- বইয়ের নামঃ একজন আলি কেনানের উত্থান-পতন
- লেখকের নামঃ আহমদ ছফা
- প্রকাশনাঃ খান ব্রাদার্স অ্যান্ড কোম্পানি
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
১. দে তর বাপরে একটা ট্যাহা
একজন আলি কেনানের উত্থান-পতন – উপন্যাস – আহমদ ছফা
উৎসর্গ – শ্ৰী চিত্তরঞ্জন সাহা
দে তর বাপরে একটা ট্যাহা।
ভিখিরিরা সাধারণতঃ ভিক্ষাদাতাকেই বাবা বলে ডাকে। আলি কেনান দাবী করে বসলো সম্পূর্ণ উল্টো। অর্থাৎ সে ভিক্ষাদাতার বাবা এবং একটা টাকা তাকে এখখুনি দিয়ে দিতে হবে। একেবারে যাকে বলে কড়া নির্দেশ। এই চাওয়ার মধ্যে রীতিমতো একটা চমক আছে।
লোকটা সদ্য ঘাটের লঞ্চ থেকে এই বুঝি নেমেছে। পরণে ময়লা পাজামা পাঞ্জাবি। দোহারা চেহারার ফুলো ফুলো মুখের মানুষটি। আলি কেনানের মুখ থেকে সদ্য নির্গত বন্দুকের গুলির মতো শব্দ কটি শুনে কেমন জানি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। গোল গোল সরল চোখ দুটি পাকিয়ে তাকায়। আলি কেনান ইত্যবসরে ভাটার মতো জ্বলজ্বলে চোখ দুটো লোকটার চোখের ওপর স্থাপন করে আরো জোরের সাথে উচ্চারণ করে, কইলামনা তর বাপরে একটা ট্যাহা দিয়া দে।
লোকটা বোধহয় সারারাত লঞ্চে ঘুমোতে পারেনি। চোখেমুখে একটা অসহায় অসহায় ভাব। অথবা এমনও হতে পারে কোর্টে তার মামলা আছে। যাহোক লোকটি দ্বিরুক্তি না করে ডান হাতের প্রায় ছিঁড়ে যাওয়া ব্যাগটা বাঁহাতে চালান করে পকেট থেকে একখানা এক টাকার মলিন বিবর্ণ নোট বের করে আলি কেনানের হাতে দিয়ে ফুটপাথ ধরে হেঁটে চলে যায়। আলি কেনানের জীবনের এই প্রথম ভিক্ষাবৃত্তি। তাতে আশানুরূপ সফল হওয়ায় শরীরের মনে একটা তড়িৎ প্রবাহ খেলে গেলো। শুধুমাত্র একটা ধমকের জোরে পরের পকেট থেকে টাকা বের করে আনা যায়, আলি কেনানের জীবনে এটা একটা অভিনব ঘটনা। সেদিন থেকেই তার জীবনে নতুন একটা অধ্যায়ের সূত্রপাত্র হলো।
আলি কেনান গত দুদিন ধরে কিছু খায়নি। শহরের কলের পানি ছাড়া ভাগ্যে তার অন্য কোনো বস্তু জোটেনি। গত তিনমাস থেকে চম্পানগর লেনের একটি হোটেলে সে সকালের নাস্তা এবং দুবেলার খাবার খেয়ে আসছিলো। প্রথম দুমাস সে নগদ পয়সা দিয়ে খেয়েছে। সেই সুবাদে হোটেল মালিকের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিলো। হোটেল মালিক মানুষটি ভালো। দিলে তার রহম আছে। আলি কেনানকে পুরো একটা মাস বাকিতে নাস্তা এবং খাবার সরবরাহ করেছে। কিন্তু পুরো এক মাস পার হওয়ার পরও যখন আলি কেনান একটা পয়সা উসুল করতে পারলো না, হোটেল মালিক জানিয়ে দিলো, সে গত একমাসের টাকা আল্লার ওয়াস্তে লিল্লাহ দিয়েছে বলে ধরে নেবে। কিন্তু আরেকটা বেলাও তাকে খাওয়াবার ক্ষমতা হোটেল মালিকের নেই।
বিপদ কখনও একা আসে না। আলি কেনান ঘুমোতে চম্পানগর লেনেরই একটি মেসে। সেই মেসে বোর্ডারের সংখ্যা ছিলো দশ বারো জন। তাদের কেউ প্রেসের কম্পোজিটর, কেউ কাটা কাপড়ের ব্যবসায়ী, ফেরিঅলা, দোকান কর্মচারী এমন কি একজন ঠেলাগাড়ীর চালকও ওই মেসের সম্মানিত সদস্য ছিলো।
এই সমস্ত মানুষের প্রতি আলি কেনানের সীমাহীন অবজ্ঞা। কপালের ফের, তাকে এই সব মানুষের সাথেই দিন কাটাতে হচ্ছে। মেসের একত্রিশ টাকা আট আনা ভাড়া সে প্রথম দু মাস নিয়মিতই পরিশোধ করেছে। কিন্তু তৃতীয় মাসে তার অবস্থা ভয়ঙ্কর শোচনীয় হয়ে দাঁড়ালো। পয়সার অভাবে মুখের দাড়িটা কাটাতে পারে, জামাকাপড় পরিষ্কার করতে পারে না। তার চেহারাটাও বন মানুষের মতো হয়ে গেলো। মেসে সদস্যরা প্রতিদিন টাকা দাবি করে, সে দিতে পারে না। একটা বাজে অবস্থার মধ্যে পড়ে গেলো সে। একদিন ঠ্যালাঅলাটি বিরক্ত হয়ে বললো, কি মিয়া বাই অমন হাতির পারা গতর লইয়া বইয়া বইয়া দিন কাটান। আপনের শরমও করে না। লন আগামীকাল থেইক্যা আমার লগে গাড়ি ঠেলবেন। একতিরিশ ট্যাহা আট আনা ভাড়া আমি দিমু।
কথাটা শুনে আলি কেনানের পায়ের তলা থেকে ব্ৰহ্মতালু পর্যন্ত জ্বলে উঠেছিলো। হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে মেসের অন্য সকলের সামনেই ঠ্যালাঅলাকে একটা চড় দিয়ে বসে। তার ফল আলি কেনানের জন্য ভালো হয়নি। তাকে তো উল্টো মার খেতেই হয়েছে, তদুপরি বিছানা বালিশ বেঁধে নিয়ে সে রাতেই মেস ত্যাগ করতে হয়েছে। শহরে তার যাওয়ার মতো কোনো জায়গা ছিলো না। দু দুটো রাত বাধ্য হয়ে সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালে ঘুমোতে হয়েছে। বাঘের মতো মশার কামড় খেয়ে আলি কেনান তার সহ্য শক্তির শেষ সীমায় এসে পৌঁছেছিলো। শরীর নড়াচড়া করার বিশেষ শক্তি ছিলো না। পুরো দুটো দিন পার্কে বসে গালে হাত রেখে আপন দুর্ভাগ্যকে ধিক্কার দিতে হয়েছে। একি জীবন হয়েছে আলি কেনানের! দুদিন পেটে দানাপানি পড়েনি। তৃতীয় দিনে অন্য কোনো উপায়ান্তর না দেখে প্রথমেই যে মানুষটার সঙ্গে সাক্ষাৎ হলো, তার কাছেই একটা টাকা দাবি করে বসলো।
তখন চলছিলো উনিশ শো উনসত্ত্বর সাল। আধঘণ্টা মুখে ফেনা তুলে চীৎকার করে একটা সিকি পাওয়া গেলে ভিখিরি মনে করতো আকাশের চাঁদ পাওয়া গেছে। অথচ আলি কেনান মাত্র একটা ধমকের জোরে একজন অচেনা অজানা মানুষের পকেট থেকে আস্ত একটা টাকা বের করে আনতে পারলো, তার জীবনের যাবতীয় দুর্ভাগ্যের মধ্যেও এটা একটা সান্ত্বনার বিষয় বটে। কি একখানা সুন্দর জীবন ছিলো আলি কেনানের। বর্তমান অবস্থার সঙ্গে সে যখন অতীতের তুলনা করে, আলি কেনান ভাবে বাবা আদমের মতো তাকেও স্বর্গ থেকে এই কষ্টের দুনিয়ায় ছুঁড়ে দেয়া হয়েছে।
আলি কেনান থাকতো আলিশান বাড়িতে। সে ছিলো পূর্ব পাকিস্তানের তৎকালীন গভর্নর সাহেবের একেবারে খাস পিয়ন। নামে পিয়ন বটে, কিন্তু দাপট ছিলো ভীষণ। গোটা গভর্নর হাউসে মাননীয় গভর্নরের পরে আলি কেনান ছিলো সবচাইতে শক্তিশালী মানুষ। তার কাছ থেকে ছাড়পত্র না পেলে কারো পক্ষে গভর্ণর সাহেবের কাছে পৌঁছার অন্য কোনো পথ ছিলো না। আলি কেনানের নাম সেই সময়ে ক্ষমতাসীন গোষ্ঠির বিভিন্ন মহলে রীতিমতো জল্পনা-কল্পনার বিষয়বস্তু হয়ে দাঁড়িয়েছিলো। আলি কেনান সুন্দর চেহারার মানুষ ছিলো না। গলার আওয়াজটিও ছিলো ভীষণ কর্কশ। তার চেহারা সুরত কথাবার্তায় কোনো লালিত্য, কোনো কোমলতার লেশ পর্যন্ত ছিলো না। তাকে ডাকাতের মতো দেখাতো। সাধারণতঃ সে হাসতো না। হাসতে দেখলে মনে হতো ভেতর থেকে ঠেলে ঠেলে ইতরতা প্রকাশ পাচ্ছে। আলি কেনানের মতো এমন একজন মানুষ কোন্ বিশেষ গুণে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্ণরের এমন পেয়ারা হয়ে দাঁড়িয়েছিলো, তা একটা রহস্য হয়ে উঠেছিলো। কেউ কেউ তাকে নব্য রাশপুটিন বলে মনে করতো।
আলি কেনান সম্পর্কে নানাজনে নানা কথা বলতেন। তার মধ্যে যে গল্পটি সর্বাধিক পরিচিত লাভ করেছিলো সেটি এ রকম :
একবার গভর্ণর সাহেব ভোলা শহরে মিটিং করতে গিয়েছিলেন। মফস্বলের ছোট্টো মহকুমা শহর। লঞ্চ পাড়ে ভেড়ানোর মতো কোনো জেটি ছিলো না। লঞ্চকে নদীর একরকম মাঝখানে থামতে হতো। যাত্রীরা নৌকোয় করে ডাঙ্গায় উঠতো। মহকুমা প্রশাসন গভর্ণর সাহেবের মতো মানুষের জন্যে কূলে নামার কোনো দ্র ব্যবস্থা করতে পারলো না। তাই লঞ্চ থেকে গভর্নর সাহেবকেও একটি বড়ো সরো নৌকোয় উঠে যেতে হলো। তিনি একা ছিলেন না, তার সঙ্গে ভোলা থেকে নির্বাচিত মাননীয় গণপরিষদ সদস্যও ছিলেন। সদস্য সাহেব রোদ চড়া থাকায় গভর্ণর সাহেবের মাথার ওপর ছাতা মেলে ধরেছিলেন।
সেটা এক অদ্ভুত পরিস্থিতির কাল। রাজনৈতিকভাবে গভর্নর সাহেবের দিনকাল খুব সুবিধের যাচ্ছিলো না। সর্বত্র সরকার বিরোধী আন্দোলন বেশ জোরালো হয়ে উঠেছিলো। এই ভোলা শহরেও তাঁকে বাধা দেয়ার জন্য এতো মানুষ সমবেত হতে পারে, সে কথা আগাম চিন্তা করলে তিনি একটু প্রস্তুতি গ্রহণ করেই আসতেন। তিনি তো লঞ্চ থেকে নেমে তীরের দিকে যাবেন। তীরে তাকে বাধা দেয়ার জন্য এতো জনতা সমবেত হয়েছে, মানুষের সেই জমায়েত দেখে মহকুমা শহরের অল্পস্বল্প পুলিশের ভয়ে জড়োসড়ো অবস্থা। তারা জনগণের আক্রমণ থেকে গভর্ণর সাহেবকে উদ্ধার করার বদলে নিজেরা কিভাবে পালিয়ে আত্মরক্ষা করবে, সে প্রচেষ্টায় ব্যস্ত ছিলো। ওদিকে গভর্ণর সাহেব নৌকায় উঠে বসেছেন। ডাঙ্গার মানুষ বাঁশ, কাঠ, ইট পাটকেল যা হাতের কাছে পাচ্ছে গভর্ণর সাহেবের নৌকোয় দিকে ছুঁড়ে মারছে। ভোলাতে গভর্ণর সাহেবের নিজের দলের মানুষ কম ছিলো না। ওই প্রাণ বাঁচানোর দায়ে তাদেরও নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে মজা দেখতে হচ্ছিলো। মহকুমা হাকিমের করবার কিছু ছিলো না। তিনি গুলি করার নির্দেশ দিতে পারতেন। কিন্তু তাতে হিতে বিপরীত হওয়ার আশঙ্কাই ছিলো বেশি।
গভর্ণর সাহেবতো নৌকায় উঠেছেন। ডাঙ্গা থেকে অবিরাম ইট পাটকেল ছুটে আসছে। লঞ্চে ফেরত যাবেন সে উপায়ও নেই। মাঝি মাল্লারাও সবাই জখম হয়ে গেছে। এক পর্যায়ে কপালে একটা ভাঙ্গা ইট লেগে তিনি নিজে জখম হয়ে গেলেন। কারো কারো মতে তিনি নদীতে মাথাঘুরে পড়ে গিয়েছিলেন। গণ পরিষদের সদস্য সাহেব ভোলার মানুষ, গাঙ তার কাছে পান্তা ভাত। ছাতাটা ফেলে দিয়ে মাত্র একটা ডুব দিয়ে মাথা বাঁচাতে তাঁর কোনো কষ্টই হয়নি। সেইদিনই গভর্ণর সাহেবের সলিল সমাধি ঘটে যেতে পারতো।
আলি কেনানরা তিন ভাই মাছ ধরা ডিঙি নৌকায় চড়ে ঘরে ফিরছিলো। গভর্ণর সাহেবের এতবড় বিপর্যয় দেখে নদীতে ঝাঁপ দিয়ে ডিঙিতে উঠিয়ে নেয়। তারপর জনতার ইট পাটকেল অগ্রাহ্য করে তড়িৎ গতিতে নৌকা চালিয়ে গভর্ণর সাহেবকে কোলে করে ডাঙ্গায় নামায় এবং পুলিশ বেষ্টনির ভেতর নিয়ে আসে। গভর্ণর সাহেব ফেরার সময় আলি কেনানকে সঙ্গে করে ঢাকা নিয়ে আসেন। ঢাকায় এসে ভোলার সমস্ত পুলিশ অফিসারদের বরখাস্ত এবং মহকুমা হাকিমের বদলির নির্দেশ দিয়ে বসেন। আর আলি কেনানকে খাস পিয়ন হিসেবে গভর্নর হাউসে পাকাঁপোক্তভাবে বহাল করেন।
সেই থেকে আলি কেনান গভর্ণর সাহেবের প্রিয় সখা পিয়ন যাই বলা হোক না কেনো, সবচাইতে সর্বশক্তিমান ব্যক্তির দ্বিতীয় সত্তা হিসেবে ষোলকলায় বাড়তে থাকে। গভর্ণর সাহেব মফস্বলে সফরে যাওয়ার সময় তার বাক্স পেটরা গুছিয়ে দিতো আলি কেনান। পানের সঙ্গে জর্দা এবং জয়পুরি মশলা ঠিকমতো নেয়া হয়েছে কিনা সে হিসেব রাখতো। গভর্ণর হাউজে বেয়ারা, খানসামা, আরদালির অন্ত ছিলো না। কিন্তু আলি কেনানের পজিশন ছিলো আলাদা। তার ডাকে সবাই বলির পাঠার মতো থর থর করে কাঁপতো। সে গভর্ণর সাহেবের খাওয়ার সময় ঠায় দাঁড়িয়ে সাহেবের খাওয়া দেখতো। গভর্ণর সাহেব অভুক্ত খাদ্য দ্রব্য আলি কেনানকে খেতে দিতেন।
আলি কেনান গভর্ণর সাহেব ঘুমোলে তাঁর ব্যক্তিগত টেলিফোন কলগুলো রিসিভ করতো। কোনো কারণে সাহেবের মন খারাপ থাকলে বা মেজাজ খিঁচড়ে গেলে টেলিফোনের অত্যাচার থেকে তার নির্জনতা রক্ষা করাও তার একটা দায়িত্ব ছিলো। গভর্ণর সাহেবের হামসায়াদের মধ্যে কেউ কেউ আলি কেনানকে বিশেষ পছন্দ করতো না। গভর্ণর সাহেবের একটি বাঁকা বাঁশের লাঠি ছিলো। সেটিকেও ঘনিষ্ঠদের অনেকে মনে করতেন একেবারে বেমানান। লাঠিটির কোনো ছিরিছাঁদ ছিলো না। অনেক সময় ভিখিরিরাও এ ধরনের লাঠি ব্যবহার করে। বন্ধু বান্ধবেরা মনে করতেন গভর্ণর সাহেবের লাঠিটি অধিক সুন্দর এবং সুগঠিত হওয়া উচিত। সোনারুপোর কারুকার্যমণ্ডিত চন্দন কাঠের লাঠি হলেই গভর্ণর সাহেবের জন্য মানানসই হয়। এরকম একটি লাঠি সগ্রহ করে দেয়ার অঢেল মানুষ ছিলো। গভর্ণর সাহেব ইচ্ছে করলেই এরকম একটা লাঠি আপনি এসে হাজির হতো। কিন্তু তাঁকে সে ইচ্ছে কখনো প্রকাশ করতে দেখা যায়নি। দু একজন অন্তরঙ্গ বন্ধু, অবসর মুহূর্তে এদিকে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। তিনি তাদের ধন্যবাদ দিয়ে একটি গল্প শুনিয়ে দিয়েছেন। গল্প নয় আসলে সত্য ঘটনা। গভর্ণর সাহেবের ওকালতি জীবনের মাঝামাঝি সময়ে এই বাঁশের লাঠির গুণে একবার বিষধর সাপের আক্রমণ থেকে রক্ষা পেয়েছিলেন। লাঠিটিকে যেমন তেমনি আলি কেনানকেও মানুষ গভর্ণর সাহেবের অবিচ্ছিন্ন অঙ্গ হিসেবে মেনে নিতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিলো। আলি কেনান যতো কর্কশ এবং রুঢ় ভাষী হোক না কেনো তার বিষয়ে ইজ্জত সম্মান মান অপমানের প্রশ্ন উত্থাপনের কোনো প্রশ্নই হয় না।
ডিপার্টমেন্টের সেক্রেটারি, কেবিনেটের মন্ত্রী, উচ্চপদস্থ আমলা, দলের নেতা, উপনেতা সকলের সঙ্গেই সে তেজের সঙ্গে তার ভোলার আঞ্চলিক ভাষাটিতেই সওয়াল জওয়াব করতো। তার ঔদ্ধত্য কতোদূর বেড়ে গিয়েছিলো- সে সম্পর্কেও একটা কাহিনী সর্বস্তরে পরিচিতি লাভ করেছিলো। নানা জিভের ঘষায় মূল কাহিনীটায় নানা রঙ লেগেছিলো। তবে আসলে যা ঘটেছিলো তার হুবহু বয়ান এরবম :
একবার হোম মিনিস্টার ওয়াজির হোসেন গভর্ণর সাহেবকে টেলিফোন করেছিলেন । তিনি তখন খাস কামরায় আরাম করছিলেন। আলি কেনান টেলিফোন ধরে জিজ্ঞেস করলো,
হ্যালো কেডা কইতাছেন? মন্ত্রী সাহেব মনে মনে বিরক্ত হলেন। তবু বিলক্ষণ জানতেন যে রাজদ্বারে যেতে হলে দ্বারীর লাঞ্ছনা শিরোধার্য করতে হয়। আলি কেনান বললো,
সাব কি কইবার চান কন? হোম মিনিস্টার সম্ভ্রান্ত বংশের সন্তান এবং নরম জবানের মানুষ। তিনি কণ্ঠস্বরে একটু গুরুত্ব আরোপ করে বললেন,
আমি হোম মিনিস্টার ওয়াজির হোসেন। বড়ো সাহেবের সঙ্গে কথা বলা প্রয়োজন। তুমি লাইনটা একটু দেবে? আলি কেনান দাপটের সঙ্গে জবাব দেয়,
না সাব অহন কতা অনবনা। সাব তিনঘণ্টা মিটিঙ কইরা হয়রান অইয়া অহন একটু আরাম করবার লাগছেন। কতা অইবনা। পরে টেলিফোন করেন।
হোম মিনিস্টার ফের অনুরোধ করেন,
দেখো না বাবা আলি কেনান, কথা বলাটা আমার বড়ো প্রয়োজন।
আপনের প্রয়োজন সাব আপনের লগে। আমি কি করবার পারি । সাব বিরক্ত না করবার কইছেন । হোম মিনিস্টার শেষ পর্যন্ত মরিয়া হয়ে বললেন,
বাবা আলি কেন তুমি একবার চেষ্টা করে দেখো না ।
এবার আলি কেনান চূড়ান্ত ক্ষেপে উঠলো,
সাব মিনিস্টার অইছেন আপনে, কিন্তু কুনু বিবেচনা আপনের নাই। আমি আপনের কতা রাখুম কেরে আপনে কি আমার কতা রাখছেন। চাকরিডা দিছেন আমার ভাগিনারে? যান সাবের লগে কতা অইবনা। যা পারেন, করেন গিয়া।
ওয়াজির হোসেন সাহেব আলি কেনানের এই ঔদ্ধত্যপূর্ণ ব্যবহার সম্পর্কে রীতিমতো লিখিত অভিযোগ করেছিলেন। গভর্ণর সাহেব কোনো আমলই দেননি। তিনি ওয়াজির হোসেন সাহেবকে ডেকে বলেছিলেন, ওয়াজির হোসেন সাহেব আপনি আলি কেনানের কথায় কান দেবেন না। সে যে কখন কি বলে আর করে তার কি ঠিক আছে? বেটা একনম্বরের পাগল। ওয়াজির হোসেন সাহেব গভর্ণর সাহেবের কথায় তুষ্ট না হয়ে বলতে যাচ্ছিলেন,
স্যার এভাবে যদি একজন পিয়ন অপমান করে, তবে…
গভর্ণর সাহেব লালচোখ মেলে তাকিয়ে জানতে চেয়েছিলেন, তবে কি মন্ত্রীগিরি ছেড়ে দেবেন? তারপর কিন্তু ওয়াজির হোসেন সাহেব আর কিছু বলেননি। গভর্ণর সাহেবের ভাষায় আলি কেনান ছিলো পাগল, তবে খুব হিসেবের পাগল। মন্ত্রী সেক্রেটারীদের ওপর প্রভাব খাঁটিয়ে অনেক আত্মীয় স্বজনকে সরকারি চাকরিতে ঢুকিয়ে নিয়েছে। তার আত্মীয় পরিজনদের মধ্যে লেখাপড়া জানা যোগ্য কেউ ছিলো না। তাই একান্ত ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও কাউকে পিয়ন, দারোয়ান আরদালির ওপরে বসাতে পারেনি। কেবল ফুফাতো বোনের ছেলেটি আই এ পরীক্ষায় ফেল করেছিলো। আলি কেনানের রক্ত সম্পর্কিতদের মধ্যে এই ভাগ্নেটিই ছিলো সবচাইতে উচ্চ শিক্ষিত। ভালোমতো উপরি পাওনা আছে এরকম একটা কেরানির চাকুরীর ব্যবস্থা করবে এটাই ছিলো তার আকাঙ্খ। মিনিস্টার ওয়াজির হোসেনের দপ্তরে এরকম একটা চাকুরী খালিও ছিলো। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মিনিস্টার গাদ্দারি করায় ভাগ্নেটির চাকুরী হলো না। এটা আলি কেনানের একটা বিরাট পরাজয়ও বটে। তার শোধ নিতে আলি কেনান ভুলেনি।
আলি কেনানেরা ছিলো সাত ভাই। ভাইদের মধ্যে একমাত্র সেই সামান্য লেখাপড়া করেছিলো। অন্য ভাইরা চাষ করতো। ধান ফলাতে পাট ফলাতো। আলি কেনান গভর্ণর হাউজে বহাল হওয়ার আগেও তাদের সাত সাতটি হাল ছিলো। গোটা গ্রামের মধ্যে আলি কেনানের পরিবারটা ছিলো সবচাইতে সম্পন্ন এবং পরাক্রমশালী। তাদের হালের বলদগুলো ছিলো মোটা এবং তাজা। লোকে দূর থেকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতো। চর অঞ্চলে তাদের নিবাস। সেখানে খুন জখম দাঙ্গা হাঙ্গামা এসব নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার। জরু এবং জমির মধ্যে মানুষ জরুর চাইতে জমিকে অধিক মূল্য দিতো সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। যার লাঠির জোর বেশি, চরের জমি তার দখলে থাকবে এটা দীর্ঘদিনের অলিখিত কানুন। আলি কেনানেরা ছিলো সাত ভাই। চাচাতো জ্যাঠাতো মিলিয়ে একডাকে পঞ্চাশজনের মতো জোয়ান মরদ তারা বের করে আনতে পারতো। যেদিকে যেতো সবকিছু কেটে চিরে ফাঁক করে ফেলতো। নিজেদের গ্রামে নয় শুধু আশেপাশের গ্রামের মানুষও তাদের চর অঞ্চলের ত্রাস মনে করতো। আলি কেনানেরা সাম্প্রতিক দাঙ্গায় দুজন মানুষকে কুপিয়ে খুন করেছে। কিন্তু সাক্ষী প্রমাণের অভাবে দারোগাকে ফাইনাল রিপোর্ট দাখিল করতে হয়েছে।
আলি কেনানের চাকুরী প্রাপ্তির সুযোগে তার আত্মীয় স্বজনের প্রতাপ গ্রামে হাজার গুণ বেড়ে গেলো। কারো টু শব্দটি করার যো রইলো না। আলি কেনান ভূমি রাজস্ব মন্ত্রীকে ধরে বিলকে বিল সরকারী খাস জমির বন্দোবস্ত নিয়ে ফেললো। আগেও তারা জোরে জবরে এসব জমি ভোগ দখল করতো। তবে কাজটি অতো সোজা ছিলো না। দাঙ্গা হাঙ্গামা করে দখল নিতে হতো। খুন জখম এসব ছিলো অনিবার্য ব্যাপার। অপরকে খুন করতে গেলে মাঝে মাঝে নিজেরও খুন হওয়ার ঝুঁকি সইতে হতো। থানা পুলিশ করতে হতো। মাঝে মাঝে মামলা হাইকোর্ট অবধি গড়াতো।
সরকারি অনুমোদনের বলে কোনো বড় ধরনের ঝুঁকি গ্রহণ ছাড়া তারা বিশাল ভূসম্পত্তির অধিকারী হয়ে বসলো। তাদের বাধা দেয়ার মতো কোনো শক্তি ছিলো না। থানা পুলিশ মায় মহাকুমা হাকিম পর্যন্ত চোখ কান বুজে থাকতেন। গভর্ণর হাউজে আলি কেনানের প্রতিপত্তির কথা গ্রামে পঞ্চাশগুণ বেশি করে প্রচারিত হয়েছে। সত্যি সত্যি গ্রামের মানুষ বিশ্বাস করতে আরম্ভ করেছিলো তার পরিবারের বিরাগ ভাজন হলে আলি কেনান লাট সাহেবকে বলে ফাঁসি পর্যন্ত দেয়ার ক্ষমতা রাখে। গ্রামের লোকের ছিলো জানের ভয়, আর আমলাদের চাকরির। আলি কেনানের বাবা পঁয়ষট্টি বছর বয়সে ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হয়ে গেলো। চাচাতো জেঠাতো দুভাই মৌলিক গণতন্ত্রের সদস্য হয়ে বসলো। তখন তাদের আর পায় কে? গোটা ইউনিয়নের সালিশ বিচার সবকিছু করার অধিকার আলি কেনানের পরিবারের একচেটিয়া হয়ে গেলো। ঢাকার গভর্ণর হাউজের অনুকরণে ভোলা মহকুমার তামাপুকুর গ্রামে একটি ক্ষুদ্র ক্ষমতা কেন্দ্র তারা তৈরি করে ফেললো। প্রেসিডেন্ট আইয়ুব যেমন ইসলামাবাদে বসে পূর্ব পাকিস্তানের শাসন কর্ম পরিচালনা করতেন। আলি কেনানও তেমনি ঢাকার গভর্ণর হাউজে বসে তামাকুপুর গ্রামের যাবতীয় কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ করতো।
একবার আলি কেনানের বোনের সঙ্গে কি কারণে তার ভগ্নিপতির ঝগড়া বাধে। বলাবাহুল্য, তাদের সাত ভাইয়ের বোন ওই একটিই এবং সে সকলের ছোটো। ভাইয়েরা তাকে ভীষণ আদর করতো। পিতৃ পরিবারের উত্তরোত্তর শ্রী বৃদ্ধিতে বোনটির চোটপাট ভালোরকম বেড়ে গিয়েছিলো। একদিন কি কারণে জানা যায়নি ভগ্নিপতি একটা পীড়ি দিয়ে আঘাত করে বোনের মাথাটা ফাটিয়ে দেয়। গ্রামদেশে এই জাতীয় সংবাদ প্রচারিত হতে বেশি সময় নেয় না। শুনে ভাইয়েরা লাঠি হাতে বোনের শ্বশুর বাড়ির দিকে ছুটে যায়। তাদের বাড়ি অবধি যেতে হলো না। বাজারের কাছেই ভগ্নিপতির সাথে মুলাকাত হয়ে যায়। তারা ভগ্নিপতিকে সাপের মতো পেটাতে থাকে। এদিকে বোনের কাছে খবর যায়, যে তার ভাইয়েরা এসে সোয়ামীকে পেটাচ্ছে। বোন লাজ শরম ত্যাগ করে একেবারে প্রকাশ্য রাস্তায় ছুটে . এসে ভাই এবং খসমকে মাঝখানে দাঁড়ায়। ভাইদের হাত থেকে লাঠি কেড়ে নেয়। আহত সোয়ামীর দিকে তাকিয়ে তার বুঝি একটু দয়া হয়, কিন্তু ভয় দেখাতে ভুলে না। ভাইজান এই হারামীর পুতরে মাইরা হাত গন্ধ কইর্যা কি লাভ। তার বদলে বড় ভাইজানরে একখানা চিঠি লেইখ্যা দেন। ভাইজান লাট সাবরে কইলে সৈন্য আইন্যা হের সাত গুষ্ঠিরে হাগাইয়া ছাড়বো। আসলেও মানুষ বিশ্বাস করতো, আলি কেনান তামাপুকুর গ্রামে সূর্য ওঠাতে আর ডোবাতে পারে।
আলি কেনানের দিনগুলো দিব্যি কাটছিলো। এই সময়ে সে গভর্ণর সাহেবের মতো দাড়ি রেখে দিয়েছে। একটা জিন্নাহ টুপি কিনে পরতে আরম্ভ করেছে। কালো কাপড় কিনে একটা শেরওয়ানী বানিয়ে নেয়ার কথাও তার মনে উদয় হয়। কিন্তু অতোটুকু সাহস করে উঠতে পারেনি। তাছাড়াও ইদানিং মনে একটা গোপন বাসনা হানা দিতে আরম্ভ করেছে। সে স্থির করেছে, আগের সে পুরোনো বউ দিয়ে তার চলবে না। সবদিক দিয়ে যোগ্য দেখে তার আরেকটা বিয়ে করা উচিত। সর্বক্ষণ বড়ো সাহেবের সঙ্গে থাকতে হয় বলে এ আকাঙ্খটি তার অপূর্ণ রয়ে গেছে।
সকলের দিন সমান যায় না। আলি কেনান ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি যে অদূর ভবিষ্যতে নীল নির্মেঘ আকাশে তার জন্য বজ্রপাত অপেক্ষা করছিলো। ঘটনাটি আচমকা ঘটে গেলো।
আরেকদিন গভর্ণর সাহেব দীর্ঘ চারঘণ্টা ধরে তাঁর দলের নেতাদের নিয়ে মিটিং করার পর একটু আরাম করে নিচ্ছিলেন। আলি কেনান অন্যান্য দিনের মতো টেলিফোনের গোড়ায় বসে ঝিমুতে ঝিমুতে নতুন বিয়ে করার বিষয়টি চিন্তা করছিলো। এমন সময়ে টেলিফোনটা তরুণ বজ্রের মতো চিৎকার করে উঠলো। আলি কেনান ভীষণ বিরক্ত হলো। আজকাল সে টেলিফোন কল রিসিভ করার সময় ভীষণ বিরক্তি বোধ করে। গভর্ণর সাহেবকে টেলিফোন করে যারা তার গভীর ভাবনায় বাধার সৃষ্টি করে, মনে মনে তাদের কুত্তার বাচ্চা বলে গাল দেয়। তবু রিসিভার কানে তুলে জিজ্ঞেস করলো, কেডা? ওপাশ থেকে গভর্ণর সাহেবের পিএ জানালেন, সাহেবকেই তার চাই। আলি কেনান তার চিরাচরিত প্যাটেন্ট জবাবটাই দিলো, বড়ো সাব আরাম করবার লাগছেন। অহন কতা অইবনা।
পি এ বললো, অত্যন্ত জরুরি। ইসলামাবাদ থেকে প্রেসিডেন্ট সাহেব কথা বলবেন। আলি কেনান এই পিএটিকে দুচোখে দেখতে পারতো না। সে মনে করতো তাকে সময়ে অসময়ে বিরক্ত করার জন্যই এই পিএ বেটার জন্ম হয়েছে। সে তার গ্রাম্য কুটবুদ্ধি দিয়ে হিসেব করলো, প্রেসিডেন্ট সাহেবের টেলিফোন ফেল করিয়ে দিলে পিএ ব্যাটার চাকুরি যাবে, তার কি!
