জাহাজিরা কেউ বলেছে, সিডনি থেকে পুরানো লোহা নিয়ে জাহাজ যাবে জাপানে।
কেউ বলছে, গম নিয়ে তেলবাড়ি।
সেলিম এইসব খবরে বিষণ্ণ হয়েছে। খুব অসহায় ভঙ্গিতে পোর্টহোলে মুখ রেখে দিগন্তরেখায় নিজের দেশকে খুঁজেছে। কখনও অপলক সমুদ্র দেখেছে। জলের নীল বিস্তৃতি দেখেছে।
সেলিম স্থির করল কাপ্তানকে শেষবারের মতো বলবে, আমায় দেশে পাঠিয়ে দিন, মাস্টার। ঘরে ফিরে আমি বিবির কোলে মাথা রেখে মরব। জাহাজে আমি মরব না। বিদেশ—বন্দরে আমি মরব না। শুয়ে শুয়ে সেলিম এইসব ভেবে উত্তেজিত হতে থাকল।
তখন সিঁড়িতে শিস দিচ্ছে বিজন। সেলিম শুয়ে শুয়ে শুনছে। এ—কেবিন সে—কেবিন সে উঁকি মারল। এঞ্জিন—পরীদাররা ঘুমোচ্ছে। এনজিন—পরীদাররা (যারা চারটা—আটটার পরীদার) গল্প করছে। বিজন লক্ষ করল শিস দিতে দিতে, সতেরো মাস সফর ওদের ক্লান্ত করতে পারেনি। বিষণ্ণ করতে পারেনি। জাহাজটা আরও যদি সতেরো মাস সমুদ্রের নোনা জল ভাঙে, যদি আরও সতেরো মাস বন্দরে না ভিড়ায় তবু নিশ্চিন্ত নির্ভয়ে জাহাজ চালিয়ে যাবে। বিজন দ্বিতীয় সিঁড়ির মুখেই শুনল—সেলিম কাশছে। কাশির জন্য দম নিতে পারছে না। বিজন আর শিস দিল না। প্রতিদিনের মতো সে ফের সেলিমের জন্য কষ্ট পেতে থাকল। সে ফোকসালে ঢুকে বলল, একবার কাপ্তান সাহেবকে বল হাসপাতালে দিতে। এভাবে আর কতদিন বাংকে পড়ে থাকবি। রাতে জাহাজ বন্দর ধরবে।
সেলিম মুখের ওপর থেকে কম্বলটা সরাল। চোখ দুটোতে নোনা পানি অথবা আকাশের রঙ নয়, কালো রঙ নয়, অথবা বেতফলের মতো রঙও ধরতে নয়—অথচ আশ্চর্য এক রঙ ধরেছে যা দেখলে সকলের ভয় হবে। অথচ মায়া হবে। সকলের মনে হবে, সেলিম রহমানে রহিম হওয়ার জন্য শরীর স্থির করতে চাইছে। এবং বাংকের সঙ্গে মিশে গিয়ে অদৃশ্য হতে চাইছে।
বিজন বলল, বলিস তো আমরা সকলে মাস্তার দি’। সারেংকে বলি মাস্তার দিতে। এভাবে আর কতদিন ভুগবি। জ্বর কাশি—দেখে—শুনে তো ব্যাপারটা ভালো লাগছে না।
সেলিম সহসা উঠে বসল। তারপর আশ্চর্য রকমের স্নিগ্ধ এবং করুণাঘন মুখ করে হাসল। তারপর ফের দুঃখময় প্রকাশে বলল, বিজন রে, তোর মতো যদি একটু ইংরেজি বুলি জানতাম, তবে আমার সব হত। সারেঙ আর কাপ্তান কী বুদ্ধিই ধরেছে খোদাই জানে। তুই সকলকে বলে কয়ে মাস্তার দে। আমাকে দেশে পাঠিয়ে দিতে বল। দেশে ফিরে বাঁচি।
বিজন এই বাংকে বসে কী করে যেন বুঝল সেলিমের এই দুরারোগ্য রোগ নিয়ে জাহাজে ষড়যন্ত্র চলেছে। সে ভেবে অবাক হল কেন সে সারেংকে বলল না, ওকে এবার অন্য ঘরে না রেখে উপায় নেই, অথবা কেন যে মেজ মালোমকে ডেকে একবার চিকিৎসার সুব্যবস্থার কথা বলতে পারেনি এতদিন! সেও আজ পোর্টহোল দিয়ে সমুদ্র দেখল। তারপর উপকূল। উপকূলে পাখিরা ফিরে যাচ্ছে। সেলিমের মুখ পাণ্ডুর। জাহাজটা চলছে এবং সেলিমের শরীর নড়ছে। সেলিমকে দেখলে আত্মহননের কথা মনে