মেয়েটা যদি সোজা কিংবা বাম দিকে যায় তাহলে সেইকি গাড়ি চালিয়ে বাসায় চলে যাবে। কালকে অফিস ছুটি। সারাদিন বাসায় বসে আরাম করা যাবে।
কিন্তু মেয়েটা যদি এদিকে আসে…
একটা শুকনো পাতা খসে জানালার উপর টোকা দিয়ে পেভমেন্টের উপর পড়ল। আগেরদিন পড়া প্রতিবেশির নিউজলেটারটার কথা মনে পড়ল ওর। রাস্তায় পড়ে থাকা পাতা পরিস্কার করা নিয়ে একটা আর্টিকেল ছিল। সেখানে। আজকে বিকেলেই পরিস্কার করা হয়েছে। যে কারনে রাস্তায় পড়া পাতার সংখ্যা কম ছিল। সকালে পাতায় ঢেকে ছিল জায়গাটা। তার মানে তাদের পাতা পরিস্কারের কাজ আজকের মত শেষ। আরেকটা শুকনো পাতা খসে পড়ে ওর গাড়ির উইন্ডসিন্ডের ওয়াইপারের মধ্যে জায়গা করে নিল।
কোথাও কোন শব্দ নেই। সেইকি গাড়ির ভেতর বসে ছিল। ওর হাত দুটো শক্ত করে স্টীয়ারিং হুইল চেপে ধরে আছে। মিররে এইমাত্র পার হয়ে আসা মোড়টা দেখা যাচ্ছে। অবশেষে চাঁদের ফ্যাকাসে আলোর মধ্যে মেয়েটাকে দেখা গেল।
২
গ্যারেজে গাড়ি পার্ক করে সেইকি তাড়াতাড়ি বিশাল ধাতব দরজাটা লাগিয়ে দিল, ক্যাঁচকোঁচ শব্দ আশেপাশে নিস্তব্ধ এলাকার মধ্যে প্রতিধ্বনি তুলল। গ্যারেজের বাইরে দাঁড়িয়ে ও পড়ে থাকা শুকনো পাতার দিকে চাইল।
গ্যারেজের পাশে লাগ্লো গাছগুলো বড় হয়ে উঠেছে। ওগুলো থেকে শুকনো পাতা পড়ে ওর গ্যারেজ প্রায় ঢেকে যাচ্ছে। তাড়াতাড়ি ওগুলো ঝাঁট দিয়ে পরিস্কার করা দরকার।
ওর বাবা-মা আর দাদি মারা যাওয়ার পর থেকেই সেইকি বাসায় একা। সব পরিস্কার করা, লন্ড্রি সব কাজ ও একাই করে। আর প্রতিবার করতে গিয়ে ওর উপলদ্ধি হয় ও কতটা নিঃসঙ্গ।
ওর সদ্য বিবাহিত একজন কলিগ মাড় দেয়া শার্ট পড়ে আসে এখন, আর সেইকির বস টেবিলের উপর নিজের বাচ্চাদের ছবি সাজিয়ে রেখেছেন।
“তোমার কি কোনদিন বিয়ে-টিয়ে করার কোন ইচ্ছা আছে, সেইকি?” ওর এক নারী কলিগ একবার প্রশ্ন করেছিল।
কোন সম্ভাবনা নেই, সেইকি ভাবল। প্রেমিকা, বন্ধু, পরিবার,..এসব কিছু ওর কাছে দূরের কোন বস্তু মনে হয়। অফিসের কাজের পরিবেশের সাথে সেইকি খাপ খেয়ে নিতে পারলেও এরচেয়ে গভীর কোন সম্পর্কের ক্ষেত্রে ওর কেমন জানি অস্বস্তি বোধ হয়।
যেসব গোপন ব্যাপার আর সমস্যা ও নিজের ভেতর তলে তলে গড়ে তুলেছে তা ওর আর অন্যদের মাঝে এক দুর্ভেদ্য দেয়াল সৃষ্টি করেছে। এমন কেউ নেই যার কাছে ও নিজের ভয়াবহ কার্যকলাপ নিয়ে স্বীকারোক্তি করতে পারে।
একটা ঠান্ডা বাতাস ওর ঘাড়ের কাছ দিয়ে বয়ে গেল। আগেরদিনের চেয়ে আজকে একটু বেশি ঠান্ডা পড়েছে। উঠোনের পাতা উড়ে যেতে দেখে সেইকি একটু কেঁপে উঠল। কিন্তু আসন্ন শীতের পূর্বাভাস ওর কাঁপুনির জন্য পুরোপুরি দায়ি নয়। সেইকি টের পেল ওর স্যুট জ্যাকেট পরা নেই। ওর সাদা শার্টের অসংখ্য ভাঁজ ওকে মনে করিয়ে দিল ওর সদ্য বিবাহিত কলিগের সুখি জীবনের কথা। লোকটার শার্ট সবসময় ইস্ত্রি করা থাকে।
