কী আর আনবি। মুখে আমার বিস্বাদ শুধু।
কিছু কমলা, কিছু আপেল?
সে অনেক দাম। অত দামের ফল আনবি না। আমার টাকার বড় দরকার, বিজন। দেশে ফিরব। শরীরের চিকিৎসা আছে, বিবি আছে, বাচ্চা আছে। ওদের জন্য ঘর করতে হবে। জমি করতে হবে। ঘর জমি হলে জাহাজে আর সফর দেব না। জমি—জিরাত দেখে, বিবি বাচ্চা দেখে আল্লার ঘরে বাকি দিনগুলো কাটিয়ে দেব।
বিজনের মুখে বিষণ্ণ হাসি। পোর্টহোলের কাচ বন্ধ করে দেবার সময় সে ইচ্ছে করেই সেলিমের শরীর থেকে জোর করে চোখ তুলে নিল। ওর খোঁচা খোঁচা দাড়ির ভিতর যে মুখ, যে মুখে একদা বসন্ত হয়েছিল, যে শরীর বাচ্চার জন্ম দিয়েছে—সেই মুখ, শরীর এবং দাড়ি, ওর চোখের সামনে মৃত অক্টোপাসের মতো পচা দুর্গন্ধময় ফুলো ফুলো শব হয়ে যাচ্ছে। সে জোর করে পোর্টহোলের কাচ বন্ধ করে দিল এবং ভয়ে চোখ বুজে ফেলল।
ভোর থেকেই সমুদ্র থেকে হাওয়া উঠে আসছে। ঠান্ডা হাওয়া। বিকেলে সে—হাওয়ার গতি আরও বাড়ল। প্রচণ্ড শীতে বিজন ওভারকোটের পকেটে হাত ঢোকাল এবং কোনোরকমে ম্যাচটা বের করে সিগারেট ধরাল। এখানে হয়তো আরও ঠান্ডা পড়বে, সে ভাবল। প্রচণ্ড শীত মাটির শেষ উত্তাপটুকু যেন শুষে নিচ্ছে। দূরে পাইন গাছগুলো থেকে পাতা ঝরছে। গাছগুলো ক্রমশ হালকা করছে শরীর। তারপর একদিন এই শীতের দৃশ্য প্রস্তরমূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকবে। প্রস্তরীভূত হবে যেন পাইন গাছগুলো। পাখিরা এদেশে থাকবে না। ওরা অন্য দেশে পালাবে। ওরা অন্য দেশে ঘর বাঁধবে। আর্শির মতো আকাশ। রোদের উত্তাপশূন্য হলদে রঙ জাহাজের উপর ছায়া ফেলে অনেক দূর চলে গেছে। পাইনের শাখা—প্রশাখায় পাখির বাসাগুলো ঝুলছে। রোদ সেখানেও যেন চুরি করে উত্তাপ দিচ্ছে। তারপর জেটি অতিক্রম করে পথ। সে পথের মানুষজন দেখতে নিচে নেমে গেল। একটি বাদাম গাছের নিচে দাঁড়াল। এখানে দুটো পথ। সে কোন পথে যাবে চিন্তা করল দাঁড়িয়ে।
দীর্ঘ সমুদ্রযাত্রার পর বন্দর ধরলে এক অনন্য সুখের সন্ধান সে পায় এই মাটির স্পর্শে। বাদাম গাছটার নিচে দাঁড়িয়ে সে কিছুক্ষণ মাটির স্পর্শ নিল। সামনে শুধু শহর। ইট কাঠ। মাটির কোনো গন্ধ নেই সেখানে। সেখানে শুধু যানবাহন, কিছু কৌরীপাইনের ছায়া, পথের দু’পাশে অথবা এভিন্যুর মোড়ে মোড়ে আলো জ্বলছে—কাচের ঘর, মাংসের দোকান, রেস্তোরাঁ, কাফে, পাব। কোথাও ডেইজি ফুলের প্রদর্শনী অথবা আরও পিছনে সমুদ্রের খাঁড়ির অভ্যন্তরে নৌকা—বাইচ। এইসব ভালো লাগলেও মাটির স্পর্শের মতো সুখপ্রদ নয় যেন এরা। তবু সে হাঁটছে। তবু এই মানুষের ভীড়ে, মাটির গন্ধের জন্যে হারিয়ে যেতে ভালো লাগছে। সে দেবনাথের সঙ্গে বের