এইসব কথায় তিনি যথার্থই অভিভূত হলেন। তিনি ধীরে ধীরে ওর কাছে এগিয়ে গেলেন। চোখ মুখ উদ্বিগ্ন। এবং অবিবাহিত জীবনের কিছু সুখদুঃখের কথা স্মরণ করতে পেরে যেন বলতে চাইলেন, স্টুয়ার্ড তুমি আমি সকলে এক সরল পাশবিকতার মোহে আচ্ছন্ন। কখনও ঘরে, কখনও উঠোনে এবং দূরের যব গম ক্ষেতের ভিতর নগ্ন শরীর আমাদের শুধু কামুক করে তোলে। অথবা এই জাহাজ আমাদের কত দীর্ঘ সময় সমুদ্র এবং আকাশের ভিতর আবদ্ধ করে রেখেছে—শুধু নোনা জল, কখনও প্রবাল দ্বীপ এবং নির্জনতা জাহাজের অস্থির এনজিনের শব্দ, দেয়ালের উলঙ্গ সব ছবি আমাদের নিরন্তর নিষ্ঠুর করে রাখছে। সুতরাং দীর্ঘ সমুদ্রযাত্রার পর বন্দর এবং রমণীর দেহ স্বাদে গন্ধে অতুলনীয়। মর্লিন মরে গেছে। এসো, ওর শরীর আমরা সযত্নে রক্ষা করি। বন্দরে ঝড়। এ অঞ্চলে উষ্ণ স্রোত প্রবাহিত। দেশটাতে এখন শীতের শেষ—কুয়াশা লেগেই থাকবে। ডেসি এমন দিনে আসবে না।
এতক্ষণ সকলকে চুপচাপ থাকতে দেখে সুখানী মর্লিনের চুল মুঠোর ভিতর তুলে বলল, স্যার দেখুন, এই সোনালি চুল কী অপূর্ব! সুখানী ভাবল, কীভাবে আর কথা আরম্ভ করা যায়। স্টুয়ার্ড ভয়ে ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ করে কাঁদছে। সুখানী দুঃখিতভাবে বলল, এই সোনালি চুলে মর্লিন স্যার সুগন্ধ তেল মাখত। গন্ধটা কিন্তু এখনও জীবিত মেয়েদের মতো, তারপর সে একটা ঢোক গিলে বলল, স্যার, আপনি পর্যন্ত ভয়ে টেসে গেলেন! কথা বলছেন না! চুপচাপ বসে মর্লিনের হাতের দস্তানা আপনার শক্ত হাতে গলাবার চেষ্টা করছেন। স্টুয়ার্ডকে উদ্দেশ্য করে বলল, এসো, তোমাকে লাশটা নামিয়ে রাখতে সাহায্য করছি।
বড় মিস্ত্রি বাংক থেকে নেমে পোর্টহোলের কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন। কাচের ভিতর থেকে পাশের জাহাজ স্পষ্ট। কাচ খুলে দিলে জাহজিদের শব্দ পেলেন, যাত্রীজাহাজ বলেই সেখানে মানুষের শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। তিনি পোর্টহোলে মুখ রেখে ভাবলেন, এই পোর্টহোল দিয়ে লাশটাকে হাড়িয়া করে দেওয়া যাক। স্টুয়ার্ডের ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ কান্না আর ভালো লাগছে না। বস্তুত বড় মিস্ত্রি নিজেও এই মৃতদেহ নিয়ে কী করা যাবে ভেবে উঠতে পারছেন না। তাঁর মাথার ভিতরও শূন্যতা এসে আশ্রয় করেছে। তিনি পোর্টহোলে মুখ রেখেই বললেন, স্টুয়ার্ড, সুখানি মর্লিনকে কাঁধে নাও। তাড়াতাড়ি পোর্টহোল দিয়ে গলাবার চেষ্টা করো বলে, তিনি পাগলের মতো পোর্টহোলটাকে টেনে ফাঁক করবার চেষ্টা করতে থাকলেন।
সুখানী বলল, স্যার, আপনারও কি মাথা খারাপ হয়ে গেল।
বড় মিস্ত্রি গোল গোল চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন, তবে আমরা কী করতে পারি সুখানী? সমস্ত জাহাজ ঘুরে দেখলাম মর্লিনকে কোথাও রাখা যাচ্ছে না। যেখানেই রাখতে যাব— সেখানেই ধরা পড়ে যাচ্ছি। তারপর তিনি থেমে থেমে বললেন, আহা, ওকে যদি সমুদ্রে নিয়ে যেতে পারতাম! সমুদ্রে ফেলে দিলে কোনো চিহ্নই পাওয়া যেত না।
সুখানী বলল, স্যার তবে আসুন, ওকে বরফ ঘরে রেখে দি। ভেড়া গোরুর সঙ্গে পড়ে থাকবে। কেউ টের করতে পারবে না। জাহাজ সমুদ্রে গেলে ওকে ফেলে দেওয়া যাবে।
বড় মিস্ত্রির কপাল কুঁচকে উঠল। তিনি আড়চোখে সুখানীর দিকে চাইলেন। যেন, সুখানী এখানে একমাত্র বুদ্ধিমান এবং স্থিরচিত্ত পুরুষ। সুতরাং তিনি ওর উপরই নির্ভর করতে পারেন এমত এক নিশ্চিন্ত মত পোষণ করছেন মনে মনে। তিনি বললেন, স্টুয়ার্ড কী বলে?
