একজন বলল, জাহাজি বলে আমরা গোরু—ভেড়া নই।
অন্যজন বলল, জাহাজি বলে আমরা বিনা নোটিশে মরব তেমন দাসখত দেওয়া নেই।
অথচ দেবনাথ বলল, বিজন, এটা নিয়ে তোমার ক’সফর জাহাজে?
বিজন বিস্মিত হল। দেবনাথ ভালো ভাবেই জানে এটা ওর ক’নম্বর সফর। ভালো ভাবেই জানে প্রথম সফরে সে কোন কোম্পানির কোন জাহাজে কাজ করেছে। তবু দেবনাথ যখন এমন একটা প্রশ্ন করল এবং দেবনাথ যখন খুব জরুরি ভাবে ওকে প্রশ্নটা করেছে তখন একটা যথোচিত উত্তর দেওয়াই যুক্তিসংগত। সে বলল, তুমি তো জানো দেবনাথ—এটা আমার দু’নম্বর সফর।
এখনও তুমি ঠিক জাহাজি হওনি। তারপর কী ভেবে বিজনকে দেবনাথ অন্য ফোকসালে নিয়ে গেল। এখানে কেউ নেই, কেউ থাকে না। জাহাজিরা এখানে কাজে যাওয়ার আগে জামাকাপড় ছাড়ে। ঘরটা একেবারেই খালি। দেবনাথ ভিতর থেকে দরজা বন্ধ করে দিল। এবং বলল, তুমি এর মধ্যে থেকো না। শেষে সকলে বেঁচে যাবে, কেবল তুমি মারা পড়বে। কাপ্তান তোমার নলি খারাপ করে দেবে। তখন তোমার পিছনে ওরা কেউ দাঁড়াবে না। আমি ওদের ভালো করে চিনি।
বিজন কথা বলল না। চুপ করে দেবনাথের পরামর্শ শুনল। শেষে জবাব দিল, কিন্তু সেলিম যে মরে যাবে?
মরে যাবে তো তুমি কী করবে? তোমার উপর ট্যান্ডল আছে, সারেং আছে—ওরা দেখছে না, তুমি দেখে কী উপকারটা সেলিমের করবে? এটা মাত্র তোমার দু’সফর। অনেক দেখবে কিন্তু জাহাজে বিদ্রোহ করলে চলবে না।
তার জন্য কোনো প্রতিকারের দাবি আমরা তুলব না!
দেবনাথ খুব অভিজ্ঞ লোকের মতো বলল, বম্বের নৌবিদ্রোহের আমি আসামি। তাই তোমাকে এতগুলো কথা বললাম। তোমাকে মাস্তার দিতে বারণ করলাম। তা ছাড়া আমি এইসব জাতভাইদের চিনি। ওরা শেষ পর্যন্ত তোমার কথা কেউ বলবে না। ওরা ওদের জাতভাইদের কথা বলবে, সারেঙের কথাই শুনবে। মাঝখান থেকে তুমি ব্ল্যাক—লিস্টেড হবে।
বিজন আর কোনো কথা না বলে দরজা ঠেলে বের হয়ে এল। সে দেখল, সকলে ওর ঘরে তখনও পরামর্শ করছে। সকলে উদগ্রীব হয়ে আছে। বিজনকে দেখে ওরা বলল, চল, মাস্তার দি বোট ডেক—এ।
বিজন দেবনাথের কথাগুলো আর একবারের জন্য ভেবে নিল। আর একবারের জন্য সকলের মুখ দেখল। সকলের মুখ ভয়ানক হয়ে উঠেছে। বিজন বুঝতে পারল—এই সমস্ত মুখের ছবি মিথ্যা হবার নয়। ওরা কখনোই ওকে অন্ধকার পৃথিবীতে ঠেলে দেবে না। বিজন দৃঢ় গলায় কিছু বলতে যাচ্ছিল, তখন সারেঙ নিচে নেমে এসে ডাকল, ইসকান্দার, সামসুদ্দিন, রহমান, শোভান। ওরা ধীরে ধীরে ঘর থেকে একান্ত বশংবদের মতো বের হয়ে যাচ্ছে। সারেং বলল, কাপ্তান তোমাদের সঙ্গে কথা বলবেন।