সেইকি ওর মাথা ঝাঁকাল। অন্যদের ব্যাপারে চিন্তা করার সময় এখন নয়। ও আবার গ্যারেজের ভেতর গিয়ে ঢুকল। গ্যারেজের এক দিকে একটা দরজা ছিল, সেটা দিয়ে ঢুকে ও গাড়ির পেছনের দরজা খুলল। স্যুট জ্যাকেট তুলতে গিয়ে দেখলে পেছনে দাগ লেগে আছে। রক্তের দাগ হবে সম্ভবত। ব্যাকসিটে শুয়ে থাকা মেয়েটার দিকে তাকাল ও। মুখ আর নাক দিয়ে রক্ত ঝরছে। সেইকি চায়নি বাড়ি ফেরার সময় কেউ গাড়িতে মেয়েটাকে দেখে ফেলুক। তাই জ্যাকেট দিয়ে ঢেকে দিয়েছিল ওকে।
মেয়েটা তখনও জ্ঞানহীন হয়ে পড়েছিল। নড়াচড়া করছিল না। গুটিসুটি মেরে পড়ে ছিল, লম্বা চুলগুলো পর্দার মত মুখের উপর পড়েছিল। মেয়েটা যদি বাধা না দিত তাহলে সেইকি ওকে আঘাত করত না, হাত ডলতে ডলতে ভাবল। মেয়েটার নখের আঁচড়ে লাল দাগ হয়ে আছে ওর তুকে।
মেয়েটাকে ধরার সময় চিৎকার করেছিল, নিস্তব্ধ রাতে সেই কম্পন তোলা চিত্তার নিশ্চয়ই সবাই শুনতে পেয়েছিল।
এরপর কি হলো তা সেইকির ঠিকমত মনে নেই। কিছু বুঝে ওঠার আগেই ও মেয়েটার মুখে কয়েকবার আঘাত করে। মেয়েটা জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল, নড়ছিল না। কিন্তু তারপরেও সেইকির হাত মেয়েটার মুখের উপর চলছিল। সে মেয়েটাকে নিয়ে ব্যাকসিটে ঢুকালো, জ্যাকেট দিয়ে ঢেকে দিল। গাড়ি চালু করে উড়ে চলে এল।
সেইকি ওর জীবনে কখনো হিংস্র কোন কিছু করেনি, ছোট থাকতেও। টিভিতে শিশু নির্যাতন সংক্রান্ত কোন খবর দেখলে বিতৃষ্ণায় ওর মাথা ঘুরাত। আর এখন কিনা সে একটা মেয়েকে মুখে ঘুষি মেরেছে। ও ওর হাতে এর প্রতিক্রিয়া টের পাচ্ছিল, মনে হচ্ছিল যেন কোন পোকা নড়াচড়া করছে হাতের উপর দিয়ে। আতংকিত হয়ে ও হাত ঝাড়ল, পোকাগুলোকে ঝেড়ে ফেলতে চাইল, কিন্তু অনুভুতিটা রয়েই গেল।
ও মেয়েটাকে তুলল। ঘরের পেছনের রুমটায় বয়ে নিয়ে গেল। আলো নিভিয়ে রেখেছিল যেন ওদের ছায়া পর্দা কিংবা জানালায় না দেখা যায়। চাঁদের আলোতে মেয়েটার হাতগুলো আর চুল নিচে ঝুলে থাকল, হাঁটার সময় দুলছিল। কাজের রুমে নিয়ে গিয়ে ও মেয়েটাকে নতুন বানানো কফিনের ভেতর শুইয়ে দিল।
সুন্দর ফিট হলো, যেন মেয়েটার কথা ভেবেই কফিনটা বানানো হয়েছিল। কিন্তু সেইকি মেয়েটার চেহারার দিকে তাকাতে পারছিল না। কিভাবে তাকাবে? নাক আর ঠোঁট থেকে রক্ত ঝরছে, ঘুষি খাওয়া জায়গাগুলো ফুলে রঙ বদলে গেছে। সেইকির ভেতর থেকে উঠে আসা অন্ধকার অশুভ ব্যাপার যে ছাপ রেখে গিয়েছিল সেগুলোর মুখোমুখি হওয়ার সাহস সেইকির নেই। সে তাড়াতাড়ি কফিনের ঢাকনা লাগিয়ে পেরেক মেরে বন্ধ করতে লাগল। ঢাকনায় দুটো ফুটো ছিল বাতাস যাওয়া আসা করার জন্য।