গ্যারেজ থেকে গাড়ি বের করে নিচ্ছে সোমা। ডিমের মতো গাড়ির আকার। সাদা, ডিমের মতো রঙ, রঙ কখনও মলিন হয় না। অনেক চেষ্টার পর সে গাড়িটা পেয়েছে। অথবা দাম অনেক বেশি দিয়েছে, তবু সোমা যখন এ গাড়িটা চড়ে সুখ পায় তখন আর টাকার দুঃখ থাকে না। গাড়িটা অর্ধেক দামে কেনা যেত। এত বেশি মাঝখানে দালাল পড়ে গেল যে সবার মুখ বন্ধ করার জন্য সে টাকার মায়া করেনি। এবং এ—গাড়িটায় চড়ে কোনো রাস্তায় বের হলে পৃথিবীতে সবচেয়ে সুখী মানুষেরা গাড়িটার ভিতর আছে সহজেই মানুষেরা ভেবে ফেলতে পারে। সে এটা অস্বীকার করে না, সে নানাভাবে রাজার মতো যখন বেঁচে ছিল, তখন এক অতীব বিষাক্ত কীটের উপদ্রব। একটা জ্বালা ধরিয়ে দিয়েছে। ওকে অসুস্থ করে দিচ্ছে। সে এমন শক্ত মানুষ, তাকে কীভাবে যে দুর্বল করে ফেলেছে!
সোমা বের হয়ে গেল। গেট খুলে যাচ্ছে। সোমা, হাত নাড়ল, এটা সোমার স্বভাব। সোমা পথের ওপরে পড়েই সাঁ সাঁ করে বের হয়ে গেল। এবং মনীষ দেখল, এসময় সে ভীষণ একা, এবং ঘরের ভিতর ঢুকতে পর্যন্ত ভয় করছে। ঘর ফাঁকা পেয়ে যদি কেউ পাঁচিল বেয়ে উঠে এসে থাকে। ব্যালকনি থেকে সে নড়তে পারল না। সে এই শীতেও ঘামছে। ভিতরে ঢুকেও যদি দেখে কেউ চাদর গায়ে দাঁড়িয়ে আছে!
সে নিজেকে স্বাভাবিক করে নেবার চেষ্টা করছে। প্রথমে সে মৃত্যু একটি অতি সহজ ঘটনা, সে, যে—কোনো মুহূর্তে আসতে পারে। সে তারপর ভাবল, ভাগ্য। ভাগ্যে লেখা থাকলে ঘটবে। কেউ রুখতে পারবে না। তারপরই ভাবল, সে কী যা তা ভাবছে। ভাগ্য আবার কী! সে তো এতদিন সোমাকে বুঝিয়েছে, পুরুষকার। সে তার বুদ্ধি এবং কৌশলের দ্বারা এমন এক অপূর্ব মণি—কাঞ্চনের ব্যবস্থা করেছে। সবাই পারে না। সবাই সে—জন্য গাড়িও চড়তে পারে না। সবার গাড়ি চড়া ঠিক না। সবাই গাড়ি চড়লে কাজ করবে কে। পৃথিবীতে কাজের লোক না থাকলে মণি—কাঞ্চন সংগ্রহ হয় না।
তারপরই মনে হল, এসবও ওর ভাবার কথা না। সে সাহসের সঙ্গে সবকিছুর সম্মুখীন হবে ভাবল। সে এক পা এগোচ্ছে আর সাহস কথাটা ভাবছে। সাহস কথাটা ওর কাছে আশ্চর্য একটি শব্দ মনে হচ্ছে। সাহস কথাটার ভিতর খুব বড় একটা ব্যাপার আছে। না হলে এমন সামান্য শব্দ, যা সে ভাবত, এমন কিছু না, এখন তাকে একেবারে গলা শুকিয়ে দিচ্ছে। সে এবার যেন না ডেকে পারল না, মনোরমা! সে ডাকল, রসুল। কেউ সাড়া দিচ্ছে না। ওরা কি কেউ নেই! সে ডাকল, রাম অবতার। না, কেউ সাড়া দিচ্ছে না। সে করিডোরে ঢুকে গেল। ওর পা এগুচ্ছে না। দুপাশে দেয়ালে সব ছবি। নানাবর্ণের ছবি। সে ছবির এগজিবিশান হলেই ভালো ভালো ছবি কিনে ফেলে। একটা ইঁদুরকে ঈগলে ধরে নিয়ে যাচ্ছে, অথবা কোনো বনের ভিতর র্যাটেল সাপের ভয়ংকর মূর্তি, এসব মিলে সে ভাবল, আর ঢোকা যাবে না। ভিতরে কী আছে কে জানে!