পিএ সাহেব বারবার অনুরোধ করে আলি কেনানকে রাজি করাতে না পেরে সমস্ত প্রটোকল ভেঙে গভর্ণর সাহেবের শয়ন কক্ষে প্রবেশ করলো। তারতো চাকুরী এবং ঘাড় দুটো বাঁচানো প্রয়োজন। তিনি অনেকটা চীকার করেই ঘোষণা করলেন,
স্যার ইসলামাবাদ থেকে প্রেসিডেন্ট সাহেবের কল। গভর্ণর সাহেব পাজামার। রশিটি খুলে দিয়ে দিবান্দ্রিা উপভোগ করছিলেন। প্রেসিডেন্ট সাহেবের কল শুনেই হন্তদন্ত হয়ে উঠে দাঁড়ালেন। পাজামার রশি বাঁধার কথাটিও ভুলে গিয়েছেন। তাড়াতাড়ি রিসিভার তুলে নিলেন। প্রেসিডেন্ট সাহেব তাঁকে কর্তব্যে গাফিলতির জন্য অনেকক্ষণ ধরে উর্দু, পশতু এবং ইংরেজি মিশিয়ে চৌদ্দ পুরুষ তুলে গাল দিলেন। গভর্ণর সাহেব থেমে থেমে ‘মাই প্রেসিডেন্ট যেয়াদা সুর হো গয়া’ শব্দ কটি উচ্চারণ করলেন। আর ওপাশ থেকে অজস্র ধারায় গালাগালির স্রোত প্রবাহিত হতে থাকলো। ঘণ্টাখানিক পরে টেলিফোন রেখে গভর্ণর সাহেব পিএকে তলব করলেন। পিএ তার সামনে এসে বলির পাঠার মতো কাঁপতে থাকে। সাহেবের মেজাজ তখন সপ্তমে। তিনি কৈফিয়ত দাবি করে বললেন,
এই কুত্তার বাচ্চা টেলিফোন দিতে এতো দেরী করলি ক্যান। পিএ ভদ্রলোক অত্যন্ত স্র স্বভাবের মানুষ। কেউ কঠোরভাবে কথা বললে যথাসম্ভব মার্জিত জবাব দেয়াটাই তার অভ্যেস। তিনি বললেন, স্যার আমি প্রথম থেকেই আলি কেনানকে অনুরোধ করে আসছিলাম। সে বারবার বলেছে আপনাকে ডেকে দিতে পারবে না। তাই শেষ পর্যন্ত আপনার বেডরুমে ঢুকে পড়তে হলো। স্যার এ বেয়াদফী মাফ করে দেবেন। আচ্ছা তুমি যাও এবং এডিসিকে আসতে বলে। এডিসি এলে গভর্ণর সাহেব রেগে অগ্নিশর্মা হয়ে নির্দেশ দিলেন, এই কুত্তার বাচ্চা আলি কেনানকে এখখুনি ঘাড় ধরে বের করে দাও। সংক্ষেপে এই হলো আলি কেনানের স্বর্গ থেকে পতনের কাহিনী।
২. গভর্নর হাউজ থেকে রাস্তায়
সে দিন সন্ধ্যেবেলা গভর্নর হাউজ থেকে রাস্তায় বেরিয়ে আলি কেনানের মনে হলো বিগত একটা বছরের জীবন সে যেনো স্বপ্নের মধ্যে কাটিয়েছে। সে ছিলো ভোলার তামাপুকুর গ্রামের এক অখ্যাত অভাজন আলি কেনান। গভর্ণর হাউজের সু উচ্চ গম্বুজের দিকে তাকিয়ে তার অবাক লাগে কি করে এই আলিশান অট্টালিকায় প্রবেশ করে গভর্ণর সাহেবের সবচেয়ে পেয়ারের মানুষ হয়ে উঠেছিলো। গল্পের মতো মনে হয়, স্বপ্নের মতো লাগে।
তার সেদিনটির কথা মনে পড়ে গেলো; যেদিন গাঙের গভীর পানি থেকে পাঁজা কোলা করে ডুবন্ত গভর্ণর সাহেবকে ডিঙ্গিতে উঠিয়ে নিয়েছিলো। আলি কেনানেরা সাত ভাই যদি সেদিন জানের ঝুঁকি নিয়ে গভর্ণর সাহেবকে বাঁচাতে ছুটে না আসতো ঐ গাঙের পানিতেই তার ভবলীলা সাঙ্গ হতো। আজ এ কথা কে বিশ্বাস করবে। ওই পূর্ব পাকিস্তানের গভর্ণর সাহেব তাকে চূড়ান্ত অপমান করে এক কাপড়ে বলতে গেলে একরকম. উলঙ্গ অবস্থায় শহরের মাঝখানে ময়লা আবর্জনার মতো ছুঁড়ে দিলেন। হায়রে আল্লা তোমার রাজ্যে এতো অবিচার! আর মানুষ এতো অকৃতজ্ঞ হতে পারে!
এখন আলি কেনানের প্রধান সমস্যা সে যাবে কোথায়? ভোলায় নিজ গ্রামে ফিরে যাওয়ার কথা স্বাভাবিকভাবেই মনে এসেছে। কিন্তু সত্যি সত্যি ব্যাপারটা ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করে দেখে তার শিরার রক্ত চলাচল একরকম বন্ধ হয়ে আসার উপক্রম। হ্যাঁ, সে ভোলায় ফিরে যেতে পারে বটে। আর যদি ফিরে যায় মানুষ কাল হোক, পরশু হোক একদিন জেনে যাবে লাট লাহেব তাকে পাছায় লাথি দিয়ে তাড়িয়ে দিয়েছে। তখন অবস্থাটা কি দাঁড়াবে? তার ভাই বেরাদরেরা যে সকল মানুষকে বিপদে ফেলেছে, শাস্তি দিয়েছে তারা তো আর বসে থাকবে না। আলি কেনানের সমস্ত কীর্তি তার চোখের সামনে খসে খসে পড়বে। সমস্ত জমি জমার পাল্টা দখল শুরু হয়ে যাবে। দুজন মানুষের লাশ তারা চরের মধ্যে পুঁতে রেখেছে। তারা জ্যান্ত হয়ে বদলা দাবি করবে। থানার দারোগা, খাশ মহালের কর্মচারী, মহকুমার এসডিও এতোকাল অনন্যোপায় হয়ে আলি কেনানের আবদার দাবি পূরণ করতে এগিয়ে এসেছে। এখন সকলে পিঠ ফিরে দাঁড়াবে। আলি কেনান স্পষ্ট দেখতে পায় তার সৌভাগ্যের নক্ষত্র ডুবে গেছে। এখন তামাপুকুর গ্রামে ফিরে যাওয়া মানে এক পাল নেকড়ের মধ্যে উলঙ্গ হয়ে দাঁড়ানো। ভোগান্তিটা যদি শুধু একা আলি কেনানের হতে কোনো কথা ছিলো না। আলি কেনান জানে পুরুষের ভাগ্য এরকমই। কিন্তু সে চোখ মেলে দেখতে পারবে না তার বুড়ো বাপকে গ্রামের মানুষ অপমান করছে, ভাইদের কোমরে দড়ি পরছে, চাষের জমি বেহাত হয়ে যাচ্ছে। অসহায়ের মতো এসব দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখার বদলে আলি কেনানের মরে যাওয়া অনেক ভালো। তাছাড়া আরো একটা ব্যাপার আছে। আলি কেনান নিজেকে এতোদিন পরিবারের সৌভাগ্যের প্রতীক বলে মনে করে এসেছে। আজকে দূর্ভাগ্যের জ্যান্ত প্রতিমূর্তি হিসেবে কিভাবে আত্মীয় স্বজনের সামনে কালোমুখ দেখাবে। তার বদলে আলি কেনানের পক্ষে চলন্ত ট্রেনের নিচে আস্ত শারীরখানা পেতে দেয়া অনেক সহজ হবে। আলি কেনান যেই মায়ের পেটে নমাস ছিলো সেখানে যেমন ফেরত যেতে পারে না, তেমনি পারে না ভোলার তামাপুকুর গ্রামে ফিরে যেতে। আত্মীয় স্বজনদের অনেককেই সে ঢাকা শহরে পিয়ন দারোয়ানের চাকুরিতে বহাল করেছে। ওদের কারো কাছে যাওয়ার কথা তার মনের ধারে কাছেও ঘেঁষেনি। কেননা তাদের কাছে আলি কেনানের পজিশন ছিলো গভর্ণর সাহেব নন, স্বয়ং আইয়ুব খানের মতো। সুতরাং ওদের কাছেও সে যেতে পারে না।
গভর্ণর-হাউজে জন্মানো খোলস পরিবর্তন করে নতুন খোলস জন্মাতে মোটামুটি তিন মাসের মতো সময় লেগেছে। এরই মধ্যে আলি কেনান মেসে বসবাস করেছে। সদঘাট লঞ্চ টার্মিনালে ঘুমিয়েছে। শহরের পার্কে বসে বসে আত্মহত্যার কথাও চিন্তা করেছে। কিন্তু আজ লঞ্চ থেকে নামা যাত্রীর কাছ থেকে টাকাটি আদায় করতে পারায় আলি কেনানের চোখে নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন ভীড় করে।
আলি কেনানের মত মানুষ ভাংবে অথচ মচকাবে না। পৃথিবীতে এখনও তার বাঁচবার যথেষ্ট উপায় আছে। তার জামা কাপড় একদম ছিঁড়ে গিয়েছিলো গভর্ণর সাহেবের অনুকরণে দ্বিতীয়বার চাদেও মতো সুন্দর করে দাড়ি রাখতে আরম্ভ করেছিলো। আজ শখ, বিলাস উচ্চাকাঙ্খগুলো তাকে মুখ ভ্যাংচাতে আরম্ভ করেছে। মুখে দাড়ির জঙ্গল হয়ে গেছে। জামা কাপড় ছিঁড়ে এমন এক দশা হয়েছে ইচ্ছা করলে আলি কেনান এখন ভিখিরিদের সারিতে গিয়ে দাঁড়াতে পারে। একটি পানের দোকানের আয়নায় আলি কেনান আরেকবার তার চেহারা সুরত ভালো করে দেখে নিলো। ময়লা ত্যানা পাজামা পাঞ্জাবি, মুখে একমুখ দাড়ি উসকো-খুসকো জট বাঁধা মাথার চুল। আগুনের ভাটার মতো জ্বলজ্বলে চোখের দৃষ্টি সব মিলিয়ে তাকে পাকা দরবেশের মতো দেখাচ্ছে। নিজেকে ঠিক ভিখিরি হিসেবে কল্পনা করার চেয়ে এ অনেক ভালো। একবার নিজের সম্পর্ক যখন নিশ্চিত হলো, কোত্থেকে সাহস এসে তাকে নতুন জীবনের পথে ছুটিয়ে নিয়ে গেলো।
চোখের সামনে যে রেস্টুরেন্ট পড়লো, সরাসরি ঢুকে গেলো। টেবিলে একটা থাবা দিয়ে বেশ গম্ভীর স্বরে উচ্চারণ করে বসলো, দে তর বাপরে একটা ট্যাহা দিয়া দে। আলি কেনান তার চোখদুটি ক্যাশে বসা লোকটির চোখের ওপর রাখলো। মানুষটি বেশ লম্বা চওড়া মাথায় কিস্তি টুপি এবং মুখে চিকন করে কাটা দাড়ি। লোকটি একটা বাক্যও উচ্চারণ না করে ক্যাশ খুলে একটা টাকা তার হাতে দিলো। আলি কেনানের হাত কাঁপছিলো। পা টলছিলো। শরীরের অবাধ্য স্নায়ুর আন্দোলন থামাবার জন্য তাকে কিছু একটা করতে হবে। তাই বললো,
আল্লাহ, তরে অনেক দিব।
এভাবে প্রথম দিনেই সে তেরো টাকা সংগ্রহ করে ফেললো। প্রথম দিনের আদায় হিসাবে মন্দ না। সব দোকানদার দেয়নি। তার জন্য আলি কেনান দোকানদারদের দোষ দেয়না। নিজের অন্তনিহিত দুর্বলতাকে দায়ী করে। সে খতিয়ে খতিয়ে হিসেব করে তার গলার আওয়াজটা অস্বাভাবিক রকমের দুর্বল ছিলো। প্রয়োজনীয় জোর সে প্রয়োগ করতে পারেনি। কিংবা দোকানে এতো ভীড় ছিলো যে তার আওয়াজ মালিকের কানে পৌঁছুতেই পারেনি। কালে কালে এসকল ছোট খাটো দোষত্রুটি সংশোধন করে নেয়া যাবে। মানুষতো তাকে টাকা দেয়ার জন্য বসেই আছে। সে নির্দেশ দিতে জানে। এমন নির্দেশ দিতে হবে যাতে অন্তরাত্মা পর্যন্ত কাঁপিয়ে তুলতে পারে। আলি কেনানের সৃজনী শক্তি আছে, একথা স্বীকার করতে হবে। সে ভেবে দেখলো এই দরবেশী জীবনের সঙ্গে খাপখাইয়ে নেয়ার মতো একটা আশ্রয়ও খুঁজে বের করতে হবে। কথায় বলে আস্তানা না পেলে মস্তান হয় না। ফুলতলির ওদিকে গতকাল সে একটা বাঁধানো কবর দেখেছে। চারপাশের দেয়ালের ঘেরটা বেশ বড়ো। অনায়াসে একজন মানুষের ঘুমোনোর পক্ষে যথেষ্ট। ঝড়বৃষ্টি হলে অসুবিধে হতে পারে। হ্যাঁ তা একটু হতে পারে বৈকি। তবে এখন আশ্বিন মাস। নীল নির্মেঘ আকাশ, আরামসে আলি কেনান এখানে রাত কাটাতে পারে। আর ভাগ্য যদি প্রসন্ন হয় কালে কালে একটা চালা উঠিয়ে নেয়া অসম্ভব নাও হতে পারে। সেই রাত থেকে আলি কেনান ফুলতলির কবর স্থানে বসবাস আরম্ভ করে দেয়। যারা দেখেছে এক আধটু কৌতূহলী হয়ে তাকিয়েছিলো কোনো প্রশ্ন করেনি। এ ধরনের ঘটনাতে হামেশাই ঘটে। দরবেশ ফকির ওরা তো সবখানে মাটি খুঁড়ে জন্মায় আর মানুষ তাদের মেনে নিতে অভ্যস্ত। একটা বখাটে ছেলে শুধু বলেছিলো, দরবেশ বাবা যতোদিন ইচ্ছা থাকবার পারবা, আমাকে মাসে মাসে পঁচিশ ট্যাহা খাজনা দেওন লাগবো। আগে বাগে কয়্যা রাখলাম। তুই কুন গাঞ্জাখোর বেটা ট্যাহা চাস? আলি কেনানও সমান তেজের সঙ্গে জবাব দিয়েছে, না ঠেকলে চিনবার পারবিনা আমি কে? ছেলেটি প্রায় তেড়ে এসে বলেছিলো, তোর দওবেশগিরি পাছা দিয়া হান্দাইয়া দিমু। এই হানে থাকতে অইলে মাসে মাসে পঁচিশ ট্যাহা দেওন লাগবো। এনিয়ে আলি কেনানের সঙ্গে হাতাহাতি হওয়ার উপক্রম। আরেকটি যুবক হস্তক্ষেপ করায় অধিক দূর গড়াতে পারলো না। হাত ধরে ছেলেটিকে নিবৃত্ত করে বললো,
আবে কালাচান, আল্লাহ কার ভিতরে কি মাল ভইরা থুইছে কইবার পারবি? এটা তো নতুন কোনো কথা নয়, চোরগুন্ডারা ফকির দরবেশকে বেশী ভক্ত করে। সুতরাং আলি কেনান ফুলতলির বাঁধানো কবরটিতে পাকা ঠিকানা পেতে বসলো। আলি কেনানের বিচরণ ক্ষেত্র অনেক দূর বিস্তৃত হয়েছে। কোনো কোনো দিন সে বাংলা বাজার সদরঘাট অঞ্চলে টাকা তুলতে যায়। কোনোদিন কমলাপুর, আবার কোনো দিন নওয়াবপুর। টিপু সুলতান রোড হয়ে নারিন্দা অবধি সমস্ত এলাকাটিকে সে তার নিজের জমিদারি বলে মনে করতে আরম্ভ করেছে। একেকটি এলাকায় সে পনেরোদিন অন্তর একবার দর্শন দেয়। পূর্বের মতো টেবিলে থাবা দিয়ে বলতে হয় না, ‘তর বাপরে একটা ট্যাহা দিয়া দে।’ এখন তার দাবি করার পদ্ধতিটাও অনেক সহজ হয়ে পড়েছে। যে শুধু তার উপস্থিতিটুকু জানিয়ে দেবার জন্যে উচ্চারণ করে, তর বাপরে…। বাক্য ব্যয় না করে দোকানদার একটি টাকা এগিয়ে দেয়। কেউ কেউ বেশীও দেয়। সে আপত্তি করে না, কিন্তু এক টাকার কম অর্থ আলি কেনান গ্রহণ করে না।
সময় গড়িয়ে যাচ্ছে। আলি কেনানের অভিজ্ঞতার ভাণ্ডার সমৃদ্ধ হচ্ছে। সে কবরের চার কোণে চারটি ত্রিকোণাকার লাল নিশান টাঙিয়েছে। কবরটিকে আপাদমস্তক লাল শালুতে ঢেকে দিয়েছে। প্রতি সন্ধ্যায় মোমবাতি জ্বালায়। কবরের এই আকস্মিক শ্রীবৃদ্ধিতে কিছু কিছু গাঁজাখোর, চণ্ডু খোর ভীড় করতে আরম্ভ করেছে। আলি কেনান লাল শালুর একটা লুঙ্গী এবং একটা আজানুলম্বিত আলখাল্লা বানিয়ে নিয়েছে। গলায় বড় বড় দানার কাঠের মালা পরেছে। দুটি লোহার শেকল কাঁধের পাশ দিয়ে ঘুরিয়ে কোমর অবধি ঝুলিয়ে দিয়েছে। এখন মাঝে মাখে তার জজবার ভাব হয়। সে সময়ে আলি কেনান অনেকটা ভাবের আবেশে কি গাঁজার নেশায় বলা মুশকিল, গেয়ে ওঠে :
হেই মানুষ জনম গুনাহগার
ভবনদী কেমনে দিবি পার
সময় থাকতে গুরুর পন্থা ধর
বাবা বু আলি কলন্দর
বাবা বু আলি কলন্দরা।।
একদিন আলি কেনান লক্ষ্য করে একটা কুকুর ছানা কুই কুঁই করে কবরের চারপাশে ঘুরছে। পয়লা তার ইচ্ছে হয়েছিলো হারামজাদা কুত্তার বাচ্চাটার একটা ঠ্যাং ল্যাংড়া করে দেয়। কুত্তার বাচ্চার দুঃসাহস তো কম নয়। পরক্ষণে তার মনে একটা মৌলিক ভাবনা জন্মায়। জখম না করে কুকুর ছানাটিকে একটু করো পাউরুটি খেতে দেয়। এভাবে দুচারদিন যেতে না যেতে কুকুর ছানাটি তার ভীষণ ন্যাওটা হয়ে পড়ে। প্রতিদিন সে নদীতে গোসল করতে যাওয়ার সময় কুকুরছানাটিকে সঙ্গে নিয়ে যায়। আপন হাতে রগড়ে রগড়ে সারা গা পরিষ্কার করে। একদিন বাজার থেকে লাল এবং সবুজ রঙের গুড়ো কিনে আনে। একটা গামলাতে সে রঙ ভাল করে গুলে নিয়ে কুকুর ছানাটির পিছনের দিকে সবুজ এবং সামনের দিকে লাল রঙ লাগিয়ে দেয়। তখন শিশু কুকুরটিকে আশ্চর্য সুন্দর দেখাতে থাকে। আলি কেনান একদৃষ্টে নিজের শিল্প কর্মের দিকে তাকিয়ে থাকে। আশ মেটে না। আবার দোকানে যেয়ে সুন্দর পেতলের শিকল এবং ঘণ্টি কিনে আনে। চামড়ার বেল্টের সঙ্গে জুড়ে আটটি ঘণ্টি গলায় ঝুলিয়ে দেয়। কুকুরটি চলতে ফিরতে টুং টুং আওয়াজ করে। এই ছোট্ট শিশু জন্তুটির এত সব ছলা কলা দেখে আলি কেনানের আনন্দ আর ধরে না।
একদিন আদায়ে বের হবার সময় কুকরি ছানাটিকেও সঙ্গে নিয়ে যায়। এই বিচিত্র জন্তু দর্শন করে শহরের শিশুরা তার পিছু পিছু অনুসরণ করে, হাত তালি দেয়। দেখা গেলো কুকুর ছানা নিয়ে যাওয়ার একটা বাস্তব সুবিধেও আছে। দোকানদারদেও আর তর বাপরে… বলে জানান দিতে হয় না। ঘণ্টির শব্দ শুনে সকলে আপনি মনোযোগী হয়ে ওঠে। আলি কেনান রোজ সকালে একটু বেলা করে কুকুর ছানাটি সঙ্গে নিয়ে শহরের পথে হেঁটে যায়। টুংটুং ঘণ্টির আওয়াজ হয়, লোকজন পিছন পিছন হল্লা করে। নতুন একটা চমৎকার জীবন লাভ করে কুকুর ছানাটি মাঝে মাঝে আনন্দে নেচে উঠে। আলি কেনানের অসম্ভব ভাল লাগে। তবে এই নতুন জীবনের সঙ্গে গভর্ণর সাহেবের জীবন বিনিময় করতে সে রাজি হবে না। গর্বে তার চোখে জল এসে যায়। কোনো মানুষের সাহায্য ছাড়া এই নতুন জীবনটিকে আপন প্রাণের ভেতর থেকে ফুঙ্কার দিয়ে মন্ত্রবলে জাগিয়ে তুলেছে।
কিছুদিন পর তার মনে অন্যরকম একটা ভাবনা আসে। এভাবে রোজ রোজ কুকুর নিয়ে ঘুরলে লোকজনের চোখে ওজন কমে যেতে পারে। এতোকাল ঘুমের মধ্যে ছিলো, এদিকটা সে চিন্তা করেনি। সে অনুভব করলো একজন কাউকে প্রয়োজন যে শিকল ধরে সঙ্গে সঙ্গে কুকুরটিকে নিয়ে যেতে পারবে।
সেদিন সন্ধ্যেবেলা বহাদুর শাহ পার্কের পাশ দিয়ে হেঁটে আসছিলো। সে খুব ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলো। পুরো নওয়ারপুর এলাকাটা চক্কর দিতে হয়েছে। আলি কেনান ভেবেছিলো পার্কে ঢুকে একটু জিরিয়ে নেবে। ঢুকেই দেখতে পেলো, একটা ছেলে লম্বা হয়ে পাথরের বেঞ্চির ওপর ঘুমিয়ে আছে। পরনের জামাটি শতছিন্ন । ক্লিষ্ট মলিন মুখ পেটের চামড়া গিয়ে পিঠে লেগেছে। কতদিন খায়নি কে জানে! এরকম কতো ছেলেই তো এভাবে শুয়ে থাকে। আলি কেনান হাঁক দিলো, এ্যাই শালা চোর। ছেলেটি ভয়ে ভয়ে শোয়া থেকে উঠে কাঁপতে কাঁপতে বললো :
মুই চোর নই। মোর বাপ মাকে তালাক দিয়া আবার হাঙ্গা বইছে। হের লাইগ্যা মুই বাপের উপর রাগ কইরা চইল্যা আইছি। চাইর দিন কিছু খাইনাই। আন্নে মোর বাবা, মোরে দুগা খাইবার দেন। আলি কেনান জানতে চাইলো,
তোর বাড়ী কই শালা?
