এবার অবনীভূষণ যুবতী দুজনকে উদ্দেশ্য করে বলল, চলুন অন্য কোথাও।
যুবতী দুজন পরস্পর মুখ দেখল। তখন ব্যান্ড বাজছে উঁচু পর্দায়, তখন সার্কাসের ঘোড়ার মতো পা ফেলে এই নাচের ভিতরই কেউ কেউ বেলেল্লাপনা করছিল। নাচতে নাচতে কোনো এক ফাঁকে দেয়ালের পাশে অথবা সামান্য অন্ধকারে পরস্পর পরস্পরকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল। তারপর সব ভিন্ন ভিন্ন ভঙ্গির ছবি। অবনীভূষণ কিছুতেই আর স্থির থাকতে পারছে না। যুবতীরা সব উটের মতো মুখ তুলে কেবল চুমু খাচ্ছে, কেবল সার্কাসের ঘোড়ার মতো পা মুড়ে বসে পড়তে চাইছে। অবনীভূষণ আবার বলল, চলুন কোথাও। অবনীভূষণ চুল—সোনা মেয়ের হাতে নরম চাপ দিল।
ব্যান্ড বাজছে, হরদম বাজছে। সামনের কাউন্টারে ফের দু—একজন করে ভিন্ন ভিন্ন দেশের নাবিক এসে ভিড় করছে। ওরা কেউ কেউ মাথার টুপি খুলে তিমি শিকারের গল্প আরম্ভ করল। উত্তর সাগরে ওরা গর্ভিণী তিমি শিকার করতে গিয়ে দুজন নাবিককে হারিয়েছে, এমন গল্প করল। ওরা গল্প করার সময় পাশের হিটার থেকে উত্তাপ নিচ্ছিল এবং গর্ভিণী তিমির প্রসব সম্পর্কে রসিকতা করছিল।
ভিড় কাচঘরে ক্রমশ বাড়ছে। মিশনের ডানদিকে মসৃণ ঘাসের চত্বর এবং মৃত বৃক্ষের মতো কিছু পাইন গাছ—তার নিচে বড় বড় টেবিল আর ফাঁকা মাঠে হেই উঁচু লম্বা এক হারপুনার হেঁটে হেঁটে এদিকে আসছে। হারপুনার কাচঘর অতিক্রম করে কাউন্টারের সামনের লোকটির সঙ্গে ফিস ফিস করে কী বলছে। অবনীভূষণ সব লক্ষ্য করছিল। আগের দলটা এতক্ষণ হইচই করছিল মদ খেতে খেতে, কিন্তু হেই উঁচু লম্বা হারপুনারকে দেখে ওরা সব যিশু হয়ে গেল। আর তখন কে বা কারা যেন সেই যুবতী দুটিকে উদ্দেশ্য করে লম্বা গলায় বড় রাস্তায় হেঁকে হেঁকে বলে যাচ্ছে—ট্যানি টরেন্টো… ট্যানি টরেন্টো… আমাদের বন্ধুবর হারপুনার এবার উত্তর সাগর থেকে গর্ভিণী তিমি শিকার করে ফিরেছে।
উঁচু লম্বা লোকটার টেবিলে সকলে এক এক করে গোল হয়ে বসে গেল। সেই যুবতীরাও ছুটে যেতে চাইল। অবনীভূষণ কিছুতেই আর স্থির থাকতে পারছে না। সে এবার বিদ্রুপ করে বলতে চাইল হ্যাঁগো সতীর দল… তোমরা আমাদের ফেলে যাচ্ছ! সে বিরক্ত হয়ে এবার উডকে বলল, উড, তুমি তো বলতে পারো বুঝিয়ে। তোমাদের সুন্দর মুখ দেখে ….।