তখনই মনীষ অবাক হয়ে গেল ভেবে, সারা বাড়িটা এ—ভাবে কখনও কখনও ভূতুড়ে হয়ে যায়। সে মরে যাবে ভাবতেই কী আশ্চর্য, এ বাড়ির চারপাশে যেন এক অতিকায় নৈঃশব্দ্য ঘুরে বেড়াচ্ছে। রাস্তায় মোটরের হর্ন, মানুষজন এত, তবু মনে হচ্ছে, এখানে কিছুক্ষণের ভিতরই এক ভয়াবহ হত্যাকাণ্ড ঘটবে। সে দ্রুত সিঁড়ি ধরে নেমে বলল, কৈ হায়।
জি হুজুর।
কেউ রয়েছে?
কোথায় হুজুর?
এই দ্যাখো তো বাগানের দিকে।
রাম অবতার বাগানের চারপাশে ঘুরে এসে বলল, কৈ, না।
মনীষ বলল, রসুল কাঁহা?
রসুল! রসুল কাহারে! হুজুর বলাতা হ।
রসুল এলে মনীষ বলল, এসো।
সে রসুলকে নিয়ে ঘরের ভিতর ঢুকল। রসুল কখনোই এত ভিতরে ঢুকতে পারে না। সে দেখে অবাক, মানুষেরা এ ভাবে বাঁচে! বেহেস্তের শামিল। তিনি ভিতরে খুট খুট করে কী করছেন। এবং কিছুক্ষণের ভিতর বের হয়ে এলে রসুল বুঝতে পারল, হুজুর কোথাও বের হচ্ছে। মনীষ একটা চাবি ওকে ছুড়ে দিল। এবং সে নিচে নেমে যখন গাড়ি নিয়ে রাস্তায় বের হয়ে গেল, মনে হল মুক্তি। এত বড় মুক্তি সে কখনও পাবে ভাবেনি। তাকে এখন কেউ চেনে না। যেন একটা বড় বাড়ির ভিতরই তাকে চেনা যায়, তার নাম মনীষ দত্ত। হবু ক্যাপিটালিস্ট। হবু ক্যাপিটালিস্টদের ওরা বোধহয় বেশি খুঁজছে। সে প্রায় পালাবার মতো গাড়ি নিয়ে এ—গলি সে—গলি করে যেন তাকে কেউ ফলো করতে না পারে, এবং সে এ—ভাবে কখন কোথায় কোথায় কীভাবে সে ঘুরে ঘুরে শান্তিবাবুর ফ্ল্যাটে কড়া নাড়ল, নিজেও বলতে পারল না। যখন শান্তিবাবু দরজা খুলে দিলেন, সে দেখতে পেল দেয়াল ঘড়িতে এগোরোটা বাজে। সে বাড়ি থেকে বের হয়েছিল সাতটায়। শান্তিবাবুর বাড়ি পৌঁছাতে খুব বেশি চল্লিশ মিনিট। বাকি সময় ভয়ে সে কেবল একটা ইঁদুরের মতো এ—গলি সে—গলি করেছে।
এগারো
বিনু, তুই এ—ছবিটা চিনতে পারিস?
বিনু ছবিটার ওপর ঝুঁকে দেখল। তারপর ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখল। তারপর চোখ বুজে কী ভাবল, বেশ কিছু সময় চোখ বুজে থাকলে সোমা ভাবল, বিনু হয়তো খুঁজে পেয়েছে। ওর মুখে হাসি দেখা দেবে, সে বলবে, ইউরেকা, এবং এ—ভাবে যখন দেখল বিনু চোখ বুজেই আছে খুলছে না, খুলবে কিনা তাও ঠিক নেই, তখন সোমা না বলে পারল না, কিরে চিনতে পেরেছিস?
বিনুর মনে হল, কেউ তাকে ডাকছে। সে চোখ খুলে বলল, কেউ আমাকে ডাকছে?