’তে ঝঞ্ঝা তাথই হাততালি দেয়, বজ্রে বাজে তূরী,
মেখলা ছিঁড়ি পাগলি মেয়ে বিজলি-বালা নাচায় হিরের চুড়ি
ঘুরি ঘুরি ঘুরি
(ও সে) সকল আকাশ জুড়ি!
থামল বাদল রাতের কাঁদা,
ভোরের তারা কনক-গাঁদা,
ফুটল, ও মোর টুটল ধাঁধা –
হঠাৎ ও কার নূপুর শুনি গো?
থামল নূপুর, ভোরের তারাও বিদায় নিল ঝুরি!
এখন চলি সাঁঝের বধূ সন্ধ্যাতারার চলার পথে গো!
আজ অস্তপারের শীতের বায়ু কানের কাছে বইছে ঝুরু ঝুরু॥
পথিক বঁধু
আজ নলিন-নয়ান মলিন কেন বলো সখী বলো বলো!
পড়ল মনে কোন্ পথিকের বিদায়-চাওয়া ছলছল?
বলো সখী বলো বলো!!
মেঘের পানে চেয়ে চেয়ে বুক ভিজালে চোখের জলে,
ওই সুদূরের পথ বেয়ে কি চেনা-পথিক গেছে চলে
ফিরে আবার আসব বলে গো?
স্বর শুনে কার চমকে ওঠ (আহা),
ওগো ওযে বিহগ-বেহাগ, নির্ঝরিণীর কলকল।
ও নয় গো তার পায়ের ভাষা (আহা)
শীতের শেষের শুকনো পাতার ঝরে পড়ার বিদায়-ধ্বনি ও;
কোন্ কালোরে কোন্ ভালোরে
বাসলে ভালো (আহা)
পরদেশি কোন্ শ্যামল বঁধুর শুনচ বাঁশি সারাক্ষণই গো?
চুমচো কারে? ও নয় তোমার পথিক-বধুঁর চপল হাসি হা-হা,
তরুণ ঝাউয়ের কচি পাতায় করুণ অরুণ কিরণ ও যে (আ-হা)!
দূরের পথিক ফিরে নাকো আর (আহা আ-হা)
ও সে সবুজ দেশের অবুঝ পাখি
কখন এসে যাচবে বাঁধন, চলো সখী ঘরকে চলো!
ও কী? চোখে নামল কেন মেঘের ছায়া ঢল ঢল॥
পথিক শিশু
নাম-হারা তুই পথিক শিশু এলি অচিন দেশ পারায়ে।
কোন নামের আজ পরলি কাঁকন? বাঁধনহারার কোন্ কারা এ?
আবার মনের মতন করে
কোন নামে বল ডাকব তোরে?
পথভোলা তুই এই সে ঘরে
ছিলি ওরে, এলি ওরে বারে বারে নাম হারায়ে।
ওরে জাদু, ওরে মানিক, আঁধার ঘরের রতন-মণি!
ক্ষুধিত ঘর ভরলি এনে ছোট্ট হাতের একটু ননী।
আজ কেন রে নিবিড় মুখে
কান্না-সায়র উথলে বুকে?
নতুন নামে ডাকতে তোকে
ওরে কে কণ্ঠ রুখে? পাঁচ-ফাগুনের জুঁই-চারা এ!
আজ মন-পাখি ধায় মধুরতম নাম আশিসের শেষ ছাড়ায়ে।