সন্ধ্যার সময় জাহাজের স্টারবোর্ড—সাইডের কেবিনগুলোর দিকে হেঁটে গেল সে। সেখানে প্রিয় বন্ধু ডেক—অ্যাপ্রেন্টিস উইলিয়াম উড থাকেন। সে দরজায় কড়া নেড়ে ভিতরে ঢুকে বলল, এ কি, তুমি এখনও চুপচাপ বসে রয়েছ! বের হবে না?
উড বলল, ভয়ংকর ঠান্ডা।
অবনীভূষণ বলল, অন্তত সিম্যান মিশানে চল। সেখানে জুটে যেতে পারে।
সুতরাং ওরা উভয়ে সাজগোজ করে বের হয়ে পড়ল। সেই লম্বা ওভারকোট গায়ে অবনীভূষণ, লম্বা তামাকের পাইপ মুখে এবং ভয়ংকর বড় বেঢপ জুতো পায়ে অবনীভূষণ গ্যাঙওয়ে ধরে নেমে গেল। আর নেমে যাবার মুখেই দেখল মেজ মালোম বন্দর থেকে ফিরছে। মেজ মালোম বেশ সুন্দরী এক যুবতীকে (বয়সে চল্লিশের মুখোমুখি) নিয়ে এসেছেন। যুবতীর পাতলা গড়ন, ছিমছাম চেহারা আর কালো গাউন, সোনালি ব্লাউজের উপর ফারের লম্বা মতো কোট গায়ে…। ওর কোমরে মেজ মালোমের হাত। যেন চুরি করে তিনি এক যুবতীকে জাহাজে নিয়ে যাচ্ছেন। সমুদ্র থেকে তেমনি ঠান্ডা বাতাস উঠে আসছে। তীক্ষ্ন শীতের ভিতর এই সামান্য উত্তাপটুকু অবনীভূষণকে অস্থির করে তুলল। মেজ মালোমকে সে ‘গুড—ইভনিং সেকেন্ড’ বলতে পর্যন্ত ভুলে গেল। সে অন্যমনস্কভাবে হাঁটছে।
তুষারপাতে গাছের সব পাতা ঝরে গেছে, আর কিছু দিন গেলে এখানে হয়তো বরফের পাহাড় জমে যাবে। বাগানের আপেল গাছগুলোকে খুব নিঃসঙ্গ মনে হচ্ছিল, চেরিফলের গাছগুলো মৃতবৎ দাঁড়িয়ে আছে। ওরা সব অপরিচিত গাছগাছালির ভিতর ঢুকে যাচ্ছে। গাছগুলোর পাতা ঝরে গেছে বলে কোনো গাছই চেনা যাচ্ছে না, ওরা বৃদ্ধ পপলার হতে পারে, পাইন হতে পারে, এমনকি বার্চ গাছও হতে পারে। এই শীতে পথের দু’পাশে কাঠের বাড়ি এবং লাল নীল রঙের শার্সির জানালা এবং বড় বড় কাচের জানালার ভিতর পরিবারের যুবক—যুবতীদের মুখ। অ্যাকর্ডিয়ানের সুর, গ্রাম্য কোনো লোকসংগীত অবনীভূষণকে ক্রমশ উত্তেজিত করছে। ইতস্তত দু’পাশে বার এবং বার পার হলেই সেই কার্নিভাল। সদর দরজার উপর একটা লোক হাঙরের মুখোশ পরে বসে নানাভাবে জাহাজিদের প্রলুব্ধ করতে চাইছে। ওরা কার্নিভালে ঢুকল না। ওরা ক্রমশ পাহাড়ের উতরাইয়ে নেমে যাচ্ছে। আর ওরা দেখল, হরেক রকমের রমণীরা মুখে ফুঁ দিতে দিতে চলে যাচ্ছে—স্থানীয় কোনো উৎসব হবে হয়তো—মেয়েরা মাথায় রুমাল বেঁধে শহরের বড় কবরখানার দিকে হাঁটছে। অবনীভূষণের এ—সময় ইচ্ছা হচ্ছিল ওর বড় থাবা দিয়ে ঠিক ছোট পাখি ধরার মতো কোনো যুবতীকে ওভারকোটের পকেটে লুকিয়ে ফেলতে।
