আবু জুনায়েদের ইচ্ছে হলো এই নতুন বানানো গোয়ালঘরটা তার কিছু বন্ধু বান্ধবকে দেখাবেন। এমনিতে আবু জুনায়েদের বিশেষ অন্তরঙ্গ বন্ধু-বান্ধব নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা তার দল করেন, প্রশাসনিক বিষয়ে নানা ব্যাপারে যারা তাকে সাহায্য করেন, তার বিরুদ্ধে অপপ্রচার হলে যারা তার পক্ষ হয়ে প্রতিবাদ করেন, ইদানীং আবু জুনায়েদ তাদের মধ্যে বিশেষ কাউকে কাউকে বন্ধু মনে করতে আরম্ভ করেছেন। আবু জুনায়েদ একটি বিশেষ কারণে সদ্যনির্মিত গোয়াল ঘরখানা সকলকে দেখাতে আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন। সত্যি বটে এটি গোয়াল ঘর এবং আগামীতে এই ঘরটিতে একটি চতুস্পদ প্রাণী বসবাস করতে যাচ্ছে। কিন্তু ঘরটির নির্মাণশৈলী এত চমৎকার দেখলে চোখটা আপনা থেকেই জুড়িয়ে যায়। পাখির বাসার মতো এই এক টুকরো একখানি ঘর । ঢেউটিনের চালসহ গোটা ঘরখানি যেন মাটি খুঁড়ে আচমকা সুন্দর একটা মাশরুমের মতো ফুটে বেরিয়ে এসেছে। উপাচার্য ভবনের অসামান্য গাম্ভীর্যের পটভূমিতে এই ছোট্ট ঘরখানা একটি স্বপ্নবিন্দুর মতো ফুটে উঠেছে। আবু জুনায়েদ যখন ভাবেন মেয়াদ ফুরিয়ে গেলে ঘরটি সঙ্গে করে। নিয়ে যেতে পারবেন না, মনটা বিষাদে ছেয়ে যায়।
আবু জুনায়েদ মনে করেন, একই সঙ্গে গরু গোয় দুটিই দেখিয়ে সকলকে তাক লাগিয়ে দেবেন। যেদিন গরুটা গোয়ালে আসবে কয়েকজনকে সন্ধ্যেবেলা চায়ের নিমন্ত্রণ করবেন। উত্তরদিকে যে শেডটা বানানো হয়েছে সেখানে চেয়ার টেবিল পেতে অতিথিদের নিয়ে বসবেন। কিন্তু গরুটা কখন আসবে? কখন আসবে? এই মহামান্য অতিথি কখন সাধের গোয়ালঘর আলো করতে আসবেন। নিষ্ঠাবান সাধক মন্দির নির্মাণের পর বিগ্রহ প্রতিষ্ঠার জন্য যেমন আকুলিত অন্তরে প্রতীক্ষা করতে থাকেন, আবু জুনায়েদের মনেও সে ধরনের আকুলি-বিকুলি জন্ম নিচ্ছিল। আবু জুনায়েদ ভেবে দেখলেন, গরুটা আকাশ থেকে তার গোয়ালঘরের বাসিন্দা বনে যাবে না। শেখ তবারক আলী সাহেব কথা দিয়েছেন তার ভাইঝি এবং নাতনিকে একটা গরু প্রেজেন্ট করবেন। প্রেজেন্ট করা গরু নিরাপদে বসবাস করতে পারে, সেজন্য এই গোয়ালঘর বানিয়ে দেবেন। গোয়ালঘর বানিয়ে তিনি কথা রেখেছেন, কিন্তু গরুটা কখন নিয়ে আসবেন? গরু বিহনে গোয়ালঘরটা যেন কাঁদছে, আবু জুনায়েদের এরকম মনে হলো। আবু জুনায়েদ ভেবে দেখলেন গোয়ালঘর বানানোর পেছনে শেখ তবারক অনেক টাকা ব্যয় করে ফেলেছেন। গরু কিনতে আরো টাকার প্রয়োজন। এদিকটা আবু জুনায়েদের দেখার বিষয় নয়। এসব তিনি ভ্রাতুস্পুত্রী এবং নাতনিকে গিফট করছেন। সুতরাং