এই ঘটনায় বিজন খুব ভেঙে পড়ল। এবং অসহ্য উত্তেজনায় ভুগতে থাকল। প্রচণ্ড শীতের ভিতর সে ওর নিচের ঘরে পায়চারি করছে। দেবনাথ উপরের বাংকে শুয়ে নির্বিঘ্নে ঘুমোচ্ছে। পোর্টহোল দিয়ে ঠান্ডা হাওয়া আসছে বলে বিজন কাচটা বন্ধ করে দিল। সারেং—এর সেই রক্তচক্ষুর কথা মনে হল এবং ভাবল কত সহজে সব নাবিকদের নিয়ে সে উপরে উঠে গেল। সে এই ফোকসালে, এই ঠান্ডায় পায়চারি করতে করতে ধরতে পারছে। ধরতে পারছে—সারেং ওদের কী বলছে এবং কী বলে ওদের প্রত্যয়কে ভেঙে দিচ্ছে। সেলিম এখনও কাশছে তার ফোকসালে—ফোকসালের অন্য বাসিন্দা কোরাণ—শরীফ পাঠ করছে বাংকে। সে পায়চারি করতে করতে সব শুনল। জাহাজটা নোঙর ফেলে আছে বলে স্টিয়ারিং ইঞ্জিনে কোনো শব্দ নেই। সবাই কেমন নিঃসঙ্গ, সব কেমন নিঃশব্দ যেন। ডেক থেকে সারেং—এর কথা ভেসে আসছে। সকলকে সারেং জোর গলায় কথাগুলো বলল। বলে ওদের ভয়ংকর বিদ্রোহের প্রতিবিম্ব মুছে দিল। সারেং ওদের বলল, তোরা তো জানিস কলকাতা বন্দরে চল্লিশ হাজার নাবিক খোদা হাফেজ বলত, এখন কিছু কিছু লোক ঈশ্বর, ভগবান বলতে শুরু করেছে। তোরা যদি বাঙালিবাবুদের কথায় মাতিস, তোরা যদি জাহাজে বিদ্রোহ করিস তবে তোদের চল্লিশ হাজার চল্লিশে নামতে আর বেশি দেরি নেই।
একসময় কাপ্তান সারেঙকে ডেকে পাঠালেন।
ব্রিজ থেকে কাপ্তান বললেন, কী বলছে সব?
ভাঙা ভাঙা ইংরেজি এবং হিন্দিতে ডেক—সারেং বলতে থাকল, সব গুড, সাব। সব ঠিক হ্যায়। জাহাজি লোক ভেরি গুড, সাব। বাঙালি বাবুলোক নো গুড, সাব। বাঙালি বাবুলোক গিভস ট্রাবল। বাঙালি বিজন, ইয়েস বিজন তেইল রূপায়াকা খালাসি, ও তো সাব রিংলিডার আছে। দুটো—চারঠু ইংলিশ স্পিকিং আছে, সাব। প্যাসেন্টকে লিয়ে কুছ ফাইট দেনে মাংতা। লেকিং নাও অলরাইট, সাব। বিগ বিগ টক লেকিন নো জব। ভেরি লেজি বাগার। সারেঙ এই পর্যন্ত বলে পায়ের কাছে থুথু ফেলল। ফের মুখ তুলতেই দেখল বাড়িয়ালা নিজের কেবিনে ঢুকে গেছেন। কেবিনে পেয়ালা—পীরিচের শব্দ। নিচে অফিসার—গ্যালিতে চিফ কুক আগুন পোহাচ্ছে। সিঁড়ি ধরে নামবার সময় সে এখানেও থুথু ফেলল।
সমুদ্রে সূর্য উঠছে। একদল পাখি উড়ছে আকাশে। দূরে ইতস্তত জাহাজ নোঙর করা। অনেকগুলো বয়া অতিক্রম করে পাইলট—শিপ। অনেকগুলো জেলেডিঙি এই শীতের ভোরেও মাছ ধরতে বের হয়ে পড়েছে। আকাশ নীল, সমুদ্র নীল। জাহাজের চিমনি দিয়ে ধোঁয়া বের হয়ে সমুদ্রে নেমে যাচ্ছে। ওরা সমুদ্র ধরে উপকূলে উঠে যাচ্ছে। উপকূলের স্কাই—স্ক্যাপারগুলো ম্যাচবাক্সের মতো মনে হচ্ছে। এইসব দেখার জন্য জাহাজিরা ডেকে দাঁড়াল। অথবা দড়িদড়া টানার জন্য ডেক থেকে টুইন—ডেকে নেমে যাচ্ছে। এখন ওরা দড়িদড়া টানছে। হাসিল নিচে নামিয়ে দিতে চাইছে। মেজ মালোম গলুইয়ে চলে এসেছেন। বড় মালোম ফরোয়ার্ড—পিকে চলে গেছেন। বিজন হাসিল কাঁধে বড় মালোমের পিছনে ছুটছে। তিনটে টাগবোট এসেছে, পাইলট এসেছেন। পাইলট ডেক থেকে বোট—ডেকে এবং ব্রিজে উঠে গেলেন।