বাড়ি ফিরতে বেশ রাত করে ফেলেছিল সোমা। সে সিঁড়ি ধরে ওপরে উঠে যাচ্ছিল। মনীষ ব্যালকনিতে পায়চারি করছিল—এবং ভীষণ উদ্বিগ্ন সে। সোমা এখনও ফিরছে না। রসুল সোমার সঙ্গে যায়নি। একা বের হয়ে গেছে। তখনই সিঁড়িতে পায়ের শব্দ। মনীষ বলল, ওকে সামান্য আঘাত দেবার জন্য যেন বলল, ওকে পেলে?
না।
গাড়িতে চড়ে ওসব মানুষের নাগাল পাওয়া যায় না সোমা।
মনীষ সোমাকে ঠাট্টা করছিল অথবা বিদ্রুপ। সোমা গায়ে মাখল না। মনীষ স্ত্রীর কাছে গেল। বলল, সোমা তুমি কী পাগল হয়ে যাচ্ছ?
সোমা সোজা তাকাল মনীষের দিকে।
আমার তাই মনে হচ্ছে। তোমার কী হয়েছে বল? তুমি এমন করলে আমি বাঁচি কী করে!
আমার তো কিছু হয়নি মনীষ। তুমি অনর্থক চিন্তা করছ।
যদি তুমি তাকে খুঁজে পাও, তবে কী করবে?
কিছুই করব না।
তবে তাকে খোঁজার কী দরকার এত?
সেটা আমি নিজেও বুঝতে পারছি না।
সোমা! মনীষ চিৎকার করে উঠল। তারপর ধীরে ধীরে বলল, কাল থেকে আর বের হবে না। বলে দিলাম।
সোমা এ—কথা শুনে কী ভাবল মুখ দেখে বোঝা গেল না। সে যেমন অন্যান্য দিন স্নান করে রেকর্ড—প্লেয়ার নিয়ে বসে তেমনি বসেছিল। এবং গত রাতে যে—সব রেকর্ড বাজিয়েছে একা একা, সে সব বাজাল। সে মনীষের সঙ্গে কথা বলতে পর্যন্ত পারছে না। মানুষটার মুখ তাকে এত বেশি হন্ট করছে।
খাবার পর অন্তত মনীষ ভেবেছিল সোমা সহজ হবে। সে রাগ করলে খায় না। না খেয়ে শুয়ে থাকে। কিন্তু আজ মনীষ ডাকতেই সে খাবার টেবিলে গিয়ে বসল। বেশ পেট ভরে খেল। পেট ভরে খেলে মনীষের মনে হয় সোমার কোনো রাগ থাকে না। সে একটা দামি চাদর সোমাকে জড়িয়ে দিল। বলল, চল তুমি গান গাইবে, আমি শুনব।
সোমা বস্তুত সেই গানগুলিই ফিরিয়ে ফিরিয়ে গাইল, গোলাপ ফুল ফুটিয়ে আছে….।
মনীষ জানে সোমার এই গান সেই এক মানুষকে উদ্দেশ্য করে গাওয়া। সে যেন এ—সব গান মনীষকে শোনাচ্ছে না, সেই নিবেদিত প্রাণকে শোনাচ্ছে। মনীষ ভিতরে ভিতরে ভয়ংকর উত্তেজিত হয়ে পড়ছে। তবু কিছু করতে পারছে না। সোমা যখন নীল চোখে তাকায় তখন মনীষের সব রাগ দুঃখ কেমন গলে যায়। মনীষ ওকে জড়িয়ে ধরল। সোমা কিছু বলছে না। ওকে শুইয়ে দিচ্ছে আস্তে আস্তে। সোমা কিছু বলছে না। মনীষ বলছে, এ—ভাবে ভালো লাগছে না। আজ তুমি লাল রঙের গাউন পরো। লাল রঙের নাইটি পরে এল সোমা। নিচে কোনো বাস নেই। সেই এক মোমের মতো নরম হাত—পা। সোমা হাত—পা বিস্তার করে দিল। মনীষ কেমন কুকুরের মতো শুঁকে শুঁকে ওর শরীরের দিকে এগুচ্ছে। অন্তস্তলে ডুব দেওয়া মাত্রই সোমা আর্তনাদ করে উঠল, মনীষ, চারপাশে কারা ঘিরে ফেলেছে বাড়িটা দ্যাখো। ওরা আমাদের পুড়িয়ে মারবে। বলেই মনীষকে শরীর থেকে ঠেলে ফেলে দিল সোমা।
