যুবতী কষ্ট করে হাসল,—আপনি আমাকে বরং একটু সাহায্য করুন।
অবনীভূষণ বলল, কী করতে হবে?
সেকেন্ড অফিসারের ঘর থেকে দয়া করে আমার পোশাকটা এনে দিন।
অবনীভূষণ মেজ মালোমের ঘর থেকে পোশাকটা এনে দিলে মেয়েটি বলল, আমাকে দয়া করে বন্দরে নামিয়ে দিন। একটা ট্যাক্সি ডেকে দিলে আমি ঘরে চলে যেতে পারব।
বেশ চলুন। বলে তুলে ধরতেই মনে হল যুবতীর মাথা ঘুরে গেছে। সে বসে পড়ল।
আপনি বন্দরের রাস্তাটুকু হেঁটে পার হতে পারবেন না। বরং এখানেই রাতটা কাটিয়ে দিন।
আমার ভয় করছে মিস্টার, সে আবার আসতে পারে। অত্যন্ত কাতর চোখে অবনীভূষণের দিকে তাকিয়ে থাকল সে।
আপনি ঘুমোন, আমি বরং দরজায় পাহারা দিচ্ছি।
যুবতী আর কথা বলতে পারল না। চোখ জলে ভার হয়ে গেছে।
আর অবনীভূষণের মনে হল দীর্ঘদিন পর সে এক অসামান্য কাজ করে ফেলেছে। সে বলল, আমি বাইরে বসে থাকছি, আপনি নির্ভয়ে ঘুমোন—বলে অবনীভূষণ দরজা বাইরে থেকে টেনে বন্ধ করে দিল এবং ঠিক দরজার সামনে ভয়ংকর ঠান্ডার ভিতর পা মুড়ে বসে থাকল এবং জেগে জেগে এক বিস্ময়কর স্বপ্ন দেখল—দ্বীপের স্বপ্ন, বড় এক বাতিঘর দ্বীপে—সব বড় বড় জাহাজ সমুদ্রগামী। অবনীভূষণ নিঃশব্দে হাঁটু মুড়ে মাথা গুঁজে বসে থাকল—তার এতটুকু নড়তে ইচ্ছা হচ্ছিল না, যেন জীবনের সাত রাজার ধন এক মাণিক, খুবই হাতের কাছে রয়েছে। তাকে গলা টিপে মারতে নেই। সুতরাং সে উঠল না এবং এই নিদারুণ রাত্রি জীবনের প্রথম আলোর পথ বলে মনে হল অবনীভূষণের।
দুই
সমুদ্রে বৃষ্টি পড়ছে। প্রথমে ইলশে—গুঁড়ি, তারপরে জোরে। জোরে বৃষ্টি নামল। মাস্তুলের গা বেয়ে বৃষ্টি ডেক ভিজাল। এখন ফল্কা ভিজছে। গ্যালির ছাদ থেকে ব্রিজের ছাদ, চার্টরুমের ছাদ সব ভিজছে। কুয়াশা—ঘন ভাব বৃষ্টির। সেলিম ফোকসালে কাশছে। বৃষ্টি সমুদ্র এবং জাহাজ সেলিমের বুকের যন্ত্রণায় কাতর হল না। বৃষ্টি পড়ছে—পড়ছে। সমুদ্রে তরঙ্গ। জাহাজ নীল জলে নোনা রঙে সাঁতার কাটছে। সেলিম শরীরে কম্বল জড়াল তখন। ফোকসাল যখন খালি, বাংকে যখন কেউ নেই, জাহাজিরা যখন ডেকে দড়িদড়া টানছে তখন কম্বলের নিচে শুয়ে বিড়ি ধরানো যাক। সে বিড়ি ধরাল এবং কম্বলের নিচে বিড়ির ধোঁয়াকে ফুঁ দিয়ে ঢুকিয়ে দিল। তারপর কম্বলটা দিয়ে গোটা ধোঁয়াকে চেপে ধরে দরজার দিকে তাকাল। কেউ নেই। কেউ সিঁড়ি ধরে নামছে না। সে নিশ্চিন্ত হল। অথচ পোর্টহোলের কাচে সমুদ্র এবং আকাশের প্রতিবিম্ব। সেলিম সে কাচে নিজের প্রতিবিম্বও দেখল। চোখ দুটো ওর পালক ওঠা মুরগির মতো। চোখ দুটো পোর্টহোলের কাচে আকাশ এবং সমুদ্রের মতো নীল হতে পারেনি। সাদাটে অথবা বরফ—ঘরের চার—পাঁচ মাসের বাসি গোস্তের মতো। সেলিম কাশির সঙ্গে রক্তের দলাটা কোঁত করে গিলে ফেলল এবার।
