স্টুয়ার্ড বলল, আসুন, স্যার, একসঙ্গে নামি। একা একা নামতে ভয় করছে। স্টুয়ার্ড হাতের দস্তানা বের করল বালিশের ভেতর থেকে। ওভারকোট নিল এবং জুতো জোড়া বের করার সময় সুখানী চিৎকার করে উঠল, স্টুয়ার্ড একটা রাস্কেল। স্যার, সে মর্লিনকে হুক থেকে নামায়নি। আমি যাব না স্যার, আমার বীভৎস দৃশ্য সহ্য হবে না।
বড় মিস্ত্রি প্রাজ্ঞ ব্যক্তির মতো হাসলেন। বললেন, ওটা বীভৎস বললে চলবে কেন সুখানী?
স্টুয়ার্ড বলল, আপনিই বলুন স্যার।
বড় মিস্ত্রি ফের বললেন, আমরা এই মানুষেরা বীভৎস স্থানটুকুর জন্যই লড়াই করছি। সংগ্রাম বলতে পারো অথবা লোভ লালসা, চরম কুৎসিত বস্তুটির জন্য আমাদের কামুক করে রাখে। এবার বড় মিস্ত্রি সুখানীকে দু’হাতে ঠেলে রসদ ঘরে ঢুকিয়ে দরজা বন্ধ করে বললেন, তুমি যদি পা দুটো উপরের দিকে ঠেলে দিয়ে দেখ, কী দেখবে সুখানী? একটা মুখের মতো অবয়ব দেখবে, নাক দেখবে, গহ্বর দেখবে। শুধু চোখ নেই। কবন্ধের মতো অথবা অন্ধ বলতে পারো। আর অন্ধ বলেই সকল অত্যাচার নীরবে সহ্য করছে। অন্ধ বলেই এত কুৎসিত, এত ভয়ংকর এবং আমাদের এত ভালোবাসা।
রসদ ঘরে আলু পেঁয়াজের গন্ধ। ডিমের শুকনো গন্ধ। বাসি বাঁধাকপির গন্ধ মলমূত্রের মতো। সুখানী ফুলগুলি এবার বুকে চেপে ধরল। স্টুয়ার্ড বরফ—ঘরের দরজা খুলে বড় মিস্ত্রিকে দেখাল—কিছু কি দেখতে পাচ্ছেন স্যার?
বড় মিস্ত্রি যথার্থই কিছু দেখতে পেলেন না। সারি সারি হুকে বড় বড় ষাঁড়ের শরীর ঝুলছে। ভেড়া এবং শূকর। টার্কির শরীর পর্যন্ত। সব এক রঙ। এক মাংস। এবং শুধু ভক্ষণের নিমিত্তই তৈরি। তিনি নিজেই এবার ভয়ে চিৎকার করে উঠলেন, মর্লিন কোথায় স্টুয়ার্ড!
ওরা একটি টেবিল সংগ্রহ করে মর্লিনকে সযত্নে তার উপরে রেখে দিল। পোশাক পরানো হল। পায়ে জুতো এবং ফুলগুলি ওর মাথার কাছে রেখে ওরা বসে থাকল নির্বোধের মতো। বড় মিস্ত্রি পায়ের দিকটায় বসে আছেন। দু’পাশে সুখানী এবং স্টুয়ার্ড। ওরা মর্লিনের মুখ দেখছিল। যত ওরা মৃত মুখ দেখছিল তত ওদের এক ধরনের আবেগ গলা বেয়ে উঠে আসছে। ওর প্রতি আচরণে এতটা নির্বোধ না হলেও চলত এমত এক চিন্তার দ্বারা প্রহৃত হচ্ছে। বড় মিস্ত্রিই বললেন, এই মৃত রমণীর কাছে আমাদের জীবনের এমন কী মহত্ত্ব ঘটনা আছে যা বলতে পারি—তিনি এইটুকু বলে উঠে দাঁড়ালেন—এমন কী ঘটনা আছে জাহাজি জীবনে যা বলে এই তীক্ষ্ন বিষণ্ণতা থেকে পরিত্রাণ পেতে পারি?
সুখানী বলল, ভয়ংকর কষ্ট হচ্ছে। এইটুকু বলে চিবুকে হাত রাখে সুখানী। কিছুক্ষণ কী যেন দেখল সমস্ত ঘরটার ভিতর। পাশের একটা ষাঁড়ের শরীর ঝুলছে। এবং মাঝে মাঝে ওর শরীরে এসে ধাক্কা দিচ্ছে যেন। সে বলল, আমরা সকলেই জীবনের কোনো না কোনো মহত্তর ঘটনা বলব। চিরদিন আমরা এমন ছিলাম না।
স্টুয়ার্ড বলল, মহত্তর ঘটনা বলতে পারলে ফের আমরা ঘুমোতে পারব।
বড় মিস্ত্রি পায়ের কাছটায় বসলেন আবার।
স্টুয়ার্ড দেখল ওদের সকলের চোখ ধীরে ধীরে কোটরাগত হচ্ছে। চোখের নিচে এক ধরনের অপরাধবোধের চিহ্ন ধরা পড়েছে। সে সুখানীকে বলল… আচ্ছা সুখানী, আমার চোখের নিচে কালি পড়েছে!
