সুখানী মুখ বিকৃত করে বলল, ওর কথা বাদ দিন স্যার।
সুখানী যা বোঝো না, তা নিয়ে কথা বলতে এসো না।
বেশ চুপ করে থাকলাম।
স্টুয়ার্ড বলল, আর একবার নামলে হয় স্যার।
কেন? আবার কেন?
দেখতাম কোথাও কিছু পড়ে থাকল কি না। স্টুয়ার্ডকে খুব বিষণ্ণ দেখাচ্ছে। যেন এই হত্যার জন্য ওকে সকলে দায়ী করে সরে পড়ছে। সে বলল, স্যার, ধরা পড়লে আমি সকলের নাম বলে দেব। কাউকে ছাড়ব না। আপনারা সকলেই ওকে কামড়েছেন।
বড় মিস্ত্রি ধমক দিলেন, স্টুয়ার্ড, তোমার মন অত্যন্ত ছোট।
স্যার, আমার অবস্থা বুঝতে পারছেন না। আপনারা কাল থেকে যদি এমুখো না হন তবে কী করতে পারি! স্টুয়ার্ডের গলায় কান্না ভেসে উঠল।
সুখানী পায়ের নখে ডেকের কাঠে আঁচড় কাটবার চেষ্টা করছিল। বড় মিস্ত্রি স্টুয়ার্ডের মুখ দেখছেন। সে মুখ বিবর্ণ। তিনি এবার স্টুয়ার্ডের হাত ধরে বললেন, রাতে কোথাও যাব না স্টুয়ার্ড। ছাদের নিচে বরফ ঘরে মর্লিনের পাশে বসে থাকব। কোনো ভয় নেই তোমার।
ওরা তিনজনই এবার যার যার কেবিনের দিকে এগিয়ে যেতে থাকল। স্টুয়ার্ড নিজের কেবিনের দরজা খুলে দিল। দরজার পাল্লাতে হাত রেখে দাঁড়িয়ে থাকল। সে দরজা বন্ধ করতে যেন সাহস করছে না। ওর ভয় করছে। এতদিনের জাহাজি জীবন অথচ কখনও এমন নিষ্ঠুর ঘটনার দ্বারা সে আহত হয়নি।
বড় মিস্ত্রি কিছু বলতে পারছেন না। তিনি খুব ধীরে ধীরে হেঁটে চলে যাচ্ছেন।
সুখানী বলল, শুয়ে পড় স্টুয়ার্ড। রাত আর বেশি নেই।
সুখানীর ঘর ডেক পার হলে। সে ফোকসালে থাকে। জাহাজের শেষ দিকটাতে জাহাজিদের জন্য অনেকগুলো ঘর। সুখানী এবং ডেক—কসপ সেখানে থাকে—পাশাপাশি বাংকে।
সুতরাং সুখানী বাইরে এসে দেখল, রাত কমে যাচ্ছে। সুখানী হাতের দস্তানা খুলে ফেলল। রাত শেষ হচ্ছে। বরফ পড়ছে না। ঝড় নেই। এক শান্ত নীল রঙ জাহাজের শরীরে যেন লেপ্টে আছে। কুয়াশা নেই। সুতরাং শহরের আলো স্পষ্ট। আকাশে ইতস্তত নক্ষত্র জ্বলছে। যেসব জাহাজ উষ্ণ স্রোতে সমুদ্রে মাছ ধরতে বের হয়েছিল ওরা একে একে ফিরে আসছে। সে এই শীতের ভিতর রেলিংয়ে ভর করে দাঁড়াল। রাতের সব ঘটনা দুঃস্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে। দেশ বাড়ির কথা মনে হল। স্ত্রীর কথা মনে হল—সন্তান—সন্ততি অর্থাৎ এক সুনিপুণ সাংসারিক জীবনের কথা ভেবে এই জাহাজি জীবনকে ধিক্কার দিতে থাকল। প্রেম, প্রীতি, স্নেহ, হৃদয়ের ঘরে সব মরে গেছে, কারণ এই মৃত্যুজনিত বেদনা সুখানীকে আড়ষ্ট করছে না, মর্লিন মরে গেছে—জাহাজের অন্যান্য জাহাজিরা ঘুমে মগ্ন শুধু ওয়াচের জাহাজিরা জেগে ওয়াচ দিচ্ছে। যদি পুলিশ খোঁজ করতে আসে, যদি এই হত্যাজনিত দায়ে একটা লম্বা দড়ি ক্রমশ বিস্তার লাভ করতে থাকে… সুখানী ভয়ে নিজের গলাটা চেপে ধরল এবার। তারপর আরও সব ভয়ংকর দৃশ্যের কথা ভেবে সে চুপি চুপি স্টুয়ার্ডের কেবিনে ফিরে যাবার জন্য পা চালাল। এক দুরারোগ্য ভয় সুখানীকে নিঃসঙ্গ পেয়ে জড়িয়ে ধরছে।