মোর বাড়ি হাতিয়া। ছেলেটি ভীষণ ভয় পেয়েছে। কিন্তু দুটো খাওয়া পাওয়ার আশাও ছাড়েনি। আলি কেনান বললো, শালা তুই চোর । ছেলেটি তার পায়ের উপর আছার খেয়ে বললো, মুই চোর নই । মোর পেটে ভুখ।
আলি কেনান নির্দেশ দিল,
শালা খাড়াইয়া কথা ক। ছেলেটি কাঁপতে কাঁপতে উঠে দাঁড়ায়। আলি কেনান তার হাতে কুকুরের শিকলটি ধরিয়ে দিয়ে বললো, শালা চল। সেদিন থেকে আলি কেনানের পেশায় সহায়তা করার জন্য কুকুর ছানার পাশাপাশি একটি মানব শিশুও তার সঙ্গে যোগ দিলো।
৩. আলি কেনানের সম্প্রসারণশীল কল্পনা
আলি কেনানের সম্প্রসারণশীল কল্পনা ঝর্ণাধারার মতো চারদিকে ছড়িয়ে পড়তে করতে আরম্ভ করেছে। তার আকাঙ্খ অনেক। আপাততঃ সে গুটিকয় খুচরো কাজে মনোযোগ দিতে আরম্ভ করেছে। ফুলতলির বাঁধানো কবরের পাশে একতলা বাঁশের ঘরটি নাম মাত্র মূল্যে ভাড়া নিয়ে তাতে পার্টিশন লাগিয়ে একটা হুজরাখানা প্রতিষ্ঠা করেছে। পার্টিশনের অপর পাশে কুকুর ছানাসহ ছেলেটি ঘুমোয়। এই সমস্ত কাজে খরচ করবার মতো টাকা আলি কেনানের হাতে আছে। উদ্যোগী মানুষকে সবাই সাহায্য করতে আসে। মহল্লার মানুষেরা ইতিমধ্যে নানা ব্যাপারে তার কাজে হাত লাগাতে ছুটে এসেছে। এলাকায় আলি কেনান আসার পর থেকে দৈনন্দিন জীবন যাপনের একঘেঁয়েমির মধ্যে একটা নতুন হাওয়া বইতে আরম্ভ করেছে ।
আলি কেনান নতুন ভাড়া করা ঘরটিতে অভ্যাগতদের বসবার সুবিধের জন্য হোগলার চাটাই পেতে রেখেছে। ননান মানুষ এখন তার কাছে আসে। তারা সেখানে এসে অপেক্ষা করে। সে আনুমানিক সকাল আটটা পর্যন্ত হুজরাখানার মধ্যে কাটায়। আবার সন্ধ্যেবেলাও ঘণ্টা খানেক সেখানে গভীর চিন্তায় নিমগ্ন থাকে। তখন সে তার নিজের মুখোমুখি হয়। একান্ত একাকিত্বের পরিমণ্ডলের মধ্যে নিজের শক্তি সামর্থ্য অনুভব করতে থাকে। আলি কেনানের এই জীবনের স্বাদটাই আলাদা। এখন সে আর কোনো সম্রাটের সঙ্গেও ওই জীবন বিনিময় করতে রাজি হবে না। স্বাধীনতা, স্বাধীনতা, চারদিকে অবারিত স্বাধীনতা। নিজেকে তার সব কিছুর নিয়ন্তা বলে মনে হয়। যতো একাকী হয় ততোই অনুভব করে সে ঈশ্বরের মতো শক্তিমান। নানা জাতের মানুষ এসে হোগলার চাটাইতে বসে অধীর আগ্রহে তার জন্য অপেক্ষা করে। সংসারে রোগ শোক আছে। আছে আশা ভঙ্গের বেদনা। আল্লাহতায়ালা মাটি দিয়ে গড়েছেন মানুষ। আর সে মানুষ বড়ো দুর্বল। প্রতি মুহূর্তে কারো কাছ থেকে ভরসা আদায় করে তাকে বাঁচতে হয়। জীবন সংগ্রামে কাতর মানুষ কোথায় পাবে সর্বক্ষণ জীবনের বোঝা বইবার প্রেরণা। আলি কেনান স্বেচ্ছায় মরণশীল মানুষের বোঝা হাল্কা করার দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছে। তাই মানুষ আলি কেনানের কাছে আসে।
কেউ এসে বলে, তার ছেলেটি বড়ো হয়েছে, কিন্তু এখনো বিছানায় প্রস্রাব করে। বাবার দোয়া চাই।
কেউ পেটের শুল বেদনার প্রতিকার প্রার্থনা করে।
কোনো মা চোখের জলে মিনতি জানায়, তার মেয়েটি অত্যন্ত অভাগী। তিন বছর স্বামীর ঘর করেছে, এখন স্বামী নিচ্ছে না। সহায়হীনা বিধবাকে ভরণ পোষণ জোগাতে হচ্ছে। বাবা যদি এর একটা বিহিত না করেন বিধবার দাঁড়াবার স্থান নেই।
আলি কেনান সকলের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনে। কিন্তু তারপর তার মুখ দিয়ে অশ্লীল অশ্রাব্য গালাগালির তুবড়ি ছুটতে থাকে :
‘খানকি মাগি, শাউরের পো’ এই সব মধুর শব্দ তার মুখ দিয়ে অবলীলায় বেরিয়ে আসতে থাকে। একেক সময়ে তার বাহ্য জ্ঞান লোপ পাবার দশা হয়। তখন কারো পাছায় লাথি মারে। কাউকে চুল ধরে ওঠ বোস করায়। কোনো মহিলাকে একটা পাউরুটির টুকরো ছুঁড়ে দিয়ে বলে,
নে মাগি এইড্যা খা। যে বালক বিছানায় প্রস্রাব করে তাকে একটা গ্লাসে ডান হাত ডুবিয়ে পানিটা মুখের কাছে ধরে বলে, নে বানচোত এই পানি খা। আবার বিছানায় মুতলে শালা লেওড়া কাইট্যা ফেলুম মনে রাখিস। বিচিত্র রকমের মানুষ আসে। আলি কেনান তাদের রোগ শোকের বিচিত্র বিধান দেয়।
সামান্য সময়ের মধ্যে চারপাশে গুজব রটে যায় যে, আলি কেনানের রোগ সারাবার আশ্চর্য ক্ষমতা রয়েছে। খবর যতো ছড়ায়, ততো অধিক হারে মানুষ তার কাছে আসে। আগে তার কাছে বস্তির মানুষ, কাজের বেটি, রিকশাঅলা এই সব নিম্নশ্রেণীর মানুষ আসতো। এখন দ্রঘরের মানুষ, বিশেষ করে মেয়েছেলেরা তার কাছে আসতে আরম্ভ করেছে। এইসব মহিলা দেখলে তার খুব আনন্দ হয়। আবার পাশাপাশি ঘৃণার একটি কৃষ্ণ রেখাও সাপের মতো এঁকে এঁকে মনের মধ্যে জেগে ওঠে। মাঝে মাঝে তার বলতে ইচ্ছে করে,
মাগিরা ব্যারাম সারাইবার কালে আলি কেনান আর মজা করার সময় অন্য মানুষ। এই সব রঙিন মাংসের পুতুল লাথি দিয়ে ভেঙে ফেলতে ইচ্ছে করে। আলি কেনান নিজেকে নিজের ভেতর ধারণ করতে পারে না। এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য সে অধিকতরো অশ্লীল বাগধারা প্রয়োগ করতে থাকে। অর্থী প্রার্থীরা বিনা প্রতিবাদে তীক্ষ্ণ চোখা গালাগাল হজম করে। এমন কেউ থাকাও বিচিত্র নয় যে প্রাণ দিয়ে বিশ্বাস করে এসব ভক্তিভরে শুনলে অর্ধেক রোগ নিরাময় হয়ে যাবে । একবার একজন জোয়ান মানুষ আলি কেনানের কানে কানে স্ত্রীর বিশ্বাসভংগের অভিযোগ করে। আলি কেনান হুঙ্কার দিয়ে বলে, শালা তর হাতিয়ারে জোর নাই। কবিলা তরে কেয়ার করবো কেরে? হের হাউস নাই? পুরুষের ছ গুণ। মাইয়া মানুষের ন গুণ। এই রকম নানা কর্মকাণ্ডের স্বীকৃতি স্বরূপ গরম দরবেশ হিসেবে আলি কেনানের নাম ফেটে যায়।
আলি কেনানের কাণ্ড জ্ঞানটি ভীষণ ধারালো। ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে সে অনুভব করে, চারদিকে তার প্রভাব যে হারে ছড়িয়ে পড়ছে, সমস্ত কর্মকাণ্ড একটা শক্ত ব্যবস্থাপনার মধ্যে বাঁধতে না পারলে যে কোনো মুহূর্তে চূড়ান্ত বিপর্যয় ঘটে যেতে পারে। পাছায় লাথি মারা, ডান হাত ডুবিয়ে পানি পড়া এসব করে অধিকদূর যাওয়া সম্ভব নয়। ভদ্র শিক্ষিত মার্জিত রুচির মানুষেরা তার কাছে আসতে আরম্ভ করেছে। তাদের চাহিদা, পছন্দ এবং রুচি মোতাবেক অনেক কিছু পাল্টাতে হবে। সে বেশ কিছুদিন মাথা খেলিয়ে একটা চমৎকার বুদ্ধি বের করলো। নিজের ভাবনার চমৎকারিত্বে আলি কেনান নিজেই চমকে ওঠে।
ফুলতলিতে একটা মসজিদ আছে। দুতিন জন মানুষ মাত্র নিয়মিত নামাজ কালাম পড়ে। একমাত্র শুক্রবারেই মসজিদে অল্পস্বল্প লোক সমাগম হয়। ফুলতলি গরিব মহল্লা, তাই মসজিদটিও গরিব । নিয়মিত আজান প্রচারের জন্য এক জোড়া মাইক লাগানোর সম্ভব হয়নি। প্রতিদিন মুয়াজ্জিন সাহেব পাখির ডাকের মতো চিহি স্বরে, পাঁচবেলা আযান ধ্বনি উচ্চারণ করেন। সে আওয়াজ মুয়াজ্জিন সাহেব নিজের কানে শুনতে পান কিনা সন্দেহ আছে। মুয়াজ্জিন সাহেব শুকনা পাতলা মানুষ। তার গলার আওয়াজটিও অতিশয় ক্ষীণ। শুক্রবারে জুমার নামাজে ইমামতি করার দায়িত্বও তার। সে হিসেব করলো,
তাকে মুয়াজ্জিন সাহেব না বলে ইমাম সাহেব বলাই সঙ্গত। শুক্রবারে মহল্লার সর্দার সাহেব নিজে জুমার নামাজ আদায় করতে আসেন। কোনো কারণে সর্দার সাহেবের আসা বিলম্বিত হলে তার জন্য সমস্ত মুসল্লিকে অপেক্ষা করতে হয়। সর্দার সাহেবের পূর্বপুরুষেরা এই মসজিদটি তৈরি করেছিলেন। সে কারণে সর্দার সাহেব নিজেই মসজিদের মোতওয়াল্লি। তাঁর অহংকারের অন্ত নেই। কিন্তু ইমাম সাহেবকে মাইনেটা ঠিকমতো দিয়ে উঠতে পারেন না। মাঝে মাঝে পাঁচ সাত মাস বাকি পড়ে থাকে। দেশের বাড়িতে ইমাম সাহেবের বিবি এবং বাল-বাচ্চারা আছে। তাদের দিন যে কেমন করে কাটে একমাত্র ইমাম সাহেবই বলতে পারেন। তিনি সব সময়ে আল্লাহর শোকর গুজার করেন। মাইনের কথা উঠালেই সর্দার সাহেব তার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেন। এনিয়ে তাকে কখনো উচ্চ বাচ্য করতে দেখা যায়নি। এই মসজিদের চাকুরি ছেড়ে অন্য কোথাও যাওয়ার কথা তার মনে স্বপ্নেও উদয় হয়নি। অথচ ইমাম সাহেব সিকি মাওলানা কিংবা আধা মাওলানা নন। তিনি হাম্মাদিয়া ওহাবী মাদ্রাসা থেকে টাইটেল পাশ করেছেন। একেবারে পাক্কা সার্টিফিকেট আছে।
আলি কেনানের মাথায় খেলে গেলো মসজিদের ইমাম সাহেবের সঙ্গে একটা ব্যবস্থায় আসতে পারলে তার লাভ এবং ইমাম সাহেবেরও লাভ। আলি কেনান আরবী ফাঁসির বিন্দু বিসর্গ জানে না। তাবিজ কবজ না দিলে আর চলছে না। তা ছাড়া শরিয়তের বিষয়ে সে একেবারে অজ্ঞ। এই পেশায় যখন চলে এসেছে, কখন কি ঘাপলা লাগে বলা তো যায় না। সুতরাং এরকম একজন মানুষ হাতের মুঠোর মধ্যে থাকা ভালো। বিপদে আপদে কাজে আসতে পারে।
আলি কেনান তীক্ষ্ণ ঘ্রাণশক্তি দিয়ে অনুভব করতে পারে, নিয়মিত খেতে না পেরে তার চেহারা এমন শুঁটকি হয়ে আছে। মাস কাবারি টাকা দিলে আরবীতে তাবিজ-কবজ লিখে দেরে এটা সে ধারণাই করে নিয়েছিলো। তবু মনে একটা খটকা ছিলো। এই জাতের মানুষ মিনমিনে হলেও অহংকারী হয়। তাই প্রস্তাবটা সরাসরি পাঠায়নি। তার বদলে এক সন্ধ্যেয় মিলাদ পড়ার দাওয়াত করলো।
ইমাম সাহেব প্রস্তাবটি গ্রহণ করবেন, কিনা মনে মনে দোটানায় ছিলেন। তিনি লোকমুখে শুনেছেন আলি কেনান অনেক শরিয়ত বিরোধী কাজ কারবার করে। নিজের চোখেও দেখেছেন। ইমাম সাহেব নিজে ওহাবী তরিকার মানুষ। কবর নিয়ে হৈ চৈ এসব মোটেও পছন্দ করেন না। তার যদি ক্ষমতা থাকতো এবং মহল্লার মানুষের সমর্থন পাওয়া যেতো, তাহলে কবে আলি কেনানকে ফুলতলি ছাড়া করতেন। পাঁচ মাস কাজ করে এক মাসের মাইনে পাননা যেখানে-সেখানে ধর্ম কাজ করার উৎসাহ আপনা থেকেই হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। তাই প্রতি শুক্রবার আলি কেনানের শরা, শরিয়ত বিরোধী কাজ কারবারের কথা তুলবেন, তুলবেন মনে করেও তুলতে পারেননি। তার মনেও একটা শংকা ছিলো। আলি কেনান অল্প দিনের মধ্যে ফুলতলি এলাকার সামাজিক শক্তি হয়ে উঠেছে। তার ওখানে প্রতি বৃহস্পতিবার গান বাজনা হয়। ওতে মহল্লার অনেক তরুণ যোগ দিতে আরম্ভ কওেছে। সর্দার সাহেবের বড়ো ছেলে এসব ব্যাপারে আলি কেনানের ডানহাত হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইমাম সাহেব লোকমুখে শুনেছেন স্বয়ং সর্দার সাহেব নাকি একবার গোটা রাত ওখানে গান বাজনা শুনেছেন। আলি কেনান মানুষটাকে ইমাম সাহেব মনে মনে ঘৃণা এবং ঈর্ষা করেন। ঘৃণা করেন এ কারণে যে তার মধ্যে একটা শয়তানি শক্তি আছে। এরই মধ্যে ফুলতলির অনেক তরুণ তার খপ্পরে পড়তে আরম্ভ করেছে। আলি কেনান তাদের শরিয়ত বিরোধী কাজে উৎসাহ যোগায়। ইমাম সাহেব দশ বছর ধরে এই মহল্লায় বসবাস করছেন। নতুন শিশু ভূমিষ্ঠ হলে তিনি আজান দেন। মৃত্যু হলে জানাজা পড়ান। এমনকি মৃত্যুর পূর্বে তিনি ফুলতলির নরনারীদের জীবনের শেষ তওবাও পাঠ করান। ভাগ্যের কি পরিহাস ইমাম সাহেবকে কেউ গেরাহ্যের মধ্যে আনে না। ছোটো বাচ্চারাও তাকে নিয়ে নানা তামাশা করে। অথচ এই আলি কেনান কদিন হলো এসেছে, বড়ো জোর ছ মাস । মহল্লার মানুষদের নাচিয়ে বেড়াচ্ছে। তাই ইমাম সাহেব আলি কেনানকে ঈর্ষা না করে পারেন না।
ইমাম সাহেব জ্ঞানতঃ ঈর্ষা করতে চান না। কিন্তু আল্লাহ তো তাকে মার্টির মানুষ করে পয়দা করেছেন। তবু ইমাম সাহেবের কোনো আফসোস নেই। খোদ রসুল করিমই তো বলে গিয়েছেন, আখেরি জামানায় ফেতনা এবং গোমরাহির শক্তি সতুর গুণ বেড়ে যাবে। এসবই ছিলো আলি কেনানের মিলাদের দাওয়াত গ্রহণ করবার দ্বিধা দ্বন্দ্বের আসল কারণ। সরাসরি দাওয়াত কবুল না করতেও তার মন চাইছিলো না। আলি কেনান দাওয়াতের সঙ্গে নগদ পঞ্চাশটি টাকা পাঠিয়ে দিয়েছে। তখন পঞ্চাশ টাকা দিয়ে আস্ত একটি গরু পাওয়া যেতো। ঐ তুচ্ছ টাকাকটিই গোল বাধালো । ইমাম সাহেব গোটা মাসে আজান দিয়ে এবং শুক্রবারে ইমামতি করে মাত্র পঁয়ত্রিশ টাকা পান। কোনো কোনো সময় পঁয়ত্রিশ মাস অপেক্ষা করেও টাকাটা ঠিকমতো পাওয়া যায় না। ইমাম সাহেব চিন্তা করলেন,
আমি এই পঞ্চাশটি টাকা ছাড়ি কেনো? যদি ছেড়েও দেই তা হলো আমার কি লাভ? এখন লোকে পাঁচ সাত টাকা পেলে মিলাদ পড়ে। হাতে হাতে পঞ্চাশ টাকা পাওয়া গেলে বায়তুল মোকাররমের ইমাম সাহেবও চলে আসতে পারেন। তিনি আরো ভাবলেন, আমি তো আল্লাহর নামে হেদায়েত করবো। ওতে তো দোষের কিছু নেই। গোমরাহির পথে কেউ গেলে তাকে তো আল্লাহর পথে ফিরিয়ে আনাও নায়েবে রসুলদের একটা দায়িত্ব। অতএব ইমাম সাহেব দাওয়াত কবুল করলেন। ইমাম সাহেব মনে মনে ভেবে রেখেছিলেন, তিনি শরিয়ত বিরোধী কাজ কর্মের কঠোর নিন্দা করবেন। আলি কেনানের নাম নেবেন না। তবু আকার ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিতে ছাড়বেন না, আলি কেনানই এলাকায় যুবকদের কুপথে যাওয়ার ইন্ধন জোগাচ্ছে। কিন্তু সেদিন এশার নামাজের পর মিলাদ পড়তে এসে কোনো কথাই তিনি মুখ থেকে বের করলেন না। আলি কেনানের প্রবল ব্যক্তিত্বের সামনে নিজেকে একটা চড়ই পাখি বলে মনে হতে লাগলো। তাই তিনি শরিয়ত খেলাপ, কবর আজাব ওসবের ধার দিয়েও গেলেন না। কেবল কোরান তেলাওয়াত করলেন এবং দরুদ শরীফ পড়লেন। তারপর মোনাজাত করে ফেললেন।
নামাজ শেষ হয়ে গেলে আলি কেনান স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে ফুলতলির সমবেত মানুষদের কাছে জানতে চাইলো,
এ্যাই তরা ইমাম সাবরে চিনোস।
অনেকে মাথা ঝুলিয়ে বললো,
হ্যাঁ তারা ইমাম সাহেবকে চিনে বটে। তিনি মসজিদে পচবেলা আজান দেন, শুক্রবার ইমামতি করেন এবং কেউ কখনো মারা গেলে জানাজার নামাজ পড়ান। এবার আলি কেনান ভীষণ রেগে গেলো।
শালা তরা বলদ ছিলি আর সারা জীবন বলদই থাকবি। খাঁটি মানুষ চেনার তাকতনি আল্লাহ তগো দিছে। বাবাজান বু আলি কলন্দর আমারে খোয়াবে দ্যাহা দিয়া কইছেন,
তুই ইমাম সাবরে ডাইক্যা মিলাদ পড়া। হের লাইগ্যা মিলাদ পড়াইলাম। আমার কারবার দেল কোরান লইয়া। পাতা কোরান ভাইজ্যা যারা খায়, হেগোরে আমি ধর্মের দারোগা-পুলিশ মনে করি। কিন্তু বাবাজান বু আলি কলন্দর আমারে কইছেন,
ইমাম সাহেবের দিলে আল্লাহর খাঁটি নূর আছে। আলি কেনানের কথা শুনে মহল্লার সমস্ত মানুষ ইমাম সাহেবের দিকে তাকায়। তাদের কেউ কেউ ইমাম সাহেবের চুপসে যাওয়া মুখমণ্ডলে অন্তরের জ্যোতির প্রতিফলন দেখতে পায় ।
আলি কেনানের প্রতি ইমাম সাহেবের রাগ বিদ্বেষ তো রইলোই না বরং তাকে আল্লাহর বিশেষ রহমতপ্রাপ্ত উঁচু মর্যাদার একজন বুজর্গ ব্যক্তি বলে ধরে নিলেন। এতোদিন তিনি অনেক দুঃখ-কষ্ট সহ্য করে ধর্মের পথে চলে আসছেন।
ইমাম সাহেব জীবনে কখনো আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কাল রাখতে ভুল করেননি। দুবেলা আহার জুটুক বা না জুটুক তিনি ফুলতলির মানুষদের হেদায়েত করে আসছেন। কিন্তু ফুলতলির মানুষ তাকে অবহেলা এবং অবজ্ঞার অধিক কিছু দিয়েছে। তার তো সে কথা মনে পড়ে না। আজ আলি কেনানের মুখে তার যে একটা নতুন পরিচয় ফুলতলির মানুষদের কাছে প্রচারিত হলো, কুদরতী ইলাহির এটাও একটা দৃষ্টান্ত বটে। তিনি মনে করলেন,
ওহাবী তরিকার মানুষ হওয়ায় মারেফাতকে এতোকাল কোনো দাম দেননি। আলি কেনানকে তিনি মন্দলোক ভেবে আসছিলেন, এটাও তার মনের একটা সংস্কার মাত্র। অন্তরে মারেফতি এলেমের পবিত্র জ্যোতি না থাকলে আলি কেনান তাঁকে এমনভাবে চিনলেন কি করে! অতএব মাসিক পঞ্চাশ টাকা মাইনেয় আলি কেনানের আস্তানায় তাবিজ লেখার কাজটি কবুল করতে তার কোনো আপত্তি হলো না। বরঞ্চ এটাকে আল্লাহতালার বিশেষ রহমত বলে ধরে নিলেন।
আলি কেনান চারদিক থেকে সব কিছু গুছিয়ে নিয়েছে। ফুলতলির সর্দার সাহেব এখন তার আস্তানায় নিত্য যাতায়াত করেন। ইমাম সাহেব এককোণায় বসে জল চৌকির ওপর কাগজ রেখে ডানদিক থেকে গুটি গুটি হরফে সুরা আয়াত লিখে লাল সুতো দিয়ে পেঁচিয়ে তাবিজ বানিয়ে রাখেন। আলি কেনান সে সব তাবিজ মক্কেলদের দিয়ে বলে, গলায় ঝুলিয়ে রাখবি। অবস্থা ভেদে তামা কিংবা পিতলের খোল ব্যবহার করতে বলে। বিবাহিত পুরুষ মানুষ হলে বিধান দেয়, বিবির সঙ্গে সহবাস করার সময় খুলে রাখবি। মেয়ে মানুষদের বলে, হায়েজ নেফাজের সময় খুলে পানিতে ভিজিয়ে রাখবি। গোছল করে পাক পবিত্র না হয়ে পরবিনে। তাহলে ক্ষেতি হবে।
আজকাল আলি কেনান দু চারটে আরবী শব্দ উচ্চারণ করতে শিখেছে। ইমাম সাহেবের প্রত্যক্ষ সংস্পর্শে আসার পর কিছু কিছু আরবী বুলি তার কণ্ঠে আপনা আপনি উঠে আসছে। একথা সে বিলক্ষণ বুঝতে পারে। সে বুঝতে পারে তার ভেতরে ইমাম সাহেবের প্রভাব ক্রিয়া করে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে তার সাধ হয় গভর্ণর সাহেবকে ডেকে বর্তমান অবস্থাটা দেখায়। সেটি তো আর সম্ভব নয়! কখনো কখনো ভোলার কথা মনে পড়ে। তখন তার প্রাণটা ছাত করে উঠে। কি জানি কেমন আছে তার বুড়ো বাপ বুড়ো মা। বাঘের মতো ছয় ছয়টি ভাই, তারা কোথায় কি অবস্থায় আছে? হয়তো তারা জেল খানায় ঘানি টানছে। কিন্তু কি করতে পারে আলি কেনান? নতুন করে জীবন নির্মাণ করার প্রক্রিয়ার মধ্যে সে বাঁধা পড়ে গেছে। ছেড়ে দিয়ে কোথাও যাওয়া তার পক্ষে এখন সম্ভব হবে না। ভবিষ্যতের কথা ভবিষ্যতে দেখা যাবে। আলি কেনানের একদল নতুন ভক্ত জুটেছে। তারা তার মতো লাল সালুর লুঙ্গি এবং আজানুলম্বিত আলখেল্লা পরে। গলায় বড়ো বড়ো কাঠের মালা ঝোলায় এবং বগলের পাশে দিয়ে পেঁচিয়ে লোহার শিকল কোমর অবধি দোলায়। আলি কেনান এই ভক্ত সম্প্রদায়কে তার কল্পনার সন্তান মনে করে। অবশ্য ভক্তদের অতীত নিয়ে নানা ধরনের কথাবার্তা চালু আছে। মোট সাতজনের মধ্যে দুজন জেল খাটা দাগী আসামী। একজন সমকামী। একজন সংসারে পোড় খাওয়া একেবারে হতাশ মানুষ। সর্বক্ষেত্রে মার খেয়ে আলি কেনানের আস্তানায় মুখ্যত দুবেলা অন্ন সংস্থানের জন্যই পড়ে আছে। বাকি দুটি ফুলতলিরই অল্প বয়স্ক কিশোর। তাদের মা বাবা আছে, আছে ঘরবাড়ি। সংসারের কোনো জটিলতা তাদের জীবন স্পর্শ করেনি। তারা আস্তানায় এসেছে লোকে সচরাচর পায়না, পাওয়া যায় না তেমনি অলৌকিক কিছু পাওয়ার প্রত্যাশায়।
এই সাত জনের দলটি নিয়ে আলি কেনান শুক্রবার দিন খুব সকাল বেলা বেরিয়ে পড়ে। কুকুর ছানাটির তাদের সঙ্গে যায়। রাস্তা দিয়ে গান গেয়ে বাজনা বাজিয়ে বিচিত্র পোশাক পরে মিছিল করে যাওয়ার সময় শহরের মানুষ তাদের দিকে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে। তারা গান গায় :
তোমরা দেইখাছো কোথায়?
