অন্ধকার বলেই আকাশে এত বেশি তারা জ্বলজ্বল করছিল। বিলেন জমি নিচে নামতে নামতে যেন পাতালে নেমে গেছে। আলপথগুলি এখনও ঠিক মতো পড়েনি, অঘ্রান গেলে, পৌষ এলে এবং ধানকাটা হলে পথগুলি স্পষ্ট হবে। এই বিলে পথ চিনে অন্য পারে উঠে যাওয়া এখন বড় কষ্টকর।
অনেকক্ষণ ধরে ঈশম একটি পরিচিত আলপথের সন্ধান করল। যারা মেলাতে যায়, অথবা বান্নিতে, তারা এই আলপথে বিলের অন্য পাড়ে উঠে যায়, ধানজমির ফাঁকে ফাঁকে কোথায় যেন পথটা লুকিয়ে আছে। সে সন্তর্পণে গাছ তুলে তুলে দেখছে আর এগুচ্ছে। এই বুঝি সেই পথ, কিছু দূরে গেলেই মনে হচ্ছে, না সে ঠিক পথে আসেনি–পথটা ওকে নিয়ে বিলের ভিতর লুকোচুরি খেলছে। তারপর ভাবল, বিলের জমির ধারে ধারে হাঁটতে থাকলে সে নিশ্চয়ই পাশের গ্রামে গিয়ে উঠতে পারবে। মনে মনে আবার উচ্চারণ করল, এলাহী ভরসা। তাকে এ-রাতে, এ-বিল, এ-মাঠ অতিক্রম করতেই হবে। অন্ধকারে পথ যত অপরিচিত হোক, শয়তানের চোখ যত ভয়ঙ্কর হোক– সে এ-মাঠ ঠেলে অন্য মাঠে গিয়ে পড়বেই। ধনকর্তাকে খবর দেবেই।
সে কখনও দৃঢ় হল। অথবা কখনও সংশয়ে ভুগে সে কেমন দুর্বল হয়ে পড়ছে। সে যেন ক্রমে এই বিলের ভিতর ডুবে যাচ্ছে। এবং মনে হচ্ছে তার, সে একই জায়গায় ঘুরে ঘুরে ফিরে আসছে। সে আদৌ এগুতে পারছে না। সে এবার বলল, খুদা ভরসা। সে যে ঘুরে ফিরে একই জায়গায় ফিরে আসছে পরখ করার জন্য হাতের লাঠিটা ধানগাছ সরিয়ে কাদামাটিতে পুঁতে দিল। সে সেই নির্দিষ্ট স্থানটি চিনে রাখার জন্য কিছু গাছ উপড়ে ফেলল। একটা কাকতাড়ুয়ার মতো করে গাছগুলিকে বেঁধে রাখল লাঠিতে। তারপর গোলমতো চারপাশে একটা দাগ দিল।
অনেকক্ষণ ধরে এই বিল এবং পথ ওর সঙ্গে রসিকতা করছে। সে একটু সময় বসল। বিশ্বচরাচর নিঝুম। মনে হয় ঠিক যেন এই বিল সেই পাগল ঠাকুরের মতো রহস্যময়। সে নিজের মনে হাসবার চেষ্টা করল। অথচ গলা শুকনো। ওব সামান্য কাশি উঠে এল গলা থেকে। দ্রুত সেই শব্দ বিলের চারপাশে ছড়িয়ে পড়ছিল। অপরিচিত শব্দ কোথাও। সে কান পেতে রাখল। এখন এই মাঠ আর তার কাছে পাগল ঠাকুরের মতো রহস্যময় নয়, নিঃসঙ্গ মাঠ অঘ্রানের শিশিরে ভিজে ওর পঙ্গু স্ত্রীর মতো ঘুমাচ্ছে অথবা রাতের কীটপতঙ্গ সকল, ঝিঁঝিপোকা সকল শীতের মরসুমের জন্য আর্তনাদ করছে। কবে শীত আসবে, কবে শীত আসবে, মাঠ ফাঁকা হবে, শস্যদানা মাঠে পড়ে থাকবে, আমরা উড়ে উড়ে খাব, ঘুরব-ফিরব, নাচ-খেলব। সে যত এইসব শুনতে থাকল, যত এইসব চিন্তায় বিষণ্ণ হতে থাকল তত সেই ভয়াবহ শিমুল গাছটা মাথায় আলো জ্বেলে ওর দিকে যেন এগিয়ে আসছে।
শিমুল গাছটার মাথায় আলোটা জ্বলছে আর নিভছে। অথবা নিভে গিয়ে আলেয়া হয়ে যাচ্ছে। দূরে দূরে যেন বিলের এ-মাথা থেকে অন্য মাথায় আলেয়াটা ওকে নেচে নেচে খেলা দেখাচ্ছে। সে বলল, ভালরে ভাল! এভাবে বসে থাকলে ভয়টা ওকে আরও পঙ্গু করে দেবে। সে দ্রুত উল্টো মুখে ছুটতে পারলেই কোন-না-কোন গ্রামে উঠে যেতে পারবে।
