বড় মালোম বললেন, গতকাল তুমি জাহাজিদের উত্তেজিত করেছিলে?
বিজন হাসিল পায়ের নিচে রেখে বলল, হ্যাঁ, স্যার। করেছিলাম।
আমি খুশি হয়েছি শুনে। বড় মালোম কসপকে স্টোর—রুমে যেতে বলে এ—কথাগুলো বিজনকে বললেন।
ওদের ভিতর আর কোনো কথা হল না। একজন জাহাজি ফরোয়ার্ড—পিকে উঠে গেছে। ওরা ওয়ারপিন ড্রাম ঘুরাচ্ছে, ওরা উইঞ্চ চালাচ্ছে। তারপর হাপিজ—হাড়িয়া এই ধরনের কিছু শব্দ। বিজন এবং অন্যান্য জাহাজিরা প্রায় আধঘণ্টা ধরে ফরোয়ার্ড পিকে কাজ করল, বিজন এবং অন্যান্য জাহাজিরা সেলিমের দুঃখ, বন্দরের জীবন এবং দেশে ফেরার অথবা জাহাজে প্রথম দিনের গল্প নিয়ে কিছু সময় মশকরা, কিছু কাঁচা খিস্তি করল। কাজ শেষ হলে নীল উর্দি ছেড়ে ওরা দাঁড়িয়ে থাকল ডেকে। কেউ নিচে নামল না। খাড়ি ধরে জাহাজ বন্দরে ঢুকছে। ওরা দাঁড়িয়ে বিভিন্ন দৃশ্য দেখল। সমুদ্রের খাড়ি ধরে জাহাজ বন্দরে ঢুকছে। দু’পাশে পাথরের পাহাড়; অতিকায় তিমি মাছের মতো কালো কালো সব পাথর। পাথরের পাহাড়। কুৎসিত এইসব পাথরের পাশে ছোট ছোট অনেক রকমের ফার—জাতীয় গাছ। পাতাগুলো শীতের হাওয়ায় কাঁপছে। নিচে সব নৌকো—বাইচ হচ্ছে। দু’পাশের জনতা চিৎকার করছে। এইসব দৃশ্যে ওরা সকলে মাটির গন্ধ নিতে চাইল এবং এই জনতার মতো উন্মত্ত হতে চাইল। এইসব দৃশ্য দেখে বিজন জাহাজি যন্ত্রণার উপশম খুঁজছে।
অথচ বিজন দীর্ঘ দু’সফরে প্রকৃত জাহাজির মতো বাঁচতে গিয়ে মাঝে মাঝে খুব বিব্রত হয়ে পড়ছে। পরিবারের কিছু সংস্কার, বিশেষত ধর্মের—সে কিছুতেই ছাড়তে পারছে না। এখনও বিফ গ্যালিতে এলে সে ভালোভাবে খেতে পারে না। দেবনাথের মতো গোমাংস—ভক্ষণে তৃপ্তি নেই। জাহাজিদের প্রচণ্ড রকমের ইতর জীবনকে সে গ্রহণ করতে পারছে না। অথচ এইসব ইচ্ছাগুলো তাকে মাঝে মাঝে টানে। তখন সে কাঁচা খিস্তি করে, শিস দেয়, অযথা ফোকসালে বসে রঙের টব বাজায় এবং কাপ্তান ও তাঁর পারিষদদের প্রতি বিরূপ মন্তব্য করে।
বিজন একদা কিছু লেখাপড়া করেছিল অর্থাৎ গ্রামের বিদ্যালয়ে দশম শ্রেণি পর্যন্ত পাঠ সমাপ্ত করেছিল। অন্য দশটা অসামাজিক ছেলে—ছোকরার মতো বাড়ি থেকে পালিয়ে জাহাজের খালাসিতে নাম লেখায়নি। বেঁচে থাকার জন্য এবং এই জীবনকে আরও দীর্ঘ করার জন্য এই জাহাজের কাজ, জাহাজি হওয়া। ‘হালিসহর’ এবং ‘ভদ্রা’র ট্রেনিং শেষ করেছে একদা, জাহাজের প্রথম সফরে দুনিয়া ঘুরেছে এবং ইংরেজি বুলিতে রপ্ত হয়েছে। জাহাজি হয়ে উপরি পাওনা হিসাবে চটপট পরিবেশকে মানিয়ে চলার স্বভাব এবং দেহজ আবেগধর্মিতার জন্য মানুষের ভালো করার সুকোমল বৃত্তির কিছু অধিকার সহজে পেয়ে গেছে। সেজন্য সেলিমকে কেন্দ্র করে একটি অশেষ দুঃখ ওকে এখনও মাঝে মাঝে উত্তেজিত করছে। খাড়ির সংকীর্ণতা এবং মানুষের এই আনন্দ সেই অশেষ দুঃখকে যেন আরও বাড়িয়ে দিল। সে বড় মালোমকে বলল, কতদিন থাকব এখানে স্যার? যেন তার জাহাজ ভালো লাগছে না।
বড় মালোম বললেন, বলতে পারছি না। ইঞ্জিন রুমে ইন্সপেকশান আছে।
