- বইয়ের নামঃ একজন আলি কেনানের উত্থান-পতন
- লেখকের নামঃ আহমদ ছফা
- প্রকাশনাঃ খান ব্রাদার্স অ্যান্ড কোম্পানি
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
১. দে তর বাপরে একটা ট্যাহা
একজন আলি কেনানের উত্থান-পতন – উপন্যাস – আহমদ ছফা
উৎসর্গ – শ্ৰী চিত্তরঞ্জন সাহা
দে তর বাপরে একটা ট্যাহা।
ভিখিরিরা সাধারণতঃ ভিক্ষাদাতাকেই বাবা বলে ডাকে। আলি কেনান দাবী করে বসলো সম্পূর্ণ উল্টো। অর্থাৎ সে ভিক্ষাদাতার বাবা এবং একটা টাকা তাকে এখখুনি দিয়ে দিতে হবে। একেবারে যাকে বলে কড়া নির্দেশ। এই চাওয়ার মধ্যে রীতিমতো একটা চমক আছে।
লোকটা সদ্য ঘাটের লঞ্চ থেকে এই বুঝি নেমেছে। পরণে ময়লা পাজামা পাঞ্জাবি। দোহারা চেহারার ফুলো ফুলো মুখের মানুষটি। আলি কেনানের মুখ থেকে সদ্য নির্গত বন্দুকের গুলির মতো শব্দ কটি শুনে কেমন জানি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। গোল গোল সরল চোখ দুটি পাকিয়ে তাকায়। আলি কেনান ইত্যবসরে ভাটার মতো জ্বলজ্বলে চোখ দুটো লোকটার চোখের ওপর স্থাপন করে আরো জোরের সাথে উচ্চারণ করে, কইলামনা তর বাপরে একটা ট্যাহা দিয়া দে।
লোকটা বোধহয় সারারাত লঞ্চে ঘুমোতে পারেনি। চোখেমুখে একটা অসহায় অসহায় ভাব। অথবা এমনও হতে পারে কোর্টে তার মামলা আছে। যাহোক লোকটি দ্বিরুক্তি না করে ডান হাতের প্রায় ছিঁড়ে যাওয়া ব্যাগটা বাঁহাতে চালান করে পকেট থেকে একখানা এক টাকার মলিন বিবর্ণ নোট বের করে আলি কেনানের হাতে দিয়ে ফুটপাথ ধরে হেঁটে চলে যায়। আলি কেনানের জীবনের এই প্রথম ভিক্ষাবৃত্তি। তাতে আশানুরূপ সফল হওয়ায় শরীরের মনে একটা তড়িৎ প্রবাহ খেলে গেলো। শুধুমাত্র একটা ধমকের জোরে পরের পকেট থেকে টাকা বের করে আনা যায়, আলি কেনানের জীবনে এটা একটা অভিনব ঘটনা। সেদিন থেকেই তার জীবনে নতুন একটা অধ্যায়ের সূত্রপাত্র হলো।
আলি কেনান গত দুদিন ধরে কিছু খায়নি। শহরের কলের পানি ছাড়া ভাগ্যে তার অন্য কোনো বস্তু জোটেনি। গত তিনমাস থেকে চম্পানগর লেনের একটি হোটেলে সে সকালের নাস্তা এবং দুবেলার খাবার খেয়ে আসছিলো। প্রথম দুমাস সে নগদ পয়সা দিয়ে খেয়েছে। সেই সুবাদে হোটেল মালিকের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিলো। হোটেল মালিক মানুষটি ভালো। দিলে তার রহম আছে। আলি কেনানকে পুরো একটা মাস বাকিতে নাস্তা এবং খাবার সরবরাহ করেছে। কিন্তু পুরো এক মাস পার হওয়ার পরও যখন আলি কেনান একটা পয়সা উসুল করতে পারলো না, হোটেল মালিক জানিয়ে দিলো, সে গত একমাসের টাকা আল্লার ওয়াস্তে লিল্লাহ দিয়েছে বলে ধরে নেবে। কিন্তু আরেকটা বেলাও তাকে খাওয়াবার ক্ষমতা হোটেল মালিকের নেই।
