স্টুয়ার্ড একধারে ফুলগুলি রেখে মর্লিনের মুখটা ঠিক করে দিল। তারপর গাউনটা টেনে পায়ের নিচটা পর্যন্ত ঢেকে দিল। তারপর বাসি ফুলগুলো যত্ন করে সরিয়ে দেবার সময় বলল, মনে হয় আমরা আমাদের প্রিয়জনের পরিচর্যা করছি। আমাদের এত যত্ন মর্লিন বেঁচে থাকতে পেত!
সুখানী বলল, আচ্ছা স্যার, এসব করার হেতু কী? কী দরকার এই ফুল সংগ্রহের। কী দরকার প্রতি রাতে এ—ভাবে… আমাদের আমাদের বিশ্বাস অবিশ্বাস যুক্তির যে ধর্ম থাকছে না।
বড় মিস্ত্রি বাধা দিয়ে বললেন, মৃতের প্রতি সম্মান দিতে হয় সুখানী। মর্লিনকে এখন যত সুন্দর মনে হচ্ছে, যত স্বচ্ছ মনে হচ্ছে, ওকে আমরা এখন যত ভালোভাবে দেখতে পারছি…
স্টুয়ার্ড মাঝপথেই বলে ফেলল, মর্লিন যে সত্যের জোরে বেঁচে ছিল এতদিন, মরে গিয়ে সেই সত্যকে সে আবিষ্কার করল, কী বলেন স্যার? আর সেজন্যই বোধহয় ওকে আমরা এত ভালোবেসে ফেলেছি।
সুখানী বলল, কীসব বলছ পাগলের মতো। বলে যে মর্লিনের শক্ত হাত পাগুলিকে ঠিক করে দিল। চুলগুলি যত্ন করে গুছিয়ে দিল। তারপর টেবিলটাকে প্রদক্ষিণ করার সময় ষাঁড় গোরু অথবা শূকরের মাংস ঝুলতে দেখে জীবন সম্পর্কে কেমন উদাসীন হয়ে পড়ল। সে চেয়ারে বসে মর্লিনের পায়ের কাছে মাথা রেখে ঘুম যাবার ভঙ্গিতে হাত পা টানা দিতে গিয়ে বুঝল এই শরীর এখন মলমূত্রের আধার। অথচ মর্লিনের চোখ পাথরের মতো। বড় মিস্ত্রি মর্লিনকে নিবিষ্ট মনে দেখছেন, স্টুয়ার্ড গল্প আরম্ভ করেছে।
সে বলল, তখন আমি জাহাজের তেলয়ালা সুমিত্র। সে বক্তৃতার কায়দায় বলল, স্যার আপনি আছেন, নচ্ছার সুখানী আছে আর এই সম্মানীয়া অতিথি—আমাদের এই মহত্তর ঘটনার স্মৃতিমন্থনই আশা করি আমাদের সুস্থ করে তুলবে।
সুখানী বলল, তাহলে বুঝতে হবে মাথাটা আর ঠিক নেই।
চুপ রও বেয়াদপ! তুমিই সব নষ্টের গোড়া। বলে মুখ ঢেকে বসে পড়ল। সে কিছু বলতে পারছিল না; ওর কষ্ট হচ্ছে বলতে। সে আবেগে কাঁপছিল। সে ধীরে ধীরে বিগত জীবনে চেরি নামক এক রাজকন্যার গল্প শোনাল। তার আর চেরির গল্প। জাহাজি জীবনের অপূর্ব এক প্রেম ভালোবাসার গল্প।
স্টুয়ার্ড গল্প শেষ করে মর্লিনের মাথার কাছে দাঁড়াল এবং ওর চোখ দুটোতে চুমু খেল। বলল, আমাদের ছোট এবং স্বার্থপর ভেব না, মর্লিন।
সারা ঘরময় সুখানী এখন কোনো মাংসের শরীর দেখতে পাচ্ছে না। দূর থেকে আগত কোনো সংগীতের ধ্বনি যেন এই ঘরে বিলম্বিত লয়ে বেজে চলেছে। সে থেকে থেকে কবিতার লাইন বারবার আবৃত্তি করল। এবং এই আবৃত্তির ভিতরেই সে এলবিকে স্মরণ করতে পারে।
ওরা তিনজন আজও ফুল রাখল মর্লিনের শরীরে। ওরা উঠে যাবার সময় কোনো বচসা করল না। ওরা কোনো সমাধি ক্ষেত্র থেকে ফিরে আসছে যেন এমত এক চোখ—মুখ সকলের।