তুষারঝড়ের চিহ্ন এখনও এই সব পাহাড়ে এবং ছবির মতো বাড়িগুলোর মাথায় লেগে আছে। কোথাও দেখল, কাচের ঘরে সুন্দরী যুবতী পিয়ানো বাজাচ্ছে, আর দু’পাশে হরেক রকমের দৃশ্য এবং অবনীভূষণ এখন উন্মাদ—সে হন্যে হয়ে যুবতীর সন্ধান করছে। এইসব জাহাজিদের আনন্দ দানের জন্য ভিন্ন ভিন্ন অশালীন পোশাকে নানা বয়সের যুবতীরা ঘোরাফেরা করছে। ওরা এক এক করে সকলে নাচের আসরে নেমে পড়ছে। স্টেজের উপর একদল লোক কালো পোশাক পরে ব্যান্ড বাজাচ্ছে। ঈগল পাখির মতো মুখওয়ালা বাঁশির শব্দ বীভৎস এবং উৎকট মনে হচ্ছিল। পাশের কাউন্টার কাচ দিয়ে মোড়া। সেখানে মেয়েরা মদ বিক্রি করছে। জাহাজিরা কিউ দিয়ে মদ গিলছিল। অবনীভূষণ এবং উড উভয়ে মদ খেল এক গেলাস করে। ওদের পার্টনার নেই, বিশেষ করে অবনীভূষণ এইসব নাচ এতদিনেও রপ্ত করতে পারেনি। সুতরাং অবনীভূষণ আর এক গেলাস মদ নিয়ে পাশের সোফাতে বসে মাংসের পুরের সঙ্গে মদটুকু খেয়ে ফেলল। বাকি মাংসের পুরটুকু সে চেখে চেখে চেটে চেটে খাচ্ছিল আর রমণীরা এই যে নেচে চলেছে, এই যে সুন্দর শরীর এবং উটের মতো মুখটি তুলে নেচে বেড়াচ্ছে, এই যে রমণীরা ঘোড়ার মতো পা ফেলে এক দুই করে সামনে পিছনে পিছনে সামনে—যাচ্ছে আসছে—তা দেখে অস্থির হয়ে পড়ছিল। ফলে অবনীভূষণ ল্যালা ফ্যালার মতো চারিদিকে তাকাচ্ছিল। তারপর সে সহসা আবিষ্কারের মতো দেখে ফেলল দুই সুন্দরী যুবতী যেখানে মদের কাউন্টার, ঠিক তার বিপরীত দিকের টেবলে বসে উল বুনছে। অবনীভূষণ মুখ নীচু করে চুপি চুপি উডের হাত ধরে ওদের দিকে গিয়ে বসল। তারপর চোখ—মুখ টান টান করে বলল, গুড ইভনিং ম্যাডাম এবং পাশে বসে পরিচিত হবার ভঙ্গিতে বলল, এম ভি সিটি অফ গ্লাসগো। সে তার জাহাজের নাম বলল ওদের।
মেয়ে দুজন ওকে স্বাগত জানালে সে কাউন্টারে আবার মদের অর্ডার দিয়ে বলল, ছবির মতো এই শহর। মেয়ে দুজনকে ভিন্ন অলীক স্বপ্নের কথা বলে অথবা সমুদ্রের গল্প বলে ভেজাতে চাইল।
অবনীভূষণ দামি সিগারেট বের করে ওদের একটি করে দিতেই ওরা এসে ওর ঘাড়ের উপর পড়ার মতো ভান করল—সো নাইস। কোনো অলৌকিক ঘটনার মতো অবনীভূষণের সিগার কেস, সিগারেট কেসটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখল ওরা।
অবনীভূষণ চুল—সোনা মেয়েটিকে বলল, ইউ লাইক ইট? বলে সে ওর সম্মতির অপেক্ষা করল না; সে চুল—সোনা মেয়ের হাতে যৌতুকের মতো সিগারেট কেস তুলে ধরার সময়ই কাচের জানালায় মুখ বার করে পাহাড়ের উতরাইয়ের ভিন্ন ভিন্ন আলো দেখল। আকাশ পরিচ্ছন্ন বলে, পথঘাট শুকনো বলে পার্কের বেঞ্চে এখন সব যুবক—যুবতীরা বসে নিশ্চয়ই গল্প করছে। অবনীভূষণ এবার উডের দিকে তাকাল, উড তন্ময় হয়ে নাচ দেখছে। সে, অবনীভূষণ অথবা চুল—সোনা মেয়েকে লক্ষ্য করছে না। সুতরাং অবনীভূষণ উডকে কনুই দিয়ে ঠেলা দিয়ে বলল, চল এবার উঠি। প্রায় ঠিক করে এনেছি।