ওরা মর্লিনের মৃত শরীর ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। বড় মিস্ত্রি পায়চারি করলেন কেবিনে। দেয়ালে শরীর রেখে মর্লিনের মুখ দেখছিল সুখানী। সে একটু হেঁটে গিয়ে কম্বল দিয়ে মর্লিনের মুখটা ঢেকে দিল। স্টুয়ার্ড দেয়ালে টাঙানো নগ্ন চিত্রের ক্যালেন্ডার থেকে—আজ কত তারিখ, কী মাস, কী বছর এবং বন্দরের নামটা পর্যন্ত তুলে আনল। স্টুয়ার্ড, বড় মিস্ত্রি এবং সুখানীর নির্বিকার ভঙ্গি দেখে দুঃখিত হল। সে বলল, স্যার, সারা রাত আমরা মড়া আগলে পড়ে থাকব।
বড় মিস্ত্রি কী ভেবে যেন দরজা খুললেন, এবং বাইরে যাবার উপক্রম করতেই সুখানী হাত চেপে ধরল, স্যার, আপনি আমাদের ফেলে চলে যাচ্ছেন?
তোমাদের ফেলে যাচ্ছি না সুখানী। মর্লিনের জন্য বাইরে একটু জায়গা খুঁজতে যাচ্ছি।
সুখানী বলল, দরজা বন্ধ করে দেব স্যার?
দাও। বড় মিস্ত্রি অ্যালওয়ে ধরে হাঁটতে থাকলেন। গ্যাঙওয়েতে মনসুর বসে আছে। তিনি গ্যাঙওয়েতে নেমে যেতেই মনসুর উঠে দাঁড়াল এবং আদাব দিল। তিনি লক্ষ্য করলেন না ওসব। তিনি জাহাজময় ঘুরে জেটিতে, জেটির জলে মর্লিনকে ফেলে রাখবার জন্য জায়গা খুঁজতে লাগলেন। তিনি কোথাও জায়গা খুঁজে পাচ্ছেন না। তিনি দেখলেন সর্বত্র এক নিদারুণ নিরাপত্তার অভাব। তিনি দেখলেন, সর্বত্রই যেন কে জেগে আছে। ওঁদের এই হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে তদন্ত শুরু করে দিয়েছে। এ সময়ে ওঁর ফের মদ খেতে ইচ্ছা হল। কিন্তু এ সময় মদ খাওয়া অনুচিত কারণ মর্লিনের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করাই এখন একমাত্র কর্তব্য। তিনি তারপর দেখলেন ডেকের উপর থেকে একটা শুকনো পাতা উড়ে উড়ে সমুদ্রের দিকে চলে যেতে থাকল। তিনি ভাবলেন, মর্লিনের শরীরে কোনো কোনো আঘাতের চিহ্ন বিদ্যমান….. মর্লিন একবার ব্যথায় চিৎকার করে উঠেছিল অথবা পাশবিকতার চিহ্ন এখনও ওর শরীরে বিদ্যমান কি না অথবা সুখানী এবং স্টুয়ার্ডের শরীরে মাংস ভক্ষণের মতো উদগার নিক্ষেপ করেছে কি না, যা ওদের তিনজনকেই গ্রাস করবে…. তিনি ছুটতে থাকলেন, তিনি তাড়াতাড়ি কেবিনের কাছে এসে ফিস ফিস করে বললেন, স্টুয়ার্ড, দরজা খোল—স্টুয়ার্ড! স্টুয়ার্ড!
কেবিনের দরজা খুললে তিনি ঝড়ের মতো ঢুকে মর্লিনের শরীর থেকে কম্বল তুলে নিলেন। ওর শরীরের শেষ আবরণটুকু খুলে ঝুঁকে পড়লেন শরীরের উপরে। সুখানী এসো, স্টুয়ার্ড এসো। বড় মিস্ত্রি চিবুকের নিচে হাত রেখে বললেন, এই দাঁতের চিহ্ন কার?
সুখানী অত্যন্ত সংকুচিত চিত্তে বলল, স্যার আমার। মর্লিনের সামনে মিথ্যা বলে পাপ আর বাড়াতে চাই না।
বড় মিস্ত্রি তীক্ষ্ন চোখে মর্লিনকে দেখতে লাগলেন। সুখানীর কথার সঙ্গে নিজেও বিড় বিড় করে বললেন, শরীরের এসব চিহ্ন দেখে পুলিশ ধরে ফেলবে।
স্টুয়ার্ড বলল, স্যার, পুলিশ আমাদের ধরে নিয়ে যাবে!