বিপদ কখনও একা আসে না। আলি কেনান ঘুমোতে চম্পানগর লেনেরই একটি মেসে। সেই মেসে বোর্ডারের সংখ্যা ছিলো দশ বারো জন। তাদের কেউ প্রেসের কম্পোজিটর, কেউ কাটা কাপড়ের ব্যবসায়ী, ফেরিঅলা, দোকান কর্মচারী এমন কি একজন ঠেলাগাড়ীর চালকও ওই মেসের সম্মানিত সদস্য ছিলো।
এই সমস্ত মানুষের প্রতি আলি কেনানের সীমাহীন অবজ্ঞা। কপালের ফের, তাকে এই সব মানুষের সাথেই দিন কাটাতে হচ্ছে। মেসের একত্রিশ টাকা আট আনা ভাড়া সে প্রথম দু মাস নিয়মিতই পরিশোধ করেছে। কিন্তু তৃতীয় মাসে তার অবস্থা ভয়ঙ্কর শোচনীয় হয়ে দাঁড়ালো। পয়সার অভাবে মুখের দাড়িটা কাটাতে পারে, জামাকাপড় পরিষ্কার করতে পারে না। তার চেহারাটাও বন মানুষের মতো হয়ে গেলো। মেসে সদস্যরা প্রতিদিন টাকা দাবি করে, সে দিতে পারে না। একটা বাজে অবস্থার মধ্যে পড়ে গেলো সে। একদিন ঠ্যালাঅলাটি বিরক্ত হয়ে বললো, কি মিয়া বাই অমন হাতির পারা গতর লইয়া বইয়া বইয়া দিন কাটান। আপনের শরমও করে না। লন আগামীকাল থেইক্যা আমার লগে গাড়ি ঠেলবেন। একতিরিশ ট্যাহা আট আনা ভাড়া আমি দিমু।
কথাটা শুনে আলি কেনানের পায়ের তলা থেকে ব্ৰহ্মতালু পর্যন্ত জ্বলে উঠেছিলো। হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে মেসের অন্য সকলের সামনেই ঠ্যালাঅলাকে একটা চড় দিয়ে বসে। তার ফল আলি কেনানের জন্য ভালো হয়নি। তাকে তো উল্টো মার খেতেই হয়েছে, তদুপরি বিছানা বালিশ বেঁধে নিয়ে সে রাতেই মেস ত্যাগ করতে হয়েছে। শহরে তার যাওয়ার মতো কোনো জায়গা ছিলো না। দু দুটো রাত বাধ্য হয়ে সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালে ঘুমোতে হয়েছে। বাঘের মতো মশার কামড় খেয়ে আলি কেনান তার সহ্য শক্তির শেষ সীমায় এসে পৌঁছেছিলো। শরীর নড়াচড়া করার বিশেষ শক্তি ছিলো না। পুরো দুটো দিন পার্কে বসে গালে হাত রেখে আপন দুর্ভাগ্যকে ধিক্কার দিতে হয়েছে। একি জীবন হয়েছে আলি কেনানের! দুদিন পেটে দানাপানি পড়েনি। তৃতীয় দিনে অন্য কোনো উপায়ান্তর না দেখে প্রথমেই যে মানুষটার সঙ্গে সাক্ষাৎ হলো, তার কাছেই একটা টাকা দাবি করে বসলো।
তখন চলছিলো উনিশ শো উনসত্ত্বর সাল। আধঘণ্টা মুখে ফেনা তুলে চীৎকার করে একটা সিকি পাওয়া গেলে ভিখিরি মনে করতো আকাশের চাঁদ পাওয়া গেছে। অথচ আলি কেনান মাত্র একটা ধমকের জোরে একজন অচেনা অজানা মানুষের পকেট থেকে আস্ত একটা টাকা বের করে আনতে পারলো, তার জীবনের যাবতীয় দুর্ভাগ্যের মধ্যেও এটা একটা সান্ত্বনার বিষয় বটে। কি একখানা সুন্দর জীবন ছিলো আলি কেনানের। বর্তমান অবস্থার সঙ্গে সে যখন অতীতের তুলনা করে, আলি কেনান ভাবে বাবা আদমের মতো তাকেও স্বর্গ থেকে এই কষ্টের দুনিয়ায় ছুঁড়ে দেয়া হয়েছে।