০১-৩. উপাচার্য পদে নিয়োগপ্রাপ্তি
গাভী বিত্তান্ত – উপন্যাস – আহমদ ছফা
উৎসর্গ
ফাদার ক্লাউস ব্যুয়েলে
আমার বন্ধু এবং শান্তিপথের যাত্রী
০১.
আবু জুনায়েদের উপাচার্য পদে নিয়োগপ্রাপ্তির ঘটনাটি প্রমাণ করে দিল আমাদের এই যুগেও আশ্চর্য ঘটনা ঘটে। বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা ফ্যাকাল্টির সদস্যবৃন্দ আবু জুনায়েদের উপাচার্যের সিংহাসনে আরোহণের ব্যাপারটিকে নতুন বছরের সবচাইতে বড় মজার কাণ্ড বলে ব্যাখ্যা করলেন। আবু জুনায়েদ স্বয়ং বিস্মিত হয়েছেন সবচাইতে বেশি। আবু জুনায়েদের বেগম নুরুন্নাহার বানু খবরটি শোনার পর থেকে আণ্ডাপাড়া মুরগির মতো চিৎকার করতে থাকলেন। তিনি সকলের কাছে বলে বেড়াতে লাগলেন যে তার ভাগ্যেই আবু জুনায়েদ এমন এক লাফে অত উঁচু জায়গায় উঠতে পারলেন । কিছু মানুষ অভিনন্দন জানাতে আবু জুনায়েদের বাড়িতে এসেছিলেন। নুরুন্নাহার বানু তাদের প্রায় প্রতিজনের কাছে তার সঙ্গে বিয়ে হওয়ার পর থেকে কী করে একের পর এক আবু জুনায়েদের ভাগ্যের দুয়ার খুলে যাচ্ছে সে কথা পাঁচকাহন করে বলেছেন । অমন ভাগ্যবতী বেগমের স্বামী না হলে, একদম বিনা দেন-দরবারে দেশের সবচাইতে প্রাচীন, সবচাইতে সম্ভ্রান্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের পদটি কী করে আবু জুনায়েদের ভাগ্যে ঝরে পড়তে পারে। যারা গিয়েছিলেন তাদের মধ্যে অনেকেই মুখে কিছু না বললেও মনে মনে মেনে নিতে দ্বিধা করেননি যে একমাত্র স্ত্রী ভাগ্যেই এরকম অঘটন ঘটতে পারে।
শিক্ষক হিসেবে আবু জুনায়েদ ছিলেন গোবেচারা ধরনের মানুষ। গোটা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ডিপার্টমেন্টে বা ডিপার্টমেন্টের বাইরে তার সঙ্গে কারো বিশেষ বন্ধুত্ব ছিল না। আর আবু জুনায়েদ স্বভাবের দিক দিয়ে এত নিরীহ ছিলেন যে তার সঙ্গে শত্রুতা করলে অনেকে মনে করতেন, শত্রুতা করার ক্ষমতাটির বাজে খরচ করা হবে। তাই গোটা বিশ্ববিদ্যালয় পাড়ায় তার বন্ধু বা শত্রু কেউ ছিলেন না।
আমাদের দেশের সবচাইতে প্রাচীন এবং সবচাইতে সম্ভ্রান্ত বিশ্ববিদ্যালয়টি হাল আমলে এমন এক রণচণ্ডী চেহারা নিয়েছে। এখানে ধন প্রাণ নিয়ে বেঁচে থাকা মোটেই নিরাপদ নয়। এখানে যখন তখন মিছিলের গর্জন কানে ঝিম ধরিয়ে দেয়। দুই দলের বন্দুক যুদ্ধে যদি পুলিশ এসে পড়ে সেটা তখন তিন দলের বন্দুক যুদ্ধে পরিণত হয়। কোমলমতি বালকেরা যেভাবে চীনা কুড়াল দিয়ে অবলীলায় তাদের বন্ধুদের শরীর থেকে হাত-পা বিচ্ছিন্ন করে ফেলতে পারে, সেই দক্ষতা ঠাটারি বাজারের পেশাদার কশাইদেরও আয়ত্ত করতে অনেক সময় লাগবে। এখানে যত্রতত্র সে সকল বিস্ময় বালকের সাক্ষাৎ মিলবে যারা কিমিয়া শাস্ত্রের গোপন রহস্য জানার মতো করে সেই চমৎকার রোমাঞ্চকর তথ্যটি জেনে ফেলেছে। রিভলবারের ট্রিগারে একবার চাপ দিলে একটি গুলি