বন্দরে এটাই ওদের শেষ রাত ছিল। ভোরের দিকে জাহাজ নোঙর তুলবে। ওরা তিনজন প্রতিদিনের মতো বসল। প্রতিদিনের মতো বাসি ফুলগুলি মর্লিনের শরীর থেকে তুলে ভিন্ন জায়গায় রাখল।
বড় মিস্ত্রি দু’হাত প্রসারিত করে দিলেন টেবিলে। সুখানী দীর্ঘ সময় ধরে উপাসনার ভঙ্গিতে বসে থাকল। সে তখন চোখ বুজে একটি বিশেষ দৃশ্যের কথা স্মরণ করে গল্পটা আরম্ভ করতে চাইছে।
সুখানী বড় মিস্ত্রিকে উদ্দেশ্য করে বলল, তখন স্যার আমার নাম ছিল বিজন। তখন আমি সুখানী হইনি। বলে, গল্পটার ভূমিকা করল।
তারপর আস্তে আস্তে বিজন এক অব্যক্ত বেদনার গল্প শোনাল। জাহাজের বাতাস পর্যন্ত স্তব্ধ হয়ে শুনল বিজনের গল্প। একসময় বিজন গল্প শেষ করে অবসন্ন ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়াল। সে এখন মর্লিনের কপাল থেকে চুল সরিয়ে দিচ্ছে। সে যেন এই কপালের কোথাও কিছু অন্বেষণ করে বেড়াচ্ছে।
বড় মিস্ত্রি এত অভিভূত যে গল্প শেষ হবার পরও তিনি কিছু সময় ধরে বিজনের মুখ দেখলেন। তিনি বিজনকে মর্লিনের কপালে নুয়ে পড়তে দেখে বললেন, কী দেখছ সুখানী?
সুখানী বড় মিস্ত্রির কাছে এল এবং বলল, Peace is on her forehead. Peace-কে অন্বেষণ করছি স্যার। মর্লিন সারাজীবন ঝড়ে নৌকা বেয়ে এখন গভীর সমুদ্রে বৈতরণী পার হচ্ছে। এইটুকু বলে বিজন পুনরায় এলবির সেই কবিতাটি একটু অন্যভাবে আবৃত্তি করল—
‘‘She had dropped the sword and
dropped the bow and the arrow : peace
was on her forehead, and she had
left the fruits of her life behind herself
on the day she marched back again to
her master’s hall.’’
জাহাজ ছাড়বার সময় ওরা তিনজন নিজেদের কাজে ব্যস্ত ছিল। শীতের প্রকোপ কমে গেছে। সুখানী, স্টুয়ার্ড এবং অন্যান্য সকল জাহাজিরাই বন্দর থেকে চোখ তুলে নিল। বন্দর ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছে। বন্দরের আলো ঘর বাতি সবই একে একে সমুদ্রের ও—পাশে হারিয়ে গেল। আবার ওরা, সকল জাহাজিরা দীর্ঘদিন এই সমুদ্রে রাত যাপন করবে। ওরা বন্দরের জন্য আকুল হবে ফের। এবং মাটির স্পর্শের জন্য হবে ভয়ংকর মরিয়া।
বড় মিস্ত্রি ডেক ধরে হেঁটে ডেক—কসপের ঘরে ঢুকলেন। বললেন, আমাকে কিছু তক্তা দাও কসপ। করাত, হাতুড়ি বাটালি দাও। কিছু পেরেক লাগবে। সব আমার ঘরে রেখে এসো।
বড় মিস্ত্রি এবং স্টুয়ার্ডের কোনো ওয়াচ ভাগ নেই বলে ওরা খুশিমতো নিচে নেমে যেত। ওরা সন্তর্পণে সকলের আড়ালে সেই কাঠ, পেরেক নিচে নিয়ে গেল।