সুখানী মর্লিনের মাথার দিকটা ধরেছিল। স্টুয়ার্ড পায়ের দিকটা ধরে বাইরে নিয়ে এল। তারপর রসদঘরে ঢুকে দরজাটা বন্ধ করার আগে ডাকল, স্যার, তাড়াতাড়ি চলে আসুন। অ্যালওয়ের আলো জ্বেলে দিন।
ওরা ধীরে ধীরে মর্লিনকে একটা টেবিলের উপর শুইয়ে দিল। টেবিল থেকে কাচের ডিস এবং অন্যান্য সব পানীয় পাত্র তুলে অন্য স্থানে রেখে দিল। এই ঘরে অন্যান্য দরজা খুললে জাহাজিদের রসদ, নিচে রসদ ঘর—ভিন্ন ভিন্ন রকমের সব সবজি এবং সবজির গন্ধ আসছে এই ঘরে। ওরা এ সময় মর্লিনের শরীরের উপর ঝুঁকে পড়ল।
স্টুয়ার্ড বলল, কম্বল দিয়ে ঢেকে দি?
বরং ওর গাউনটা নিয়ে এসো।
মর্লিনের নগ্ন শরীর ভয়ানক কুৎসিত দেখাচ্ছে। বড় টেবিলের উপর ওর শরীর মৃত ব্যাঙের মতো—হাত পা দুটো শীর্ণ এবং চুলের সেই গন্ধটা তেমনি ফুর ফুর করে উড়ছে। চোখ দুটো এখনও শুধু স্থির। ওর বুকের পাঁজর স্পষ্ট। স্তনের সর্বত্র মাতৃত্বের চিহ্ন ধরা পড়ছে। স্টুয়ার্ড এবার কেমন শিউরে উঠল। এই শুকনো স্তনের আশে পাশে সহসা সে দেখে জঠরে নিমগ্ন কোনো যুবক যেন হাত বাড়াচ্ছে। সে তাড়াতাড়ি কম্বল এনে ওর শরীর ঢেকে দিল।
ওরা এখন সকলেই কথা কম বলছে। বড় মিস্ত্রি ভিতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলেন। বললেন, নিচে হাড়িয়া করে দেওয়া যাক তবে।
স্যার। স্টুয়ার্ড ডাকল।
বলো।
আপনি স্যার আমাদের ওপরওয়ালা। আপনি আমাদের সাহস দিন।
যেন এই পশুবৎ আচরণ অথবা নিষ্ঠুর ইচ্ছার দ্বারা প্রহৃত এই যুবতীর সকল অস্তিত্বের করুণা ক্রমশ জাহাজের ঘুলঘুলিতে মুখ রাখছে। দেয়ালে ওদের ছায়া পড়ছিল। সুখানী কেমন বিকৃতভাবে একটা ঢোক গিলে বলল, আমি নিচে নেমে যাচ্ছি। আপনারা উপর থেকে ওকে হাড়িয়া করুন। এই বিসদৃশ ঘটনা চোখে আর দেখা যাচ্ছে না।
বড় মিস্ত্রি নিচের ঢাকনা খুলে দিল। নিচের ঘরগুলো অন্ধকার। সুখানী সিঁড়ি ধরে নেমে যাবার আগে নিচের আলো জ্বেলে নিল। স্টুয়ার্ড হাঁটু গেড়ে বসল। নিচের ঘরগুলোতে ভয়ানক ঠান্ডা। আলু, পেঁয়াজ এবং শাক—সবজি এখান থেকে কিছু কিছু চোখে পড়ছে। বরফের ঠান্ডা স্রোত সুখানীকে ভয়ংকর কষ্ট দিচ্ছে। সবকিছু ক্লান্তিকর। সে এবার উপরের দিকে তাকাল। বড় মিস্ত্রি হাতের ইশারায় তাকে ডাকছেন।
ওরা তিনজন বড় টেবিলের সামনে দাঁড়াল। ওরা তিনজন মাথায়, কোমরে এবং পায়ে হাত রাখছে। বড় বড় চিনেমাটির বাসন টেবিলের নিচে, কাবার্ডে টি—সেট সাজানো। মাদক দ্রব্য পানের নিমিত্ত সব পাতলা কাচের পাত্র ইতস্তত সজ্জিত। বড় মিস্ত্রি অন্যমনস্ক ছিলেন। পা সরিয়ে আনার সময় কিছু কাচের পাত্র ভেঙে নিচে গড়িয়ে পড়ল। কাচ ভাঙার শব্দ, টেবিলের উপর বড় দর্পণে তিনজনের প্রতিবিম্ব, মর্লিনের শক্ত শরীর—সবই ভীতিপ্রদ। মর্লিন ওদের দিকে যেন শক্ত চোখ নিয়ে চেয়ে আছে। সুতরাং নিরন্তর এক পাপবোধ ওদের তীব্র তীক্ষ্ন করছিল।
