এলবি চোখ বুজল। যেন রবীন্দ্রনাথকে, তাঁর দেশকে, বিজনকে অনুভব করার জন্যই চোখ বুজল। বিজন এই আবেগধর্মিতায় বিমুগ্ধ হল না। বরং পীড়িত হল। সাহিত্যের অ—আ—ক—খ সম্বন্ধে যার কোনো স্পৃহা নেই, তাকেই এই নিদারুণ সত্যে টেনে আনার কী যে অর্থ, বিজন বুঝতে পারল না। তবু সে ভাবল, হাতে অনেক দিন, পরে ভেবে যা কিছু একটা বলা যাবে।
বিজন এবার উঠতে চাইল এবং বলল, তোমার নামটা জানা হল না।
এলবি বলল, আমাকে সকলে এখানে এলবি বলেই জানে। পুরো নাম সিসিল এলবার্টি। মিস এলবার্টি বলেও ডাকতে পারো।
এলবি পুনরায় স্মরণ করিয়ে দিল, আমি তোমায় কবিতা শোনাব। ট্যাগোরের কবিতা।
বিজন ভাবল, আচ্ছা ঝামেলায় পড়া গেল। সে উঠে পড়ল।
এ সময় এলবি ওর সামনে এসে দাঁড়াল এবং হ্যান্ডশেক করল। তারপর প্রশ্ন করল, জাহাজ তোমার কোন ডকে নোঙর ফেলেছে?
সাউথ—ওয়ার্ফে। বিজন এবার দৌড়ে পালাবার মতোই হলঘর থেকে বের হয়ে রাস্তায় নেমে গেল এবং দুঃসহ ভার থেকে যেন মুক্ত হল।
ডেকে তখন পুরোদমে কাজ চলছে। এনজিন রুমেও। এনজিন—রুমে বড় বড় প্লেট সব স্ক্র্যাপ করা হচ্ছে। বড় বড় সব অক্সিজেনের সিলেন্ডার নামানো হচ্ছে। ফল্কায় ফল্কায় কাজ; জাহাজিরা রঙ করছে ফানেলে, বোট—ডেকে। একজন দুজন করে সকলে উঁকি মেরে যাচ্ছে সেলিমের কেবিনে। বিজন গতকালের ঘটনার কথা কাউকে বলেনি, সে এ ব্যাপারে যথেষ্ট গোপনীয়তা রক্ষা করতে চায়। শুধু আজ সে কিনারার লোকেদের ডেকে সেলিমের অবস্থা দেখাচ্ছে। দেখাল—এইখানে সেই লোকটি থাকে, তাকে তোমরা দেখে যাও।
প্রচণ্ড শীত এবং হাওয়ার জন্য জাহাজিদের হাতে কাজ তেমন জমছে না। ওরা ফানেলের উপর ঝুলে অথবা বোটের উপর দাঁড়িয়ে শীতে কাঁপছিল। মাঝে মাঝে গ্যালিতে গিয়ে আগুনের উত্তাপ নিয়েছে। শক্ত হয়েছে ওরা এবং রাত্রির কোনো আকস্মিক যৌন ঘটনার কথা ফলাও করে বলে কোনো জাহাজি বাহবা নিতে চাইছে।
বিজন নিচে দাঁড়িয়ে ফানেলে যে রঙ করতে উঠে গেছে তার দড়িদড়া ঢিল দিয়ে অথবা শক্ত করে বেঁধে রেখে কাজে সাহায্য করছে। আকাশ তেমনি আর্শির মতো। বন্দরের পাইন গাছ থেকে তেমনি পাতা ঝরছে। এ শীতেও এনজিন—ট্যান্ডল পুরোনো কোট গায়ে লুঙ্গি পরে নিচে নেমে গেল। জেটি ধরে হাঁটতে থাকল। গতরাতেও এনজিন—ট্যান্ডল শীতে কাঁপতে কাঁপতে বন্দরে নেমে গেছে। শীতে কাঁপতে কাঁপতে বন্দরের পথ ধরে শহরে উঠে গেছে। পুরোনো বাজারে গিয়ে দু—শিলিং দাম দিয়ে পুরোনো জামাকাপড় কিনেছে। জাহাজিরা আফ্রিকার বন্দরে অথবা ফিজি দ্বীপে ওগুলো বিক্রি করবে। গতরাতে ফেরার পথে ট্যান্ডল শীতে যখন আর হাঁটতে পারছিল না, যখন সস্তায় যৌন সংযোগের দায়িত্ব পালন করে আর হাঁটতে পারছিল না, তখন বুড়ি মেমসাব গাড়ি থেকে এই বুড়ো ট্যান্ডলকে একটা দামি ওভারকোট দয়াপরবশ হয়ে ছুড়ে দিয়েছিল। ভোরে সে দামি ওভারকোটটা সকল জাহাজিদের ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখিয়েছে। বলেছে—শীতে রাস্তায় কাঁপছিলাম, বুড়ি মেমসাব দিয়ে দিল। গতকাল এই ভারতীয় নাবিকদের কথাই দুঃখ করে বলছিল এলবি। বিজন ফানেলের নিচে দাঁড়িয়ে এনজিন—ট্যান্ডলকে শহরে উঠে যেতে দেখছে আর বিরক্তিতে ফেটে পড়ছে।
বিজন ফানেলের পাশ থেকে অন্য জাহাজিকে উদ্দেশ করে বলল, মকবুল, দেখলি এনজিন—ট্যান্ডলের কাণ্ড! আজও এই ভোরে শীতের ভিতর লুঙ্গি পরে বন্দরে নেমে গেল। দেশের জাত—মান সব ডুবাচ্ছে। তোরা কিছু বলতে পারিস না ওকে?