আয়নায় দেখো। আমার তো মনে হয় তোমারই সবচেয়ে বেশি!
সুমিত্র, বড় মিস্ত্রি অবনীভূষণকে উদ্দেশ্য করে বলল, স্যার, কাপ্তান আমাকে বলেছেন, তোমার কি কোনো অসুখ করেছে স্টুয়ার্ড? তোমাকে খুব পীড়িত দেখাচ্ছে!
অবনীভূষণ বললেন, তুমি আবার বলনি তো, রাতে স্যার ঘুম হচ্ছে না। কেমন এক অশরীরী পাপবোধ চারধারে ঘোরাফেরা করছে। বলনি তো?
আমি পাগল নাকি স্যার! আমি এমন কথা বলতে পারি?
সুখানী এবার কঠিন গলায় বলল, তুমি শালা পাগল। আলবত পাগল। পাগল না হলে একটা রুগণ বেশ্যা মেয়েকে কেবিনে কেউ তুলে আনতে পারে?
স্যার, আপনি শুনুন। নালিশের ভঙ্গিতে বলল সুমিত্র।
সুখানী, তুমি বেশ্যা বলবে না। মর্লিন বেশ্যা হলে তোমার মা—ও বেশ্যা।
বড় মিস্ত্রি তার মাকে বেশ্যা বলেছে—বিজন ভাবল। সে সুখানী জাহাজের আর অবনীভূষণ বড় মিস্ত্রি জাহাজের। সুতরাং বড় মিস্ত্রির বিজনের মাকে বেশ্যা বলার এক্তিয়ার আছে। সুতরাং বিজন চুপচাপ বসে থাকল। কোনো জবাব দিল না। নির্বোধের মতো তাকাতে থাকল ফের ঘরের চারিদিকে।
সুমিত্র আর দেরি করতে চাইল না। সে বলল, স্যার আমার জীবনে একটা মধুর ঘটনা আছে। অনুমতি দিলে বলতে পারি।
বলবে? অবনীভূষণ অদ্ভুতভাবে ঠোঁট চেপে কথাটা বললেন।
হ্যাঁ স্যার, আগেই বলে ফেলি। আগে আগে যদি একটু ঘুমোতে পারি।
বলো।
সুমিত্র গল্প আরম্ভ করার আগে মর্লিনের মুখের খুব কাছে ঝুঁকে পড়ল। বলল, এই মুখ দেখলে, স্যার আমার শুধু চেরির কথা মনে হয়। তখন জাহাজে স্যার তেলওয়ালার কাজ করতাম।
বিজন এবার উঠে দাঁড়াল। আমি সুখানী জাহাজের, তাছাড়া আমি স্যার এই তিনজনের ভিতর সকলের ছোট। আমাকে সকলের আগে বলতে দেওয়া হোক। বলে সেও মর্লিনের মুখের কাছে ঠিক স্টুয়ার্ডের মতো ঝুঁকে পড়ল। সে বলল, এই মুখ দেখলে শুধু এলবির কথা মনে হয়। তখন স্যার আমাদের জাহাজ অস্ট্রেলিয়াতে।
সুমিত্র চিৎকার করে উঠল, বেয়াদপ!
বড় মিস্ত্রি দেখলেন ওরা ঝগড়া করছে—তিনি বললেন, বরং গল্পটা আমিই বলি। বলে তিনি আরম্ভ করলেন—শেষ রাতের দিকে ভীষণ ঝড়ের ভিতর জাহাজ বন্দর ধরেছে। আমি তখন জাহাজের পাঁচ নম্বর মিস্ত্রি। আমাদের জাহাজ সেই কবে পূর্ব আফ্রিকার উপকূল থেকে নোঙর তুলে সমুদ্রে ভেসেছিল, কবে কোন এক দীর্ঘ অতীতে যেন। আমরা বন্দর ফেলে শুধু সমুদ্র এবং সমুদ্রে ভাসমান দ্বীপ—বালির অথবা পাথরের জনমানবহীন দ্বীপ দেখছি। সুতরাং দীর্ঘদিন পর বন্দর পেয়ে তুষাররাতেও আমাদের প্রাণে উল্লাসের অন্ত ছিল না। আমাদের মেজ মালোম উত্তেজনায় রা রা করে গান গাইছিলেন…।