শুকনা ডালে জবা ফুলে
ভ্রমর মধু খায়।
পরান পদ্মের গহীন তলে
মধুর রসের ধারা
সেইখানেতে শুরুরে ভাই
মারেফাতের পাড়া।…
ফুলতলি পেরিয়ে বাংলা বাজার রোড ধরে এ রাস্তা সে রাস্তা অতিক্রম করে আস্ত মিছিলটি হাইকোর্টে এসে থামে। হাইকোর্টের মাজার জমজমাট থাকে। এই মাজারের আভিজাত্য আছে। এখানে অনেক লোক আসে গাড়িতে চড়ে। তারা দান খয়রাতও করে। সে জন্য অন্য মাজারের তুলনায় এখানে গরিব গোরবা ফকির ফোকরার ভীড় বেশি। মাজারে আলি কেনানেরা অনেকক্ষণ গান বাজনা করে। তাদের গান মানুষের হৃদয়ে আবেদন সৃষ্টি করে। দলের দুজনের কণ্ঠ খুব মিষ্টি। আলি কেনান বেছে বেছে সেসব গানই নির্বাচন করে, যেগুলো মানুষের অনুভব শক্তিকে ধাক্কা দিতে পারে। লোকজন চারপাশে ভীড় করে। গান বাজনার পর বাবার মাজার সালাম করে। দুপুর গড়িয়ে গেলে আবার পথে নামে।
এভাবে হেঁটে হেঁটে তারা নিমবাগান অবধি আসে। নিমবাগানের মাজারটিতে ঢুকে বোঁচকা বুচকি খুলে কিছু খেয়ে নেয়। খাওয়া দাওয়ার পাঠ সারা হলে আমগাছটির ছায়ায় বসে বিশ্রাম করে এবং গাঁজা টানে। তখন আলি কেনানের মনে জগৎ জীবনের নানা রহস্য ভীড় করতে থাকে।
এই জগৎ কি? এখানে এলাম কেননা এবং যাবো কোথায়? এই সমস্ত সূক্ষ বিষয়ও তার মনে ছায়া ফেলে। যাহোক বিশ্রাম পর্ব শেষ হলে শেষ গন্তব্য স্থল মিরপুরের শাহ আলি বাবার মাজারের উদ্দেশ্যে পা বাড়ায়।
শাহ আলি বাবার মাজারে আলি কেনানের অসীম প্রতিপত্তি। তার কারণ অন্য কিছু নয় তার দলটির গান। আলি কেনানের দলটি বাস্তবিকই সুন্দর গায়। গানের তো নিজস্ব ক্ষমতা আছে। হিন্দুরা গানকে স্বয়ং ভগবান মনে করে। বাংলাদেশের এতো পীরফকির বুজর্গের মাজার, ভক্তবৃন্দদের গানের শক্তিতেই তার বেশির ভাগ টিকে আছে। গানের রস না থাকলে মাজারগুলো মরুভূমি হয়ে যেতো। সেখানে মানুষ যাওয়ার কোনো প্রয়োজন দেখা দিতো না। প্রতি শুক্রবারে বাবার মাজারে গান বাজনার আসর বসে। আলি কেনানের দলের মধ্যে জেলফেরত একজন দাগী আসামী এবং ফুলতলির কিশোরদের একজন, তারা বেবাক পরিবেশ ভাপিয়ে তোলে কণ্ঠের উত্তাপে। জেলফেরত লোকটির নাম কালাম। তার গলাটি একটু ভারী। আর অন্যদিকে কিশোরটির কণ্ঠস্বর বাঁশির মতো। আলি কেনানের দল বেছে বেছে সে সকল গানই গায় যেগুলো মানুষকে কাঁদায়, ভাবায় এবং চিন্তার মধ্যে ডুবিয়ে রাখে। আলি কেনান কান পাকা মানুষ। দূর দূরান্তে যেখানেই ভাল গান শুনতে পায় কথাগুলো যত্নসহকারে কপি করে নিয়ে আসে। আল্লাহ আলি কেনানকে অনেক দিয়েছে। তবু আল্লাহর বিরুদ্ধে তার একটি নালিশ আছে। আল্লাহ তাকে গানের গলাটি দেননি।
আলি কেনানের অভিজ্ঞতার ভাণ্ডার সমৃদ্ধ হচ্ছে। মাজারে ঘুরে ঘুরে নানা কিসিমের মানুষের সঙ্গে তার পরিচয় ঘটতে থাকে। ওদের কেউ স্বভাব ভিখিরি। কেউ মস্তান, লুচ্চা, বদমায়েশ সব ধরনের মানুষই মাজারে থাকে। মাজারে অবস্থান করে এমন দু তিনটা জাত খানকির সঙ্গেও তার চেনাজানা হয়েছে। এখানে সংসার বিরাগি স্বর্গ পাগল মানুষ সে দেখেছে। দেখেছে ধর্মপ্রাণ মানুষ। ধর্মকর্মের ধার ধারে না মেয়ে মানুষ নিয়ে অবৈধ ব্যবসা চালায়, তেমন মানুষও মাজারে থাকে। কেউ আপত্তি করে না। অন্ধ নুলা বোবা খঞ্জ পাপীতাপী সকলকে মাজার সমান মেহে আদরে লালন করে। মাজারের ছায়া অনেক দূর প্রসারিত। এখানে সবাই আশ্রয় পায়।
পয়লা দেখলে মনে হতে পারে মাজারে যে সকল মানুষ দেখা যায় তারা জন্মের পর থেকেই এখানে বসবাস করছে। কিছু মানুষ স্থায়ীভাবে মাজারে বসবাস করে একথা সত্যি। কিন্তু পাশাপাশি আরেক দল মানুষ আছে যারা ভাসমান। এক মাজার থেকে অন্য মাজারে ছুটে ছুটে বেড়ায়। যে মেয়েটি বট গাছের ছায়ায় রেহেলে একটি কোরান শরীফ খুলে বসে থাকতো, দেখা গেলো একদিন হঠাৎ সে উধাও। হয়তো চট্টগ্রাম বায়েজিদ বোস্তামী কিংবা আমানত শাহের মাজারে একই ভাবে রেহেলে কোরান নিয়ে বসে রয়েছে চুপচাপ। চুপচাপ বসে আছে এ কারণে যে সে কোরান পড়তে জানে না। হয়তো একমাস কি দুমাস পর আবার মিরপুরের মাজারে হাজির হলো। অনেক তরতাজা, কারণ গায়ে নতুন হাওয়া লেগেছে। কেউ যদি জিগগেস করে, কই গেছিলি ফাতেমা খাতুন? ফাতেমা খাতুন ফোকলা দাঁতে হেসে জবাব দেবে, মুই গিছিলাম বাজী মস্তান (বায়েজিদ বোস্তামী)। যে অন্ধটির চোটপাটে প্রতিদিন মিরপুর মাজারে শায়িত বাবার ঘুম ভেঙে যাবার দশা হয় এক সকালে দেখা গেলো সেও নেই। কাউকে কিছু বলেও যায়নি। পনেরোদিন বাদে দেখা গেলো সিলেটে শাহজালাল বাবার মাজারে মনের সুখে ভিক্ষে করে বেড়াচ্ছে।
মাজারে যারা থাকে, তাদের সকলের না হলেও অনেকেরই, আলাদা একটি ভূগোল থাকে। মিরপুরের মাজার থেকে মানুষ খুলনায় খানজাহান আলীর মাজারে যায়, সেখান থেকেও মানুষ আসে রাজশাহীর শাহ মখদুমের মাজারে। আবার শাহ মখদুমের মাজার থেকে মানুষ আসে হয়তো চট্টগ্রামের মাইজ ভাণ্ডার। কেননা যে তারা মাজারে মাজারে ঘুরাফেরা করে তা নিজেরাও বলতে পারে না। এটা একটা নেশার মতো। যাকে একবার পেয়েছে এক জায়গায় স্থির হয়ে বসে থাকতে দেবে না। এই নেশা যাদের মনে অপেক্ষাকৃত গাঢ় তারা দেশের সীমানা অতিক্রম করে চলে যায় দূরে আরো দূরে। দিনে রাতে আল্লাহর কাছে মুনাজাত করে বলে,
আল্লাহ নিজামুদ্দিন আউলিয়া, বখতিয়ার কাকির মাজার জিয়ারত করার সুযোগ দেও। এমনও মানুষ আছে যারা একবেলা খেয়ে পয়সা জমায় হিন্দুস্থানের সুলতান খাজা মইনুদ্দিন চিশতীর রওজা শরীফ জেয়ারত করার জন্য।
আলি কেনানের প্রখর কাণ্ডজ্ঞান তাকে মাজারের নানা ধরনের কর্মকাণ্ডের ব্যবস্থাপনার দিকটির প্রতি অধিক মনোযোগী করে তুলেছে। এই জিনিসগুলো সে অতি সহজে বুঝতে পারে। মাজারের অনেক কিছু সে বুঝে না, বুঝতে চায় না। এক একটি মাজার বছরে লক্ষ লক্ষ টাকায় নিলাম হয়। হাট বাজার ঘাটের মতো। যে সর্বোচ্চ অর্থ প্রদান করতে পারে সে বছরের সমস্ত টাকা পয়সা আদায় করার দায়িত্ব পেয়ে যায়। এদিক দিয়ে দেখলে একেকটা মাজার অন্য দশটা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের চাইতে আলাদা নয়। তফাৎ শুধু এটুকু যে অন্য ব্যবসায়ে মূলধন মারা যাওয়ার ঝুঁকি আছে, মাজার ব্যবসায়ে তা নেই। মাজারে মানুষ আসবেই। মানুষ আসবে কারণ সে দুর্বল অসহায় এবং উচ্চাকাঙ্খী।
সারা দিন মাজারের দান বাক্সে যতো টাকা পড়ে, সন্ধ্যেবেলা সে টাকা নিলামকার মহাজনের বাড়িতে চলে যায়। যতো লোক রক্ষণাবেক্ষণে থাকে সব মাইনে করা কর্মচারী। জিলিপি, রসগোল্লা, আগরবাতি, মোমবাতি, গোলাপজল যতো মাজারে আসে সব পিছনের দরজা দিয়ে ঘুরে আবার দোকানে চলে যায়। একেক দিনের মধ্যে এক সের মিষ্টি যে কতোবার কেনা বেচা হয় কেউ হিসেব রাখতে পারে না। কেবল বিক্রির অর্থটাই জমা হয় মহাজনের সিন্দুকে। প্রতিটি মাজার নিজের নিয়ম কানুনে চলে। এখানে সরকারের আইন বিশেষ কাজ করে না। গাঁজা, চরস, সিদ্ধি এসব অবাধে কেনাবেচা হয়। পুলিশের খপ্পরে পড়ার কোনো আশঙ্কা নেই। সে কারণে তাদের নিলামকারকে চড়াহারে কমিশন দিতে হয়।
আলি কেনান দেখেছে মাজারে শায়িত মহাপুরুষদের বংশধরদের মধ্যে মাজারের দখল নেয়ার জন্য কি তীব্র প্রতিযোগিতা। এক শরিকের মুরিদ আরেক শরিককে বাগিয়ে নিতে কোনো রকমের বিবেক দংশন অনুভব করে না। খুন জখম হয়ে যাওয়াও বিচিত্র নয়। মামলা হাইকোর্ট পর্যন্ত গড়ায়। বছরের পর বছর চলতে থাকে। এই সমস্ত কাহিনী মানুষ জানে, তবু তারা মাজারে আসে। স্বর্গবাসী পুরুষের মুক্ত চেতনার সঙ্গে পৃথিবীর শকুনিদের লোভ লালসা এক করে না দেখার আশ্চর্য ক্ষমতা মানুষের আছে। তাই তারা মাজারে আসে।
গভর্ণর হাউজে থাকার সময় আলি কেনান খুব নিকট থেকে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব প্রত্যক্ষ করেছে। এই লাইনে আসার পর থেকে তার মনে হতে থাকে ওইখানে এই মাজারে সেই দ্বন্দ্বটি কম নয়। তবে সূক্ষ এবং ঘেরাটোপের আড়ালে ঢাকা থাকে।
শাহ আলী বাবার মাজারে আলি কেনান প্রতি শুক্রবার দলবল নিয়ে গান বাজনা করতো। সঙ্গীতের একটা নিজস্ব দাহিকা শক্তি আছে। যারা শুনে বাহবা দেয়, তাদের যেমন সংসার যন্ত্রণা ভুলিয়ে রাখে, তেমনি যারা গায়, বাজায় তাদেরও সব ভুলতে বাধ্য করে। আলি কেনান নিজেকে এই সম্মোহন থেকে মুক্ত রাখার প্রাণপণ চেষ্টা করতো। কিন্তু সফল হতে পারেনি। তার জীবনের এটা একটি দুর্বলতার দিক। এমনও হয়েছে, কোন্ দিক দিয়ে রাত শেষ হয়ে গেছে, টেরও পায়নি।
বিরাট বট গাছটির বাঁধানো চত্বরে আলি কেনানের দলটি গান করতো। সাধারণত এ জায়গায় কাউকে গান করতে দেয়া হয় না। আলি কেনানের দলটি খুব। ভাল গায় বলে এই বিরল সুযোগ পেয়েছে। অজগর সাপের মতো বট গাছের শেকড়ে হেলান দিয়ে একটা বুড়ো মানুষ বসে থাকে। বয়স বোধকরি সত্ত্বর পঁচাতুর হবে। এখনো শক্ত সমর্থ আছে। বগলে দুটো লাঠি ভর দিয়ে বুড়োকে চলাফেরা করতে হয়। ঝড় হোক, বৃষ্টি হোক বারমাস বুড়ো শেকড়ে হেলান দিয়ে বসে থাকে। কারো কাছে কিছু একটা সাধারণত দাবি করে না। লোকজন স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে অনেক সময় টাকা, আধুলি সিকিটা এনামেলের প্লেটে দিয়ে যায়। লোকটাকে দেখলেই মনে হবে বট গাছটির মতই প্রাচীন এবং একাকী।
ধীরে ধীরে এই মানুষটির সঙ্গে আলি কেনানের পরিচয় জমে ওঠে। আলি কেনান ভীষণ অহংকারী এবং উদ্ধৃত প্রকৃতির মানুষ। কিন্তু বুড়োর মুখোমুখি দাঁড়ালে বিচলিত বোধ না করে পারে না। তার উগ্র স্বভাবটি আপনাআপনি সংযত হয়ে আসে। দুজনের মধ্যে একটা সমঝোতা প্রতিষ্ঠিত হতে অবশ্য দীর্ঘ সময় লেগেছে। একদিন বুড়ো আলি কেনানকে জিজ্ঞেস করে,
অ মিয়া তোমরা হগলে দিনরাতই এই শিকলের বোঝা কেমন কইরা বও?
আলি কেনান একটুও না ভেবে জবাব দিলো,
এইডা আমাগো চিন্ন। বুড়ো ফের জিজ্ঞেস করে,
কীয়ের চিন্ন?
আলি কেনান বলে, বু আলি কলন্দর তরিকার চিন্ন। বুড়োর মুখে রসিকতা ঝিলিক দিয়ে ওঠে :
বু আলি কলন্দরের কতা থাউক, তরিকা কারে কয় হেইডা বোঝনি?
আলি কেনান সত্যি সত্যি লা জওয়াব হয়ে যায়। বুড়োর কাছেই প্রথম জানতে পারে তরিকার অর্থ হলো পথ। ঢাকা শহরে যতগুলো রাস্তা, লেন, বাইলেন আছে ইসলাম ধর্মের ততোগুলো তরিকা আছে। সব নদী যেমন সাগরে গিয়ে মিশে, তেমনি সব তরিকা আমাদের দ্বীনের নবী মুহম্মদের মধ্যে মিশে গিয়েছে। তিন লাখ সতুর হাজার পয়গম্বরের সর্দার আমাদের নবী। আর সমস্ত আউলিয়া কুলের সর্দার। হলেন হজরত আব্দুল কাদির জিলানি। হযরত আবদুল কাদির জিলানির দুই কাঁধের ওপর স্থাপিত আমাদের দ্বীনের নবীর কদম মোবারক এবং তামাম আউলিয়া কুলের কাঁধের ওপর চরণ রেখেছেন হযরত আবদুল কাদির জিলানি। বেবাক হিন্দুস্থানে যত আউলিয়া বুজুর্গ আছেন, তাদের সর্দার হলেন হযরত খাজা মইনুদ্দিন চিশতি। তিনি গরিব গোবরার দোস্ত এবং হিন্দুস্তানের সম্রাট। এই যে শাহ আলী বাবার মাজার দেখতে আছো তিনিও খাজা বাবার সিলসিলার বুজুর্গ।
এসব কথা আলি কেনান রূপকথার গল্পের মতো শুনে। সব কথা তার বিশ্বাস হতে চায় না। তবু বুড়োর বলার ধরনের মধ্যে এমন একটা ভঙ্গী আছে, সেখানে সম্ভব অসম্ভব বাস্তব অবাস্তবের মধ্যবর্তী সীমারেখা হারিয়ে যায়। তার মনে এক আধটু ভাবান্তর আসে। মাঝে মাঝে মন ছুঁড়ে একটা প্রশ্ন জাগ্রত হয় :
মানবজীবন- এর কি কোনো উদ্দেশ্য আছে? গরম বালুতে পানি পড়লে যেমন হারিয়ে যায়, তেমনি কোনো কিছুই তার মনে স্থায়ী হয় না। গত্বাঁধা পথে জীবন চলতে থাকে। মানুষ জন এলে তাবিজ দেয়। কুকুর ছানাটি নিয়ে আদায়ে বের হয়। আজকাল টাকা পয়সার তাগাদায় তার বের না হলেও চলে। তথাপি সে নিয়ম ভঙ্গ করে না। সম্প্রতি আলি কেনানের মধ্যেও একটা পরিবর্তনের হাওয়া লেগেছে। বাইরে তার প্রকাশটি খুব স্পষ্ট নয়।
ফুলতলি মসজিদের ইমাম এবং শাহ আলি বাবার মাজারের বুড়োর কাছে সে অনেক কিছু শিখেছে। মাঝে মাঝে চোখ বুজে চিন্তা করে। তখন তার মনে হয়, সে সোজা কিংবা বাঁকা যে কোনো পথে যাক না কেনো, সর্বক্ষণ একটা ইতিহাসের ধারাকেই বহন করে নিয়ে যাচ্ছে। ইচ্ছে করলেও সে নিজেকে মুক্ত করতে পারে না। একটা না একটা ধারা এসে টেনে নিয়ে যায়। সে দরবেশের অভিনয় করছে, কিন্তু তার মধ্য দিয়েও সমস্ত দরবেশের সাধনার ধারা পাহাড়ী নদীর মতো ঝোঁপঝাড়ের ভেতর দিয়ে আছড়ে পড়ে তাকে গ্রাস করে ফলেতে চাইছে। দুনিয়াটা বড়ো আশ্চর্য জায়গা।
ইমাম সাহেবের কাছ থেকে সে শরিয়তের নানা বিষয়ের বিস্তর সংবাদ সংগ্রহ করেছে। আর বুড়ো স্থূল জগতের মধ্যে যে আরেকটা সূক্ষ্ম জগৎ আছে সে বিষয়ে তাকে কৌতূহলী করে তুলেছে। আলি কেনানের গ্রহণশীলতার তুলনা নেই। সে যা শুনতে চায়, তাই-ই শুনে। তার সবকিছুই কঠোর প্রয়োজনের নিগরে বাঁধা, তার বাইরে একচুল যেতেও তার মন প্রস্তুত নয়। সে বুড়ো কিংবা ইমাম সাহেব কারো কাছে আত্ম সমর্পণ করে বসেনি। সে যে ধর্মকর্ম-এসব বিষয়ে অধিক জানে না, একথা জানান দিতে আত্মসম্মানে বাধে। হাজার হোক জানাশোনার সঙ্গে কর্তৃত্বের একটা প্রত্যক্ষ সম্পর্ক তো আছে। তাই দৈনন্দিন আলাপে সালাপে যতোটুকু জানতে পেরেছে, তাই নিয়ে সে সন্তুষ্ট। তার প্রয়োজন ছাড়া কোনো বিষয়ে সে বেশি শিখতে চায় না। বেশী শেখার বিপদ আছে। তাহলে তাকে হয়তো ইমাম সাহেব কিংবা বুড়োর মতো হতে হবে। সে ধরনের জীবন সে গ্রহণ করতে পারে না। জীবনকে পাকা সুপুরির মতো সবসময় একটা নীরেট বস্তু হিসেবে দেখে। সে চরের মানুষ। দাপটের সঙ্গে বাঁচাই তার আবাল্যের স্বভাব। ‘মারো অথবা মরে যাও’ এই হলো তার কাছে জীবনের সংজ্ঞা। এই বাঁচার কি আনন্দ, কি সুখ বুড়ো কিংবা ইমাম সাহেব তা জানেন না। আলি কেনান অনেক তত্ত্বকথা শুনেছে বটে, কিন্তু বাস্তব কাজে অবহেলা করেনি। ফুলতলির আবাসস্থলটিতে কিছু কিছু সংস্কারের কাজ সে করে ফেলেছে। হুজরা খানার সংলগ্ন ফাঁকা জায়গাটিতে আরো দুটি নতুন ঘর উঠিয়ে নিয়েছে। দুজন মেয়ে মানুষ, মা ও মেয়ে তার আস্তানায় এসে জুটেছে। সে অবাক হয়ে ভাবে তার যা প্রয়োজন আল্লাহ নিজে তা পাঠিয়ে দেন। আল্লাহ যে রহমানুর রহিম বুঝতে কোনো অসুবিধে হয় না। তাকে ঘিরে ফুলতলিতে যে কর্মচক্র সৃষ্টি হয়েছে, মাঝে মাঝে তার মধ্যে নিজেকে বন্দি বলে মনে করে। এতো ছলাকলা এতো কলকৌশল এসবের কি কোনো প্রয়োজন আছে? একটাইতো জীবন! একভাবে না একভাবে কাটিয়ে দেয়া যায়। যতো লাল সালুর আলখেল্লা পরুক দাড়ি গোঁফ বড়ো করে রাখুক, আলি কেনান জোয়ান মানুষ। একটি মেয়ে মানুষের অভাবও সে তীব্রভাবে অনুভব করে।
তার অভাবগুলোও যে তীব্র। একেবারে জমাট বাঁধা। কিছুতেই অন্যবস্তু দিয়ে পূরণ করা যায় না। ভোলা থেকে সেই পুরোনো বউটিকে ফিরিয়ে আনার কথাও তার মনে এসেছে। সেটা অসম্ভব মনে করে তাকে দীর্ঘশ্বাস ফেলতে হয়েছে। সাপের পুরোনো খোলসের মতো সেই জীবন সে ফেলে এসেছে। কাঁচা ঘরের কড়ি বরগা যেমন পাকা ঘরের কোনো কাজে আসে না, তেমনি ভোলার জীবনের কোনো কিছুই তার আর কাজে আসবে না।
একদিন হুজরাখানা থেকে বেরিয়ে আচমকা আলি কেনান চমকে ওঠে। তখনও লোকজন আসতে শুরু করেনি। আলি কেনান দেখে দুজন মেয়েমানুষ হোগলার ওপর বসে আছে। তাদের মধ্যে একজনের বয়স চল্লিশ টল্লিশ হবে। মুখে কয়েকটি গুটি বসন্তের দাগ। শরীরের বাঁধুনি এখনো বেশ শক্ত। অন্য মেয়েটির বয়স আঠারো থেকে বিশের মধ্যে। গায়ের রং উজ্জ্বল ফর্সা না হলেও মোটামুটি সুন্দরী বলা চলে। গরিব ঘরের মেয়ে ঠিকমত খেতে পরতে পারলে গায়ের রং যে আরো খোলতাই হবে তাতে সন্দেহ নেই। আলি কেনান তার স্বভাবসিদ্ধ কর্কশ ভঙ্গিতেই জিজ্ঞেস করলো,
এ্যাই তোরা কি চাস? তবু তার গলার স্বর বুঝি একটু কাঁপলো। রয়স্কা মেয়ে মানুষটি তার পায়ের ওপর আছার খেয়ে বললো,
বাবা আমারে বাঁচান। আলি কেনান এই মুহূর্তটিতে বাবা ডাকটি শুনতে চাইছিলো না।
সে বললো,
মাগি তামাসা রাখ। কি অইছে হেইডা ক।
মেয়ে মানুষটি কেঁদে কুটে অনেকক্ষণ কসরত করে যা বললো, তার সারমর্ম এরকম :
মেয়েকে নিয়ে সে বস্তিতে থাকে। সোয়ামী চটকলে চাকুরী করতো। বছর দুই হলো মারা গিয়েছে। তারপর থেকে মা মেয়ে এই বস্তিতে ডেরা পেতে আছে। মা মেয়ে দুজনই পরের বাড়িতে বাড়িতে কাজ করে কোনো রকমে কষ্টেসৃষ্টে দিন কাটায়। এই পেটের মেয়েই এখন তার কাল হয়েছে। মেয়ের কারণে, তাদের দিকে বস্তির খারাপ মানুষদের দৃষ্টি পড়েছে। গত রাতে আট দশজন মানুষ তার মেয়েকে লুট করে নিয়ে যাওয়ার জন্য হানা দিয়েছিলো। তারা তাকে জানে মেরে ফেলবে বলে ভয়ও দেখিয়েছে। বহু কষ্টে ঘরের পেছনের বেড়া ভেঙে চুপিচুপি আর একটা ঘরে গিয়ে রাত কাটিয়েছে। এখন বস্তির কেউ আর তাদের আশ্রয় দিতে রাজি নয়। বেহুদা পরের জন্য নিজের বিপদ ডেকে আনতে কে রাজী হবে! বাবা দয়া করে আশ্রয় না দিলে এই সংসারে তাদের আর যাওয়ার কোনো জায়গা নেই।
আলি কেনান আবার চীৎকার দিলো,
মাগি তর লাঙ ঢুকাইবার স্বভাব আছে? কহন যায়না মাগিগো লগে শয়তান ঘুইরা বেড়ায়।
জবাবে মেয়ে মনুষটা বললো, বাবা চইদ্দ বছর বয়সের সময় আমার বিয়া অইছে। আপন খসম ছাড়া অন্য কুনু বেডা মাইনসের চউকে চউকে চাইয়া কতা কই নাই। সে আবার আলি কেনানের পায়ের ওপর আছার খেয়ে বলতে থাকলো,
বাবা আমি একা অইলে কুনু ভাবনা আছিল না। পেডের মাইয়াডি গলার কাড়া। হেরে থুইয়া মরবার চাইলেও পারি না। আপনে আমাগোরে উদ্ধার করেন বাবা। এবার আলি কেনানের মেজাজ একটু নরোম হয়।
সে জিগগেস করে,
রাঁধবার পারবি?
হ বাবা পারুম, মেয়ে মানুষটি জবাব দেয়।
এই কুত্তার বাচ্চারে গোসল করাইয়া রং মাখাইবার পারবি?
