বড়বৌ বড় বড় চোখ নিয়ে ঈশমকে শুধু দেখল। কোনও কথা বলল না। বললেই যেন চোখ ফেটে জল বেবিয়ে আসবে। ঈশম যেন এই চোখ দেখে ধরতে পেরেছে বড়মামা এখন বাড়িতে নেই। অথবা কোথায় থাকে, কই যায় কেউ খোঁজখবর রাখে না। রাখবার সময় হয় না। অথবা দরকার হয় না। ঈশম ডাল দিয়ে সবকটা ভাত হাপুস করে মাকড়সার মতো গিলে ফেলল। বড়মামি এখন কাছে নেই। বৈঠকখানায় লোক পাতলা হয়ে আসছে। বড়মামিব বড় ছেলে, ধনমামিব বড় ছেলে রান্নাঘরে তাড়াতাড়ি খেয়ে নিচ্ছে।
ঈশম বৈঠকখানা থেকে লাঠি নিল একটা, লণ্ঠন নিল হাতে। ঈশম মাথায় পাগড়ি বাঁধল গামছা দিয়ে। এই আঘুন মাসের ঠাণ্ডায় কাদাজল ভাঙতে হবে। খাল পার হতে হবে, বিল পার হতে হবে। গামছা মাথায় সে পাঁচ ক্রোশ পথ হাঁটবে। কোথাও খালের পাড়ে পাড়ে কোথাও পুলের উপর দিয়ে, কখনও চুপচাপ, কখনও গাজির-গীত গাইতে গাইতে ঈশম দীর্ঘপথ হাঁটবে। ঈশম রান্নাঘর অতিক্রম করবার সময় দেখল কুয়োতলার ধারে বড়মামি অন্ধকারে দাঁড়িয়ে কার জন্য যেন প্রতীক্ষা করছেন। ঈশমকে দেখে বড়বৌ বলল, ঈশম, দেখবে তো তোমার বড়মামাকে ট্যাবার বটতলায় পাও কিনা, তুমি তো বটতলার পথেই যাবে।
ঈশম বাঁশঝাড় অতিক্রম করে মাঠের অন্ধকারে নেমে যাবার সময় বলল, আপনে বাড়ি যান। যাইতে যাইতে যদি পাই–পাঠাইয়া দিমু। এই বলে ঈশম ক্রমে অন্ধকার মাঠে মিশে যেতে থাকল। ঈশমকে আর দেখা যাচ্ছে না, শুধু মাঠের ভিতর লণ্ঠন দুলছে।
ঈশমের ডান হাতে লাঠি, বাঁ হাতে লণ্ঠন। অঘ্রান মাস। শিশির পড়ছে। এখনও ভাল করে ধানখেতের ভিতর আল পড়েনি। সরু পথ খেতের পাশে পাশে। পথ থেকে বর্ষার জল নেমে গেছে-পথের মাটি ভিজা, কাদামাটিতে পা বসে যাবার উপক্রম। অথচ পা বসে যাচ্ছে না কেমন নরম তাল তাল মাটির উপরে দিয়ে ঈশম হেঁটে যাচ্ছে। গাঢ় অন্ধকার বলে ঈশম চারদিকে শুধু লণ্ঠনের আলো এবং তার অস্তিত্ব ব্যতিরেকে অন্য কিছু প্রত্যক্ষ করতে পারল না। এ অঞ্চলে হেমন্তে শীত পড়তে আরম্ভ করে। শীতের জন্য ঝোঁপজঙ্গলের কীট-পতঙ্গরা কেমন চুপচাপ হয়ে আছে। ঈশম লণ্ঠন তুলে এবার উঁচু জমিতে উঠে এল। পাশে করলার জমি। উপরে ট্যাবার পুকুর আর সেই নির্দিষ্ট বটগাছ। এখানে অনেক রাত পর্যন্ত বড়কর্তা বসে থাকেন। এখানে বড়কর্তাকে অনেকদিন গভীর রাতে খুঁজে পাওয়া গেছে। ঈশম লণ্ঠন তুলে ঝোপে-জঙ্গলে বড়কর্তাকে খুঁজল। ঝোপে ঝোপে জোনাকি। বটের জট মাটি পর্যন্ত নেমেছে। পুরানো জট বলে জটসকল ভিন্ন ভিন্ন ঘরের মত ছায়া সৃষ্টি করছে। সে ডাকল, বড়মা আছেন? সে কোনও উত্তর পেল না। তবু লণ্ঠন তুলে গাছটার চারধারে খুঁজতে থাকল–তারপর যখন বুঝল তিনি এখানে নেই, তিনি অন্য কোথাও পদযাত্রায় বের হয়েছেন, তখন ঈশম ফের নিচু জমিতে নেমে হাঁটবার সময় দূরে দূরে সব গ্রাম, গ্রামের আলো, হাসিমের মনিহারি দোকানে হ্যাঁজাকের আলো দেখতে দেখতে নালার ধারে কেমন মানুষের গলা পেল।
সে বলল, কে জাগে?