হয়নি। দেবনাথ জাহাজ থেকে নেমে প্রথমেই কোনো পাব অনুসন্ধান করবে, প্রথমে পেট ভরে অন্তত বিয়ার খাবে এবং কোনো পাব অথবা কুকুরের রেসে না গিয়ে এখন শুধু এইসব সুন্দরী রমণীদের ভিড়ে বিজনের হারিয়ে যাওয়া। সে এই ভিড়ে হারিয়ে যেতে চায়। কেমন এক অশ্লীল শরীরী চিন্তায় দু’দণ্ড সে ওদের সঙ্গে কথা বলে সুখ পায়। অথচ সে ওর দেহজ কামনাকে রূপ দেবার ভঙ্গিটুকু এখনও ইচ্ছে করে আবিষ্কার করেনি। মূলত সে ভালো ভাবের জাহাজি হয়ে বাঁচতে চায়।
সে একটা দোকানে ঢুকে কিছু ফল কিনল সেলিমের জন্যে। মেয়েটি ওর হাতে ফলের প্যাকেট দিয়ে মাথা নোয়াল এবং হাসল। বিজন একগুচ্ছ মিমোসা ফুল দেখেছিল মিসিসিপি নদীর তীরে, কোনো যুবতী ওকে ফুলের গুচ্ছটি দিয়েছিল, এ—মেয়ের হাসি সে—যুবতীকে, স্মৃতির কোঠায় এনে দিল।
সে ফলের দাম দিয়ে প্যাকেট হাতে রাস্তায় নেমে এল। ফেল্ট—হ্যাটটা আর একটু টেনে দিল কপালের উপর। এবং ওভারকোট টেনে পথের ভিড়, বিশেষ করে পথের সব ফুলের মতো মেয়েদের দেখতে দেখতে ঝুলন্ত ব্রিজের রেলিংয়ে এসে দাঁড়াল। সমুদ্র থেকে এখন তেমন জোরে হাওয়া উঠে আসছে না। সে এখানে দাঁড়িয়ে তা টের পেল। দুটো খোলা গাড়িতে পুরুষ—রমণীরা হাসতে হাসতে বন্দর থেকে শহরে উঠে যাচ্ছে। দুজন যুবক—যুবতী পরস্পর কোমর ধরে হাঁটছে। সে দেখল—ওরা দুজন নেমে যাচ্ছে এবং নিচে নেমে ব্রিজের থামের আড়ালে দাঁড়াল। সে স্পষ্ট দেখল ওরা রাস্তার উপরই প্রকাশ্য আলোতে কোমর জড়িয়ে চুমু খাচ্ছে। এইসব দেখে বিজন হাঁটতে পারছে না। সস্তায় কিছু মদ এবং সস্তায় যৌন সংযোগের তাড়নায় সে বিব্রত হয়ে পড়ল। নাইটিঙ্গেল ধরে রাত যাপনের ইচ্ছায় সে পীড়িত হতে থাকল। অথচ যেমন করে প্রতি বন্দরে এ—ইচ্ছার জন্ম হয়েছে এবং যেমন করে প্রতি বন্দরে এ—ইচ্ছার মৃত্যু—কামনা করেছে আজও তেমন ধারণার বশবর্তী হয়ে সে হাঁটতে থাকল। ভালো ভাবের জাহাজি হতে গিয়ে সে গোলাপি নেশা করে জাহাজে ফিরবে ভাবল।
সে জাহাজের সিঁড়ি ধরে উপরে উঠে এল। সেলিমের ফোকসালের দরজা বন্ধ। দরজার সামনে সে দাঁড়াল। ডাকল—সেলিম, ঘুমিয়ে পড়েছিস?
সেলিম উঠে দরজা খুলছে। সে বাইরে দাঁড়িয়ে বুঝতে পারছে দরজা খুলতে সেলিমের খুব কষ্ট। তবু সেমিল দরজা খুলবে এবং ওকে একটু ওর পাশে বসতে বলবে। দু’দণ্ড গল্প করতে চাইবে। দেশের গল্প, জোত—জমির গল্প। বিবি—বাচ্চার গল্প। অথবা মাছ এবং বনমুরগি ধরার গল্প। অথবা বর্ষাকালে কোড়া পাখি ধরবার সময় ধানক্ষেতের আলে কেমন করে নৌকায় ঘাপটি মেরে পড়ে থাকতে হয় তার গল্প। তখন দেখলে মনে হবে সেলিম যেন এ—জাহাজেও কোড়া ধরছে। কোড়া পাখি শিকার করছে।