বিজন দেখল মকবুলের মুখেও এমত ইচ্ছা—শীতের রাতে নীলরঙের পায়জামা পরে ছেঁড়া কোট গায়ে বের হয়ে যাওয়া, পথে দাঁড়িয়ে শীতে কষ্ট পাওয়া এবং কোনো পুরুষ অথবা মহিলার দাক্ষিণ্য গ্রহণ করা। বিজন ভাবল, শীতের রাত, রাস্তায় বরফ পড়ছে, তবু নীল মার্কিন কাপড়ের জামা পায়জামা শরীরে এঁটে এইসব জাহাজিদের ভিড় কিনারায়। এইসব জাহাজিরা ভারতবর্ষ থেকে আসে। বড় গরিব, বড় নিঃস্ব। এইসব জাহাজিদের ইংরেজ কোম্পানির মালিকেরা কলকাতা বন্দর থেকে ধরে নিয়ে আসে। তাদের খেতে দেওয়া হয় বাসি গোরুর মাংস, ডাল, ভাত। মাঝে মাঝে বাঁধাকপির তরকারি দিয়ে কোম্পানি বদান্যতা দেখায়। এইসব জাহাজিরা বন্দরে লুঙ্গি পরে, ছেঁড়া ওভারকোট গায়ে শীতের রাতে ঘন আঁধারে বুড়ি মেমসাবদের খুঁজে বেড়ায়। দাম যত কমে হয়, জিনিস যত নীরস হয় ক্ষতি নেই, তবু যৌন সংযোগটুকু রক্ষা করতেই হবে। তখন বিদেশে এলবির মতো রমণীরা ভাবে ওরা অসভ্য, ওরা বর্বর। একদা পৃথিবীর সব বন্দরগুলোতে কলকাতা বন্দরের এইসব নাবিকেরা ঘুরে বেড়িয়েছে। পৃথিবীর সব বন্দরে বন্দরে ভারতবর্ষকে ওরা নোংরা নিঃস্ব প্রতিপন্ন করেছে। আজও করছে। অথচ বিজন ভাবল এর বিরুদ্ধে নালিশ নেই। যতদিন এরা থাকবে—এনজিন—ট্যান্ডলের মতো এইসব লোকগুলোও থাকবে।
বিজন এইসব ভেবে এত বিরক্ত এবং অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল যে কখন মকবুল ফলঞ্চার দড়িতে ঢিল দিতে বলেছে, কখন ইটন এসে ওর পাশে দাঁড়িয়েছে এবং ওর অন্যমনস্কতা লক্ষ্য করে হাসছে—বিজন তার কিছুই ধরতে পারেনি।
ইটন বলল, গুড মর্নিং।
বিজন বলল, ইয়েস, গুড মর্নিং।
তারপর ওরা সকলেই লক্ষ্য করল জাহাজে কেমন একটা চঞ্চলতা প্রকাশ পাচ্ছে। অনেকগুলো মোটরগাড়ি এসে বন্দরে থেমেছে। সব লম্বা চৌক মুখওয়ালা লোকেরা জাহাজে উঠে আসছে। ডেকের উপর সব জাহাজিরা, কিনারায় লোকগুলো হাত তুলে আকাশ দেখছে। ইটনও আকাশ দেখল, বিজনও আকাশ দেখল। দেখে বিস্মিত হচ্ছে। ইটনের মুখ রহস্যময় হয়ে উঠেছে, ইটন বলছে—কেমন, কাজ হল তো।