ধনকর্তা হকচকিয়ে গেলেন, এখানে খুন-ডাকাতি!
সুন্দরআলি বলল, মাঠের উপর দিয়া আসেন কর্তা। নিচ দিয়া আমি যামু না।
ধনকর্তা এবার জোরে ধমক দিলেন, আয় দাখি, কি খুন কে খুন দাখি। ধনকর্তা লণ্ঠন তুলে সন্তর্পণে মানুষটার মুখের উপর ধরলেন। মানুষটা বড় চেনা যেন। তিনি নাড়তে থাকলেন ওকে। দেখলেন শ্বাস-প্রশ্বাস পড়ছে। তিনি ডাকলেন, ঈশম, তর কি হইল? ঈশম, অঃ ঈশম! ঈশমের শরীরে কোনও আঘাত চিহ্ন নেই–তিনি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলেন সব।
ঈশমের পাশে বসে ধনকর্তা চোখ টেনে দেখলেন। না সবই ঠিকঠাক আছে। এবার মনে হল– বিলেন মাঠে এমন আঁধারে ঈশম পথ হারিয়েছে। তিনি বিল থেকে জল আনলেন। রুমালে ভিজিয়ে ভিজিয়ে জল দিলেন চোখেমুখে এবং একসময় জ্ঞান ফিরলে বললেন, কিরে তর ডরে ধরছে। আমি তর ধনমামা।
ঈশম চোখ মেলে ধীরে ধীরে দেখল। প্রথমে বিশ্বাস করতে পারল না। তারপর কেমন অবিশ্বাসের গলায় ডাকল, ধনমামা! আপনে ধনমামা! ধনকর্তাকে দেখে সে কেঁদে ফেলল। মামাগ, আমারে কানাওলায় ধরছে! সারাটা মাঠ, বিল, জমি ঘুরাইয়া মারছে। শরীরটা আর শরীর নাইগ মামা।
–আস্তে আস্তে হাঁট। বিলে তুই আইছিলি ক্যান?
এতক্ষণ পর ঈশমের সব মনে হল। কেন এসেছিল এই মাঠে, কোথায় যাবে, কী করবে, কী খবর দিতে হবে সব এক এক করে মনে পড়ল। ধনমামা, আপনের পোলা হইছে। আমিও আপনের কাছে যামু বই ‘ইর হইছি। পথে এই কাণ্ড-কানাওলা।
ধনকর্তা বিশাল বিলেন মাঠে আলো-আঁধারে দাঁড়িয়ে কি জবাব দিতে হবে ভেবে পেলেন না। আকাশে তেমনি হাজার নক্ষত্র জ্বলছে। ঠাণ্ডা হাওয়া ধানের গন্ধ বয়ে আনছে। ঈশম সে সময় বলল, চলেন মামা আস্তে আস্তে হাঁটি। যেতে যেতে খুব সংকোচের সঙ্গে বলল, আমারে একটা এফন দিতে হইব।
ওবা হেঁটে হেঁটে একসময় ট্যাবার পুকুর পাড়ে এল। অশ্বত্থ গাছ পার হতে গিয়ে ঈশম ডাকল, বড়মামা আছেন, বড়মামা! কোনও উত্তর এল না। পুকুর পাড়ে গভীর ঝোঁপ-জঙ্গল। এত রাতে এই জঙ্গলে বসে থাকলে কিছুতেই কেউ টের পাবে না। ভিতবে কেউ আছে কি নেই–দিনের বেলাতেও টের পাওয়া যায় না। ঈশম অথবা চন্দ্রনাথ বৃথা আর ডাকাডাকি করল না। করলা খেত পার হয়ে ধানের জমিতে নেমে আসতেই টের পেল যেন খেতের ভিতর খচখচ শব্দ হচ্ছে। ধান খেতে সামান্য জল। পায়ের পাতা ডোবে কি ডোবে না। ঈশম লণ্ঠন তুলতেই দেখল-বড়কর্তা। ধান খেতেব ভিতর বড়কর্তা কেমন উবু হয়ে বসে আছেন। ঈশম খেতের ভিতর ঢুকে বলল, উঠান। বাড়ি যাইতে হইব। বড়মামি আপনের লাইগা জাইগা আছে। কিন্তু বড়কর্তার মুখে কোনও কথা ফুটে উঠল না। যেমন বসেছিলেন তেমনি বসে থাকলেন। কিছুতেই উঠছেন না। কিসের উপর চেপে বসে আছেন। পায়ের নিচে অন্ধকার এবং ধান গাছ। খচখচ শব্দ। গাছগুলি নড়ছে। সে লণ্ঠনটা নিচে নামাতেই দেখল একটা বড় কাছিম। একটা প্রকাণ্ড কাছিম চিৎ করে তিনি তার উপরে বসে আছেন। কাছিমটা পা’গুলি বের করে মুখ বের করে কামড়াতে চাইছে। কিন্তু তার হাত পা নাগাল পাচ্ছে না। কেবল গাছগুলি নড়ছে। ঈশম কি বলতে যাচ্ছিল, সঙ্গে সঙ্গে কাছিমের বুকে বসে বড়কর্তা হেঁকে উঠলেন, গ্যাৎচোরেৎশালা।
