যে-সকল বই প্রকাশকেরা সচরাচর ছাপেন না, সে-সকল মানসম্পন্ন রচনা বাংলা একাডেমী প্রকাশ করে থাকে। আমি বাংলা একাডেমীর শরণাপন্ন হলাম। একাডেমীর তৎকালীন আমলা মহাপরিচালক আমাকে যেভাবে পত্রপাঠ বিদায় করেছিলেন, সেই ঘটনাটি আমার মনে বিষাক্ত ক্ষতের মতো চিরদিন জেগে থাকবে। অথচ বাংলা একাডেমী আরেক ভদ্রলোককে, শেকসপীয়রের একটি নাটক অনুবাদ করার জন্য সোয়া লক্ষ টাকা অগ্রিম প্রদান করেছিল।
স্যারের বাড়িতে যেতে আমি বিব্রত বোধ করতাম। তিনি প্রকাশক পাওয়া গেলো কি না সে সংবাদ জানতে চাইতেন। আমি জবাব দিতে পারতাম না। আমার হাতে তখন টাকা পয়সাও ছিল না। বেঁচে থাকা ভীষণ কষ্টকর হয়ে দাড়িয়েছিলো। আমার করুণ মলিন মুখ দেখে স্যার পাছে আমাকে করুণা করেন, সেই ভয়ে স্যারের বাড়িতে যাওয়া অনেক কমিয়ে দিয়েছিলাম। স্যার আমার মনোবেদনার কথা জানতেন। ফাউস্ট সম্পর্কে আর কোনো কিছু জিগ্গেস করতেন না। আমিও আর সে প্রসঙ্গ উত্থাপন করতাম না।
একদিন স্যার আমাকে ডেকে পাঠালেন। আমি গেলে তিনি বললেন, কাইল আমি আলি আহসানের কাছে গেছিলাম। আপনের ফাউষ্টের ব্যাপারে কথাবার্তা কইছি। আপনেও যদি সময় পান একবার যাইয়েন। আলি আহসান আমারে কথা দিছেন, হে জাৰ্মান অ্যাম্বাস্যাডারের লগে কথাবার্তা কইয়া দেখব।
স্যারের কথামতো আমি একবার সৈয়দ আলি আহসান সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। তখন তিনি জিয়াউর রহমান সাহেবের উপদেষ্টা। আমি কোনোদিনই সৈয়দ সাহেবের প্রতিভাজন ছিলাম না। তবু আমি অবাক হলাম, এ কারণে যে তিনি আমাকে অত্যন্ত স্নেহের সঙ্গে গ্রহণ করলেন। আর বললেন, রাজ্জার স্যার বলেছেন তোমার ফাউস্টের অনুবাদটা খুব ভালো হয়েছে। আমি জার্মান অ্যাম্বাস্যাডারের সঙ্গে একটুখানি আলাপ করেছি। পরে আলাপ করে কী হল স্যারকে জানাবো।
দিন পনেরো পরে স্যার আমাকে আবার ডেকে পাঠালেন। আমি যখন স্যারের বাড়িতে গেলাম, দেখি স্যার বাইরে যাওয়ার জন্য তৈয়ার হচ্ছেন। আমাকে দেখে বললেন মৌলবি আহমদ ছফা। আমি এক জায়গায় যাইবার লাইছি, বেশি সময় অইব না। জার্মান অ্যাম্বাস্যাডারের লগে সৈয়দ আলি আহসান সাহেবের কথা আইছে। জার্মান অ্যাম্বাস্যাডার কইছেন, আপনের বই ছাপানোর সব খরচ অরা বিয়ার করব। আমি আলি আহসানরে একটা ভূমিকা লেইখ্যা দিবার কথা কইছি।
স্যারের কথা শুনে আমি ভীষণ উৎফুল্ল হয়ে উঠেছিলাম, কিন্তু যখন শুনলাম তিনি সৈয়দ আলি আহসানকে ভূমিকা লিখতে বলেছেন আমার মনটা বিশ্ৰী রকম খারাপ হয়ে গেলো। স্যারের ওপর আমার ভীষণ রাগ হল। আমি বারো বছর অমানুষিক পরিশ্রম করে অনুবাদকর্মটি সম্পন্ন করেছি। স্যার আমার মতামত না জেনে সৈয়দ আলি আহসান সাহেবকে ভূমিকা লেখার প্রস্তাব দিয়েছেন। এটা আমি কিছুতেই মন থেকে মেনে নিতে পারছিলাম না। সেদিন স্যারকে কিছু না বলে চলে এসেছি। ঘরে এসে ব্যাপারটা গভীরভাবে চিন্তা করে দেখেছি। স্যার আমার ভালো চান, তাই আপনা থেকে উপযাচক হয়ে গিয়ে সৈয়দ আলি আহসান সাহেবের কাছে প্রস্তাব করেছেন, তাঁকে রাজি করিয়েছেন। এখন আমি যদি রাজি না হই স্যার মনেমনে চোট পেয়ে যাবেন। সে রাতে ঘুমোতে আমার অনেক কষ্ট হয়েছে। যে অনুবাদটি করতে আমি বারো বছর ব্যয় করেছি, সে বইটির জন্য অন্য কেউ আড়াই