স্টুয়ার্ড কোনো কথা বলছে না। সুখানী ওদের দুজনকে অনুশাসনের ভঙ্গিতে বলল, তবে আর দেরি করে লাভ নেই। ওকে কাঁধে তুলে নেওয়া যাক।
মর্লিনের হাত পোর্টহোলে গলানো ছিল এবং মাথাটাও। পোর্টহোল থেকে ওর শরীর ঝুলে পড়ছিল। স্টুয়ার্ড ওর কোমর একটু উপরে তুলে রেখেছে। বড় মিস্ত্রি ডানদিকে দাঁড়িয়ে মর্লিনের তলপেটের নিচে হাত রেখে স্টুয়ার্ডকে ধরে রাখতে সাহায্য করছিলেন।
ওরা তিনজন মিলে মর্লিনকে বাংকে শুইয়ে দিল। ওরা প্রথমেই দরজা খুলে দিল না। সুখানী এখন মাঠে দাঁড়িয়ে কোনো সেনাবাহিনীকে যেন নির্দেশ দিচ্ছে। সে বলল, স্যার, দরজা খোলার আগে আমাদের কান পেতে শুনতে হবে, বাইরে কোনো শব্দ হচ্ছে কিনা। তারপর দরজা খুলে একজনকে ডাইনিং হলের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। অন্য কেউ যদি আসে তবে শিস অথবা হাতের ইশারা। ইতিমধ্যে মর্লিনকে রসদঘরে নিয়ে যাওয়া হবে। তারপর ফের দরজা বন্ধ করে ছাদের ঢাকনা খুলে মর্লিনের লাশ নিচে হাড়িয়া করে দিলেই ভয় থেকে নিষ্কৃতি। সে রাজ্যটা চিফস্টুয়ার্ডের একান্ত নিজস্ব। এবং আশা করব জাহাজ যতদিন না বন্দর ছেড়ে সমুদ্রে যায় ততদিন স্টুয়ার্ড মর্লিনকে আগলে রাখতে পারবে। তাই বলে সুখানী স্টুয়ার্ডের কাঁধে চাপ দিল।
এনজিন রুমে নেমে যাওয়ার দরজাটা বন্ধ। অ্যাকোমোডেশান ল্যাডার ধরে ডেক—ছাদে উঠে যাওয়ার পথটাতে বড় মিস্ত্রি কড়া নজর রাখছেন। তাছাড়া ডাইনিং হলের পথটা স্পষ্ট দৃশ্যমান। বড় মিস্ত্রি অ্যালওয়ের আলো নিভিয়ে পাহারাদারদের মতো অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকলেন। এখন বাইরে ঝড় নেই বললেই হয়। এনজিন রুমে কোনো ফায়ারম্যান হয়তো ওয়াচ দিতে নেমে যাচ্ছে, বুটের ঠক ঠক শব্দ সিঁড়ি ধরে ক্রমশ নিচে নিচে—তিনি সন্তর্পণে অন্ধকার থেকেই বললেন, এবার তোমরা রসদঘরে ঢুকে যাও। কেউ নেই।