সুতরাং সে হাতের লণ্ঠন নিয়ে দ্রুত ছুটতে থাকল। হাতের লণ্ঠনটা দু’বার দপ করে জ্বলে উঠল। লণ্ঠনটা নিভে যাবে ভয়ে সে দ্রুত ছুটে যেতে পারল না। সে দু’হাঁটুতে আর শক্তি পাচ্ছে না। বার বার কেবল পিছনের দিকে তাকাচ্ছে। সে এবার দেখল, স্পষ্ট দেখতে পেল, শিমুল গাছটা যথার্থই এগিয়ে আসছে। সে দেখল গাছের মাথায় আলো আর ডালে ডালে মড়কের মৃতদেহ ঝুলছে। সে ধানগাছ দিয়ে কাকতাড়ুয়া জায়গাটায় ফিরে এসেছে। শিমুল গাছটা সহসা জাবও হবে। গেল। এতক্ষণ তবে সে একই বৃত্তে ঘুরছে! ভয়ে বিবর্ণ ঈশম দস্যুর মতো লাথি মারল কাকতাড়ুয়াকে। উ পড়ানো গাছগুলি অন্ধকারে বিলের প্রচণ্ড হাওয়ায় উড়তে থাকল।
সে বলল, শয়তানের পো ভাবছটা কি শুনি! বিলের পানিতে আমারে ডুবাইয়া মারতে চাও। বলেই সে লাঠিটা তুলে উপরের দিকে ঘোরাল। যেমন সে মহরমের দিন বাজনার সঙ্গে সঙ্গে সামনে-পিছনে অথবা উপরে-নিচে, ডাইনে-বাঁয়ে লাঠি ঘোবাতো, লাঠি এগিয়ে দিত, পিছিয়ে আনত, সে উপরের দিকে উঠে যাবার সময় তেমন সব খেলা দেখাতে থাকল। এই বিলের জমি এবং শিমুল গাছটার ভয়ে সে এখন মরিয়া। কিন্তু খেলা দেখালে হবে কি–কারা যেন ওকে পেছনে টানছে। চারপাশে হাঁটছে কারা। মনে হচ্ছে সারা বিলে মানুষের পায়ের শব্দ ভেসে বেড়াচ্ছে। একদল অবয়বহীন শয়তান ওর সঙ্গে হাঁটছে অথচ কথা বলছে না। অন্ধকারে সে কেবল উপরে ওঠাব পরিবর্তে নিচে নেমে যাচ্ছে। এবারে সে চিৎকার করে উঠল, খুদা এইটা কি হইল! ধনকর্তাগ, আমারে কানওলায় ধরছে। সে লণ্ঠন ফেলে লাঠি ফেলে বিলের আলে আলে ঘুরতে থাকল। ধান পাতা লেগে পা কেটে যাচ্ছে। সে বার বার একই জায়গায় ঘুরে ঘুরে এসে হাজির হচ্ছে। আর এ সময়ই সে দেখল ভুতুড়ে আলোটা একেবারে চোখের সামনে জ্বলছে নিভছে। সেই আলোর হাজার চোখ হয়ে গেল, অন্ধকারের ভিতর ভূতের মতো চোখগুলো জ্বলছে। ঈশম আব লড়তে পারল না, ধীরে ধীরে আলের উপর সংজ্ঞাহীন হয়ে গেল।
.
আগে সুন্দরআলি লণ্ঠন হাতে। পিছনে ধনকর্তা। তিনি চারদিন আগে ধনবৌর চিঠি পেয়েছেন। ধনবৌ লিখেছে–শরীরটা আমার ভাল যাচ্ছে না, এ সময় তুমি যদি কাছে থাকতে। ধনবের চিঠি পেয়ে চন্দ্রনাথ আর দেরি করেন নি। বড় কাছারি বাড়িতে মেজদা থাকেন, তার কাছে গিয়ে বললেন, দাদা, আমি একবার বাড়ি যামু ভাবছি। আপনের বৌমা চিঠি দিছে। অর শরীর ভাল না–একবার তবে ঘুইরা আসি। ভূপেন্দ্রনাথ তার সঙ্গে সুন্দরআলিকে দিয়েছেন। রাত হয়ে যাবে যেতে। সেরেস্তায় কাজের চাপ পড়েছে–নতুবা তিনি নিজেও বাড়ি যেতেন। ছেলে হয়েছে এমন খবর জানা থাকলে চন্দ্রনাথ এতটা বোধহয় উদ্বিগ্ন হতেন না। তিনি দ্রুত পা চালিয়ে হাঁটছেন। সুন্দরআলিকে নিয়ে লণ্ঠন হাতে নেমে এসেছেন। শীতলক্ষ্যার পাড়ে পাড়ে এসে ৰাজার বায়ে ফেলে মাসাব পোনা হয়ে বুলতার দিঘি ধরে ক্রমশ এগিয়ে চলেছেন। পেয়াদা সুন্দরআলি মাঝে মাঝে কাশছিল। নির্ভয়ে নিঃশব্দে তাঁরা এ মাঠে এসে নেমেছেন। মাঠ পার হলেই ফাওসার খাল, তারপর দু’ক্রোশ পথ। বাড়ি পৌঁছাতে দেরি নেই। এমন সময়ে সুন্দরআলি চিৎকার করে উঠল, নায়েব মশাই, খুন। হাত থেকে লণ্ঠনটা পড়ে যাবে যাবে ভাব হল সুন্দরআলির। সুন্দরআলি পেছনের দিকে ছুটে পালাতে চাইল।