ঘণ্টায় আড়াই পৃষ্ঠার ভূমিকা লিখে দেবেন, সেটি কবুল করার চাইতে আমার ডানহাত কেটে ফেলা অনেক সহজ ছিলো। স্যারকে পরদিন গিয়ে জানিয়ে দিয়েছিলাম, আমি আরও কিছুদিন অপেক্ষা করবো, যদি বইটি অন্য কোনোভাবে প্রকাশ করা যায়। আমার আপত্তি কোথায় স্যার নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছিলেন। তিনি হুঁকোর নলটা মুখে দিয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর ছোটো একটা নিশ্বাস ফেলে বললেন, আপনের উপকার করা অসম্ভব। আমাদের শ্রদ্ধাভাজন বয়োজ্যেষ্ঠরা যেভাবে আমাদের উপকার করতে চান আমরা পরবর্তী প্রজন্মের তরুণরা যেভাবে উপকৃত হতে চাই, তার মধ্যে বিস্তর ফারাক, সেদিন খুব ভালোভাবে বুঝতে পেরেছিলাম।
পরবর্তীকালে আমার পক্ষে ফাউস্ট প্রকাশ করা সম্ভব হয়েছিলো। এমনকি কোলকাতাতেও একটি এডিশন প্রকাশিত হয়েছিলো। জার্মান অ্যাম্বেসির অর্থানুকূল্যে ঢাকার এডিশনটি প্রকাশিত হয়েছিল। কলকাতার এডিশনটির ব্যয়ভার বহন করেছিলেন কোলকাতার জার্মান কনসাল জেনারেল।
স্যারের বিষয়ে লিখতে গিয়ে আমার ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ যথাসম্ভব এড়িয়ে যেতে চেষ্টা করেছি। তথাপি ফাউষ্টের বিষয়টি আমি বাদ দিতে পারলাম না। এই নাতিক্ষুদ্র রচনাটিতে আমার পক্ষে যতোদূর সম্ভব প্রফেসর রাজ্জাকের মতামতসমূহ তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। উনি যেভাবে তার কথা বলেছেন, আমি যেভাবে সেগুলো প্রকাশ করেছি। এমন দাবি আমি করতে পারবো না—একটা ফারাক অবশ্যই থেকে গিয়েছে। সে ব্যাপারে অবশ্যই আমি সজাগ। স্মৃতি থেকে তুলে আনার সময় তার মতামত এবং ব্যক্তি হিসেবে তাকে যথাযথ উপস্থাপন করা সম্ভব হয়নি। আমার যেটুকু সাধ্য আমি করেছি। এপর্যন্ত আমি রাজ্জাক স্যারের কথা বলেছি। তাঁর সম্পর্কে আমার আরও কিছু কথা আছে, সেগুলো পরবর্তীতে বলার চেষ্টা করছি।
১৫. সিঙ্গাপুর থেকে চোখের চিকিৎসা
স্যার সিঙ্গাপুর থেকে চোখের চিকিৎসা করে আসার পর বেশ কয়েকবার যাওয়া হল। তার চোখেমুখে পানি নেমেছে। একটানা কথা বলতে গেলে হাঁপিয়ে ওঠেন। উঁচু চেয়ার থেকে ঝুকে টেবিলের ওপর বইপত্র পড়ার সময় তাকে একটি শিশুর মতো দেখায়। নানান কথা জিগ্গেস করে স্যারকে কষ্ট দিতে ভীষণ খারাপ লাগে। ইদানীং স্যারের মধ্যে নতুন প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে। কথা বলা শুরু করলে থামতে চান না। একটানা কথা বলতে থাকেন। আগে কথা বলার সময় উইট ঠিকরে বেরিয়ে আসতো। হালে সে জিনিসটি বিশেষ লক্ষ করা যাচ্ছে না। স্যার তাঁর স্মৃতির ভাণ্ডে যতো কথা জমা হয়ে আছে সব উজাড় করে দিতে পারলেই যেনো বেঁচে যান। আগে স্যার হিসেব করে কথা বলতেন। কেউ আহত হচ্ছে কি না, সমাজে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হতে পারে আগুপাছু নানারকম ভেবে তার মতামত প্রকাশ করতেন। বর্তমান সময়ে তিনি তার সঞ্চিত কথা নিঃশেষ করে ফেলার একটা নেশা যেনো তাকে পেয়ে বসেছে। বোধহয় তিনি উপলব্ধি করতে পারছেন তার সময় দ্রুত শেষ হয়ে আসছে। তাই তিনি যাদেরকে নির্ভরযোগ্য এবং বিশ্বাসযোগ্য মনে করেন, তাদের কাছে অভিজ্ঞতার কথা, উপলব্ধির কথা, চিন্তার কথা প্রকাশ করে স্বস্তি অনুভব করেন।