সারেং বলল, সরফাই হবে জাহাজে। জাহাজ বন্দরে বসবে। ঠিক তখনই বিজন দেখল দুজন জাহাজি সেলিমকে ধরে ধরে বোট—ডেকে তুলছে।
কাপ্তানের সামনে দাঁড়িয়ে সেলিম বলল, সাব, আমাকে দেশে পাঠিয়ে দিন। সারেং ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে কথাটা অনুবাদ করে শোনাল।
কাপ্তান বললেন, আমিও তা চাইছি। হাসপাতালে দিলে ওরা সহজে ছাড়বে না। জাহাজ এখান থেকে তোমার দেশেই যাচ্ছে। এই বলতে গিয়েই দেখলেন কাশির সঙ্গে সেলিমের মুখে রক্ত। সকলের সামনে ধরা পড়ে যাবে ভয়ে সে এখানেও কফটা গিলে ফেলল। কাপ্তান উপলব্ধি করলেন। তাহলে অসুখটা অনেক দূর গড়িয়েছে। কোম্পানির ওষুধ এবং ইনজেকশন কোনো কাজে আসেনি। তিনি সারেংকে ডেকে বললেন, ওকে সকলের সঙ্গে রাখা চলবে না। ওকে ওপরে তুলে আনো এবং কোনো খালি কেবিনে ফেলে রাখ। ওর ভাতের থালা এবং মগ ভিন্ন করে দাও। তোমরা কেউ ওর জিনিসপত্র ব্যবহার করবে না। কাপ্তান সারেংকে অন্যত্র নিয়ে কথাগুলো বললেন। বললেন, সাবধান, কেউ যেন জানতে না পারে সেলিম খারাপ রোগে ভুগছে। যে ক’টা দিন বাঁচে এ—জাহাজেই বাঁচুক।
তারপর তিনি সেলিমের সামনে বললেন, জাহাজ বন্দরে ভিড়লেই তোমাকে কোম্পানির ভালো ডাক্তার দেখানো হবে। আশা করছি তুমি শীগগিরই ভালো হয়ে উঠবে। ‘ঈশ্বর তোমায় করুণা করুন’ এই বক্তব্যে তিনি স্বয়ং জেসাস—এর মতো চোখ বুজলেন।
বাড়িয়ালার এই পাদ্রিসুলভ চেহারাতে সারেং বিমুগ্ধ হল। পির—পয়গম্বরের মতো তিনি হয়তো কোনো ওক্তে সারেংকে দোয়া জানাবেন। সে এবারে বলল, সাব, ইউ ফাদার। ইউর শিপ, ইউর ম্যান, ইউ সি সাব এভরিথিং। সারেং এইসব বলে এই মুহূর্তে দোয়া ভিক্ষা করছে। অর্থাৎ সেলিমের প্রতি বিগলিত করুণার অংশীদার হতে চাইছে।
বিজন ডেকে কাজ করতে করতে সব দেখল। সে জাহাজ জেটিতে বাঁধতে দেখল। বন্দরের পথ ধরে সব শহরবাসীরা সামনের ঝুলন্ত ব্রিজের দিকে যাচ্ছে। কিছু টিনের শেড অতিক্রম করে মাঠ। সেখানে মেয়েপুরুষরা এই শীতেও ক্রিকেট খেলছে। সে দেখল সেলিমকে ডেকের উপর দিয়ে দুজন লোক সেই নিঃসঙ্গ কেবিনটায় নিয়ে যাচ্ছে। সেলিম সেখানে থাকবে, সেখানে খাবে, সেখানে শোবে। বিজন এও বুঝল যেন সেলিম আর বেশি দিন বাঁচবে না। জাহাজের ওই ঘরটাতেই অন্য দিন বিজন এবং অন্যান্য কয়েকজন জাহাজি মিলে কিছু পাথর, দুটো বড় গানি—ব্যাগ যত্ন করে এক কোণায় রেখে দিয়েছিল। জাহাজে মৃত্যু হলে সমুদ্রে এই সব পাথর এবং গানি—ব্যাগ দিয়ে সলিল—সমাধি দেওয়া হবে। দেহজ আবেগধর্মিতার জন্য ওর সুকোমল বৃত্তিরা ওকে ফের অশেষ যন্ত্রণাতে আচ্ছন্ন করে দিচ্ছে। কাপ্তানের নিষেধ আছে বলে সে আর ঘরে ঢুকল না। পোর্টহোলের কাচ ফাঁক করে দেখল, সেলিম বাংকে শুয়ে সেই পাথর এবং গানি—ব্যাগগুলো দেখছে। শরীরটা ওর স্থির। সে এখন কফ চুরি করে গিলে খাচ্ছে না। এখন সে নিচের পাত্রে কফ ফেলছে। এবং সঙ্গে কিছু রক্ত পুঁজ ফেলছে। পোর্টহোল দিয়েই বিজন কথা বলল, বিকেলে ভাবছি কিনারায় যাব। তোর জন্য কিছু আনব কি?