জেটির তিন নম্বর ক্রেনের নিচ থেকে।
সুখানী স্টুয়ার্ডকে পুলিশের মতো জেরা করে বলল, সে তখন কী করছিল?
একজন জাহাজিকে সুখ দিচ্ছিল।
কতক্ষণ ধরে?
খুব শীত। সময় আমি হিসাব করিনি।
তুমি ওকে কী বললে?
আমি একটু সুখ চাইলাম।
উত্তরে সে কী বলল?
ওরা উঁচুনিচু পথ ধরে হাঁটছিল। ওরা শহরের বাজার দেখার জন্য এবং ফুল কেনার জন্য উঠে যাচ্ছে। বড় মিস্ত্রি চলতে চলতে লাঠি ঘুরাচ্ছিলেন, যেন তিনি কুকুরের দৌড় দেখতে যাচ্ছেন। হত্যাজনিত কোনো ভয়ই ওদের এখন নেই, এমত চোখ—মুখ ওদের সকলের।
সে বলল, একটু গরম দাও আমাকে, নইলে শীতে মরে যাব।
বড় মিস্ত্রি ধমকের সুরে বললেন, সুখানী, আমরা এই বন্দর—পথ ধরে কোথায় যাচ্ছি?
স্যার, ফুল কিনতে।
কিন্তু গোটা পথটা ধরে তুমি একটা পেটি দারোগার মতো কথা বলছ!
বড় মিস্ত্রিকে খুশি করার জন্য সে বলল, আজ ভোরেও স্যার কাগজ দেখলাম। শহরের কর্তৃপক্ষ মর্লিন সম্পর্কে একেবারে উদাসীন। শহর থেকে একটি মেয়ে গায়েব হয়ে গেল অথচ…
স্টুয়ার্ড নাকের মধ্যে রুমাল ঢুকিয়ে ভিতরটা পরিষ্কার করল। এবং বলল, নিরুদ্দিষ্ট কলামটা দেখেছিলে?
হ্যাঁ, দেখেছিলাম বইকি। ওতে আছে, এক ভদ্রমহিলার একটি কুকুর নিখোঁজ হয়েছে। কুকুরের যে খোঁজ দিতে পারবে তাকে দশহাজার পাউন্ড পুরস্কৃত করা হবে। স্যার, চলুন, একটা কুকুর ধরে নিয়ে ভদ্রমহিলার কাছে যাই।
ওরা একটা পথের মোড় ঘুরল। এই পথটা একটু অন্ধকার। ওরা ক্রমশ সমুদ্র থেকে দূরে সরে আসছে। সমুদ্রের গর্জন শোনা যাচ্ছে না আর। বাতাসের সঙ্গে তেমন জলীয় কণাও নেই। আগন্তুক তিনজনকে শহরের পুরুষ ও রমণীগণ দেখছিল। নীল আলো, হিমেল হাওয়া এবং পথের বাস, ট্রামের শব্দ, নাইট ক্লাবের সংগীত, কাফে, বার মিলে একটা রহস্যের অন্ধকার যেন এই পথটার ভিতর ঢুকে স্তব্ধ হয়ে আছে। ওরা এখানে থামল। একটা বাড়ির ভিতর থেকে কিছু কুকুরের চিৎকার ভেসে আসছে। ওরা দেখল, উপরে লেখা আছে ‘কুকুর ভাড়া পাওয়া যায়’।
ওরা একসময় একটা সরু লেগুনের পাড় ধরে হাঁটতে থাকল। উঁচুনিচু পথ। সমুদ্র বড় সন্তর্পণে খুব সরু পথ করে শহরের ভিতর ঢুকে গেছে। কতবার ডেসি এবং বড় মিস্ত্রি এখানে নৌকা বাইচ দেখতে এসেছিলেন। ডেসিকে নিয়ে বড় মিস্ত্রি কোন কোন ঘটনার সম্মুখীন হয়েছিলেন—নৌকা বাইচ দেখার পর লেগুন অতিক্রম করে এক নির্জন স্নিগ্ধ সন্ধ্যায় একটি বার্চগাছের নিচে অথবা দূরের সব পাহাড়শ্রেণী পার হলে ছোট্ট কিশোরী মেয়ের গ্রাম্য এক পাবে সারাদিন মাতলামি এবং অন্য অনেক সব নগণ্য ঘটনার স্মৃতি ভিতর থেকে বয়ে বয়ে উঠে আসছিল।