সে স্টুয়ার্ডের কেবিনে এসে দেখল, দরজা খোলা! পাল্লা ধরে স্টুয়ার্ড আগের মতো দাঁড়িয়ে আছে। সে ডাকল, এই! এই! হচ্ছে কী! এবং মনে হচ্ছে বজ্রজনিত মৃত্যু। সুখানী ওকে নাড়া দিল বারবার। এবং স্টুয়ার্ডকে টেনে নিল বাংকের কাছে; তারপর ধমক। চুপচাপ শুয়ে থাক। এমন করবে তো খুন করব।
সুখানী ঘুরে গিয়ে বড় মিস্ত্রির কেবিনের সামনে এসে দাঁড়াল। কেবিনের দরজা খোলা। বড় মিস্ত্রি একটা টেবিলের উপর ঝুঁকে আছেন। শরীরে কোনো জীবনের লক্ষণ পাওয়া যাচ্ছে না।
সুখানী ডাকল, স্যার, দরজা বন্ধ করে শুয়ে পড়ুন।
বড় মিস্ত্রি টেবিল থেকে নড়লেন না।—দরজাটা টেনে দাও সুখানী। বড় মিস্ত্রি টেবিল থেকে মাথা তুললেন না। মর্লিনের সাদা চোখ ওঁকে তখনও অনুসরণ করছে যেন। তিনি কেবিনে পায়চারি করতে থাকলেন। রাত শেষ না হওয়া পর্যন্ত তাঁর পায়চারি করার ইচ্ছা। ভোরের বাতাসে পাখিরা যখন উড়বে, যখন কোথাও কোনো হত্যা অথবা রাতের দুর্ঘটনাজনিত দুঃখ মাস্তুলের গায়ে লেগে থাকবে না, তখন বড় মিস্ত্রি বাংকে শুয়ে ঘুম যাবার চেষ্টা করবেন।
কিন্তু অধিক সময় তিনি পায়চারি করতে পারলেন না। তিনি বাংকে শুয়ে পড়লেন।
সুখানী ডেক ধরে হেঁটে চলে গেল। সে নিজের ফোকসালে ঢুকে চুপচাপ বসে থাকল। আলো জ্বালল না। দরজা বন্ধ করে পোর্টহোল খুলে সামনে মুখ রেখে বসে থাকল। রাতের সব পাখিদের দেখে ইতস্তত ছড়ানো নাবিকদের সব ছবি দেখে এবং দূরের জেটিতে একটি শিশুর কান্না শুনে ওরও মর্লিনের জন্য কষ্ট হতে থাকল!
ওরা তিনজন জাহাজের তিনটি ঘরে পোষা পাখিদের মতো ঘুমোচ্ছিল। বরফ ঘরে মর্লিন। ত্রিপলে শরীর ঢাকা পড়ে আছে। অন্যান্য কেবিনে দীর্ঘদিন পর রাতের এই প্রহরটুকুকে জাহাজিরা আস্বাদন করছে। ঠান্ডার জন্য সকলেই কেমন কুঁকড়ে ছিল। কোয়ার্টার মাস্টার গ্যাঙওয়ের ওয়াচ শেষ করে ফোকসালে ফিরে আসছে। ভোরের আলো ফুটে উঠলে সকলে রেলিংয়ে ভর করছে—জেটি অতিক্রম করে শহরের বাস ট্রাম এবং রমণীদের প্রিয়মুখ… তারপর মাটির স্পর্শের জন্য উদ্বিগ্ন এক জীবন…. আহা এই দেশ, মাটি, পাব, নাইট ক্লাব, সুখ শুধু সুখ, উলঙ্গ এক চিন্তা সব সময়ের জন্য—জাহাজিরা দীর্ঘ সমুদ্রযাত্রার পর সুখ নামক উলঙ্গ এক নগরে হাঁটছে যেন।