হ বাবা হগলডি পারুম। কেবল আমার পোড়া কপাইল্যা মাইয়াডারে বাঁচান।
তুই হগলডি পারবি? আলি কেনান অনেকটা ফিস ফিস করে জিগগেস করে। মেয়ে মানুষটি ঘাড় কাৎ করে।
আলি কেনান রাজি হয়ে গেলো। যা অই খালি ঘরটাতে থাক গিয়া। খবরদার লাঙলুঙ ঢুকাইলে শাউয়ার মধ্যে তাজা আঙরা হান্দাইয়া দিমু। সেদিন সন্ধ্যে থেকে আলি কেনান নারীর হাতের রান্না খাওয়া আরম্ভ করলো।
মেয়েমানুষ দুটি আস্তানায় আসার পর থেকে আলি কেনানের উড়ু উড়ু ভাবটি অনেক কমেছে। সে অনুভব করে মাটির সঙ্গে শেকড়ের যোগ যেনো প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। নিজেকে অকারণে পূর্বের চাইতে অনেক ভারী বলে মনে হতে থাকে। মেয়ে মানুষটি অকৃপণ অনুরাগে তার সেবাযত্ন করে। প্রতিদিন দুবার করে ভেতরের ঘর, বাইরের ঘর ঝাট দেয়। হুজরাখানা পয় পরিষ্কার রাখে। আলি কেনানের সারা গায়ে সাবান মেখে গোসল করায়। গোসলের পর গা মুছিয়ে দেয়। গা মোছা সারা হলে সারা গায়ে মাথায় শর্ষের তেল দিয়ে মালিশ করে। যতোই দিন যাচ্ছে, মেয়ে মানুষটি আলি কেনানের জীবনের বাইরের অংশে অধিকার প্রসারিত করছে এবং আলি কেনানও ক্রমশ মেয়ে মানুষটির ব্যবস্থাপনার মধ্যে আত্মসমর্পন করতে থাকে। তার মেয়েটি কচিত ঘরের বের হয়। বাটনা বাটে, তরকারি কুটে, রান্নাসহ ভিতরের সব কাজ করে। আলি কেনান তার হাতের রান্নার তারিফ করে। সে সকাল বিকেল খাওয়ার পর আলি কেনানের জন্য চমন বাহার দিয়ে পান বানিয়ে পাঠায়। আলি কেনানের কাছে সে পান খুব মিঠে মনে হয়।
এখনো আলি কেনান ভক্তদের নিয়ে প্রতি শুক্রবার জুড়ি আর খঞ্জনি বাজিয়ে মাজার পরিক্রমায় বের হয়। কুকুর ছানাটিও তাদের সঙ্গে যায়। হাইকোর্টের মাজার সালাম করে নিমবাগান মাজারে এসে খাওয়া দাওয়া সারে। সে দিন গাঁজায় দম দিয়ে আলি কেনানের মনে হলো তার জীবনে এতো সুখ রাখবার কোনো জায়গাই নেই। ভক্তদের নির্দেশ দিলো,
এ্যাই কালাম, এ্যাই বশির গানে টান দে। ভাব আইবার লাগছে। তখন সবকিছুর দুঃখ ভুলে গিয়ে তারা গাইতে লাগলো :
জলিল ও জব্বার বাবা
জলিল ও জব্বার
তোমার প্রেমেতে হলো
দুনিয়া গুলজার।
পেয়ে তোমার প্রেমের মধু
কুল ছাড়িল কুল বধু
অসাধু হইল সাধু
প্রেমেতে তোমার।
আলি কেনান জানতো না যে সে একটা বড়ো ধরনের ভুল করে বসে আছে। তখনো শুক্রবারের জুম্মার নামাজ শেষ হয়নি। নামাজের সময় গান বাজনা। স্বভাবতই মুসুল্লিদের কেউ কেউ ভীষণ ক্ষেপে উঠেছিলো। মাজারের খাদেমও এই রকম একটা সুযোগের প্রতীক্ষায় ছিলো। নিমবাগানের মাজারটির পেছনে কোনো জমকালো ইতিহাস নেই। কোন্ সাধু পুরুষের দেহাবশেষের ওপর এই মাজার জন্ম নিলো, তার নামটিও আশ পাশের মানুষ ভালো করে বলতে পারে না। খাদেম অবশ্য ইদানিং একটা লম্বা চওড়া সাইনবোর্ড ঝুলিয়েছেন- হজরত আমজাদ আলি শাহ খোরাসানি (রাঃ) এর মাজার। এই খোরাসানি বাবা সম্পর্কে কেউ আগ্রহ প্রকাশ করলে খাদেম একটা দীর্ঘ বৃত্তান্ত শুনিয়ে দিয়ে থাকেন। কাহিনীটি বার আউলিয়ার চরিত কথা নামক পুস্তক থেকে সংগ্রহ করে, স্থান বিশেষে সম্পাদনা করে খোরাসানি বাবার নামে চালিয়ে থাকেন। খাদেমের মতে হজরত খোরাসানি বাবা বখতিয়ারের বাংলা বিজয়ের পর পরই সুদূর খোরাসান থেকে আপন পীরের নির্দেশে ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে এই বাংলা মুলুকে আসেন এবং এইখানে দেহ রক্ষা করেছেন। বাবার দুয়েকটা কেরামতির কথাও অবস্থা বুঝে প্রকাশ করেন। কেউ বলে,
বাবাজান কুমীরের পিঠে সওয়ার হয়ে এসেছিলেন। আবার কারো মতে, একটা মানুষ খেকো বাঘ পিঠে করে তাঁকে বয়ে এনেছিলো।
এই নিমবাগানের মাজারের খাদেমের শত্রুর অভাব ছিলো না। তাদের কেউ বলতো, একটা মামুলি কবরের ওপর এই মাজার উঠেছে। আবার কেউ কেউ খাদেমের বিগত জীবন নিয়ে নানা কথা উত্থাপন করতো। সেসব খুব একটা ধর্তব্যের ব্যাপার নয়। খোরাসানি বাবা এখানে দেহ রক্ষা করেছেন কিনা সেটাও বড়ো কথা নয়। আসল ব্যাপার হলো মানুষের মনে অচলা ভক্তি আছে, সেই ভক্তি কোথাও নিবেদন করতে হবে। মানুষের ভক্তি এবং খাদেমের অক্লান্ত প্রয়াসে এই সুন্দর মাজারটি এই নিমবাগানের মাটি খুঁড়ে জন্মাতে পেরেছে। মানুষের জীবনে সমস্যা আছে, আছে দুঃখ ও শোক। তারা যাতে বিনা দ্বিধায় বিশ্বাস করতে পারে সে জন্য মাজারের পেছনে একটা জমাট ইতিহাসও চাই। এই খাদেমের কৃতিত্ব হলো সেই ইতিহাসটি লোকগ্রাহ্য করে তুলতে পেরেছেন।
খাদেমকে কেউ নিয়োগ করেনি। তিনি স্বয়ং নিযুক্ত হয়েছেন। মাজারের কোনো কমিটি নেই। তিনি একাই সব। সবেতো মাজারের জন্ম হলো। এতো তাড়াতাড়ি কমিটি আসবে কোত্থেকে? অবশ্য তাঁর নিযুক্তির দাবির পেছনে একটা স্বপ্ন নির্দেশের কথা বলে থাকেন।
খাদেম এই আলি কেনান মানুষটিকে শুরু থেকে সন্দেহের চোখে দেখে এসেছেন। তাদের পোশাক আশাকের জেল্লা, সঙ্গী সাথী এবং সংঘবদ্ধতা খাদেমের মনে ভয় ঢুকিয়ে দিয়েছে। তিনি মনে মনে চাইতেন আলি কেনান যেনো এই মাজারে না আসে। তার একটা আশঙ্কা ছিলো কোনোদিন আলি কেনানেরা যদি মাজার দখল করে বসে। যদি তাকে তাড়িয়ে দেয়, সে বড়ো দুঃখের ব্যাপার হবে। তিনি অকূলে পড়ে যাবেন। আবার মুখ ফুটে তিনি নাও করতে পারছিলেন না, অলি আল্লার ভক্ত আসবে, সেখানে খাদেম বাধা দেওয়ার কে? তাই তিনি তক্কে তক্কে ছিলেন, যদি কোনো দিন সুযোগ পাওয়া যায়।
আজকে না চাইতেই সেই সুযোগটা হাতের কাছে এসে গেলো। আলি কেনানের অপরাধ সে নামাজের সময় গান গেয়েছে। তাতে মুসুল্লিদের নামাজের ব্যাঘাত হয়েছে। দ্বিতীয়তঃ দলেবলে সে গাঁজা খেয়েছে। তৃতীয়তঃ সবচেয়ে গর্হিত অপরাধ যেটা সে করেছে, ধর্মস্থানে কুকুর নিয়ে প্রবেশ করেছে। কুকুর আমাদের রসুলের জানের দুশমন। মুসল্লিরা প্রচণ্ড রকম ক্ষিপ্ত হয়ে আলি কেনান এবং তার দলবলকে আচ্ছা করে পিটিয়ে দিলো। আলি কেনানের মাথা ফেটে চৌচির হয়ে গিয়েছিলো। আলি কেনান ক্ষিপ্ত মুসল্লিদের বোঝাতে চেষ্টা করেছিলো কুকুর খুব খারাপ জানোয়ার। কিন্তু মাঝে মাঝে ভালো কুকুরও পাওয়া যায়। যেমন আসহাবে কাফের সঙ্গে একটা কুকুর ছিলো। ক্রুদ্ধ মুসুল্লিরা তার কথা কানে তুলেনি। তারা। কুকুরটিকেও এমন মার দিয়েছে পেছনের পা দুটো একেবারে জখম হয়ে গেছে।
আলি কেনানের সমস্ত রাগ কুকুরটার ওপর পড়ে। সে ধরে নিয়েছে কুকুরটার কারণেই তার এতো লাঞ্ছনা। তাই কুকুরটার পেটে একটা লাথি দিয়ে রিকশায় উঠে বসলো। তাদের সকলের মিরপুরের মাজারে যাওয়া বন্ধ রেখে ফুলতলিতে ফিরে আসতে হলো।
আসার সময় নিমবাগানের খাদেমের দিকে তর্জনী প্রসারিত করে বললো, খানকির পুত মনে রাখিস, তরে একদিন দেইখ্যা লমু।
অতি সংকটেও আলি কেনান কাণ্ডজ্ঞান হারিয়ে বসে না। সে তার ভক্তদের বলে:
এই কালাম, এই হাফিজ এই কতা ফুলতলির মানুষদের কইয়া লাভ নাই। মনে থাকবে? শিষ্যেরা মাথা ঝাঁকায়।
সেই রাতে মেয়ে মানুষটি পরম যত্নে তার সেবা শুশ্রূষা করে। গরম পানিতে গামছা ভিজিয়ে সারা শরীরের রক্তের দাগ পরিষ্কার করে। শরীরের জখমী জায়গাগুলোতে ডাক্তারের দেয়া মলম লাগিয়ে দেয়। আলি কেনান ডান হাতটা নাড়াতে পারছিলো না। মেয়ে মানুষটি নিজের হাতে গ্লাস পাকিয়ে ভাত খাইয়ে দেয়।
ক্লান্তিতে আলি কেনানের চোখ বুজে আসছিলো। মাঝরাতে কি একটা স্বপ্ন দেখে তার ঘুম ভেঙে যায়। দেখে এখনো মেয়ে মানুষটি তার বিছানার পাশে বসে আছে। চোখের দৃষ্টি তার দিকে স্থির। আধো আলো আধো অন্ধকারে মেয়ে মানুষটিকে তার চোখে একটি অনুচ্চ ঝোঁপের মতো মনে হচ্ছিলো। হঠাৎ করে তার বুকের ভেতর আকাঙ্খ দুলে উঠলো। সে ফিস ফিস করে জিগগেস করে,
এই তর নাম কি করে? মেয়ে মানুষটিও ফিস ফিস করে জবাব দেয়,
আমার নাম ছমিরন। অতি কষ্টে জখমি হাতটা বাড়িয়ে ছমিরনকে তার দিকে আকর্ষণ করে। ছমিরন যেনো সে জন্যই অপেক্ষা করছিলো। সে আলি কেনানের শরীরের সঙ্গে কাদার মতো লেপ্টে থাকে। সেদিন থেকে ছমিরন এবং আলি কেনানের মধ্যে একটা গোপন শারীরিক যোগাযোগ প্রতিষ্ঠিত হলো।
৪. ঘুম ভাঙে বেশ দেরিতে
সেই ঘটনার পরের দিন আলি কেনানের ঘুম ভাঙে বেশ দেরিতে। অনুভব করে সর্বশরীরে প্রচণ্ড ব্যথা। নড়াচড়া করার শক্তি নেই। তবু সে অনুভব করে একটা প্রশান্তি তাকে আচ্ছন্ন করে আছে। তার আপন অস্তিত্ব পাথর খণ্ডের মতো ভারি মনে হয়।
এদিকে সকালের রাঙা আলো ছড়িয়ে পড়তে আরম্ভ করেছে। নতুন সূর্যালোক জাগ্রত ধরিত্রীর রূপরস গন্ধ তাকে ক্রমাগত চঞ্চল এবং উতলা করে তুলেছে। আলি কেনান অনুভব করে এই পৃথিবী সুন্দর। সুন্দর তার প্রসন্ন সূর্যোদয় সুন্দর সূর্যাস্ত। ঘাসপাতা, গাছপালা পাখপাখালি সবকিছু সুন্দর। আল্লাহ মেয়ে মানুষ সৃষ্টি করেছে বলেই তো এই দুনিয়া এতো রূপরসে ভরা। মেয়ে মানুষ না থাকলে পৃথিবী একটি মরুভূমিতে পরিণত হতো। আলি কেনান শুয়ে শুয়ে অনুভব করে।
এই আকাশ পৃথিবীর কোথায় রসের একটা গোপন উৎসধারা খুলে গেছে। এই ধারা স্রোতে সে যেনো ভেসে যাচ্ছে। সর্ব অস্তিত্বে নিজেকে নবজাত শিশুর মতো পেলব এবং সুকুমার মনে করতে থাকে।
আলি কেনান চোখ বুঝে আছে, তবু টের পায় ছমিরন হুজরাখানায় ঢুকেছে। মেয়ে মানুষের শরীরের আলাদা একটা ঘ্রাণ আছে। সহসা ছমিরনকে দেখার একটা তীব্র গভীর তৃষ্ণা মনের মধ্যে অনুভব করে। গা ধুয়েছে ছমিরন। তার মাথায় আধভেজা চুলের বোঝা পিঠের ওপর ছড়িয়ে পড়েছে। দুয়েক ফোঁটা পানি ঘাড়ের কাছটিতে চকচক করছে। মুখে গুটিবসন্তের দাগগুলো স্পষ্ট হয়ে দেখা যাচ্ছে। চোখে চোখ পড়তেই ছমিরন ঠোঁট ফাঁক করে হাসলো। বাহু দুটো অকারণে নাড়া দিলো। আলি কেনানের মনে হলো,
এই বাহু দুটোর ভাষা আছে। যেনো তারা বলছে, তুমি বাঁধা পড়ে গিয়েছে গো। আর যাবে কোথায়?
আস্তানায় লোকজন আসতে শুরু করেছে। অগত্যা আলি কেনানকে শয্যাত্যাগ করে উঠতে হয়। সে প্রাতঃকৃত্য শেষ করলো। ছমিরন এবারও গরম পানিতে গামছা ভিজিয়ে তার সারাগা মুছে দিলো। দু জনের মধ্যে একটি কথাও বিনিময় হয়নি। আলি কেনান ছমিরনের দিকে তাকাতে পারছিলো না। কোত্থেকে একটা লজ্জা এসে তাকে আড়ষ্ট করে দিচ্ছিলো। সে বেমালুম ভুলে গেলো, গতকাল তার ওপর একটা বিরাট ঝড় বয়ে গেছে।
আলি কেনান বাইরে এসে দেখে হোগলার চাটাইয়ের ওপর লোকজন বসে রয়েছে। আর ইমাম সাহেব একটি জলচৌকির ওপর কাগজ রেখে কোরানের আয়াত লিখছেন। আলি কেনান ভীষণ বিরক্ত হলো। রোজ রোজ একই দৃশ্য ঘুম থেকে উঠে তাকে দেখতে হয়। ইমাম সাহেবকে ডেকে বলে,
ইমাম সাহেব হগলডিরে কইয়া দ্যান, কারো লগে আমি কতা কইবার পারুম না।
ইমাম সাহেব মিন মিন করে বললেন, অনেকে অনেক দূর থেইক্যা আইছে। চইল্যা যাইতে বলা কি ঠিক অইব? কথা না বাড়িয়ে আলি কেনান বলে,
তা অইলে আপনে দেইখ্যা শুইন্যা তাবিজ আর পানি পড়া দিয়া দেন। তার কথা শুনে ইমাম সাহেব যেন আকাশ থেকে পড়লেন!
আমি দিলে লোকের উপকার অইব?
আলি কেনান বললো,
আপনে নিজেরে এত আদনা ভাবেন কেরে। কলন্দর বাবা স্বপ্নে কইছে, আপনে দিলেও কাম অইব। খুশিতে ইমাম সাহেবের চোখ দুটো নেচে উঠলো। আপনে হাঁছা কইতাছেন?
হ হাঁছা
সে বাইরে এসে রোজকার মতো মনু মনু বলে কুকুর ছানাটিকে ডাকলো।
পরিচিত চিৎকার করে, ঘন্টি বাজিয়ে কুকুর ছুটে এলো না।
কি কারণ? তখনই আলি কেনানের নিমবাগান মাজারের ঘটনাটি মনে পড়ে গেলো। শরীরের ব্যথা বোধকরি নতুন করে তেতে উঠলো। পাশের ঘরে দু-এক জন শিষ্য অসহ্য যন্ত্রনায় কাতরাচ্ছে। আলি কেনান হঠাৎ করে ভিন্ন মানুষে রূপান্তরিত হয়ে যায়। স্থির করে ফেললো খানকীর বাচ্চাটাকে একটা শিক্ষা দিতে হবে।
আলি কেনান বাস্তববাদী মানুষ। সবকিছু গুছিয়ে চিন্তা করার ক্ষমতা তার আছে। মাথাটাও ভীষণ পরিষ্কার। সবচেয়ে কম ঝুঁকি গ্রহণ করে প্রতিপক্ষের মারাত্মক ক্ষতি কিভাবে করা যায় সে শিক্ষা যৌবনে চর দখলের সময় সে পেয়েছে। শরীরের স্নায়ুর সমস্ত ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া ঐ বিষয়টি ঘিরেই আবর্তিত হতে থাকে। তখন বিষয়ান্তরে মননানিবেশ করা তার পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়ে। সে চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ কাটায়। তার মাথায় একটা নতুন পরিকল্পনা বিজলীর শিখার মতো ঝিলিক দিয়ে জেগে উঠলো।
গায়ের জড়তা, ক্লান্তি যথাসম্ভব দূর করে সে সোজা হয়ে উঠে দাঁড়ালো। কিছু কিছু সাপ নাকি আছে, ক্ষেপে গেলে লেজের ওপর সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে ছোবল মারে। আলি কেনানেরও অনেকটা সেই অবস্থা। সে শিষ্যদের হাঁক দিলো :
এই কালাম, এই বশির, এই ফজলা তোরা হগলে আইয়া হুইন্যা যা। যে দুজন বাড়িতে থাকে, তাদেরও ডেকে আনা হলো। ফজলা খুব কঁকাচ্ছিলো। আলি কেনান তার পরিকল্পনাটা প্রকাশ করতে পারছিলো না। তার একান্ত ইচ্ছে শিষ্যেরা মন প্রাণ দিয়ে তার কথাগুলো শুনুক। সে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করবার জন্য বাঘের মত একটা হালুম করলো। সকলে তার দিকে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে তাকায়। আলি কোন বয়ান করতে আরম্ভ করে :
তোরা বেবাকডিতে হুন, গত রাইতে কলন্দরি বাবার কাছে অনেকক্ষণ ধইর্যা জারজার অইয়া কানলাম। কানতে কানতে ঘুমাইয়া পড়ছি কহন টেরও পাই নাই। এক সময়ে দেহি হুজরাখানা রোশনাইয়ে ভইরা গেছে। আর চাইরদিকে বেহেশতের বাস। আমি চউক মেইল্যা চাইয়া দেহি একডা বুইড়া মানুষ। মুহে সাদা দাড়ি। হাতে লাঠি আর গায়ে আমাগো মতোন শিকল। মুহের দাড়ি থেইক্যা, হাতের লাঠি থেইক্যা রোশনি বাইর অইবার লাগছে। এমুন ছবি আমি আর জিন্দেগিতে দেহি নাই। বুইড়া মানুষডি আমারে কইলো,
আলি কেনান তুই উইঠ্যা খাড়া। আমি কইলাম,
নিমবাগান মাজারে আমারে ধইর্যা কিলাইছে। উঠবার শক্তি নাই। তহন তিনি আমার গায়ে হাতের লাঠি তুইল্যা একটা বাড়ি দিলেন। লগে লগে আমার দরদ ব্যথা সব চইল্যা গেল। আমি বুইড়া মানুষডির পায়ের উপর আছরাইয়া পইরা কইলাম,
বাজান আপনে কেডা? তখন তিনি আমারে সোহাগ কইরা হাত বুলাইয়া কইলেন,
আমার নাম বু আলি কলন্দর। আলি কেনান বলতে থাকে, শিষ্যেরা অবাক হয়ে শুনে। তারপর আমার দুই চউক দিয়া হু হু কইর্যা পানি পড়তে লাগলো। বাবাজান তাঁর পাক হাতে আমার চউকের পানি মোছাইয়া কইলেন,
বেটা আলি কেনান, তর দিলে খুব মহব্বত। আর কান্দনে কাম নাই। আমি কষ্ট পাইতাছি তোগো লাইগ্যা।
আলি কেনান নির্বিকার বলে যাচ্ছিলো। শিষ্যেরা সম্মোহিত হয়ে শুনছিলো। দেখা গেলো ইমাম সাহেবও আয়াত লেখা বন্ধ করে মুগ্ধ বিস্ময়ে আলি কেনানের স্বপ্ন পুরানের কথা শুনছেন। আলি কেনান বলে যায়,
তারপর বাবা আমারে কইলেন, খোরাসানি আমার মুরিদ আছিল। এই ব্যাপারে তার লগে আমার ফাইন্যাল কথা অইয়া গেছে।
ঐ খাদেম বেটা নাপাক বজ্জাত আর হারামি। তুই অরে খেদাইয়া মাজারের দহল লইয়া ল। তিনখান কতা মনে রাখিস। কুত্তা লইয়া যাবি না। অহন আসহাবে কাফের জমানা নয়। অহন কুত্তা নাপাক। জন্তু জানোয়ারে যদি হাউস থাহে, ভেড়া লইয়া যাবি। ভেড়া পাক জন্তু। আমাগো দ্বীনের নবী ভেড়ার গোশত খাইতে পছন্দ করতেন। আর হুন এশার নামাজের আগে গান বাজনা করবিনা। আমার ঘুম ভাইঙ্গ্যা গেল। দেহি শরীরে আর দওর ব্যথা নাই। বেবাক ঘরে ম ম খোশবু। আমি কানতে কানতে কইলাম,
বাজান আরেকবার দর্শন দ্যান। আমার চউকে আর নিদ্রা আইলনা। তরা হুইঙ্গা দেখ অহনও আমার গতরে খোশবু লাইগ্যা আছে। ইমাম সাহেব নাকটা আলি কেনানের আলখেল্লার কাছে নিয়ে গেলেন, হাঁছাইত দেহি, চম্পা ফুলের মত বাস পাওয়া যায়। বু আলি কলন্দর যে স্বপ্নে দর্শন দিয়েছেন, সে ব্যাপারে আর কারো সন্দেহ রইলো না।
এত কিছুর পরও আলি কেনানের মনের দ্বিধার ভাবটা কাটলো না। জেলফেরত আসামী কালামের মুখে একটুও ভাবান্তর লক্ষ্য করা গেলোনা। শুরু থেকেই আলি কেনানের মনে বেজেছে এই কালাম হারামজাদা তার কথায় বিশ্বাস করে না। এমনকি মনে মনে তাকে একটা দাগাবাজ ভাবলেও সে বিস্মিত হবে না। মানুষের মনের ভাষা পাঠ করার ক্ষমতা না থাকলে সে এই অল্প দিনে এতো দূর প্রতিষ্ঠা লাভ করতে পারতো না। কালাম এখানে থাকলে খেতে পায় বলেই আছে। তার মনে নিশ্চয়ই অন্য কোনো মতলব আছে। তথাপি আলি কেনান তাকে তাড়িয়ে দিতে পারেনি। তাহলে দলটি কানা হয়ে যায়। আরো একটি বিষয় চিন্তা করার আছে। কালামের গানের গলাটি ভারী মিষ্টি।
আলি কেনান হুঙ্কার দিয়ে বললো,
এ্যাই শালা কালাম্যা। এত কি ভাবতে আছস? শুনলি বাবা বু আলি কলন্দর কি কইয়া গেছেন। অহন তোরা কি করবি, হেইড্যা ক?
কালাম কোনো রকম দ্বিধা না করেই বললো,
তা অইলেতো মারামারি করতে অয়। আর মারামারি কইর্যা আমরা পারুম কেনে। অরা অনেক। একবার খাদেমের মাইনসে আমাগো খেদাইয়া দিছে। আপনে কি করবার চান, আপনে জানেন, আমি কিছু কইবার পারুমনা। তাকে কথা বাড়াতে না দিয়ে আলি কেনান বলে বসলো,
হ হাঁছা কতাই কইছস। আমি বাবা বু আলি কন্দরের হাতের বাঁশি। তিনি যেভাবে বাজান, আমি সেভাবে বাজি। আর তরা আমার হাতের যন্ত্র। যা করবার কমু, করবি? কেউ তখন আলি কেনানের প্রতিবাদ করলো না। সুতরাং সে নিশ্চিত হয়ে তার পরিকল্পনাটা প্রকাশ করে। আমরা হগলে যাইয়া আগামী শুক্রবারে মাজারের দখল লইয়া লমু। আমাগো উপর বাজানের দোয়া আছে। কুনু বাপের ব্যাটা ঠ্যাহাইতে পারতো না। বাজান যা যা কইছেন আমরা হগলডি মাইন্যা চলুম। ঐ মাজারে আমরা তামুক টামুক খামু না। এশার নামাজের আগে গান বাজনা করুম না। আর ভেড়া লইয়া যামু। বাজান কইছেন, ভেড়া পাক জন্তু। তরা জখম টখম সারাইয়া ল।
কালাম বলেই বসলো,
অরা অনেক, আমরা মাত্র সাতজন।
আলি কেনান ধমক দিয়ে তার মুখ বন্ধ করে দিলো।
শালা চোরা, তর দিলে ইমানের তেজ নাই। বাবা মঈনুদ্দিন একলা আইসা তামাম হিন্দুস্তানে ইসলাম জারী করছে। ইমানের বলে অসাধ্য সাধন করা যায়। তারপরে আর কারো কিছু বলার থাকে না।
ফজল আর মুন্নাফ গাবতলির হাটে গিয়ে দুধের মতো সাদা ধবধবে একজোড়া ভেড়ার বাচ্চা কিনে আনে। আলি কেনান নিজে দাঁড়িয়ে তাদের গোসল করানো দেখলো। তারপর রোদে বেঁধে রেখে গা শুকিয়ে নেয়া হলো। লোমগুলো একেবারে ঝরঝরে হয়ে গেলে দুটি গামলাতে রং গুলে একটাকে সামনের দিকে সবুজ এবং পেছনে লাল রং লাগানো হলো। আর অন্যটাকে পেছনের দিকে নীল এবং সামনের দিকে হলদু রং মাখিয়ে দেয়া হলো। গলায় চামড়ার বেল্ট পরিয়ে ঘণ্টি লাগানো হলো। চার পাঁচদিন ধরে শিষ্যরা শিকল ধরে শহরের রাস্তায় ভেড়ার বাচ্চাদের হাঁটা চলার টেনিং দিলো।
শুক্রবার দিন ঠিক জুমার নামাজের পূর্ব মুহূর্তটিতে আলি কেনানেরা সদলবলে নিমবাগানের খোরাসানি বাবার মাজারে এসে হাজির হলো। কোনোরকম বিলম্ব না করেই সকলে নামাজের কাতারে দাঁড়িয়ে যায়। কেউ কেউ কৌতূহলী হয়ে তাদের দিকে তাকায়। দুয়েকজনের অনুতাপও হয়। তারা গত শুক্রবারে এই ফকিরদের গায়েই হামলা করেছে। কার দিলের ভেতর কি আছে সেতো আল্লাহ জানেন। পারতপক্ষে কেউ বিকেকের কাছে দায়ী হতে চায় না। সুতরাং নামাজ শেষে যে যার মতো ঘরে চলে গেলো।
আলি কেনানেরা মসজিদে প্রবেশ করার সময় ভেড়ার বাচ্চা দুটোকে মাজারের সামনে শ্বেত করবী গাছের সঙ্গে বেঁধে গিয়েছিলো। গত শুক্রবারেও তারা কুকুরটিকে এই নিমবাগানের মাজারেই রেখে গিয়েছিলো। বেচারী আহত কুকুর সেই থেকে এখানেই পড়ে আছে। কুকুরসুলভ ঘ্রাণশক্তি দিয়ে বোধ করি বুঝতে পেরেছিলো, আলি কেনানের অন্ন আর তার ভাগ্যে নাই। ভেড়ার বাচ্চা দুটো দেখে কুকুরের প্রতিশোধ স্পৃহা জাগ্রত হওয়া একটুও অস্বাভাবিক নয়। তাই হা করে ভেড়ার বাচ্চা দুটোকে কামরাতে ছুটে আসে। রং করা ভেড়ার বাচ্চা দুটো প্রচণ্ড ভয় পেয়ে চীৎকার করতে থাকে। ভাগ্যিস তখন নামাজ শেষ হয়ে গিয়েছিলো। নইলে আজকে একটা অঘটন ঘটে যেতে পারতো।
খাদেম মাজারেই ছিলেন। আসলে তিনি আলি কেনানের কাজ কর্মের ওপর নজর রাখছিলেন। তিনি অসম্ভব রকম ক্ষেপে গিয়ে আলি কেনানকে বললেন, অ মিয়া তোমার মনে কি আছে কওতো দেহি? একবার আস কুত্তা লইয়া, একবার আস ভেড়া লইয়া। মাইর খাইয়াও তোমার শিক্ষা অইলো না? মাজারটারে নাপাক না কইর্যা ছারবানা দেখছি। তোমার মতি গতি ত সুবিধার নয়।
আলি কেনান এটাই চেয়েছিলো। সে খাদেমকে বলে,
তোর কথা শেষ অইছে?