বড় মিস্ত্রি, সুখানী এবং স্টুয়ার্ডের সঙ্গে প্রাণ খুলে কথা বললেন কারণ যে সেতুটা এই লেগুনকে সংযুক্ত করছে সেখানে হরেক রকম যুবক—যুবতী লেগুনের জলে প্রতিবিম্ব সৃষ্টি করছে এবং প্রেম নিবেদন করছে। দূরে পাহাড়শ্রেণী, মাথায় লাল নীল অজস্র আলো। লেগুনের নীল জলে সরু সরু স্কিপ বাঁধা। ছই আছে এবং অনেকটা ঘরের মতো—যেখানে ইচ্ছা করলেই কোনো বেশ্যা রমণীকে নিয়ে রাত কাটানো যায়। ডেসি এবং বড় মিস্ত্রি অনেকবার এইসব স্কিপে রাত কাটিয়েছেন—ওদের দুজনকে আজ তিনি এ কথা জানালেন। জাহাজে রোজ রোজ ডেসি যাচ্ছে আর রোজ রোজ তিনি তাড়িয়ে দিচ্ছেন—এ কথাও জানালেন। নির্মল এই আকাশ, মাথার উপর পাহাড়শ্রেণীর অজস্র আলো এবং দূরের কোনো গ্রাম্য পাবের কিশোরী এক বালিকার মুখচ্ছবি—বড় মিস্ত্রিকে প্রাণ খুলে কথা বলবার জন্য উৎসাহ দিচ্ছিল।
বড় মিস্ত্রি বললেন, কী ফুল কিনবে?
ওরা তখন সেতু অতিক্রম করে নিচে বাজারের মধ্যে ঢুকে যাচ্ছে।
সুখানী বলল, রজনীগন্ধা দিতে পারলে ভালো হত। কিন্তু এখানে তা পাওয়া যাবে না।
সুখানী একটা ফুলের নাম মনে আনার চেষ্টা করছিল। অথচ কিছুতেই সে নামটা স্মরণ করতে পারল না। ফুলগুলি এ অঞ্চলে পাওয়া যায়, ঠিক রজনীগন্ধারই মতো। ফুলগুলির গায়ে মোমের রঙ অথবা যেন কচি আঙুরের স্তবক এবং সুগন্ধময়। সে ভাবল সেই সব ফুলের স্টিক কিনে নেওয়া যাবে।
ওরা বাজারে ফুলের গলিতে ঢুকে গেল।
স্টুয়ার্ড বলল, স্যার আমরা ব্যবহারে যথার্থই মানুষের মতো হবার চেষ্টা করব। আমরা মদ খাব না এই ক’দিন।
এটা ভালো প্রস্তাব বটে। বড় মিস্ত্রি মাথা নাড়লেন।
ওরা ফুল নিয়ে জাহাজে উঠে গেল একসময় এবং ভালোবাসার অভিনয় করার জন্য নাটকের প্রথম অঙ্কের গর্ভে ঢুকে গেল।
কেবিনে ওরা আরও কিছুক্ষণ বসে থাকল। দেয়ালের সাদা রঙ কেবল এই কেবিনে শূন্যতা সৃষ্টি করছে। ওরা পরস্পর কিছুক্ষণের জন্য অপরিচিতের মতো মুখ করে বসে থাকল। ওয়াচের ঘণ্টা পড়ছে। সারাদিন জেটিতে যে চঞ্চলতা ছিল, রাত গভীর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তা নিভে আসছে। দূরে সমুদ্র গর্জন করছে। আকাশ তেমনি পরিষ্কার। এই জাহাজের বুকে নক্ষত্রের আলো এসে নামছে। তিনজন নাবিক বসে থাকল। রাতের নিঃসঙ্গতার জন্য বসে থাকল। ওরা মর্লিনের জন্য মর্লিনের পাশে দুঃখ লাঘবের জন্য বসে থাকল। ওরা আগের মতোই চুপচাপ। দূর থেকে আগত সমুদ্র গর্জন শোনার জন্যই হোক অথবা এই জাহাজের কোনো কক্ষে রমণীর মৃত শরীর হুকে ঝুলছে, রমণীর ঘর সংসার, ওদের দুঃস্বপ্ন সকল… মানুষ এক নির্লজ্জ ইচ্ছার তাড়নাতে ভুগছে এইসব চিন্তা, তারপর সমুদ্র অতিক্রম করে সেই প্রিয় সংসার এবং মাঝে মাঝে পুলিশ নামক এক জন্তুর ডাক… ওরা ভয়ে পরস্পর এখন তাকাতে পারছে না।