সে ক্রমে খালের দিকে নেমে যাচ্ছিল। ওর হাঁটু পর্যন্ত ধানগাছ শিশিরে ভিজছে। ঈশম পরাপরদীর পথ থেকে ক্রমশ ডাইনে সরে যাচ্ছে। এ অঞ্চলে সে কোন মানুষের সাড়া পাচ্ছে না। নীরবে যেন একটা মাঠ গাভীন গরুর মতো অন্ধকারে শুয়ে আছে। পথ ধরে কোনও,হাটুরে ফিরছে না। ফসলের ভারে গাছগুলি পথের উপর এসে পড়েছে। সে লাঠি দিয়ে গাছগুলি দুদিকে সরিয়ে দিচ্ছে এবং পথ করে নেমে যাচ্ছে। খালের পাড়ে গিয়ে দেখল গুদারা বন্ধ। মাঝি এপারে নৌকা রেখে চলে গেছে। নৌকাটা অস্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। বাঁ পাশে সে কয়েক কদম হেঁটে গেল। অদূরে মনে হল আকাশের গায়ে একটা লণ্ঠন জ্বলছে। ঈশম জানত, এ সময়ে জেলেনৌকা থাকবে-বর্ষার জল খাল বিল ধরে নেমে যাচ্ছে। যে জল এ অঞ্চলে উঠে এসেছিল জোয়ারে–আঘুন মাসের টানে তা নেমে যাবে। জলের সঙ্গে মাছ এবং কচ্ছপ। জেলেরা এসেছে, খড়া জাল নিয়ে খালের ভিতর জাল পেতে অন্ধকারে ঘাপটি মেরে বসে আছে। ঈশম খালের পাড়ে সেই লণ্ঠনের আলো পর্যন্ত হেঁটে গেল। পাড়ে গিয়ে দাঁড়াল। ডাকল, আমি ঈশম। আমারে পার কইরা দ্যাও। আমি যাইতাছি এক খবর নিয়া। ধনকর্তার পোলা হইছে। তারপর সে কেন যে হঠাৎ ডাকল, বড়মামা আছেন, বড়মামা! বড়মামি আপনের লাইগা জাইগা বইসা আছে, বাড়ি যান। কোনও উত্তর এল না। শুধু একটা নৌকা ওপার থেকে ভেসে এল। বলল, ধনকর্তার পোলা হইছে?
ঈশম বলল, হ।
–তবে কাইল যামু, একটা গরমা মাছ লইয়া যামু। মাছ দিয়া একটা পিরান চাইয়া নিমু। বলে সে পাটাতন তুলে অন্ধকারে একটা বড় মাছ টেনে বের করল। ঈশম লণ্ঠনের আলোতে নীল রঙের তাজা মাছটা পাটাতনে লাফাতে দেখল। চোখ দুটো বড় অবলা। যেন এক পাগল মানুষ নিরন্তর এইসব মাঠে ঘাটে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ফুল-ফল পাখি দেখে বেড়াচ্ছে-এই চোখ দেখলে, পাগল মানুষটার চোখ শুধু ভাসে। বড়মামি বড় বড় চোখ নিয়ে প্রত্যাশায় বসে আছে, কখন ফিরবে মানুষটা। সে বলল, বড়মামারে দ্যাখছ?
মানুষটা বলল, বড়কর্তারে আইজ দেখি নাই।
ঈশম আর কোনও কথা বলল না। এই সব মাঠে পাগল মানুষ দিনরাত ঘুরে বেড়ান। কোন অন্ধকারে, কোথায় তিনি কার উদ্দেশে হেঁটে যান ঈশম টের করতে পারে না। তাকে খাল পাৰ করে দিলে, সে মাঠ ধরে হাঁটতে থাকল শুধু।
এখন সে পাটের জমি ভাঙছে। এখানে এখন কোনও ফসল নেই। কলাই, খেসারি এসব থাকার কথা–কিন্তু কিছুই নেই। শুধু ফসলহীন মাঠ। শুধু খোঁচা খোঁচা দাড়ির মতো পাট গাছের গোড়া উঁকি মেরে আছে। যোগী-পাড়াতে এত রাতেও তাঁত বোনা হচ্ছে। মাঠেই সে তাঁতের শব্দ পেল। সে গ্রামে উঠে যাবার মতলবে কোনাকোনি হাঁটছে। জেলেদের নৌকাগুলি এখন আর দেখা যাচ্ছে না। শুধু খড়া জালের মাথায় বাঁশের ডগাতে লণ্ঠনের আলো প্রায় যেন এক ধ্রুবতারা-ওকে পথের নির্দেশ দিচ্ছে। সে কতটা পথ হেঁটে এল, এবং কোনদিকে উঠে যেতে হবে-অন্ধকারে সেই এক আলো তাকে সব বাৎলে দিচ্ছে। এ মাঠের শেষেই সেই বুড়ো শিমুল গাছটা যেন ক্রমে অবয়ব পাচ্ছে। দিনের বেলাতে এ-জমি থেকে গাছটা স্পষ্ট দেখা যায়। সেই গাছটার পাশের গ্রামে একবার মড়ক লেগেছিল–ঈশম কেমন ভয়ে ভয়ে হাঁটছে! শিমুলগাছটার দূরত্ব ঈশমকে কিছুতেই ভয় থেকে রেহাই দিচ্ছে না। সে যত দূর দিয়ে যাচ্ছে তত মনে হচ্ছে গাছটা ওর দিকে হেঁটে আসছে। ডান পাশে প্রায় আধ ক্রোশ হেঁটে গেলে সেই গাছ এবং নিচে তার কবরভূমি–যেহেতু টিলা জমি থেকে একবার সে গাছটাকে দেখতে পেয়েছিল, একদিন হাট ফেরত রাতে গাছটার মাথায় সে আলো জুলতে দেখেছিল-সেজন্য ঈশম ভয়ে ভয়ে দ্রুত পা চালিয়ে যোগীপাড়াতে উঠে এল। কেউ দেখে ফেললেই বলবে, এলাম সেই কবর ভেঙে-কারণ ঈশমের মতো সাহসী পুরুষ হয় না–এ তল্লাটে সে এমন একজন সাহসী মানুষ। কিন্তু ঈশম কোনওকালে তার ভয়ের কথা খুলে বলে না। সাহসী বলে সে রাতেবিরেতে পরাণের ভিতরে ভয় লুকিয়ে রেখে চোখ বুজে চলে যেতে থাকে। যোগীপাড়াতে উঠতেই মানুষের শব্দে, চরকার শব্দে এবং শানা মাকুর শব্দে ভয়টা কেটে গেল। তারপর পরিচিত মানুষের গলা পেয়ে বলল, আমীর চাচার গলা পাইতাছি।
–তুমি…?