আমাকেও নেবে। বড় মিস্ত্রি একবার সুখানীর দিকে তাকালেন।
সুখানী বলল, বড় অমানবিক!
স্টুয়ার্ড বলল, এই তুষারঝড় এ—জন্য দায়ী।
বড় মিস্ত্রি বললেন, পুলিশের ঘরে আমাদের বিচার হওয়াই উচিত। সুতরাং এসো, ওকে এখন আর কোথাও নিক্ষেপ না করে এখানেই ফেলে রাখি।
এইসব কথা বলার পর সকলে দাঁড়িয়ে থাকল। সকলে পরস্পরকে চোখ তুলে দেখল।
স্টুয়ার্ড বলল, স্যার, যা হয় তাড়াতাড়ি করুন।
সুখানীর সঙ্গে তোমার এখানেই ফারাক। এসব কাজ তাড়াতাড়ি হয় না।
তাড়াতাড়ি হয় না?
না, হয় না।
স্যার আপনি ঠিক কথা বলেছেন!
আমাদের এখন ভাবতে হবে কোনো অপরাধই আমরা করিনি। এখন শুয়ে পড়লে ঘুমোতে পারব এমন মনের অবস্থা সৃষ্টি করতে পারলেই এই হত্যাকাণ্ড থেকে রেহাই পাওয়া যাবে। যদিও আমরা জানি মনের এমন অবস্থা সৃষ্টি করা অসম্ভব। সুতরাং বোস।
বড় মিস্ত্রি ফের বললেন, একটু কফি হলে ভালো হত। সুখানী কী বলছ।
তা মন্দ নয় স্যার।
স্টুয়ার্ড কিন্তু বের হতে চাইল না। কারণ ওর ভয় কফি আনতে গেলেই ওরা এই কেবিন ছেড়ে চলে যাবে এবং ভোরবেলায় যখন সব জাহাজিরা,—তখনও অন্ধকার থাকবে ডেকে, তখনও সূর্য ভালো করে আকাশের গায়ে ঝুলবে না,—সকল জাহাজিরা ডেক—ছাদ অথবা এনজিনে নেমে যেতে শুনবে স্টুয়ার্ডের ঘরে একজন তরুণীর মৃতদেহ—কম্বলের নীচে স্টুয়ার্ড মৃতদেহটিকে আড়াল করে রেখেছিল।
স্টুয়ার্ড বলল, স্যার আমার মাথার ভিতরটা কেমন ফাঁকা ঠেকছে। তারপর ওদের উত্তর করতে না দেখে বলল, স্যার, আসুন মর্লিনকে পোর্টহোল দিয়ে জেটির জলে ফেলে দি।
যখন লাশ ফুলে ফেঁপে জলের উপর ভেসে উঠবে, যখন দাঁতের কামড় দেখে তোমার দাঁতের চিহ্ন নেবে, তখন…?
কোথাও কোনো উপায় নেই।
আপাতত দেখতে পাচ্ছি না।
সুখানী বলল, বড় দুঃখজনক পরিস্থিতি।
বড় মিস্ত্রি অন্যমনস্কভাবে মর্লিনের দস্তানা হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করছিলেন।
স্টুয়ার্ড যেন ক্ষেপে গেল।—স্যার, আমার কেবিনে এসব হচ্ছে! আপনারা আমাকে জপাতে চাইছেন। আপনারা যদি আমাকে এ কাজে সাহায্য না করেন আমি একাই ওকে বয়ে নিয়ে যাব। স্টুয়ার্ড তাড়াতাড়ি কম্বলের ভিতর থেকে মর্লিনকে তুলে কাঁধে ফেলল তারপর দরজা দিয়ে বের হতেই মিস্ত্রি ওর হাত চেপে বলল, তুমি কি ক্ষেপে গেলে?
স্টুয়ার্ড এবার কেঁদে ফেলল, স্যার, আপনারা এ সাংঘাতিক ঘটনাকে আমলই দিচ্ছেন না! আমাকে আপনারা ফাঁসিয়ে দিতে চাইছেন। ঘরে আমার স্ত্রী আছে, সন্তান—সন্ততি আছে।