টাকার অঙ্কে তিনি হিসেব করবেন কেন? কিন্তু গরুটা কখন আসবে? চট করে তার মাথায় একটা চিন্তা খেলে গেল। তবারক সাহেব, তার স্ত্রী, জামাই আবেদ হোসেন এবং কন্যাকে দাওয়াত করলে চমকার হয়। তাদেরকে একবার তবারক সাহেব দাওয়াত করে খাইয়েছেন, পাল্টা দাওয়াত করা তার একটি সামাজিক কর্তব্য। দাওয়াত খেতে এলে গরুটা কখন আসবে সঠিক তারিখ জানা সম্ভব হবে। আসল তারিখটা জানতে পারলে বাড়তি উৎকণ্ঠার অবসান হবে।
সেদিনই রাতে জুনায়েদ শেখ তবারক আলীকে টেলিফোন করে বসলেন । তবারক সাহেব নিজেই রিসিভ করেছিলেন। আবু জুনায়েদ আগামী শুক্রবারে আবেদ হোসেন, তার স্ত্রী এবং চাচা চাচিকে খাওয়ার নিমন্ত্রণ করলেন। শেখ তবারক আলী বললেন,
-এত ঘটা করে দাওয়াত করার দরকার কী। মেয়ের বাড়ি যখন ইচ্ছে খেয়ে যাব। আবু জুনায়েদ একটু ধান্ধায় পড়ে গিয়েছিলেন। তবে কি তবারক সাহেব আবু জুনায়েদের নিমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করলেন? পরের ব্যাখ্যায় আবু জুনায়েদের কাছে সবকিছু স্পষ্ট হয়ে গেল। শেখ তবারক আলী বললেন,
-শুনুন জামাই মিয়া দাওয়াত টাওয়াত ওগুলো এখন রাখেন। বানু এবং তার মেয়ে আমার এখানে যতবার ইচ্ছে যখন খুশি আসতে পারেন। এমনকি আপনি এলেও কিছু এসে যায় না। আমি বাস করি একেবারে মানুষের ধরাছোঁয়ার বাইরে। আমার এখানে কে এল কে গেল কে হিসেব রাখে। কিন্তু স্যার ভুলে যাবেন না আপনি দেশের সবচাইতে বড় বিশ্ববিদ্যালয়টির উপাচার্য। আপনি কী করেন না করেন শত শত চোখ তাকিয়ে আছে। একটুখানি খুঁত পেলেই আপনার নিজের পেশার মানুষেরাই আপনাকে ছিঁড়ে খুঁড়ে ফেলবে। আপনার বাড়িতে খেলাম না খেলাম এ নিয়ে উতলা হবেন না। আমাদের ভেতরের যে সম্পর্ক সেটা তো তুচ্ছ কারণে নষ্ট হওয়ার নয়। আমি আপনার কাছ থেকে একটা জিনিসই জানতে চাইব।
আবু জুনায়েদ বললেন, বলুন কী বলতে চান?
-গোয়াল ঘরটা আপনার পছন্দ হয়েছে কি না।
আবু জুনায়েদ বললেন,
-হ্যাঁ খুবই পছন্দ হয়েছে। গরুর বদলে যে কোনো রুচিবান মানুষকে এই ঘরে বাস করতে বললে খুশি হয়ে রাজি হবে। আপনার পছন্দবোধ এত উন্নতমানের।
শেখ তবারক আলী বললেন,
-আপনি পছন্দ করেছেন শুনে আমার দিলটা ঠাণ্ডা হয়ে গেল। বানুর কেমন লেগেছে?
-আপনাদের মেয়ে তো একেবারে পাগল। লোকজনকে ডেকে দেখাবার জন্যে হন্যে হয়ে উঠেছে।
-শুনুন জামাই মিয়া, শেখ তবারক আলী বললেন,
-ওটি ঘটতে দেবেন না। এই সমস্ত জিনিস যত কম মানুষ জানে ততই উত্তম। আমি কী বলছি আপনি বুঝতে পারছেন তো?
আবু জুনায়েদ এক মিনিট থামলেন, তারপর বললেন,
-হ্যাঁ পারছি।