বেরিয়ে আসে, সে-একটিমাত্র গুলি একজন মানুষের বুকে আঘাত করে সে মানুষটিকে জগৎ থেকে পত্রপাঠ বিদায় নিতে হয়। উপন্যাস রচনা করা কিংবা উচ্চাঙ্গের ট্র্যাজেডি লেখার চাইতে অনেক সুন্দর এবং কঠিন এই কর্ম। একবার দক্ষতা অর্জন করতে পারলে কাজটি কিন্তু অতি সহজে নিষ্পন্ন করা সম্ভব। সকলের দৃষ্টির অজান্তে এখানে একের অধিক হনন কারখানা বসেছে, কারা এন্তেজাম করে বসিয়েছেন সকলে বিশদ জানে। কিন্তু কেউ প্রকাশ করে না। ফুটন্ত গোলাপের মতো তাজা টগবগে তরুণেরা শিক্ষক হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢোকার পর হনন কারখানার ধারেকাছে বাস করতে করতে নিজেরাই বুঝতে পারেন না কখন যে তারা হনন কারখানার কারিগরদের ইয়ার দোস্তে পরিণত হয়েছেন। তাই জাতির বিবেক বলে কথিত মহান শিক্ষকদের কারো কারো মুখমণ্ডলের জলছবিতে খুনি খুনি ভাবটা যদি জেগে থাকে তাতে আঁতকে ওঠার কোনো কারণ নেই। এটা পরিবেশের প্রভাব। তুখোড় শীতের সময় সুঠাম শরীরের অধিকারী মানুষের হাত-পাগুলোও তো ফেটে যায়।
বিশ্ববিদ্যালয়টিতে কোনো কাজ অত সহজে হওয়ার কথা নয়। সহজে ভর্তি হওয়ার উপায় নেই, সহজে পাস করে ছাত্ররা বেরিয়ে যাবে সে পথ একরকম বন্ধ। এখানকার জীবনপ্রবাহের প্রক্রিয়াটাই অত্যন্ত জটিল। এই জটিলতার আবর্তে ঘুরপাক খেতে খেতে তরুণ-তরুণীর হৃদয়াবেগ পর্যন্ত টকে যাওয়া দুধের মতো ফেটে যায়। একজন তরুণ শিক্ষককে কোনো ছাত্রাবাসের আবাসিক শিক্ষকের রদ্দি মার্কা কাজটি পেতেও জুতোর সুখতলা ক্ষয় করে ফেলতে হয়। কোনো শিক্ষক যখন অবসর নেন, তার বাসাটি দখল করার জন্য শিক্ষকদের মধ্যে যেভাবে চেষ্টা তদবির চলতে থাকে, কে কাকে ল্যাঙ মেরে আগে তালা খুলবে, সেটাও একটা গবেষণার বিষয়বস্তু হয়ে উঠতে পারে। পরীক্ষার খাতা দেখার বেলায়, কে কার চাইতে বেশি খাতা হাতিয়ে নিয়েছে তা নিয়ে যে উত্তাপ, যে ঠাণ্ডা যুদ্ধ চলতে থাকে তা একটা স্থায়ী অসুখ হিসেবে চিহ্নিত করা যেতে পারে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে বিনা যুদ্ধে নাহি দেগা সূচাগ্র মেদিনী’ এটা একটা রীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেখানে মিয়া মুহম্মদ আবু জুনায়েদ বিনা প্রয়াসে বলতে গেলে একরকম স্বপ্ন দেখতে দেখতে উপাচার্যের আসনটি দখল করে বসবেন, সেই ঘটনাটি সকলকে বিস্ময়াবিষ্ট করে ছেড়েছে। আবু জুনায়েদের স্ত্রী নুরুন্নাহার বানুর কাহিনীটিকে সঠিক বলে মেনে নিলে মাথা ঘামানোর বিশেষ প্রয়োজন পড়ে না। ধরে নিলাম সতীর ভাগ্যে পতির জয় হয়েছে। তারপরেও ভাগ্যচক্রের হাতিটি কোন পথ দিয়ে আৰু জুনায়েদকে পিঠে করে বয়ে এনে এই অত্যুচ্চ আসনে বসালো তার একটি ব্যাখ্যা দাঁড় করানো প্রয়োজন। তা নইলে নবীর মেরাজ গমন, যীশুর স্বর্গারোহণের মতো আবু জুনায়েদের ব্যাপারটি একটি অলৌকিক কাণ্ড বলে মেনে নিতে হবে।