উডের কথা যুবতী দুজন তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে শুনল। ওরা চুল ঘাড়ে ফেলে উলের কাঁটা ব্যাগের ভিতর ভরে সেই চৌকোমুখ এবং গামবুট—পরা ভদ্রলোক—যে গর্ভিণী তিমি শিকার করে এইমাত্র উত্তর সাগর থেকে ফিরেছে—তার টেবিলের দিকে হাঁটতে থাকল। অবনীভূষণ প্রচুর মদ গিলেছে। ওর শরীর নেশায় টলছিল। অবনীভূষণের ভিতরে ভিতরে এক অপরিসীমা তৃষ্ণা—সে পাগলের মতো চুল—সোনা মেয়ের হাত ধরে ফেলল। কারণ সে যেন সেই চৌকোমুখ হারপুনার, মাথায় যার হাঙরের হাড়ের টুপি, যে বিশ্রী এবং যে ওখানে বসে কটু গন্ধের তামাক টানছে, যার চেহারা দেখলে মনে হয় মেয়েমানুষ সামান্য বস্তু—তার দৃষ্টি একেবারেই সহ্য করতে পারছিল না। সে রাগে—দুঃখে চুল—সোনা মেয়েকে টেনে হিঁচড়ে ঘর থেকে বের করে নিয়ে যেতে চাইলে—হারপুনার ব্যক্তিটি ও তার দলবল লম্বা লম্বা পা ফেলে দরজার সামনে পথ আগলে দিলে। অবনীভূষণ ক্ষিপ্ত এক জানোয়ারের মতো গর গর করে উঠল। হারপুনারের দলবল তখন অবনীভূষণকে এলোপাথাড়ি মুখে মাথায় ঘুষি চালাচ্ছে।
বাইরে সাদা আলোর ভিতর নাক মুছতে গিয়ে অবনীভূষণ দেখল সামান্য রক্ত নাকের ডগায় জমাট বেঁধে আছে। ভিতরে তখন সেই যুবতী হারপুনারের সঙ্গে রসিকতা করছিল এবং হাসছিল।—কাচের ভিতরে সব স্পষ্ট। সুতরাং অবনীভূষণ আর সহ্য করতে পারছে না। সে ফের দরজা অতিক্রম করে ভিতরে ঢোকবার চেষ্টা করলে উড হাত চেপে ধরে বলল, অবনী, তুমি বেশ জোরে হারপুনারকে মেরেছ। লোকটা পেটে লাথি খেয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গল গল করে মদ বমি করছে।
অবনীভূষণের ঝুট—ঝামেলা করার আর ইচ্ছা থাকল না। এবং এখানে আর যুবতী অনুসন্ধান করা নিরর্থক ভেবে ওরা পাহাড়ের গায়ে গায়ে অথবা সেতুর দুই পাশে, লোহালক্কড়ের কারখানার দেওয়ালের ছায়ায় এবং যেখানে সব তিমি মাছের চর্বি সংরক্ষণ করার জন্য বড় বড় পিপের সারি সেইসব অঞ্চলে ঘুরতে ঘুরতে একসময় শহরের মাঝামাঝি অঞ্চলে এসে গেল।
অবনীভূষণ চড়াই—উতরাইয়ে হাঁটতে হাঁটতে একসময় উডকে উদ্দেশ্য করে বলল, আজ এই শীতে সতীর দল গেল কোথায়?
তখন উড সহসা আবিষ্কারের ভঙ্গিতে বলল, ঐ দেখ অবনী, লাইটপোস্টের নিচে যেন দুজন মেয়ে শিস দিচ্ছে। বলে উড দূরের লাইটপোস্টের দিকে হাত তুলে নির্দেশ করল।
অবনীভূষণ বলল, চল তবে।
শীতের রাত। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অবনীভূষণের মনে হল ওরা শীতে জমে যাবে ক্রমশ। মনে হল ওরা যুবতী দুজনে বেশিদূর আর অনুসরণ করতে পারবে না। অথবা মেয়ে দুজন এই শীতের রাতে ওদের সঙ্গে লুকোচুরি খেলছে। পথের ভিড় ক্রমশ পাতলা হয়ে আসছে, দূরে দূরে সব পুলিশের বুটের শব্দ এবং ট্রলি বাসের আলো আর পথে পড়ছে না, শহর ক্রমশ যেন নির্জন নিঃসঙ্গ হয়ে আসছে। উড পর্যন্ত আর জোরে হাঁটতে পারছিল না।
একসময় ওরা এবং যুবতী দুজন শোকেসের সামনে মুখোমুখি পড়ে যেতেই উড ঝুঁকে বলল, আস্তানা কত দূর?