ঈশম বলল, বড়মামা, এইটা আপনে কি করছেন? এতবড় একটা কাছিম ধইরা বইসা আছেন? তারপর সে বলল, আপনে বাড়ি যান। ধনমামায় আইছে। ধনমামার পোলা হইছে।
ধনকর্তা বললেন, উইঠা আসেন বড়দা। কাছিমটা ঈশম লইয়া যাইবখন।
বড়কর্তা ভাল মানুষের মতো ধনকর্তাকে অনুসরণ করলেন। বড়কর্তা কখন ছুটতে থাকবেন, কখন হাতে তালি বাজাবেন–এই সব ঘটনার সম্মুখীন হওয়ার জন্য ধনকর্তা সন্তর্পণে পিছনে পিছনে হাঁটতে থাকলেন। বড়কর্তা অন্ধকারে ছুটতে চাইলে ধনকর্তা বললেন, আমার হাতে লাঠি আছে বড়দা। ছুটবেন ত বাড়ি মারমু। ঠ্যাঙ ভাইঙ্গা দিমু।
চন্দ্রনাথের মুখে এমন কথা শুনে বড়কর্তা ঘুরে দাঁড়ালেন। আমাকে তুমি ভর্ৎসনা করছ চন্দ্রনাথ। এমন এক করুণ মুখ নিয়ে চন্দ্রনাথকে দেখতে থাকলেন। তিনি যেমন কোনও কথা বলেন না, এখনও তেমনি কোনও কথা না বলে অপলক চেয়ে থাকলেন। এমন চোখ দেখলেই মনে হয় এই উত্তর চল্লিশের মানুষ বুঝি এবার আকাশের প্রান্তে হাত তুলে তালি বাজাবেন। চাঁদের কাকজ্যোৎস্না এখন আকাশের সর্বত্র। যথার্থই এবার বড়কর্তা দুহাত উপরে তুলে হাতে তালি বাজাতে থাকলেন, যেন আকাশের কোন প্রান্তে তার পোষা হাজার হাজার নীলকণ্ঠ পাখি হারিয়ে গেছে। হাতের তালিতে তাদের ফেরানোর চেষ্টা। আর ধনকর্তা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সব কিছু নতুন করে লক্ষ করলেন– বড়দার বড় বড় চোখ, লম্বা নাক, প্রশস্ত কপালের পাশে বড় আঁচিল, সবচেয়ে সেই সূর্যের মতো আশ্চর্য রঙ শরীরের এবং সাড়ে ছয় ফুটের উপর শরীরে ঋজুতা। দেখলে মনে হবে মধ্যযুগীয় কোন নাইট রাতের অন্ধকারে পাপ অন্বেষণ করে বেড়াচ্ছেন! চন্দ্রনাথ দেখলেন, বড় এবং গভীর চোখ দুটো সারাদিন উপবাসে কোটরাগত। দুঃখে চন্দ্রনাথ চোখের জল রোধ করতে পারলেন না। বললেন, বড়দা আপনে আর কত কষ্ট পাইবেন, সবাইরে আর কত কষ্ট দিবেন।
বড়কর্তা ওরফে মণীন্দ্রনাথ শুধু বললেন, গ্যাৎচোরেৎশালা। ফের তিনি আকাশের প্রান্তে তালি বাজাতে থাকলেন। সেই তালির শব্দ এত বড় মাঠে কেমন এক বিস্ময়কর শব্দ সৃষ্টি করছে। এইসব শব্দ গ্রাম মাঠ পার হয়ে সোনালী বালির চর পার হয়ে তরমুজ খেতের উপর এখন যেন ঝুলছে। মণীন্দ্রনাথের বড় ইচ্ছা, জীবনের হারানো সব নীলকণ্ঠ পাখিরা ফিরে এসে রাতের নির্জনতায় মিশে থাক–কিন্তু তারা নামছে না–বড় কষ্টদায়ক এই ভাবটুকু। তিনি এবার চন্দ্রনাথকে অনুসরণ করে ঘরের দিকে চলতে চলতে যেন বলতে চাইলেন, চন্দ্র, তোমার ছেলে হয়েছে, বড় আনন্দ! অথচ কথার অবয়বে শুধু এক প্রকাশ, গ্যাৎচোরেৎশালা। এবার তিনি নিজের এই অপ্রকাশের দুঃখে কেমন দুঃখিত হলেন-”এত নক্ষত্র আকাশে অথচ তার পাগল চিন্তার সমভাগী কেউ হতে চাইছে না। সকলেই যেন তার ঠ্যাঙ ভেঙে দিতে চাইছে। মণীন্দ্রনাথ আর কোনও কথা না বলে সেজভাইকে শুধু অনুসরণ করে হাঁটতে থাকলেন।