দুপুর থেকে শুনে আসছে—উপকূল দেখা যাচ্ছে। সকলে ডেকে চিৎকার করছে—কিনারা দেখা যাচ্ছে। সকলে উপরে হল্লা করছে। সেলিম কোনোরকমে সিঁড়ি ধরে উপরে উঠছিল, সেও মাটি দেখবে, মাটি দেখে উত্তেজিত হবে, কিন্তু সিঁড়ির মুখেই সারেঙের ধমক, কোথায় যাচ্ছ মিঞা। মরণের দাওয়াই কানে বাঁধতে চাও? সেলিম ভয়ে ফের ফোকসালে নেমে এসেছিল। সে বাংকে শুয়ে সব যেন ধরতে পারছে—যেন কিছু সমুদ্রপাখি ফল্কায় বসে ভিজছে। পাখিরা ফল্কায় একদা বসতের মতো আশ্রয় নিয়েছে। উপকূল দেখে অথবা দ্বীপ দেখে ওরা উড়ছে। এমন ভেবে সেলিম কাশল। সমুদ্রপাখিরা হয়তো এতক্ষণে উড়ে গেছে। ওর জানার ইচ্ছা হল ওরা আকাশে উড়ছে, না দ্বীপের পাশাপাশি কোথাও উড়ছে। আর কেন জানি এই সময় বারবার ওর বিবির কথা মনে হচ্ছে। বিবির মুখে সুখের ইচ্ছা, শখের ইচ্ছা। সেলিমের শরীরে যন্ত্রণা, বুকে যন্ত্রণা। সে যেন বলতে চাইল—এবার আমরা ফিরব, বিবি। ছোট ঘরে তুই তোর খসমের মুখ দেখবি। জাহাজ এবং সমুদ্র উভয়ই আমাদের বিনাশ করতে পারেনি। আমি ফিরব, ফিরব। আমরা ফিরব। খতে এমন একটা প্রত্যয়ের কথা লিখতে ইচ্ছে হচ্ছে সেলিমের।
দীর্ঘ সফর, নোনা পানীর অশ্লীল একঘেয়েমি এতদিন ওকে দেশে ফেরার জন্য মাতাল করতে পারেনি। সেলিম দুবার দুটো ওয়াচ করেছে, ফোকসালে এসে শুয়েছে, হাত—পা ছড়িয়ে, অশ্লীল চিন্তা করতে করতে সমুদ্রের বুকে ঘুম দিয়েছে; অথবা হিসাবের কড়ি গুণে—সফর শেষ হতে কত দেরি—এইসব ভেবে স্থান—কাল—পাত্রের কিংবা বন্দরের বেশ্যামেয়ের হিসাবের কড়ি গুণেছে। গুণতে গুণতে ওর একদিন কাশি উঠল। কাশি আর থামছে না। বিকেলে জ্বর এল। বন্দর থেকে বন্দর ঘুরে জ্বর বেড়েছে। শরীর ভেঙেছে। এক বন্দরে কাপ্তানের কাছে আর্জি পেশ করেছে—সাব, একবার হাসপাতালে যাব। কাশির দমকে আর বাঁচছি না। মনে হচ্ছে, মরে যাব।
এই নিয়ে অন্য ফোকসালে কথা হচ্ছিল। কথা হচ্ছিল, এ বন্দর নিয়ে পাঁচ বন্দর হবে অথচ সেলিম এখনও জাহাজেই আছে। সেই কবে ফ্রি—ম্যান্টেল বন্দরে ওকে ডাক্তার দেখানো হয়েছিল। ডাক্তার বলেছিল, আর নয়, আর জাহাজে রাখা চলবে না। বন্দরে নামিয়ে দিতে হবে। হাসপাতালে পাঠাতে হবে। এ—অবস্থায় জাহাজে রাখা নিরাপদ নয়।
সেলিম এখনও জাহাজেই আছে। সে কাশছে। কাশির সঙ্গে রক্ত উঠলেই কোঁত করে ঢোক গিলছে। কিছুদিন থেকে এটা ওর অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। সে সকলকে বলছে কাশির ব্যামোটা তেমন নয়। ওটা সেরে যাবে। কোম্পানি দামি দামি ওষুধ দিচ্ছে। দিচ্ছে বলেই এবং বাড়িয়ালা গা করছে না দেখে সেও বুঝেছে ওটা ধীরে ধীরে সেরে যাবে। কাশি যখন বেশি হয় তখন সেলিম অপরাধের কথা ভাবে। নিজের অপরাধের কথা। বিবিকে নিয়ে অথবা বন্দরে দেখা কোনো মেয়েকে নিয়ে বিছানায় পড়ে থেকে অশ্লীল ধারণায় অথবা অশ্লীল আবেগে মেখে শরীরে উত্তাপ সঞ্চয়ের বৃথা চেষ্টা না করলেই হত। অথচ রক্ত কম উঠলে ওষুধে কাজ করছে এমত ভেবে সে খুশি হয়। ওর ইচ্ছা ওর দুরারোগ্য রোগের কথা কেউ না জানুক, কেউ না ভাবুক সে দুরারোগ্য রোগে ভুগে মরে যাবে। অথচ প্রত্যয়ের ঘোরে এই ভেবে খুশি—সে ঘরে ফিরবেই। বিবি তার খসমের মুখ দেখে উজ্জ্বল হবেই। এ—শরীরে সে কিছুতেই সমুদ্রে অথবা বিদেশ বন্দরে রেখে যেতে চাইছে না। সে সকলকে শুধু জিজ্ঞেস করছে—জাহাজ কবে ফিরবে? কবে আমরা ঘরের বন্দর পাব?