খাদেম বললেন,
এইখান থেইক্যা কাইট্যা পড়। আর কুনু দিনই এইমুখি আইবানা। আইলে পিডের ছাল থাকতনা। আলি কেনান তার আপন স্বরূপ প্রকাশ করলো।
খানকির পোলা, তর বড় বাড় অইছে। আর বাড়তে দিমুনা। বাবা বু আলি কলন্দর আমারে খোয়বে আইস্যা কইয়া গেছেন খোরাসানি বাবা বু আলি কলন্দরের মুরিদ আছিলো। বাবায় কইছেন, তুই মাজার নাপাক কইর্যা ফেলবার লাগছস। তরে মাজার থেইক্যা তাড়াইয়া দিবার হুকুম দিছেন। কুত্তা আছিল নাপাক জন্তু, হের লাইগ্যা কুত্তারে তর কাছে রাইখ্যা গেছি। তুইও নাপাক, কুত্তাও নাপাক। এইবার ভেড়া লইয়া আইছি। ভেড়া পাক জন্তু আমাগো দ্বীনের নবী ভেড়ার গোশত খাইতেন।
খাদেমের মনে তখনও যথেষ্ট সাহস ছিলো। গত জুমার দিন তিনি নিজের চোখেইতো দেখেছেন আলি কেনানরা কেমন মারটা খেয়েছে। আশা করেছিলেন আজকেও তেমন একটা কিছু ঘটে যাবে। আর শরীরের উত্তেজনাও এসে গিয়েছিলো। তিনি বলেই বসলেন,
বেশী তেড়িমড়ি করলে জান খাইয়া লমু মিয়া, কাইট্যা পড়।
শুয়রের বাচ্চা, খানকির পোলা, গত শুক্কুরবারে কি করছস মনে আছে। অহনও গতরের দরদ ব্যথা যায় নাই। একক্ষণে এ্যাই মাজার থাইক্যা যদি বাইর অইয়া না যাস, খুন কইর্যা পুঁইত্যা রাখুম। সাত সাতজন মানুষ খাদেম সাহেবের দিকে তেড়ে এলো। খাদেম ডানে বামে সামনে পিছনে তাকিয়ে দেখেন, তিনি একেবারে একা। সাহায্য করার মতো কেউ নেই। তবু কণ্ঠের শেষ জোরটুকু প্রয়োগ করে বললেন,
অ মিয়া আগে ভাগে কইয়া রাখলাম, ভালা অইব না কিন্তু।
শাউরের পুত। তরে ভালা অহন দেহাইতাছি।
আলি কেনান খাদেমের কপালে একটা ঘুষি বসিয়ে দিলো। শিষ্যেরাও ছুটে আসে। খাদেম সাহেব কমজোর মানুষ। অল্পক্ষণের মধ্যেই তাকে ধরাশায়ী করে ফেলতে তাদের কোনো অসুবিধে হলো না। নিমবাগানের কিছু কিছু কৌতূহলী মানুষ চারপাশে জড়ো হয়ে মজা দেখে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ জিগগেস করে,
কি হয়েছে, অমন করে মানুষটাকে মারছো কেনো?
আলি কেনান তার কণ্ঠস্বর এক কাঠি চড়িয়ে বলে,
না মাইর্যা পেয়ার করুম নাকি? আপনেরা এই হারামীরে চেনেন? হারামজাদা খুনি বজ্জাত। ব্যাটা ডাকাইত, মাজারটারে পচাইয়া ফেলাইল। জানেন অর নামে থানায় দশটা মামলা আছে? তার শিষ্যদের নির্দেশ দিলো,
এই নাপাক জন্তুটারে ব্যাবাকডিতে বাইরে থুইয়া আয়। শাউরের পুত মনে থাকে য্যান, মাজারে আবার যদি দেখি জান খাইয়া ফেলামু। যথেষ্ট মানুষ জমা হয়েছিলো। ইচ্ছে করলে খাদেম আত্মপক্ষ সমর্থন করতে পারতেন। আলি কেনানরা তাকে মেরেছে, খুনি বলেছে, ডাকাত বলেছে, বলেছে থানায় মামলা আছে। তিনি কেনো চুপ করে থাকলেন, তিনিই বলতে পারেন। তাঁকে নিরুত্তর দেখে লোকজনও এগিয়ে এলো না। কেউ কেউ মনে করলো, হয়তো লোকটার অতীত খুবই খারাপ। গর্হিত কোনো কাজ করে মাজারে ছদ্মবেশে আশ্রয় নিয়েছে। খাদেমকে তাড়ানোর পর আলি কেনানের দলবল মাজারে প্রবেশ করে আল্লাহ আল্লাহ শব্দে জিকির করতে থাকে। নিম বাগানের কিছু কিছু মানুষ মনে করলো, তাদের মহল্লার মাজারটির নিশ্চয়ই কিছু আছে। নইলে পাগল দরবেশের দল কি আর শুধোশুধি জিকির করতে আসে। আলি কেনানেরা চীকার করে জিকির করতে করতে মুখে ফেনা তোলে। কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। তারপর লাইলাহাইল্লাল্লাহ শব্দে দ্বিতীয় দফা জিকির আরম্ভ করে। জিকির শেষ করে আলি কেনান শিষ্যদের সামনে সিনা টান করে দাঁড়িয়ে বললো,
তগোরে কইছিলাম না, বাবায় কখনো মিছা খোয়াব দেহায় না। অহন ত তরা চউকের সামনে পরমান পাইয়া গেলি। এই জানোয়াররে আমরা বাইর কইরা দিছি। অহন মাজার আমাগো।
আলি কেনানের অট্টহাসি আসতে চায়। আল্লাহ যা করে ভালার লাইগ্যা করে। হেইদিন হেই কাণ্ড না ঘটলে, আইজকার ঘটনা ঘটত না। মাজার আলি কেনানদের দখলে চলে এলো।
আলি কেনান চরের মানুষ। কোনো জিনিস দখল করলে কি করে রক্ষা করতে হয় তা সে ভালোভাবেই জানে। সে শিষ্যদের মধ্যে তিনজনকে সার্বক্ষণিকভাবে নিমবাগানের মাজারে মোতায়েন রাখলো। সেও প্রায় প্রতিদিন বেলা দশটার সময় রিকশায় চেপে ফুলতলি থেকে এখানে এসে হাজির হয়। প্রথম চার পাঁচদিন তারা আশেপাশের লোকজনকে জানিয়ে দিলো :
আগে যে মানুষটি এই মাজারে থাকতো সে একটা খুনি ডাকাত। থানায় তার নামে দশ বারোটা খুনের মামলা আছে। জনমত তো সবসময় হাওয়ার অনুকূলে চলে। তারা ধরে নিলো ব্যাপারটা সত্য হতেও পারে। কেউ কেউ অবাক হয়ে চিন্তা করলো, এতদিন এই খাদেম লোকটা তাদের বোকা বানিয়ে গেছে। আল্লাহর দুনিয়াতে কতো রকমের যে ভেল্কিবাজ আছে।
আলি কেনান বসে থাকার মানুষ নয়। ইতিমধ্যে সে নিমবাগানের ওয়ার্ড কমিশনারের সঙ্গে আলাপ পরিচয় করে ফেলেছে। এলাকার আরো কিছু প্রভাবশালী মানুষের সঙ্গে তার জানপাহচান হয়ে গেছে। কিছু বখাঠে এবং বেকার যুবক কিশোরও তার সঙ্গে জুটে গেলো। আলি কেনান ছোঁড়াদের কানে মন্ত্র দিয়েছে। আগামী পাঁচই রজ্জব মাঘ মাসের তেইশ তারিখে খোরাসানি বাবার মাজারে ওরশ করতে হবে। ছোঁকড়ারা গিয়ে কমিশনারকে ধরেছে। আমরা মাঘ মাসের তেইশ তারিখ খোরাসানি বাবার মাজারে ওরশ পালন করবো। আপনাকে আমাদের সঙ্গে থাকতে হবে।
কমিশনার সাহেবের ছোঁকড়াদের সঙ্গে থাকতে কোনো আপত্তি ছিলো না। কিন্তু ভয় পাচ্ছিলেন ছোঁড়ারা তাঁর কাছে একটা গরু কিংবা খাসীর দাম দাবী করে বসবে। এই আশঙ্কায় তিনি উশখুশ করছিলেন। তিনি আপত্তি করে বললেন,
হঠাৎ করে ওরশ কি ব্যাপার? ছোঁকড়াদের একজন বলে বসলো,
কোনোদিন ওরশ হয়নি বলে এবার ওরশ হবে না, তার কোনো অর্থ থাকতে পারে না। আপনি এটা কি কথা কইলেন, আপনি কোনো দিনতো কমিশনার হননি। এইবার হয়েছেনে। সত্য কিনা কন? বলে রাখলাম, আমরা এবার ওরশ করবো, আপনাকে পেছনে থাকতে হবে।
কমিশনার বুঝে গেলেন, তিনি রাজী না হলেও ওরা ওরশ করে ফেলবে। তাই কথা ফিরিয়ে নিয়ে বললেন,
না না আমি সে কথা বলিনি। তবে এখন টাকা পয়সার খুব টানাটানি চলছে কিনা, তোমরা যদি টাকা পয়সা দাবী করে বসো আমার দেবার ক্ষমতা নেই। ছোঁড়ারা বললো,
আপনাকে টাকা পয়সা দিতে হবে না। আপনি শুধু পেছনে থাকবেন। আমরা রাস্তায় গাড়ি আটকে টাকা উঠাবো। বাড়ি বাড়ি গিয়ে চাল তুলবো। বাজারের মহাজনদের কাছে যাবো। এরকম একটি সুন্দর প্রস্তাবে কমিশনারের আপত্তি থাকার কোনো কারণ রইলো না।
আলি কেনানের শিষ্য এবং নিমবাগানের ছোঁকড়ারা বাহুতে মাথায় লাল সালুর ফেট্টি বেঁধে রাস্তায় নেমে পড়লো। প্রতিটি বাস, প্রাইভেট কার থামিয়ে দাবি করতে থাকলো,
খোরাসানি বাবার ওরশ, চাঁদা দিন। কতো টাকা কতো জায়গায় খরচ করেন, দিন আল্লাহর নামে দশ বিশ টাকা দিয়ে যান। গাড়িওয়ালাদের মধ্যেও ঘাউরা লোক কম ছিলো না। তারা অনুরোধ কানে তুললো না। অনেকে দশ পনের টাকার বদলে গাড়িটা অক্ষত ফেরত নিয়ে যেতে পারছে ভেবে ভাগ্যকে ধন্যবাদ দিলো। আরেক দল বস্তা কাঁধে নিমবাগানের বাড়ি বাড়িতে ধরনা দিতে থাকলো। আগামী তেইশে মাঘ খোরাসানি বাবার মাজারে ওরশ। সুতরাং চাল দেন, টাকা দেন, যে যা পারেন দেন। একেবারে না করবেন না। আল্লাহ বেজার হবে। টাকা পয়সা চাল এসব মন্দ উঠলো না। কিন্তু তার একাংশ দেশী মদ এবং ব্লু ফিল্ম-এর পেছনে হাওয়া হয়ে গেলো। তারপরেও দু-দুটো গরু তারা কিনতে পারলো। বাজারের মহাজনদের কাছে গিয়ে তেল, মশলা, ডাল এবং অন্যান্য জিনিসপত্তর খুব অনায়াসে জোগাড় করে ফেললো। ব্যবসায়ীরাতে ধর্মকাজে টাকা পয়সা দিতে কৃপণতা করে না।
দেখতে দেখতে আঠারোই মাঘ এসে গেলো। সেদিন সকাল থেকে কাজের অন্ত নেই। নতুন লালসালু দিয়ে মাজার সাজানো হচ্ছে, শামিয়ানা টানানো হচ্ছে। প্রাঙ্গণের ঝোঁপ জঙ্গল পরিষ্কার করা হচ্ছে। এতে কাজ করার মানুষ কোত্থেকে এলো কেউ বলতে পারে না। কোরান খতম হচ্ছে, দরুদ পাঠের শব্দ ভেসে আসছে। জোহরের নামাজের পর গরু দুটো জবাই করা হলো। ভিখিরি এবং নগর কাকের চীকারে কান পাতা দায় হয়ে পড়লো। আছরের নামাজের অন্তে খোশবাগ শাহী মসজিদ এবং বায়তুল তুমাম মসজিদের ইমাম সাহেব দুজন এসে মিলাদ পড়ালেন। তারা আল্লাহর মহিমা, নবীর তারিফ বয়ান করার পর কবরে শায়িত মহাপুরুষের রুহের শান্তি কামনা করে মোনাজাত করলেন। মহাপুরুষের দয়ার অছিলায় দুনিয়ার সমস্ত মুসলমান নর নারীর গুনাহ মাফের আরজ করলেন।
নিমবাগানের চিন্তাশীল মানুষেরা ভেবে দেখলেন ওই মাজারটির নিশ্চয়ই কোনো অলৌকিক মহিমা আছে। নইলে জামানার বুজুর্গ এই সমস্ত বিশিষ্ট আলেম এখানে ফাতেহা পাঠ করতে আসবেন কেনো? অনেকের মন থেকে সন্দেহের শেষ বাম্পটুকুও দূর হয়ে গেলো। মাগরিবের নামাজের পর খাওয়াদাওয়া শুরু। মাত্র দুটো গরু জবাই হয়েছে। অন্যান্য বড়ো বড়ো ওরশের তুলনায় এটা কোনো ব্যাপারই নয়। দীন আয়োজনই বলতে হবে। তবে বড়ো কাজের সূচনা দীনভাবে হওয়াই ভালো। এ বছর দুটো গরু জবাই হয়েছে। তার পরের বছর বিশটা। এমনি ভাবে বাড়তেই থাকবে। ওরশ যতো জমকালো হবে, বাবার মহিমাও ততো ছড়িয়ে পড়বে।
এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তি সবাই এসেছিলেন। ভিখিরি যারা এসেছিলো ভর পেট খেতে পেরেছে। তারপরেও বেশ কিছু ভাত এবং মাংস ডেকচির তলায় ছিলো। সেগুলো মাটির সানকিতে করে স্থানীয় সম্ভান্ত লোকদের বাড়িতে বিলি বণ্টন করা হলো। খাওয়া দাওয়ার পাট চুকলে এশার নামাজের পর শুরু হলো গান। আলি কেনানের দলটি তো ছিলোই। তাছাড়াও বাইরের একটি কাওয়ালির দল আমন্ত্রিত হয়ে এসেছিলো। রাত ভর গান বাজনা চললো। ছোট্টো একটা অপ্রীতিকর ঘটনা ছাড়া তেমন খারাপ কিছু ঘটেনি। সেটা হলো : নিমতলির দুদল ছোকরার মধ্যে চাঁদার টাকার ভাগাভাগি নিয়ে প্রথমে তর্কাতর্কি তারপর হাতাহাতি। বয়স্করা এগিয়ে এসে মিটমাট করে না দিলে খুনোখুনি পর্যন্ত গড়াতে পারতো। নিমবাগান এলাকায় আলি কেনানের খুব সুনাম ছড়িয়ে পড়লো। বলতে গেলে আলি কেনানের চেষ্টার পরই খোরাসানি বাবার নাম প্রচার হয়েছে। পুরোনো খাদেমটির কথা ভুলে যেতেও মানুষের সময়ের প্রয়োজন হলো না।
৫. নিমবাগানের মানুষেরা
নিমবাগানের মানুষেরা আলি কেনানকে ফুলতলির বাস উঠিয়ে দিয়ে নিমবাগানে উঠে আসতে যথেষ্ট অনুরোধ করেছে। এখন নিমবাগানের মানুষ তাকে তাদের গৌরব বলে ভাবতে আরম্ভ করেছে। এ কথা আলি কেনানের মনেও একাধিক বার জেগেছে। কিন্তু ফুলতলির বাঁধানো কবরটি ছেড়ে দিতে তার মন চায় না। এই করবটি দিয়েই তার এতোদূর প্রতিষ্ঠা। নাড়ির বন্ধনের মতো ফুলতলির প্রতি একটা টান অনুভব সে না করে পারে না। তা ছাড়া সে ভয়ানক হুঁশিয়ার। সবদিক নিশ্চিত না হয়ে কোনো কাজ করে না। এখনো পর্যন্ত আলি কেনান ফুলতলি আর নিমবাগানে পালা করে যাওয়া আসা করেই কাটাচ্ছে। ফুলতলিতে মাঝেমাঝে অনুপস্থিত থাকলেও অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। ইমাম সাহেব একা চালিয়ে নিতে পারবেন। ইমাম সাহেবের বিস্তর পরিবর্তন ঘটে গেছে। তিনি আলিকেনানের দ্বিতীয় সত্তা হয়ে উঠেছেন। সাদা তহবন্দ এবং বকের পাখার মতো সাদা পাঞ্জাবি পরেন। তাঁর গায়ে গতরে চেকনাই লেগেছে। আগের মিনমিনে ভাবটি আর নেই। লোকজন পরিপূর্ণ আস্থা সহকারে তার হাত থেকে তাবিজ এবং পানি পড়া গ্রহণ করে। আলি কেনানই তো ইমাম সাহেবের প্রাণে ফুঙ্কার দিয়ে তার ভেতর থেকে একজন ব্যক্তিত্বকে টেনে বের করে এনেছে। পাশাপাশি একটা ভয়ও আলি কেনানের আছে। তাবিজ-কবজ পানি পড়া দেয়া ইমাম সাহেবদেরই পেশা। আলি কেনান একজন বহিরাগত। এক নাগারে বেশীদিন যদি সে অনুপস্থিত থাকে তাহলে ইমাম সাহেব তাকে একদিন বেদখল করতে পারে। মক্কেলদের সঙ্গে ইমাম সাহেবের সরাসরি সংযোগ ঘটে গেছে। তিনি ইচ্ছে করলে, তাকে বেদখল করতে পারেন। আলি কেনান জানে ইমাম সাহেবের দিলে এখনো তেমন হিম্মত হওয়ার কথা নয়। কিন্তু মানুষের বদলে যেতে কতোক্ষণ। এসব তো গেলো বাইরের কথা। কেনো সে ফুলতলি ছেড়ে যেতে এখনো প্রস্তুত নয়, তার অন্য একটি গভীর কারণও আছে। সে আর ছমিরন ছাড়া সে কথা কেউ কোনোদিন আঁচ করতে পারবে না। ছমিরনের সঙ্গে অবাধ গোপন মিলনে ব্যাঘাত ঘটে এমন কোনো কাজ সে করতে পারবে না। প্রাণ গেলেও না।
আলি কেনানের জীবন অত্যন্ত মসৃণভাবে চলে আসছে। সত্যি বলতে কি সে নিজেকে মনে মনে একজন বুজুর্গ ব্যক্তি হিসেবে ভাবতে আরম্ভ করেছে। কেননা সে যা করতে চাইতো আপনা থেকেই হয়ে যাচ্ছিলো। সমস্ত প্রকৃতি তার একান্ত সংগোপন মনের কথা যেনো শুনতে পেতো। কোনো কোনো রাত্রিবেলা উন্মুক্ত আকাশের গ্রহ নক্ষত্রের দিকে তাকালে তার আকাঙ্খর বেগ এতো প্রবল, এতো তীক্ষ্ণ হয়ে ওঠে যে তার মনে হয় সে গ্রহ নক্ষত্রের গতি পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। সে অনুভব করে তার চেতনায় বিদ্যুত সঞ্চারিত হচ্ছে। এই রকম সুখের সময়টিতে ছোট্টো একটি ঘটনায় তাকে চাঁদের অপর পিঠ দেখতে হলো। একদিন সন্ধ্যেবেলা সে হুজরাখানায় শুয়েছিলো। শরীরটা ম্যাজ ম্যাজ করছিলো। তাছাড়া আকাশটাও ছিলো মেঘলা। মেঘ করলে অকারণে আলি কেনানের মন বিগড়ে যায়। তাই কোথাও বের হয়নি। নারী কণ্ঠের একটা খিলখিল হাসি তার কানে আসে। জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে দেখে ছমিরনের মেয়ে আনজুমন। আনজুমন তো বটেই কিন্তু সে হাসাহাসি করছে কার সঙ্গে? ভালো করে চেয়ে দেখে জেলফেরত আসামী কালাম আনজুমনের একটা হাত ধরে আছে। আর আনজুমন কখনো খিলখিল করে হেসে তার দিকে ঝুঁকছে, কখনো সরে আসছে। টিমটিম করে জ্বলা বাতিটির আলোয় আলি কেনান আনজুমনের মুখ দেখতে পায়, দেখতে পায় তার পরিণত স্তনগুলি। ছমিরনের মেয়ে আনজুমন এতো সুন্দর। আলি কেনানের মাথায় তৎক্ষণাতই রক্ত চড়ে যায়। তার ইচ্ছে হয়েছিলো, দুটোকেই কেটে গাঙের পানিতে বাসিয়ে দেয়। সে তুল কালাম কাণ্ড করে বসতো কিন্তু নানা কথা ভেবে সে চুপ করে গেলো। আজকাল তাকে অনেক কিছু বুঝে সমঝে চলতে হচ্ছে। একটা সামান্য ভুলের জন্য যদি পাড়ায় প্রচার হয়ে যায় তার এখানে কেষ্ট লীলা চলছে, তাহলে তাকে বেশ বিপদের মধ্যে পড়তে হবে। মানুষের আস্থাই তো এই পেশার একমাত্র অবলম্বন। আগ পাছ নানা কথা চিন্তা করে মনের রাগ মনের মধ্যে হজম করে ফেললো।
সেদিন রাতে ছমিরন তার ঘরে এলে আলি কেনান বিস্ফোরণ ঘটায় : মাগি খবর রাহস তর মাইয়া ঘরে লাঙ ঢুকাইবার শুরু করছে।
কথার পিঠে কথা বলা ছমিরনের অভ্যাস নয়। সে আলি কেনানকে একজন অসাধারণ মানুষ বলে মেনে নিয়েছে। আলি কেনান তাকে নিয়ে যা ইচ্ছে করে। আপত্তি করেনি কোনো ব্যাপারে। এতো বড় একজন মানুষ আলি কেনান, সে কথা মনে করে ছমিরন আত্মপ্রসাদ অনুভব করেছে। তার ওই আত্মসন্তুষ্টির আরো একটা কারণ আছে। সে মনে করে দুনিয়ার সব পুরুষ এক রকম। তার দীর্ঘ জীবনের এটাই অভিজ্ঞতা। আলি কেনানকে সে অন্য রকম মনে করেছিলো। এখন বিজয়িনীর একটা গোপন পুলক সে অনুভব না করে পারে না। পেটের মেয়ে আনজুমনকে ছমিরন ভীষণ ভালোবাসে। তার সন্তান একটাই। ওই মেয়ের জন্য সে জীবনে অনেক কষ্ট করেছে। তার নামে এসব কথা সহ্য করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়ালো। সরাসরি প্রতিবাদ না করেও বললো,
এইডা কি কন আপনে? আপনেরে আমার আনজুমনের নামে কেউ কিছু লাগাইছে নি? আলি কেনান বললো,
মাগি লাগাইব কেডা, আমি হাঁঝবেলা আপন চউকে দেখছি তর মাইয়া কালাম হারামজাদার লগে হাইস্যা কতা কইতাছে। আর হে তর মাইয়ার বুনি টিপতাছে। একটু বাড়িয়ে বললো।
আপনে আপন চউকে দেখছেন? ছমিরন জানতে চাইলো,
মাগি তর লগে মিছা কতা কইতাছি নাকি। আমি কি মিছা কতা কই?
এবার ছমিরন মেয়ের পক্ষ সমর্থন করে বললো,
মাইয়া আমার অত খারাপ নয়। আপনের মানুষ গুলান অরে খারাপ করবার চাইছে। আপনে হেরারে দাবরাইয়া দিবার পারেন না?
আলি কেনান ছমিরনকে কখনো মুখে মুখে কথা বলতে শুনেনি। আজ তর্ক করবার প্রবৃত্তি দেখে বললো,
মাগি তর মাইয়া অত খারাপ নয়! কাপড় খুইল্যা দেখ। গাঙ বানাইয়া দিছে। হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে সে ছমিরনকে একটা চড় দিয়ে বসে। চড় খেয়ে মেয়ে মানুষটি ঘুরে পড়ে যায়। তার সব শঙ্কা, সব দ্বিধা কোথায় চলে যায়। সে আলি কেনানের চোখে চোখ রেখে তেজের সঙ্গে বললো,
মাইয়া লাঙ ঢুহাইছে, বেশ ভালা করছে। আপনেও তো আমার লাঙ। তয় কি অইছে? ভবিষ্যতে কিছু দেখলে মুখ বন্ধ কইর্যা থাকপেন। আপনে মুখ খুললে, আমিও খুলুম। আল্লাহ আমারেও জবান দিছে হেইডা মনে রাইখেন। ঝাড়টা পা দিয়ে সরিয়ে সে হুজরাখানা থেকে বেরিয়ে এলো। নিজের ঘরে গিয়ে আনজুমনকে মারতে মারতে একদম মাটিতে লুটিয়ে দিলো। আলি কেনানের আফশোস হতে থাকলো,
ছমিরনকে চড়টা দিয়ে সে ভালো করেনি।
তারপর দিন মনে পাথরের মতো একটা অপরাধবোধের বোঝা নিয়ে আলি কেনানের ঘুম ভাঙ্গে। রোজকার অভ্যেস মাফিক আজকেও ছমিরন এসে হুজরাখানা ঝাট দিয়ে গেছে। চোখাচোখিও হয়েছে। কিন্তু দৃষ্টিতে বিদ্যুৎ খেলে যায়নি। মাত্র এক রাতের ব্যবধানে তারা একে অন্যের শত্রু হয়ে দাঁড়িয়েছে। আলি কেনান তার আলখেল্লা পরলো। লোকজনদের দর্শনও দিলো। তবে কারো সঙ্গে বিশেষ কথাবার্তা বলা সম্ভব হলো না। সে মনে করতে লাগলো চার দিকের মানুষ তার দিকে তাকিয়ে আছে। তাদের দৃষ্টিতে ঘৃণা এবং অবজ্ঞা। মাঝে মাঝে আলি কেনানের মনে হতো, অসীম ক্ষমতা তার। শরীরের মধ্যে কোথাও এক জোড়া পাখা জন্ম নিয়েছে। ইচ্ছে করলে সে উড়ে যেতে পারে। বুকের ভেতর থেকে একটা বোধ বুদবুদের মতো জেগে তার সমগ্র সত্তা আচ্ছন্ন করে ফেললো। আহা তার পাখা জোড়া কাটা পড়েছে। এখন সে নেহায়েত ধুলোর জীব। সীরসৃপের মতো বুকে ভর দিয়েই তাকে ধুলোর ওপর দিয়ে চলতে হবে।
তার চোখে পড়লো কালাম, জেল ফেরত দাগী আসামী কালাম কবরের ওপাশে বসে বিড়ি টানছে। আড় চোখে এদিক ওদিকে তাকাচ্ছে। আলি কেনান বুঝতে পারে, তার চোখ আনজুমানকে তালাশ করছে। দুয়েকবার তার সঙ্গে চোখাচোখিও হলো। আলি কেনান আঁচ করতে পারে কালাম তার দিকে প্রতিপক্ষের দৃষ্টি নিয়ে তাকাচ্ছে। তার অর্থ আলি কেনানের কাছে অত্যন্ত প্রাঞ্জল।
তুমি যদি মায়ের সঙ্গে ঘুমোতে পারো আমি মেয়ের সঙ্গে আশনাই করতে পারবো না কেনো? তোমার যেমন ক্ষুধা আছে, আমারও তেমনি ক্ষুধা। তোমাতে আমাতে তফাৎ কোথায়? আহা আলি কেনান এক জায়গায় কালামের সমান হয়ে গেলো। তার চাইতে মৃত্যু তার জন্য ভালো ছিলো।
মরপুর মাজারের দুই বগলে লাঠি ভর দেয়া বুড়োটির কথা তার মনে পড়ে গেলো। বুড়ো এক রাতে আপন মনে গুন গুন করে গান গাইছিলো :
‘ফকিরি সহজ কথা নয়। লম্বা চুলে তেল মাখিলে ফকিরি পাইতা নয়।‘ তার দিকে জ্বলজ্বলে চোখ মেলে তাকিয়ে বলেছিলো,
অ মিয়া ফকিরি করবার ত খুব ভঙ্গিটঙ্গি করতে আছো, ফকিরির মানে বোঝ? আলি কেনান জবাব দেয়নি। সে ফকিরির অর্থ বোঝে না। বুঝতেও চায় না। কিচ্ছু না জেনে, না বুঝে তার দিনকাল তো মন্দ কাটছে না। অধিক কি প্রয়োজন? সেই বুড়ো যাকে আলি কেনান মনে মনে ভয় পায় এবং ঘৃণা করে, কাটা কাটা ভাষায় বলেছিলো :
বাঁইচ্যা থাকার একশ একটা পথ আছে, সময় থাকতে বাইছা লও একটা। এই পথ তোমার নয়। ক্ষুরের ধারের ওপর দিয়ে চলা। তুমি পারবানা একবার পিছলাইয়া গেলে বুঝবা পরিণাম। ফকিরি অইল গিয়া মিয়া অনন্ত অসীমেরে কোলে লইয়া হগল সময় বইস্যা থাকা। আল্লারে চামড়ার চউকে কেডা দেখছে। এই অনন্ত অসীমই তো আল্লাহ। আমাগো দ্বীনের নবী মেরাজে গেছিলেন, হেইড্যা আর কিছু নয়, অনন্ত অসীমের মধ্যে লয় অইয়া গেছিলেন।
আলি কেনান মনে করে এসেছে, প্রতিটি প্রতিষ্ঠিত মাজারের পেছনে তার মতো করিতকর্মা কোনো মানুষের ফন্দিফিকির কাজ করেছে।
আসল বস্তু কিছু নেই। আজকে তার চিন্তার সীমাবদ্ধতা কে যেনো চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলো। কিছু কিছু মানুষ দুনিয়াতে ছিলো বা এখনো আছে যারা অনন্ত অসীমকে কোলে নিয়ে জিন্দেগী কাটিয়ে দিতে পেরেছেন। এই ধরনের কিছু মানুষ দুনিয়াতে ছিলেন বলেই, আলি কেনানের মতো মানুষেরা ফন্দিফিকির করে বাঁচতে পারে। ফকিরি করার ভান করে মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করে যেতে পারে। আলি কেনান অনুভব করে অতো উর্ধ্বে ওঠার ক্ষমতা তার নেই। দুর্বল পা তাকে অতোদূরে নিয়ে যেতে পারবে না। তার কাদার পা।
একদিন বিহান বেলা ছমিরনের কান্নার শব্দ শুনে তার ঘুম ভাঙে। মেয়ে মানুষটি বুক চাপড়ে কাঁদছে :
হায়রে আল্লাহ আমার এত বড় বাশ কেডা করলো। আমার নাবালেগ মাইয়ারে যাদুটোনা কইর্যা কেডা লইয়া এলো।
আলি কেনান বুঝতে পারে, কালাম, হ্যাঁ কালামের কাজ। ঐ হারামজাদাই ছমিরনের মেয়েটি নিয়ে ভেগেছে। প্রথমে তার ভীষণ রাগ হলো।
কালামকে চরম শাস্তি দেয়ার সংকল্পে তার হাত দুটো মুষ্টিবদ্ধ হয়ে আসে। আনজুমনকে সেদিন দেখার পর থেকে তার রক্তে রক্তে একটা অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়েছিলো। তবে একটা বিষয় বিবেচনা করে মনকে সংযত করতে হলো। আনজুমনতো তারই বাড়ির পোষা মুরগি। এক সময়ে আপনা থেকেই তার হাতে এসে পড়বে। একটা বিরাট পরাজয় তার ঘটে গেলো। চীকার করে আকাশ পাতাল তোলপাড় করার মতো ভাবাবেগ তার মনে জন্মেছিলো। কিন্তু অন্যান্য বিষয় বিবেচনা করে চুপ করে থাকলো।
আলি কেনানের তীক্ষ্ণ ঘ্রানশক্তি দিয়ে বুঝে ফেললো, তার ক্ষয় শুরু হয়েছে। এই ফুলতলিতে থাকলে সে আর পতন ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না। তাকে নতুন জায়গা খুঁজে বের করতে হবে এবং যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব। স্বভাবতই নিমবাগানের চিন্তাটাই তার মনে এলো। বেলা বাড়লে শিষ্যদের ডেকে বললো,
কলন্দরি বাবা খোয়বে আইস্যা কইয়া গেছেন, ই হান থাইক্যা দুই দিনের মধ্যে নিমবাগানে চইল্যা যাইতে অইবো। সে কথা না বাড়িয়ে চূড়ান্ত নির্দেশ দিয়েই বসলো। শিষ্যেরা পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে জানে বু আলি কলন্দর বাবার নির্দেশ হেরফের করবার উপায় নেই। একমাত্র ছমিরনই বুঝতে পারলো আলি কেনান পালাচ্ছে। এ ছাড়া তার আর উপায় কি? দুদিন বাদে আনজুমন আর কালামের কথা উঠবে। নাড়াচাড়া পড়ার আগেই কেটে পড়ছে। সে কি করবে? হ্যাঁ তাকেও যেতে হবে বৈকি। বুকটা ভেঙে যাচ্ছে। কিন্তু আলি কেনানের সঙ্গে সে নিশির অদৃশ্য বাঁধনে আটকা পড়েছে। সেখান থেকে পালাবে কোথায়?