হয়। বিজন বাংক থেকে ওঠার সময় সেলিমকে ফের লক্ষ্য করল, ওর কম্বলের ভিতর থেকে ধোঁয়া বের হচ্ছে। সে হাসল। সেলিমও হাসল। ওরা পরস্পর দুঃখটুকু ধরতে পেরে ফের দুজনই অন্যমনস্ক হতে চাইল। বিজন দরজা ধরে বের হচ্ছে। সারেং—এর ঘরে উঁকি মেরে সে দেখে, তিনি নেই। ফোকসালে নেই। নিশ্চয়ই মেজ মালোমের কেবিনে অথবা ফরোয়ার্ডপিকে আছেন। বিজন ডেকের উপর দিয়ে ধীরে ধীরে হাঁটতে থাকল।
বন্দরে জাহাজ ভিড়বে বলে সারেং ডেক—কসপের নিকট দড়িদড়া সব বুঝে নিচ্ছে। বিজন ডেক অতিক্রম করে কসপের ঘরের দিকে যাচ্ছে। সে একবার দাঁড়াল। বড় মালোমের পোর্টহোলে উঁকি দিল। বড় মালোম কেবিনে নেই। বিজনের ইচ্ছা হল বড় মালোমকে বলতে—আপনার জাহাজে এমন একটা মারণ রোগ পুষে রাখছেন, সেলিমকে হাসপাতালে দেওয়া হবে না, দেশে পাঠানো হবে না, কোম্পানির টাকা বাঁচানো হবে, অন্যান্য জাহাজিরা পর্যন্ত নিরাপদ নয়—এমতাবস্থায়ও আপনারা চুরি করে মদ গিলতে পারছেন!—আশ্চর্য! সে ভেবে আশ্চর্য হল। সে হাঁটল।
সে সারেঙকে বলল, চাচা চোখ বুজে আর কতদিন থাকবেন?
সারেং ফিসফিস করে বলল, তোমার এত মাথাব্যথা কেন? বেশ তো আছ। সফর করছ। তোমার তো কোনো অসুবিধা করছে না কোম্পানি।
সেলিমের মুখ দিয়ে কফের সঙ্গে রক্ত উঠছে। আপনি জানেন এটা অন্যান্য জাহাজিদের পক্ষে কত ক্ষতিকর। তাছাড়া দেখছি সেলিম বিনা চিকিৎসায় মারা যাবে। এ নিয়ে পাঁচ বন্দর হল অথচ কোনো বন্দরেই ওকে হাসপাতালে দেবার ব্যবস্থা করছেন না।
সব জানি বাপু। সব বুঝি বাপু। অথচ জেনেশুনেও চুপ করে আছি। বাড়িওয়ালার ইচ্ছা নয় সেলিম হাসপাতালে থাকুক। কোম্পানির অযথা এত খরচ করাতে বাড়িয়ালা রাজি হচ্ছে না।
তবে ওকে দেশে পাঠিয়ে দিন। দেশে পাঠিয়ে দেবার ব্যবস্থা করুন।
দু—একজন করে তখন অন্য জাহাজিরাও ওর চারপাশে জড়ো হচ্ছে। ওরা শুনছে ওরা সারেং—এর মুখ দেখছে। বিজনকে চিন্তিত দেখাচ্ছে। সেই লঘু পরিহাসজনিত অথবা হালকা সুরের শিস দেওয়া মুখ কোথায় যেন অদৃশ্য হয়ে গেছে। সমুদ্রের উদার নীল বিস্তৃতিতে ওরা কয়েকজন কেমন অসহায়ের ভঙ্গিতে ডেকে পদচারণা করছে। এনজিনের শব্দ, সমুদ্রের তরল ঠান্ডা হাওয়া ওদের নিঃশব্দ এই ভাবটুকুকে নিদারুণ দুঃখময় করে তুলছে।
রাত্রিতে সব জাহাজিরা যখন একত্রিত হল, একমাত্র আটটা—বারোটার পরীদাররা যখন নিচে বয়লারে কয়লা মারছে, যখন ওরা সকলে শুনল, জাহাজ বন্দর ধরবে সকাল দশটায়—রাতে আর পাইলট—বোট আসছে না, ডেক—জাহাজিরা নিশ্চিন্তে ঘুমোতে পারে, তখন ওরা বিজনের ঘরে জড়ো হয়ে বলল, আমরা সকলে একযোগে বিদ্রোহ করব। আমরা সকলে জাহাজ চালাব না। কাপ্তান আসুক, ডেক—সারেং আসুক, কেউ আমাদের নড়াতে পারবে না। আমাদের কথা শুনলে আমরা ওদের কথা শুনব। সেলিমকে হাসপাতালে পাঠালে অথবা দেশে পাঠালে আমরা কাজে যাব। জাহাজ চালাব।