ওরা এবার মর্লিনকে কোলের কাছে নিয়ে শব—বাহকের মতো সিঁড়ি ধরে নেমে যাবার সময় সন্তর্পণে ছাদের ঢাকনা টেনে খুব ধীরে ধীরে—যেন এতটুকু আওয়াজ না হয় অথবা যেন মর্লিনের গায়ে আঁচড় না লাগে—ওরা মর্লিনকে এ সময় আলিঙ্গনে আবদ্ধ করছিল। অথচ মর্লিনের শরীর মুরগির মৃত ঠ্যাং—এর মতো কদর্য এবং কঠিন। এই আলিঙ্গনের উষ্ণতা ওদের তিনজনকেই ভাবপ্রবণ করে তুলছিল।
মর্লিনের মুখ থেকে সব রঙ মুছে গেছে। চোখে টানা কাজলের চিহ্ন তখন চোখের নিচে এবং ভ্রুর আশেপাশে লেগে আছে। পুতুলনাচের নায়িকার মতো চোখ—মুখ। ওরা মর্লিনকে দরজার সামনে শুইয়ে দিল। বরফ ঘরের তালা খুলে দিল স্টুয়ার্ড—বড় বড় সব মাংস, গোরু, ভেড়া, শূকর এবং গোটা গোটা ধড় হুকের মধ্যে ঝুলছে। অথবা বড় বড় সব টার্কির মাংস—সোঁদা গন্ধ সর্বত্র, প্রচণ্ড ঠান্ডা এই বরফ ঘরে। ওরা তিনজনই ভিতরে ঢুকে তাড়াতাড়ি মর্লিনকে একপাশে রেখে একটা ত্রিপলে ঢেকে বের হয়ে পড়ল। দরজা টেনে সিঁড়িতে ওঠার মুখে প্রথম কথা বলল স্টুয়ার্ড—স্যার, কাল ভোরে যখন চিফ কুক রসদ নিতে আসবে, কী বলব?
রসদ দেবে।
ওরা ঠিক এখানে দাঁড়িয়েই রসদের ওজন দেখে। দরজাটা খোলা থাকলে দেখার ভয় আছে।
দরজা বন্ধ রাখবে।
দরজা সবসময় বন্ধ রাখলে সন্দেহ করতে পারে। কারণ মেস—রুম মেট গোস্ত কেটে এনে ওজন করে দেয়।
মেস—রুম মেটকে ভোরবেলায় অন্য কাজ দেব। রসদ ভালো দেবে, ওজন বেশি দেবে। সবাই খুশি থাকবে তবে। কেউ সন্দেহ করবে না।
স্টুয়ার্ড তবু সিঁড়ি ধরে উঠল না। সে বরফ ঘরের দিকে পিছন ফিরে তাকাল।
সে নড়ছিল না। সে বিড়বিড় করে কীসব বকছিল। সে দরজাটার সামনে হেঁটে গেল। দরজা খুলতেই দেখল পা’টা মর্লিনের খালি। সে ত্রিপল দিয়ে পা’টা ঢেকে দরজা বন্ধ করে তালাটা লাগাল। তালাটা টেনে দেখল ক’বার। যখন দেখল তালাটা ঠিকমতো লেগেছে—কোথাও কোনো গোপন বিশ্বাসভঙ্গ উঁকি দিয়ে নেই অথবা যখন সবই অতি সন্তর্পণে সংরক্ষিত হল…. আর কী হতে পারে, স্টুয়ার্ড এইসব ভেবে সন্দেহের ভঙ্গিতে বলল, স্যার এটা আমার ভালো লাগছে না। অর্থাৎ এখন মনে হচ্ছে যেন স্টুয়ার্ড নিজের জালে নিজেই জড়িয়ে পড়ছে।
এতক্ষণ পর মনে হল, বড় মিস্ত্রির গলাটা ভিজে যাচ্ছে। এতক্ষণ পর একটা চুরুটের কথা মনে হল। তিনি চুরুটে আগুন দিয়ে বললেন, কেন, কী হতে পারে?