অন্ধকার থেকে জবাব এল, তুমি ক্যাডা?
–আমি ঈশম শেখ। সাকিম টোডারবাগ। ঈশম যেন বলতে চাইল, আমি গয়না নৌকার মাঝি ছিলাম। এখন ঠাকুরবাড়ির খেয়ে মানুষ। অন্ধকার মানি না। বাবু ভদ্রলোকের সঙ্গে আমার বাস। নদীর চরে তরমুজ খেত পাহারায় থাকি। ঠাকুরবাড়ির বান্দা আমি। বয়স বাড়ছে, গয়না নৌকা চালাতে আর পারি না।
–আমি আনধাইর রাইতে হাসিম ভুইঞা জাগি। সাকিম কলাগাইছা।
–অঃ, হাসিম ভাই। তা কি করছ?
–মাছ ধরতাছি। দ্যাখছ না জল নামছে। আমি কৈ মাছের জাল পাইতা বইসা আছি। ঘুট ঘুইটা আনধাইরে কই রওনা দিলা?
–যামু মুড়াপাড়া। ধনকর্তার পোলা হইছে। সেই খবর নিয়া যাইতাছি।
–ধনকর্তার কয় পোলা য্যান?
–এরে নিয়া দুই পোলা। তোমার কাছে কাঠি আছে, বিড়িটা আঙ্গাইতাম।
ঈশম বিড়ি ধরাল। ওর বড়কর্তার জন্য মনটা খচখচ করছে। বড়কর্তা রাতে বাড়ি না ফিরলে বড়মামি অন্ধকাবে মানুষটার জন্য জেগে থাকবে। সে বলল, বড়মামারে দ্যাখছ?
–দুফরে দ্যাখছিলাম–নদীর চরে হাইটা যাইতাছে।
ঈশম কেমন দুঃখের গলায় বলল, ভাইরে, তোমার আমার ছোটখাটো দুঃখ। ঠাকুরবাড়ির দুঃখে চক্ষে পানি আসে। ঈশম ফের হাঁটতে থাকল। সে হন হন করে হেঁটে যাচ্ছে। ফাওসার খাল পার হবার জন্য সে হন হন করে হেঁটে যাচ্ছে। হাট ভাঙার আগে যেতে পারলে সে গুদারাঘাটে মাঝি পাবে। নতুবা এই শীতে সাঁতার কেটে খাল পার হতে হবে। ঠাণ্ড, কথা ভাবতেই ওর শরীরটা কেমন কুঁকড়ে গেল।
ইচ্ছা করলে ঈশম একটা সংক্ষিপ্ত পথ ধরে আরও আগে খালের পাড়ে পৌঁছাতে পারত। কিন্তু একটি অজ্ঞাত ভয়, বিশেষ করে বামন্দি-চকের বুড়ো শিমুল গাছটা এবং ওর বাজে-পোড়া মরা ডাল বড় ভয়ের কারণ। নিচে কবর, আবহমানকাল ধরে মানুষের কবর, হাজার হবে, বেশিও হতে পারে–ঈশম ভয়ে সেই পথে খালের পাড়ে পৌঁছাতে পারছে না।
ঈশম হাতের লাঠিটা এবার আরও শক্ত করে ধরল। সে ভয় পেলেই আকাশের দিকে মুখ তুলে তাকায়। আল্লা মেহেরবান। সে যেন আসমানে তার সেই মেহেরবানকে খুঁজতে থাকে। অজস্র তারা এখন বিন্দু বিন্দু হয়ে জ্বলছে। নিচে সেই এক শুধু গাঢ় অন্ধকার। দূরে দূরে সব গ্রামের আলো, হ্যাঁজাকের আলো-গাছের ফাঁকে এবং ঝোঁপজঙ্গলের ফাঁকে এখনও দেখা যাচ্ছে। পরাপরদীর পথ ধরে কিছু লোক যাচ্ছিল জল ভেঙে-ওদের হাতে কোনও আলো নেই-জলে ওদের পায়ের শব্দ। কিছু কথাবার্তা ঈশমের কানে ভেসে আসতে থাকল।