৬. নিমবাগান মাজার
নিমবাগান মাজারে এসে আলি কোন নতুনভাবে গুছিয়ে নিতে আরম্ভ করেছে। মাজার প্রাঙ্গণেই একটা বড়োসড়ো চালা ঘর উঠিয়ে নেয়। নাম ফেটে গিয়েছিলো। তাই বেড়ার ঘরে টিনের ছাউনি দিতে বিশেষ অসুবিধে হলো না। নিমবাগান মোটামুটি সম্পন্ন এলাকা। ধর্মপ্রাণ মানুষেরা খোরাসানি বাবার মতো ওরশটিকে আলি কেনানের একটা বিশেষ কেরামতি বলে ধরে নিয়েছে। সুতরাং আলি কেনানের কোনো দাবি, কোনো অভাব তাদের কাছে অপূর্ণ থাকার কথা নয়।
এক ধরনের নিষ্ক্রিয়তা আলি কেনানের শরীরে ভর করেছে। গায়ে গতরে মেদও জমতে আরম্ভ করেছে। সর্বক্ষণ তার হাসফাঁস লাগে, কিন্তু নিমবাগানের অধিকাংশ মানুষ আলি কেনানের এই আকস্মিক শারীরিক পরিবর্তনকে তার পবিত্রতার চিহ্ন বলে মনে করতে থাকে। এটাও খুব আশ্চর্যের ব্যাপার নয়। এই দেশের অলস নিষ্ক্রিয় মানুষেরা সবসময়ে সাধুপুরুষ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়ে আসছে। কিন্তু আলি কেনানের মনের ঝড় থামে না। মিরপুর মাজারের বুড়ো মানুষটির কথা তার মনে হানা দিয়ে জাগ্রত হয়। তার ভেতর একটা আলো ছিলো। খুব নির্জন মুহূর্তে সে অনুভব করতো, ধোঁয়া বাষ্পের গভীরে অন্তরে ঘৃতের প্রদীপের মতো কি একটা জ্বলছে। এখন সে অনুভব করে সে আলোটা আর তার ভেতরে নেই। নতুন কর্মের প্রেরণা তাকে আর তাড়িত করে না। চোখের জলে তাকে স্বীকার করতে হয়, মানুষের মধ্যে আসমানের মতো উঁচু, পর্বতের মতো দৃঢ় কতিপয় বস্তু আছে, সারা জীবন সন্ধান করলেও সেগুলোর নাগাল সে পাবে না। সে গর্তের জীব গর্তের ভেতরই তাকে থাকতে হবে। তবু আলি কেনান ভেবে অবাক হয়, তার মতো মানুষের মনেও এক সময় অমর হওয়ার বাসনা মুকুল মেলেছিলো। আহা তার জীবনের বসন্ত শেষ হয়ে গেছে। অন্তরের আলোতে পথকেটে চলা তার পক্ষে অসম্ভব। এখন থেকে লাঠির ওপর ভর করা ছাড়া কোনো উপায় নেই। নিজেকে ভারবাহী পশুর মতো মনে হয়। একেকটা দিন আসে আর যায়। সে জড়পিণ্ডের মতো পড়ে থাকে। আগে অন্তর থেকে সে পেতো কর্মের প্রেরণা। সেই প্রেরণার বলে বাইরের জগতে তরঙ্গ সৃষ্টি করতো। অন্তরের আগুন ঠিকরে বাইরে বেরিয়ে আসতো। সে আগুনে আত্মাহুতি দেয়ার জন্যে ছুটে আসতো মানুষ। আলি কেনানের জীবন ধারণের সমস্ত উল্লাস অবসিত হয়ে এসেছে।
এভাবে বেঁচে থাকার কোনো মানে সে খুঁজে পায় না। সে অনুভব করে হাড়ে মাংসে অস্থি মজ্জায় সে ভোলার একজন লাঠিয়াল। জীবন তার কাছে একটা উৎসব বিশেষ। এভাবে সে কি করে বেঁচে থাকবে? ভেতর থেকে প্রেরণা আসছে না বলে সে এমনভাবে স্থানুর মতো বসে থাকতে পারবে না। বাইরে থেকে প্রেরণার সন্ধান করতে হবে। নিজের অন্তরের শৃঙ্খলা বাইরে আরোপ করার ক্ষমতা নেই। সুতরাং তাকে বাইরের শৃঙ্খলার কাছে আত্মসমর্পণ করতে হবে।
উনিশশো উনসতুর সাল শেষ হয়েছে। সত্ত্বর সালের মাঝামাঝি অতীত প্রায়। বাংলাদেশের মুক্তি আন্দোলনটি ভীষণ বেগবান হয়ে উঠেছে। জয়বাংলা ধ্বনির একাধিপত্য গোটা দেশটিকে ঢেকে রেখেছে। সকালে জয় বাংলা, দুপুরে জয় বাংলা, সন্ধ্যেয় জয়বাংলা, এমনিক রাত্রির গভীর অন্ধকারে জয়বাংলা ধ্বনি কামানের গোলার মতো ফেটে পড়ে। যে শিশুর মুখে সদ্য কথা ফুটতে আরম্ভ করেছে, মা বাবা উচ্চারণ করার আগে জয়বাংলা শব্দ দিয়ে কথা বলা শুরু করে।
আলি কেনান চিন্তা করে দেখলো এটা একটা সময় এবং সুযোগ বটে। এই তীব্র স্রোতের খর তরঙ্গে সে ভেসে পড়তে পারে। এই প্রচণ্ড ধারাস্রোত তাকে টেনে টেনে নিয়ে যাবে। এই জয়বাংলা ধ্বনির সঙ্গে একাত্ম হওয়ার একটা ব্যক্তিগত কারণও সে নিজের মধ্যে আবিষ্কার করে। গভর্ণর সাহেবকে সে একবার প্রাণে বাঁচিয়েছিলো। আর সেই গভর্ণর সাহেবই তাকে রাস্তায় উলঙ্গ করে ছেড়ে দিয়েছিলেন। আলি কেনানের মনের ভেতর তাঁর প্রতি একটা ঘৃণা শক্ত হয়ে জমাট বেঁধে আছে। এতোদিন সেকথা মনেই হয়নি। এখন চিন্তা করে দেখলো এই জয় বাংলার মানুষদের সঙ্গে সে যদি নেমে পড়ে তাহলে একটা প্রতিশোধও নিতে পারবে। গভর্নর সাহেব নিজেও এখন গভর্ণর হাউজে নেই। আইয়ুব তাকে সরিয়ে দিয়ে ক্ষমতা থেকে বাধ্য হয়ে নিজেও সরে গেছেন। তবু গভর্ণর সাহেব গুলশানের রাজবাড়ির মতো বাড়িতে বহাল তবিয়তে আছেন। আলি কেনানের একান্ত ইচ্ছে একবার গভর্ণর সাহেবের মুখোমুখি দাঁড়াবে। বলবেন, আমার নাম আলি কেনান। একদা আপনি যাকে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন। পেছনে আলখেল্লা পরা যাদের দেখছেন। এরা সবাই আমার শিষ্য। এখন আমি জয়বাংলার দরবেশ। আমার কথায় এরা প্রাণটি পর্যন্ত বিলিয়ে দেবে। কিন্তু আপনার কথায় এই বাংলাদেশের একটা কুত্তাও ঘেউ করবে না। এই খবরটি জানিয়ে দিতে কষ্ট করে আপনার কাছে এলাম।
আলি কেনান এখন চাঙ্গা হয়ে উঠেছে। মনের বিমর্ষতা কেটে গেছে। তাকে ভেবেচিন্তে আর কাজ খুঁজে বের করতে হয় না। কাজ পায়ে হেঁটে তার কাছে এসে হাজির হয়। নিমবাগানের ছেলেরা মাজার প্রাঙ্গণে অফিস করছে। অধিক রাতে রাস্তায় পোস্টার লাগিয়ে কিংবা মিছিল করে আর ঘরে ফেরা সম্ভব হয় না। তাকে ডেকে বলে, দরবেশ বাবা বাড়ির দরোজা বন্ধ হয়ে গেছে। আজ রাতে তোমার এখানে ঘুমোতে হবে। আর থাকলে কিছু খেতে দাও। আলি কেনান বলে,
তরা যত ইচ্ছা খা। আর যতক্ষণ মন লয় ঘুমাইয়া থাক। বাবার দরজা তোগো লাইগ্যা কুনুদিন বন্ধ অইবো না। কেবল হপ্তায় হপ্তায় চাইল, ডাইল বাজার থন পাঠাবি। গভীর রাতে আলি কেনানের আস্তানায় রান্না চড়ানো হয়। ছেলেরা আলুর ভর্তা আর ডাল দিয়ে ভাত খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। সকালে তারা বেরিয়ে যায়। দুপুরে আরেক দল আসে। তারপর আরেক দল। আলি কেনানের আস্তানাটি জয়বাংলা আন্দোলনের প্রাণকেন্দ্র হয়ে দাঁড়ায়। সে এক রোখা স্বভাবের মানুষ। দশজনের সঙ্গে শলা পরামর্শ করে কাজ করার বিশেষ অভ্যেস তার নেই। এই সমস্ত পিচ্চি পিচ্চি পোলাপান ধমক দেয়, চোখ রাঙায়। মাঝে মাঝে আলি কেনানের ধৈৰ্য্যচুক্তি ঘটে। সে সব সময় হুকুম দিয়ে অভ্যস্ত এবং হুকুম পালন করতে হলেও একজনের বেশী কর্তা সহ্য করতে পারে না। আগে গভর্ণর সাহেবের হুকুম মেনে কাজ করতে পারলে খুশি হতো। শেখ সাহেবকে সে আজকাল পছন্দ করতে আরম্ভ করেছে। কেননা শেখ সাহেব গভর্নর সাহেবের সঙ্গে টক্কর দিয়ে তাকে চিৎ করে ফেলেছেন। একটা বাঁশের মাথায় উঁচু করে শেখ সাহেবের ছবি টাঙিয়েছে বটে, কিন্তু তাঁর সমস্ত কাজকর্ম মেনে নিতে পারে না।
আলি কেনান আগে গভর্ণর সাহেবকে নানা বিষয়ে বুদ্ধি পরামর্শ দিয়েছে এবং সঙ্গত কারণেই শেখ সাহেবকেও নানা বিষয়ে পরামর্শ দেবার অধিকার আছে। কিন্তু শেখ সাহেবের সঙ্গে সাক্ষাত হওয়ার ক্ষীণতম সম্ভাবনাটিও আলি কেনান দেখতে পায় না। নিজের ওপর বিরক্ত হয়। শেখ সাহেব তাকে একি পরিস্থিতির মধ্যে ছুঁড়ে দিয়েছেন। দুধের বাচ্চাও তাকে হুকুম করে, দরবেশ বাবা এটা করো ওটা করো। তার বর্তমান দুর্ভাগ্যের জন্য মনে মনে শেখ সাহেবকেই দায়ী করে। মনকে এই বলে সান্ত্বনা দেয় যে, আলি কেনান যখন তর নিজের ভিতরে নূর নাই বাইরের ধুয়া থেইক্যা নিঃশ্বাস টানতে অইবো। গোস্বা টোস্থা কইরা আর কি লাভ?
শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে তার একটা সাংঘাতিক অনুযোগ আছে। শেখ সাহেব জয়বাংলা করতে চান ভালো, বিহারী পাঞ্জাবিদের খেদিয়ে দিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন করতে চান আরো ভালো। সেই জন্যই তো আলি কেনান তাঁর দলে যোগ দিয়েছে। কিন্তু তিনি ফকিরনির পোলাদের বুকে সাহস দিয়ে এমন বেয়াদব করে তুলেছেন, এটা ঠিক না। ফকিরনির পোলারা ফকিরনির পোলাই। যেহেতু নিজেকে জয়বাংলার দরবেশ বলে ঘোষণা করেছে, তাই আলি কেনান মনে করে শেখ সাহেবের সঙ্গে রাগ, অভিমান করার অধিকার তার আছে। আলি কেনান বুঝে নিয়েছিলো ছোকরাদের মন জুগিয়ে চলা তার কর্ম নয়। তারা তাকে কোথায় নিয়ে যাবে তার কোনো হদিশ নেই। সে নিয়মিত সংবাদ পাচ্ছে এখানে গুলি হচ্ছে, ওখানে ধরপাকড় চলছে। পাকিস্তান থেকে উড়োজাহাজে করে লাখে লাখে সৈন্য আসছে। কখন কি ঘটে বলা যায় না। আলি কেনান হুঁশিয়ার মানুষ। তাছাড়া মনের গভীরে এই বাঙালিদের সে মানুষ বলে মনে করে না। গভর্ণর হাউজে থাকার সময় এই একটা জিনিস তার উপলব্ধির মধ্যে গেঁথে গিয়েছিলো যে পাকিস্তানিরাই হলো আসল মানুষ। আর বাঙালিরা সব চুতিয়া। কেউ তাকে বলে দেয়নি। কিন্তু এই ধারণাটি তার মনে জন্ম নিয়েছে। পরিস্থিতির চাপে নিজেকে জয়বাংলার দরবেশ ঘোষণা করেছে বটে। কিন্তু জয়বাংলার মানুষদের সঙ্গে সে অধিকদূর যেতে চায় না।
একদিন আলি কেনান নিমবাগানের প্রভাবশালী কজন ছোকরার সামনেই শিষ্যদের কাছে বললো :
বাবা বু আলি কলন্দর আবার স্বপ্ন দর্শন দিয়া কইছেন, বিহারী আর পাঞ্জাবীরা নাপাক জন্তু। তাদের বাংলার মাটি থেইক্যা তাড়াইয়া দেওন লাগবো। সে জন্য বাবায় কইছেন জয় বাংলার নিশান নিয়ে মাজারে মাজারে যাওয়া লাগবে। শিষ্যরা বু আলি কলন্দরের স্বপ্নের ব্যাপারে কোনোদিন কোনো আপত্তি করেনি। আজকেও করলো না। আলি কেনান বললো, বাজান আরো একটি কথা কইছেন। শিকল পরা বাদ দিয়া জয় বাংলার নিশান বইতে অইবো এবং সব জায়গায় বঙ্গবন্ধুর ছবি নিয়া যাইতে অইবো। সবদিক রক্ষা পাওয়ার মতো এরকম একটি মৌলিক পরিকল্পনা তার মাথায় এসেছে, সে জন্য নিজেকে ধন্যবাদ দিলো।
ছোকড়াদের সঙ্গ ত্যাগ করে জয় বাংলার পতাকা এবং শেখ মুজিবের ছবি নিয়ে মাজারে মাজারে ঘুরতে আরম্ভ করলো। আলি কেনান বুঝতে পারেনি যে এই ছোকরাদের সঙ্গে থেকে তার শিষ্যদের মধ্যেও একটা ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছে। মাজার পরিক্রমার দ্বিতীয় দিনে অত্যন্ত বেদনার সঙ্গে তাকে আবিষ্কার করতে হলো একসঙ্গে চারজন শিষ্য কোথাও কেটে পড়েছে। অনেক খোঁজ খবর নিয়েও কোনো কুল কিনারা করতে পারলো না। এখন তার সঙ্গে শুধু ফুলতলির কিশোরটি আছে। আলি কেনান তার এই দুর্ভাগ্যের জন্য পুরোপুরি বর্তমান পরিস্থিতিকেই দায়ী করলো। রাগে দুঃখে অপমানে তার মরে যেতে ইচ্ছে হচ্ছিলো। সে রাতে আর নিমবাগানে ফিরতে প্রবৃত্তি হলো না। মিরপুর মাজারেই রয়ে গেলো।
সন্ধ্যে গড়িয়ে গেলো। মিরপুর মাজারের সেই বুড়োটির সঙ্গে আবার তার সাক্ষাৎ হলো। বুড়ো পরিহাস মিশ্রিত ভাসায় জিগগেস করলো, অ মিয়া, দেখছি শিকল টিকল সব খুইল্যা ফেলাইছ। হাতে কি? আর বুকে ঝুলাইছ এইড্যা কি? আলি কেনান বললো :
হাতে জয়বাংলার নিশান আর বুকে মুজিবরের ফটো। বুড়ো বললো, মিয়া ভং চং ত বেশ করতাছ। টের পাইবা আর দেরি নাই।
সেটা ছিলো পঁচিশে মার্চের রাত। সে রাতেই নিথর নিদ্রিত ঢাকা নগরীর বুকে বন্দুক কামান, ট্যাংক নিয়ে প্রচণ্ড হিংস্রতায় পাকিস্তানি সৈন্য ঝাঁপিয়ে পড়ে। আলি কেনান ভীষণ ভয় পেয়ে গিয়েছিলো। সে মনে করেছিলো, পাকিস্তানি সেনা রাস্তায় মশাল জ্বালিয়ে একটা মানুষেরই খোঁজ করছে, তার নাম আলি কেনান। এক নাগাড়ে চারদিন মিরপুর মাজারে অবস্থান করতে হলো আলি কেনানকে। পঞ্চম দিন পাকিস্তানি সৈন্যদের আক্রমণ ধারা একটু শিথিল হতেই সে মনস্থ করলো নিমবাগান ফিরে যাবে। ডানে বাঁয়ে খোঁজ করলো কিন্তু ফুলতলির কিশোর শিষ্যটির কোথাও দেখা পেলো না। সুতরাং একাই তাকে পথে বেরোতে হলো।
এই পাঁচদিনে শহরের কি চেহারা হয়েছে দেখে তার কান্না পাচ্ছিলো। বাড়ির ছাদে আর জয় বাংলার নিশান ওড়ে না। রাস্তায় মানুষ জনের কোনো চিহ্ন নেই। কী ভূতুড়ে পরিবেশ। এখানে ওখানে মানুষের লাশ পড়ে আছে। মিলিটারী আর সাঁজোয়া গাড়ি রাস্তায় টহল দিচ্ছে। আলি কেনান উপলব্ধি করলো শেখ মুজিবরের বারোটা বেজে গেছে। এই অবস্থা হবে সেটা সে জানতো। ফকিরনির পোলাদের নিয়ে শেখ মুজিব রাজা হতে চেয়েছিলো।
সে যখন নিমবাগান মাজারের কাছে এলো তার চোখ ফেটে পানি এসে গেলো। তার থাকার ঘর এবং জয়বাংলার অফিস পুড়িয়ে দিয়েছে। পোড়া মাটির গন্ধ তার নাকে এসে লাগলো। সবশেষে মাজারের ভেতরে ঢুকে আর কি হবে। উল্টোদিকে পা বাড়িয়েছিলো– পরিচিত কণ্ঠস্বর শুনে ফিরে দাঁড়ালো। সেই পুরোনো খাদেম। চোখে প্রতিহিংসা চকচক করছে : অ মিয়া কই যাও, আইয়ো ভেড়ার গোশত খাইয়া যাও। ভেড়া পাকজন্তু, আমাগো নবী করিম ভেড়ার গোশত খাইতে পছন্দ করতেন। আলি কেনান ভালো করে তাকিয়ে দেখে শ্বেত করবী গাছের নিচে হোগলা বিছিয়ে বিশ, পঁচিশ জন মানুষ খেতে বসেছে। তাদের টুকরো টুকরো, কথা বার্তা তার কানে এলো। উর্দুতে কথাবার্তা বলছে। খাদেম মুহম্মদপুর থেকে বিহারীদের ডেকে এনে তার ভেড়া দুটো জবাই করে খাওয়াচ্ছে। আর ছমিরন বাসন পত্তর ধুয়ে দিচ্ছে। সবতো শেষ। আর কেননা, সে উল্টোদিক ফিরে হাঁটতে আরম্ভ করলো। কিছু দূর যেয়ে সে দেখে একটি রোগা ঘেয়ো কুকুর তার সঙ্গে সঙ্গে আসছে। সেই কুকুর ছানাটি যেটাকে সে একদিন পেটে লাথি দিয়ে ফেলে চলে গিয়েছিলো।
৭. উনিশশো বাহাত্তুর সালের মাঝামাঝি
উনিশশো বাহাত্তুর সালের মাঝামাঝি দিকে আলি কেনান নিমবাগান মাজারে আবার ফিরে আসে। যুদ্ধের এই ন মাস কোথায় ছিলো, কি অবস্থায় ছিলো কেউ তা জানেনা। ভীষণ কৃশ হয়ে গেছে আলি কেনান। শরীরের মেদ একবিন্দুও নেই। তাকে চকচকে কষ্টি পাথরের মূর্তির মতো দেখাচ্ছে। নিকষ কালো রঙ যেনো শরীর থেকে ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চায়। চোখ দুটো জবা ফুলের মতো লাল। চুল দীর্ঘ হয়ে জটার মতো হয়েছে। গায়ের রঙিন লুঙ্গি আলখেল্লা নেই। একটি সাদা লুঙ্গি এবং চাদর তার পরনে।
নিমবাগান এলাকার মানুষ আলি কেনানকে বীরের সম্মান দিয়েই গ্রহণ করলো। এই এলাকার মানুষের আলি কেনানের প্রতি বাড়তি এ অনুরাগ, তার কারণ আছে। আলি কেনান জয় বাংলার দরবেশ। তার অবর্তমানে এ মাজার পুরোনো খাদেম দখল করেছিলো। এলাকার লোকদের প্রতি খাদেমের একটা তীব্র বিদ্বেষ ছিলো। কেননা তারা আলি কেনানকে নানা ব্যাপারে সাহায্য করেছে। সে জন্য খাদেম সব সময় মুহম্মদপুর থেকে বিহারীদের ডেকে আনতো। এলাকাবাসীদের ভীতি প্রদর্শন করাত। রাজাকারদের আনাগোনা ছিলো নিয়মিত। নিমবাগানের মানুষ সব সময় সন্ত্রস্ত অবস্থায় থাকতো কখন খাদেম কি বিপদ ঘটায়। নিমবাগানের একজন প্রবীণ বললেন,
আমাদের বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরা আইলেন, বাবাও মাজারে আইলেন। আলি কেনান মনে করলো এই তুলনা একান্তই যুক্তিসঙ্গত। তারপর থেকে আলি কেনানের চিন্তা ভাবনা সম্পূর্ণ নতুন একটি খাতে প্রবাহিত হতে আরম্ভ করলো। কাউকে বলবার সাহস তার নেই। মর্মের গভীরে ধরে নিয়েছে শেখ মুজিব জয় বাংলার নেতা এবং সে নিজে জয়বাংলার দরবেশ। এতোকাল বাবা বু আলি কলন্দর এর সঙ্গে যে কাল্পনিক সম্পর্ক সে প্রতিষ্ঠা করেছিলো এই সম্পর্ক তার চাইতে অনেক জোরালো। কেননা এর বাস্তব ভিত্তি আছে। শেখ সাহেব যেমন সব ব্যাপারে হুকুম দিচ্ছেন, তেমনি হুকুম দেয়ার অধিকার তারও আছে।
আলি কেনানের সঙ্গে পূর্বের লোকজন নেই। যা কিছু অর্জন করেছিলো, সব হাওয়া হয়ে উড়ে গেছে। পরোয়া করে না আলি কেনান। মানুষের জীবনে এরকম তো কতোই ঘটে। কেউ না থাকুক না থাকুক আলি কেনানের অদম্য মনোবল আছে। দিব্যদৃষ্টি প্রসারিত করে সে দেখতে পায় সামনের সময়টা তারই। এই সময়কেই সে চাষ করবে? সময়ের গর্ভে সৌভাগ্য তার জন্য অপেক্ষা করে আছে। তখনকার সময়টা ছিলো ভীষণ টালমাটাল। দশ কোটি মানুষের একটা দেশের তাবত মানুষের সামাজিক বন্ধন আলগা হয়ে পড়েছে। সমাজের তলা থেকে প্রচণ্ড একটা গতিশীলতা জাগ্রত হয়ে গোটা সামাজিক কাঠামোকেই কাঁপিয়ে তুলেছে। পুরোনো যা কিছু ছিলো ভেঙে তছনছ হয়ে যাচ্ছে। এ এমন একটা পরিস্থিতি উচ্চ চিৎকার করে না বললে কেউ কারো কথা পর্যন্ত কানে তোলে না। আলি কেনান এলাকার ছেলেদের সহায়তায় খুব সহজে একটা মাইক্রোফোন যন্ত্র যোগার করে ফেললো। এক শুক্রবার জুমার নামাজের পর ঘোষণা করে, এই বাংলাদেশে আমি আর শেখ মুজিব ছাড়া আর কুনু বাঘের বাইচ্চ্যা নাই। শেখ সাহেবের কতা যেমন হগলে হুনছে, হেইরকম আমার কতাও হুনুন লাগবো। অনেক লোক জুটেছিলো, কেউ আলি কেনানের কথার বিরোধিতা করলো না।
আলি কেনানের সাহস বাড়তে থাকে দিনে দিনে। প্রতিদিন সে মাজারের সামনের চত্বরটিতে মাইকের সামনে এসে দাঁড়ায়। কখনো হাসে, কখনো কাঁদে। চীকার করে, অশ্লীল গালাগাল দেয়, কখনো খেলনা পিস্তল দিয়ে লোকজনকে ভয় দেখানোর ভঙ্গি করে। সব দিক দিয়ে সে যেনো সময়ের উপযুক্ত প্রতিনিধি হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশের সমাজ শরীরের ভেতর যতগুলো ধারা উপধারা ক্রিয়াশীল, তার সবগুলোই যেনো জীবন লাভ করে আলি কেনানের মধ্যে ঝর্ণার বেগে ফেটে পড়তে চাইছে। আশ্চর্য, মানুষও তার এই ভূমিকাটি মেনে গিয়েছে। সকলে মনে করছে, এটিই স্বাভাবিক এবং এ হওয়াই উচিত ছিলো।
আলি কেনান অসাধ্য সাধন করতে পারে, তার চরণস্পর্শে দুরারোগ্য বাতব্যাধি সেরে যায়। মুখের ফুঁ দেয়া পানি খেলে শুলবেদনার উপশম হয়, বন্ধ্যা রমনী গর্ভবতী হয়–এমনি কতো ধরনের আজগুবি গুজব তার নামে ছড়িয়ে পড়ে। দলে দলে মানুষ তার কাছে আসে। যখন খুশি সে মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে লেকচার ঝাড়ে, গান গায়, যখন খুশি নাচে। এই যুদ্ধে যে ঝোড়োশক্তি বাংলাদেশের অন্তর থেকে মুক্তি লাভ করে সর্বত্র একটা তোলপাড় অবস্থার সৃষ্টি করেছে সেই গন্তব্যহীন অন্ধ আদিম শক্তির সবটাই যেনো তার শরীরে ভর করেছে। যখন সে নাচে তার চোখ দুটো লাল আরো লাল হয়ে জ্বলতে থাকে। দীর্ঘল চুলের জটারা জ্যৈষ্ঠ মাসের ঝড়ের পূর্বাভাস রচনা করে। শরীরের বাঁকে বাঁকে আদিম ছন্দ মূর্তিমান হয়ে ওঠে। যে দেখে চোখ ফেরাতে পারে না, সম্মোহিত হয়ে যায়।