–আমি ঈশম।
–এত রাইতে!
–যামু মুড়াপাড়া। ধনকর্তার পোলা হইছে–খবর লইয়া যাইতাছি। আপনার শরীর ক্যামন?
–ভাল নারে বাজান। ভাল না। একটু থেমে বলল, বড়কর্তার মাথাটা আর ঠিক হইল না?
–না চাচা।
–শোনলাম বুড়া কর্তা চক্ষে দেখতে পায় না।
–না। সারাদিন ঘরে বইসা থাকে। বড়মামি, বুড়া ঠাইরেন দেখাশুনা করে।
–পোলাটা পাগল হইল আমার কর্তার-অ চক্ষু গেল।
–হ চাচা।
–তা একটু বইস। তামাক খাও।
–আর একদিন চাচা। আইজ যাইতে দ্যান। ঈশম কথা বলতে বলতে সৈয়দ মিস্ত্রির শোলার মাচান অতিক্রম করে রামপদ যোগীর আমবাগানে ঢুকে গেল। তারপর গ্রামের মসজিদ পার হয়ে মাঠে পড়তেই শিমুল গাছটার কথা মনে হল। সে জোরে জোরে মনের ভিতর সাহস আনার জন্য বলল, এলাহী ভরসা। গাছটা যেন ক্রমে শয়তান হয়ে যাচ্ছে। শয়তানের মতো পিছু নিয়েছে। মাঝে-মাঝে হাতের লাঠিটা লণ্ঠনটা ভয়ানক ভারী-ভারী মনে হচ্ছে। সে ভাবল–এমন তো হবার কথা নয়। সে ভাবল, অনেক রাত, অনেক দূরে সে কত মানুষের সুসংবাদ, দুঃসংবাদ বয়ে নিয়ে গেছে–অথচ আজ এখনও সে ফাওসার চক ভাঙতে পারেনি। শিমুল গাছটা বড় কাছে মনে হচ্ছে। কখনও পেছনে তাড়া করছে, কখনও সামনে! সে দু’বার লাঠিটা মাথার উপর বন বন করে ঘোরাল। ওর পাইক খেলার কথা মনে হল–লাঠি খেলায় ওস্তাদ ঈশম এই মাঠে গাছটাকে প্রতিপক্ষ ভেবে মাঝে মাঝে লাঠি ঘোরাতে থাকল। লণ্ঠনটা সে বাঁ হাতে রেখে ডান হাতে লাঠি মাথার উপর ঘোরাচ্ছে এবং নিচের দিকে নেমে যাচ্ছে। যখন ধানগাছগুলো পা জড়িয়ে ধরেছে, সে লাঠি দিয়ে ধানগাছ সরিয়ে ফের হাঁটছে। সে লাঠি দিয়ে মাঝে মাঝেই ধান গাছ সরাচ্ছিল–কিছুটা নিজেকে অন্যমনস্ক করার জন্য, কিছুটা পথ পরিষ্কার করার জন্য। মাঠে নেমেই শরীরটা ঠাণ্ডা মেরে যাচ্ছে। ভয়ানক শ মর্থ শরীর ঈশমের। এই বুড়ো বয়সেও সে ঘাড়-গলা শক্ত রাখতে পেরেছে। অথচ এই রাত, অন্ধকার, বিশাল বিলেন মাঠ এবং যে শিমুল গাছটা এতক্ষণ ওকে তাড়া করছে–এই সব মিলে তাকে কেমন গোলমালের ভিতর ফেলে দিয়েছে। ঈশম লণ্ঠনের আলোতে যেন পথ দেখতে পাচ্ছে না। এই বিল ভেঙে উঠতে পারলেই ফের গ্রাম, ফের গ্রামের পথ, গোলাকান্দলের ভুতুড়ে পুল এবং পুরীপূজার মাঠ। ফের গ্রামের পর গ্রাম, তারপর বুলতার দিঘি এবং নমশূদ্রপাড়া–পেড়াব পোনাব, মাসাব গ্রাম।