মনীষের মুখে এ—শীতের রাতেও ঘাম। সে স্ত্রীকে জোর করে সাপ্টে ধরল ফের। সোমা এলোপাথাড়ি হাত—পা ছুঁড়ছে। না, না। আমি পারব না। আমাদের ওরা আজ হোক কাল হোক পুড়িয়ে মারবে। তুমি আমাকে ছেড়ে দাও। আমাদের ওরা কোনোদিন ক্ষমা করবে না।
কিন্তু মনীষ শুনছে না। কী যেন এক অমানুষিক লোভ ওকে তাড়া করে ফিরছে। আজ তিনদিন সোমা ওকে দূরে সরিয়ে রেখেছে, নানারকমের অজুহাত সোমা দাঁড় করায়। সে কিছু শুনবে না। জোর করে বাঘ যেমন শিকার নিয়ে পালায় তেমনি সে সোমাকে পাঁজাকোলে করে নিজের খাটের দিকে এগুচ্ছে। আর সোমা, এক অবোধ বালিকার মতো হাত—পা ছুঁড়ে বাধা দিচ্ছে। ওর নাইটি ছিন্ন ভিন্ন হয়ে গেছে। বলছে, মনীষ, ওরা এসে গেছে। ওরা আমাদের পুড়িয়ে মারতে এসে গেছে।
মনীষ কিছু শুনল না। সে তার স্ত্রীকে উলঙ্গ করে ফেলে রাখল। বলল, তুমি উঠবে না। উঠলে আমি তোমাকে হত্যা করব। মনীষ ওকে এবার যথার্থই ভয় দেখাল। উত্তেজনায় ওর হাত—পা কাঁপছে। কে এমন মানুষ, যে আমার সর্বস্ব কেড়ে নিচ্ছে! একেবারে উঠবে না। আমি তোমার পাশে শোব। তোমাকে ধর্ষণ করব।
সোমা শক্ত হয়ে থাকল। কিন্তু মনীষের যতটা ইচ্ছা ছিল আজ ওকে ছিন্নভিন্ন করে দেবার, নীল চোখ দেখে সে আর তা করতে পারল না। শিয়রে বসে থাকল। এবং সহসা দুহাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকল, বল তোমার কী হয়েছে। খুলে বল। আমি তোমার জন্য সব করব।
সোমা পাশ ফিরে শুল। ঘরে আর কেউ আছে সোমার যেন মনে নেই। মনীষ বলল, তুমি উঠে দেখো কেউ আমাদের বাড়ির চারপাশে নেই। কেউ আমাদের পুড়িয়েও মারতে আসছে না।
সোমা ঘুমিয়ে পড়েছে।
মনীষ একা একা একটা মৃদু আলো জ্বালিয়ে পায়চারি করতে থাকল। তার ঘুম আসছিল না। গত রাতে সোমা যেমন শীতের রাতে ব্যালকনিতে চুপচাপ বসেছিল, আজ সে তেমনি নিজে সেখানে চলে গেছে। তার ভিতর সোমা কী করে যেন এক মৃত্যুভয় ঢুকিয়ে দিয়েছে। সকালের কাগজ পড়ার পর সেই মৃত্যুভয় তাকে অনেকক্ষণ কাজের ভিতর ডুবতে দেয় না, তবু সে সারাক্ষণ কাজ—পাগলা মানুষের মতো অফিসে থাকে। আজ এখন সেই মৃত্যুভয় ওকে এমন জড়িয়ে ধরেছে যে একা একা ব্যালকনিতে পায়চারি করতে সে ভয় পেল। ওর কেন জানি মনে হল সত্যি কারা চারপাশে, মাঠ ঘাট অথবা গ্রাম থেকে মশাল জ্বালিয়ে শহরের দিকে উঠে আসছে। হাতে ওদের মশাল। এবং বর্শার ফলাতে মানুষের মৃত্যু নাচছে। ওর মনে হল ওরা সব অন্নহীন ভূমিহীন মানুষ। সে তাদের সর্বস্ব কেড়ে নেবার যে ষড়যন্ত্র করেছিল, একা পেয়ে তাকে বর্শায় গেঁথে তুলে নিয়ে যাচ্ছে।