আলি কেনান জানে না তার এই উন্মত্ততার মধ্যেও একটা নিখুঁত সাংসারিক হিসেব নিকেশ আপনা থেকে ক্রিয়া করে যাচ্ছিলো। তাকে মানুষ দরাজ হাতে টাকা দেয়। লোকজন তাকে চার পাশে থেকে সব সময় ঘিরে রাখে। মাঝখানে একটি গোলাকার বেষ্টনীর মধ্যে সে নাচে, গান গায়। সেখানে টাকা পয়সার স্তূপ জমে যায়। দশ টাকা, বিশ টাকা, পঞ্চাশ টাকা একশো টাকার নোট। কিছু মানুষ স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে সে টাকা কুড়িয়ে নেয়। হিসেব করে কতো টাকা হলো। তারপর বান্ডিল বেঁধে আলি কেনানের ডেরায় পৌঁছে দেয়। আলি কেনান একেকটি বাভিল খুলে হাতের মুঠোতে যা ওঠে লোকদের মধ্যে বিলিয়ে দেয়। বাকি টাকা তোষকের তলায় ফেলে রাখে। এভাবে টাকার বান্ডিল জমতে জমতে তোষকটা ওপর দিকে ফুলে ফুলে উঠতে থাকে। আলি কেনানকে কিছুই ভাবতে হয় না। তার চারপাশে আপনা থেকেই একদল ভক্ত জুটে গেছে। তারমধ্যে মেয়ে মানুষও আছে। তারা বাবার কাপড় কাঁচে, তামুক বানায়- মানে গাঁজার কল্কি সাজিয়ে দেয়। রান্না বান্না করে, গা টিপে। তাছাড়া বাবার আরো কতোরকম খেয়াল টেয়াল আছে। পুরুষ ভক্তদের কাজ একটু ভিন্নরকমের। তারা দর্শনার্থীদের সামলায়। সবাই যাতে বাবার কাছে আসতে পারে, সেদিকে দৃষ্টি রাখে। বিশিষ্ট ব্যক্তিরা এলে বাবার সঙ্গে একান্তে সাক্ষাৎ করার ব্যবস্থা করে। টাকা পয়সার হিসেব রাখে। এমনকি কেউ কেউ গাঁজা চরশ এসব নেশার ব্যবসারও তদারকি করে।
এই সময়ের মধ্যে আলি কেনান আস্ত একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়ে গেলো। জাতীয় সংবাদপত্রসমূহে অনেকগুলো সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশিত হলো। তাতে আলি কেনানের বিষয়ে অনেকগুলো খারাপ কথাও প্রকাশিত হওয়ায় শিষ্যেরা ঠিক করলো, এরপর থেকে তারাই সাংবাদিকদের সমস্ত খবরাখবর সবরাহ করবে, যাতে বাবার নামে এ ধরনের অপ্রচার না ঘটতে পারে। ব্রিটিশ টেলিভিশনের কোনো একটা চ্যানেল আলি কেনানের ওপর একটা ডকুমেন্টারি ফিল্ম প্রদর্শন করে। সেই ফিল্মের শিরোনাম ছিলো এ ডারবিশ হু হ্যাজ ওয়ান্ডারফুল সিক্রেট হিলিং পাওয়ার। এই সংবাদ যে দিন প্রচার পেলো, আলি কেনানের গলার জড়ির মালাটি চল্লিশ হাজার টাকা মূল্যে নিলাম হয়ে গেলো।
ভদ্রলোকের সন্তানেরা আলি কেনানের নামে পাগল হয়ে উঠলো। তারা দলে দলে তার চারপাশে ভীড় জমাতে আরম্ভ করে। আলি কেনান একটা মুক্ত দুনিয়া সৃষ্টি করে নিয়েছিলো। এখানে মদ চলে, গাঁজা চলে। শিল্পী আসে, কবি আসে, সাংবাদিক আসে। সকলেই আলি কেনানকে প্রেরণার একটা গভীর উৎস হিসেবে ধরে নিয়েছে। গুজব রটেছে, ভদ্রঘরের মেয়েরাও আলি কেনানের ওখানে গিয়ে গাঁজা টানে।
শহরের এসপি আলি কেনানের যাবতীয় কর্মকাণ্ডের প্রতি তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখছিলেন। তিনি সেকেলে ধরনের মানুষ। তাই তাঁর আশঙ্কা হওয়া খুবই স্বাভাবিক, এভাবে চললে সমাজ উচ্ছন্নে যাবে। সবদিক বিবেচনা করে তিনি আলি কেনানকে এক বিকেলে এ্যারেস্ট করে হাজতে চালান করে দিলেন। তারপর শুরু হলো হৈ হৈ ব্যাপার, রৈ রৈ কাণ্ড। হোমরা চোমরা ব্যক্তিরা তার অফিসে টেলিফোন করতে থাকেন। নিমবাগান থেকে মাঝারি ধরনের একটা মিছিল বের হলো। মিছিলকারীরা হোম মিনিস্টারের বাড়ির সামনে বসে থাকে। বাধ্য হয়ে হোম মিনিস্টারকে মিছিলকারীদের সঙ্গে দেখা করতে হয়। তিনি আশ্বাস দেন যে আজই দরবেশকে ছেড়ে দেবেন এবং অনতিবিলম্বে এসপির বদলির অর্ডার ইস্যু করবেন। একদিন পর জেলখানা থেকে বেরিয়ে আসে আলি কেনান। ভক্তবৃন্দের সামনে দাঁড়িয়ে ঘোষণা করে,
তরা মনে রাহিস, আলি কেনান শেখ মুজিব ছাড়া আর কুনু বাপের বেটারে পরোয়া করে না। হে আমারে বুঝে, আমি হেরে বুঝি। হে সমাজতন্ত্রের তরিকার দরবেশ, আর আমি কলন্দরী তরিকার দরবেশ। এভাবে আলি কেনানের দিনগুলো কেটে যাচ্ছিলো। হঠাৎ করে কোত্থেকে একটা উৎপাত এসে তার মধ্যে একটা অন্যরকম অস্থিরতার সৃষ্টি করে। এক বিলেত ফেরত মহিলা একদিন সন্ধ্যেবেলা আলি কেনানের পা ছুঁয়ে সালাম করে বললেন,
বাবা আমাকে একটু খাস দিলে দোয়া করবেন। আমি ভীষণ বিপদে আছি। আলি কেনান তাকিয়ে দেখলো, মহিলা অত্যন্ত সুন্দরী। গায়ে দুধে আলতার রং। চুল কোমর অবধি নেমে এসেছে। চোখ দুটো অসম্ভবরকম কালো এবং ভাসা ভাসা। বয়স পঁয়ত্রিশ টয়ত্রিশ হবে। তখনই আলি কেনানের মনে হলো, তার পরনে একটা নেংটি জাতীয় পোষাক ছাড়া আর কিছু নেই। মহিলার দিকে তাকিয়ে এই প্রথম অনুভব করলো, সে অর্ধ উলঙ্গ। সামনে এমন সুন্দরী এক নারী- যার কণ্ঠস্বর এমন কোমল, দৃষ্টি এতো গভীর, এরকম একটি নারীর জন্য সবকিছু ছেড়েছুঁড়ে দিয়ে সে পৃথিবীর অপর প্রান্ত পর্যন্ত ছুটে যেতে পারে। তার ইচ্ছে হয়েছিলো মহিলার পায়ের তলায় লুটিয়ে পড়বে। তার ইচ্ছে হয়েছিলো মহিলাকে বলবে,
আমি চুলের জটা কেটে ফেলবো। শহরের সবচেয়ে ভালো দোকান থেকে সবচেয়ে সুন্দর দামী জামা কাপড় কিনবো। আমার অঢেল টাকা আছে। আমি তোমার সঙ্গে পৃথিবীর অপর প্রান্ত পর্যন্ত হেঁটে যাবো, দয়া করে তুমি আমাকে গ্রহণ করো। কিন্তু আলি কেনানকে বাস্তবে বলতে হলো,
বেটি কুনু চিন্তা করবি না, তর উপর বাবা বু আলি কলন্দরের দোয়া আছে। সব দুঃখ বিপদ আপদ কাইট্যা যাইবো। মহিলা একান্ত ভরসার চোখে তার দিকে তাকিয়ে বললেন,
আমার বিপদ আপদ কেটে যাবে?
আলি কেনান বললো, হ্যাঁ, বেটি সব কাইট্যা যাইবো।
বাবা আপনার এখানে মাঝেমাঝে এলে আপনি রাগ করবেন?
বেটি তুই আমার মাইয়া, যহন মন লয়, আইবি। মহিলা পা ছুঁয়ে আলি কেনানকে সালাম করে চলে গেলেন।
সেদিন আলি কেনান তার শিষ্য সাগরেদদের অশ্লীল অশ্রাব্য ভাষায় গালাগাল করে,
শালা খানকির পুত, ভ্যাদামার বাইচ্চারা, আমারে নেংটি পিন্দাইয়া মজা লুটবার লাগছস। চোতমাড়ানীর পুতেরা। আমি তগোরে মজা দেখামু। সকলে তার কণ্ঠের অমৃত বর্ষণ শুনে কেমন জানি ভ্যাকাচ্যাকা খেয়ে যায়। আলি কেনানের কথার পিঠে কথা বলার কারো সাহস হলো না। শেষ পর্যন্ত তার ইচ্ছানুসারে দোকান থেকে এক জোড়া দামী পাঞ্জাবি কিনে আনা হলো। সে নিজের ঘরে গিয়েই পায়জামা পাঞ্জাবী পরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মাথার চুলের জটা ধরে টানাটানি করে আর গালাগাল দিতে থাকে : আমার মাথায় জটা ক্যান? খানকির পোলারা। নাপিত ডাইক্যা আন, কাইট্যা ফেলা। সিনেমার হিরোগো মতন কইরা চুল ছাইট্যা দে। সে রাতে তার সেবা করার জন্য দুটি মেয়ে গিয়েছিলো। তাদের পাছায় লাথি মেরে সে বের করে দিলো। অন্ন জল কিছুই স্পর্শ পর্যন্ত করলো না। কেবল আপন মনে আউড়াতে থাকলো, আহা কি খুবসুরত, কি দেইখলাম? গঙ্গা যমুনার পাড়ে খাড়াইয়া য্যান, দেখলাম সুরুজ অস্ত যাইতেছে। দেখলাম আন্দার রাইতে জঙ্গলের মাঝখান দিয়া চান উঠবার লাগছে। আহা কি দেইখলাম। কি খুব সুরত!
আলি কেনানের বায়না ছিলো সে সিনেমার হিরোর মতো চুল কাটাবে। শহরের সেরা দোকানের সবচেয়ে দামী পোষাক পরে মহিলার চোখ ধাঁধিয়ে দেবে। তারপর তার হাত ধরে পৃথিবীর অপর প্রান্তে ছুটে যাবে। কিন্তু পরের দিনেও তাকে সেই পুরোনো পোষাকে গিয়ে মাইকের সামনে দাঁড়াতে হলো। নাচতে হলো, গান করতে হলো। অসহ্য, অসহ্য লাগে আলি কেনানের। যদি পারতো তার জীবনের এই বাইরের খোলসটাকে ভেঙে চুরমার করে ফেলতো। কিন্তু পারে না। সে কম্বল ছাড়তে চায়, কিন্তু কম্বল তাকে ছাড়ে না। আসলে কম্বল নয় ওটা ভালুক। আলি কেনানের নানারকম ইচ্ছে জাগে। কখনো মনে করে সে এই মহিলাকে সবলে দুহাতে তুলে নিয়ে যেদিকে দুচোখ যায় ছুটে যাবে। কখনো ভাবে তাঁর সামনে হাঁটু গেড়ে বসে মিনতি জানাবে। যে ভক্তি যে আবেগে সে বাবা বু আলি কলন্দরকে দিতে পারেনি সব মহিলাকে উজাড় করে দেবে। কিন্তু প্রতিদিন বাস্তবে ঘটে তার উল্টো।
মহিলাটি মাঝে মাঝে তার কাছে আসেন। পা ছুঁয়ে সালাম করেন। প্রাণগলানো স্বরে বাবা বলে সম্বোধন করেন। বর্তমানে মহিলার একটি মানস সংকটকাল চলছে। তিনি অনেকদিন বিলেতে ছিলেন। দেশে ফিরে খুবই অল্প সময়ের মধ্যে সমাজের মক্ষীরাণী হয়ে বসেছিলেন। তিনি প্রকাশ্যে সিগারেট খেতেন, ড্রিংক করতেন। তার অনেক ভক্ত, অনেক অনুরাগী জুটে গিয়েছিলো। তারা নিজেদের মধ্যে তার ব্যাপার নিয়ে এত ঝগড়া বিবাদ, এত হানাহানি করেছে যে খুব অল্প দিনের মধ্যেই তার পরিচিতি দেশের সর্বাধিক জনপ্রিয় চিত্রাভিনেত্রীর কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিলো। তাছাড়া মহিলার মাথায় ছিট ছিলো। আজকে যার সঙ্গে হেসে কথা বলতেন, কাল তার গালে চড় বসিয়ে দিতে একটুও দ্বিধা অনুভব করতেন না।
হুঁশিয়ার মানুষেরা মহিলাকে প্লেগের মতো ভয় করতে লাগলেন। প্রেমের জাগ্রত দেবী মনে করে একদল পেছনে ছুটতে থাকলো। মহিলারা গার্হস্থ্য শান্তি অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য তার মুখের ওপর বাড়ির দরোজা বন্ধ করে দিতে আরম্ভ করলেন। আত্মীয় স্বজনেরা এতো দূর বিগড়ে গিয়েছিলো যে পারলে খাবারের সঙ্গে বিষ মিশিয়ে দিয়ে তাকে খুন করতো। ঢাকা শহর বড় শহর নয়। এখানে সকলে সকলের হাঁড়ির খবর খুব সহজে জেনে যায়। মোটামুটি পরিস্থিতিটা এমন দাঁড়িয়েছিলো যে এই সম্প্রসারণশীল শহরটি তার ওজন বইতে পারছিলো না। এই রকমের একটি অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে মহিলা আলি কেনানের কাছে আসতে শুরু করেন।
এখনো মহিলা আলি কেনানের কাছে আসেন। পা ছুঁয়ে সালাম করেন। তার খাস দিলের দোয়া প্রার্থনা করেন। মহিলা যেদিন আসেন আলি কেনানের অস্থিরতা ভয়ঙ্কর বেড়ে যায়। তাকে সামলাতে শিষ্যদের হিমশিম খেয়ে যেতে হয়। মেয়ে সেবিকাদের পদাঘাত সহ্য করতে হয়। এক নাগাড়ে এই অবস্থা চার পাঁচ দিন ধরে চলতে থাকে। সে জন্য মহিলা এলেই তার শিষ্যকুল সচকিত হয়ে ওঠে। যদি ক্ষমতা থাকতো, আলি কেনানের সঙ্গে তাকে দেখা করতে দিতো না। বিলেত ফেরত অনিন্দ্য সুন্দরী মহিলা যাকে দেখলে পুরুষ ঘোড়া পর্যন্ত উত্তেজিত হয়ে ওঠে, তাঁকে ঠেকানোর ক্ষমতা আলি কেনানের শিষ্যদের কি করে হবে?
এই সময়ে মহিলার সঙ্গে এক ইঞ্জিনিয়ার ভদ্রলোকের পরিচয় হয়। এই ভদ্রলোকেরও দিনকাল তখন ভালো যাচ্ছিলো না। তাকে ছেড়ে তার স্ত্রী আর একজনের সঙ্গে আমেরিকা পালিয়েছে। তারা একজনে অন্যজনের সঙ্গে পরিচিত হয়ে কিঞ্চিত মানসিক সান্ত্বনা লাভ করে। যথাসম্ভব গোটা শহরের সহানুভূতিহীন দৃষ্টি এড়িয়ে একে অন্যের সঙ্গে দেখা করতো, সিনেমায় যেতো। কিংবা ছুটির দিনে দূরে কোথাও চলে যেতো। এভাবে তারা পরস্পরের ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠে।
একদিন মহিলা ইঞ্জিনিয়ার ভদ্রলোককে সঙ্গে নিয়ে আলি কেনানের কাছে আসেন। আলি কেনানের পা ছুঁয়ে সালাম করে ভদ্রলোককে দেখিয়ে বললেন,
বাবা ইনি আমার বন্ধু। আপনি আমাদের খাস দিলে দোয়া করবেন। আলি কেনানের ভদ্রলোককে খুন করার ইচ্ছে জেগেছিলো। কিন্তু উপস্থিত লোকজনের সামনে তাকে বলতে হলো,
বেটি তোগো উপরে বাবা বু আলি কলন্দরের দোয়া আছে। কুনু চিন্তা নাই। সব ঠিক অইয়া যাইবো। সেদিন ঘরে ফিরে আলি কেনান চীৎকার করে বলতে লাগলো,
শালা খানকির বাচ্চা, খেয়াল রাখিস তুই কার জিনিষের উপর নজর দিছস। খুন কইরা ফেলামু। কইলজা টাইন্যা ছিড়া ফেলামু। শরীলের লউ খাইয়া ফেলামু। আজরাইল অইয়া জান কবজ কইরা ফেলামু। অক্ষম আক্রোশে সে রাতভোর হাত পা ছুঁড়ে। খাটের উপর পদাঘাত করে যায় ক্রমাগত।
মহিলা তার ইঞ্জিনিয়ার বন্ধুটি নিয়ে ক্রমাগত আসে। আলি কেনানকে সালাম করে। ঘনিষ্ঠ হয়ে বসে। কানে কানে নিজেরা আলাপ করে। আলি কেনানকে এ দৃশ্য দেখতে হয়। দেখে নীরবে হজম করতে হয়। সন্ধ্যের পর ডেরায় যখন ফেরে প্রাগৈতিহাসিক জন্তুর মতো অন্ধ আক্রোশে ফেটে পড়তে থাকে। যতো রাত অধিক হয়, রাগের মাত্রাও বাড়তে থাকে। তার উন্মুক্ত প্রলাপে শিষ্যদের কারো ঘুমোবার উপায় থাকে না। সে বলতে থাকে :
শালা পাটকাঠির মতন তর শরীল। তুই হেরে সামলাইতে পারবি না। তর চোখ দুইড্যা ট্যারা। কয় পয়সা তর আছে। তুই হেরে ছাইড়া দে। হে আমার। হেরে আমি রাণী বানামু। হের লগে আমি দ্যাশ ছাইড়া চইলা যামু। আর যদি তর লগে দেখি লাশ পইর্যা থাকবো- কইয়া রাখলাম।
ধীরে ধীরে আলি কেনানের সবকিছুর প্রতি আগ্রহ কমে আসতে শুরু করে। রাতের নিভৃত প্রলাপগুলো দিনের বেলাও বলা অভ্যাসে হয়ে দাঁড়ায়। মানুষ জনের প্রতি আর কোনো আকর্ষণ বোধ করে না। একেকটা দিন চলে যায়, সে নিজেকে ফাঁদে পড়া পশুর মতো মনে করতে থাকে। যদি পারতো ধারালো ছুরি দিয়ে সব বন্ধন ছিন্ন করে ওই মহিলার পেছন পেছন ছুটে যেতো। তাকে আলিঙ্গন করে বলতো।
তোমাকে ছাড়া চলবে না, তুমি আমাকে নাও, আমাকে গ্রহণ করো। গ্রহণ করো এই উন্মত্ততা, এই বেদনা, এই দুঃখ, এই অস্থিরতা। মহিলা রাজী না হলে বুকে ছুরি বসিয়ে খুন করতো, তারপর নিজে আত্মহত্যা করতো।
মাসখানেক সময়ের মধ্যে সেই মহিলা ও ইঞ্জিনিয়ার ভদ্রলোকের সম্পর্ক অনেক নিবিড় হয়ে এসেছে। তারা স্থির করলো বিয়ে করবে। মহিলা বিলেত ফেরত হলে কি হবে মনে কুসংস্কারের অন্ত নেই। তিনি মনে করলেন বাবার দোয়াতেই তিনি এত তাড়াতাড়ি একটা স্বামী জুটিয়ে নিতে পারলেন। বাবার প্রতি ভক্তি শ্রদ্ধা অনেক গুণে বেড়ে গেলো।
তাঁর হবু স্বামীকে সঙ্গে করে এক সন্ধ্যো বেলা আলি কেনানের আস্তানায় এসে পদধুলি নিলো এবং হবু স্বামীটিকেও পদধূলি নিতে বাধ্য করলো। যা আলি কেনানের কর্ণে অমৃত বর্ষণ করে, সেই প্রাণ গলানো কণ্ঠস্বরে আলি কেনানকে একান্তে ডেকে নিয়ে বললেন :
বাবা একটু খাস দিলে দোয়া করবেন। আমরা বিয়ে করতে যাচ্ছি। হাতে বিশেষ সময় নেই। তবু আপনার অনুমতি এবং দোয়া চাইতে এসেছি।
আলি কেনানের মনে হয়েছিলো, দুনিয়া দুটুকরো হয়ে গেছে, সূর্য নিভে গেছে। কে যেনো তার বুকে তীক্ষ্ণধার ছুরি আমুল বিধিয়ে দিয়েছে। তবু তাকে বলতে হলো,
বেটি তর উপর বু আলি কলন্দর বাবার দোয়া আছে। সব ঠিক অইয়া যাইবো।
সেদিন সন্ধ্যেবেলা ঘরে ফিরে আলি কেনান কোত্থেকে একটা রামদা খুঁজে বের করে। একটি পাথরের ওপর অনেকক্ষণ ধরে শান দিতে লাগলো। শিষ্যদের কেউ কাছে ঘেঁষতে সাহস করলো না। যদি একটা কোপ দিয়ে বসে। তারপর রামদাটি দুহাতে ঊর্ধ্বে তুলে চিৎকার করতে থাকলো : শালা, অহনও সময় আছে, তুই হেরে ছাইরা দে । হে আমার জিনিস। তুই অরে ছুঁইলে এই রামদা দিয়া তরে কুচিকুচি কইর্যা কাইট্যা গাঙ্গে ভাসাইয়া দিমু। প্রচণ্ড উত্তেজনায় ডানে বামে রামদাটি ঘঘারাতে থাকে। তারপর এক সময় ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে ঘরে ঢুকে।
ঘরে ঢুকে সে তোষকটা উল্টায়। তোষকের নিচে ভাঁজে ভাঁজে রাখা টাকার তোড়া। অনেক টাকা, অনেকগুলো বান্ডিল। সব একসঙ্গে জড়ো করে আবার চিৎকার আরম্ভ করে, আমার ভেস্তের হুর, আমার আসমানের চান, আমার হইলদ্যা পাখি। তুই আমার কাছে আয়। এই ট্যাহা বেবাক তর। অনেক ট্যাহা। শেখ মুজিবের ব্যাংকেও অত ট্যাহা নাই। সব তর লাইগ্যা। সব তর লাইগ্যা তুই আয়, গতরের চামড়া দিয়া তর জুতা বানাইয়া দিমু। শরীরের লউ দিয়া তর পায়ে আলতা কইরা দিমু। তুই আয়, তুই আয়। তরে ছাড়া আমার চলত না। বেবাক দুনিয়া লইয়া আমি কি করুম। তুই আয়, তুই আয়। এক সময় ক্ষিপ্তের মতো টাকার বান্ডিলগুলো একের পর এক বাইরে ছুঁড়ে মারতে থাকে।
আমার আসমানের চান নাই, আমার দিনের সুরুজ ডুইব্যা গেছে। হইলদ্যা পাখি উইড়া গেছে। আমি কাগজের ট্যাহা লইয়া কি করুম? সে হাউ মাউ করে উচ্চ শব্দে কাঁদতে থাকে। অনেকক্ষণ প্রাণফাটা চিৎকার করার পর এক সময়ে বিছানায় ঢলে পড়লো।
তাকে বিছানায় শুয়ে পড়তে দেখে তার শিষ্য সাগরেদরা টাকার বান্ডিলগুলো কুড়িয়ে নিয়ে নিজিদের মধ্যে ভাগাভাগি করে যে যার মতো রাতের অন্ধকারে কেটে পড়লো। আলি কেনানের সেবা করে কাউকে নিরাশ হতে হয়নি।
তার পরদিন ভোরবেলা পেটে প্রচণ্ড ক্ষুধা নিয়ে তার ঘুম ভাঙে। আলি কেনানের মনে পড়লো আগের রাতে সে কিছু খায়নি। মাথাটা ব্যাথায় টনটন করছিলো, দুহাতে টিপে ধরে উঠে দাঁড়ালো। তখনি তার আনুপুর্বিক সমস্ত কথা মনে পড়ে গেলো। সে দাঁত তোলার মতো ব্যথা অনুভব করতে লাগলো। জীবনের সমস্ত সাধ, সমস্ত স্বপ্ন মিটে গেছে। তবু জীবন, এ পোড়া জীবন তাকে বয়ে বেড়াতে হবে। হায়রে জীবনের বিড়ম্বনা, হায়রে জীবনের মায়া। সে কিছু খেতে চাইলো। আজ কেউ আসেনি। কি ব্যাপার। সবাই গেল কই? উঠে সবগুলো ঘর তন্নতন্ন করে দেখলো, সব খা খা করছে। একটিও জনমানব নেই। কাউকে না পেয়ে রাস্তার কাছে চলে এলো। মোড়ের দোকানে রেডিওতে শুনতে পেলো শেখ মুজিবের মৃত্যু সংবাদ প্রচারিত হচ্ছে। আলি কেনানের চোখের সামনে গোটা জগতটাই দুলে উঠলো। সে বিড়বিড় করে বলতে থাকলো,
শেখ মুজিবর বাঁইচ্যা নাই, আমি ঢাহায় থাকুম কেরে? হের সমাজতন্ত্র অইলনা আমি হইলদ্যা পাখিরে হারাইলাম। ভোলায় চইল্যা যামু। অই তরা আমারে লঞ্চের একটা টিকেট কাইট্যা দে।
কিন্তু তার চীৎকার হাওয়ায় মিলিয়ে যেতে থাকলো। সময় নষ্ট না করে শোবার ঘরে ঢুকে তোষকটা উল্টে পাল্টে দেখলো। অবাক কাণ্ড। একটা আধুলিও পড়ে নেই। কাল এই তোষকের তলায় থরে থরে সাজানো ছিলো টাকার বান্ডিল। আজ কিছু নেই। সব হাওয়া। মাজারে ঢুকে গলা চড়িয়ে বলতে থাকলো, হাতে একটা পয়সাও নাই। আমি ভোলায় মা বাপের কাছে ফেরত যামু কেমনে? কেমনে যামু? মাজারের ভেতরে তার কণ্ঠস্বর প্রতিধ্বনিত হতে থাকলো-কেমনে যামু? কেমনে যামু?…