দরজা খুললে সে ফলগুলি সেলিমের হাতে দিয়ে বলল, তোর জন্যে এনেছি।
এতগুলো!
বিজন একটু হেসে বলল, ভয় নেই। এবারেও তোর কাছে টাকা চাইব না। আমি তোকে খেতে দিলাম।
বিজন বাইরে এসে দাঁড়ালে সেলিম বলল, কোনো খবর পেলি? জাহাজ কোথায় যাচ্ছে, কবে ছাড়ছে?
ঠিক কিছু বলা যাচ্ছে না। এজেন্ট—অফিস থেকে কোনো খবর আসেনি। বড়মালোম শুধু বললেন, জাহাজে সরফাই হবে। কাল সব সাহেব—সুবোরা আসবেন। এনজিন—রুমে মেরামতের কাজ আছে অনেক। জাহাজ এখানে কতদিন বসবে কাপ্তান নিজেও বলতে পারেন না।
এবার চুপি চুপি সেলিম বলল, জানিস, কাপ্তানকে আমি বললাম, সাব আমাকে দেশে পাঠিয়ে দেন। দেশে গেলেই আমি ভালো হয়ে উঠব। কাপ্তান বললেন, সেজন্যেই তো তোমাকে হাসপাতালে দিচ্ছি না। একবার হাসপাতালে গেলে তোমাকে ওরা সহজে ছাড়তে চাইবে না। তার অনেক আগেই তুমি দেশে পৌঁছে যাবে।
বিজনের বলতে ইচ্ছা হল, তা ঠিকই যাবি। তার অনেক আগেই যাবি। সে বিরক্তিতে ফেটে পড়ল। সারেং এবং কাপ্তান মিলে সেলিমকে নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে। সে আর কোনো কথা বলতে পারল না সেলিমের সঙ্গে। সেলিমের বিষণ্ণ দৃষ্টি ওকে অত্যন্ত আচ্ছন্ন করে ফেলেছে। সে ডেকে এসে নামল। কী মানুষটা কী মানুষ হয়ে গেল, ভাবল, সে সিঁড়ি ধরে ফের উপরে উঠছে। সমস্ত জাহাজে অদ্ভুত এক নিঃসঙ্গতা জাহাজের উপরে এখন যেন কেউ জেগে নেই। কিছু কিছু জাহাজি বন্দরে নাইটিঙ্গেল ধরতে বের হয়ে গেছে—তাদের ফিরতে দেরি হবে। যারা শুধু নেশা করে ফিরবে তারা একটু বাদেই ফিরবে। বিজন গলুই ধরে হাঁটল। সে এখানে রেলিংয়ের ধারে দাঁড়িয়ে একটি সিগারেট ধরাল। অন্য জেটিতে কাজ হচ্ছে বলে তার কিছু শব্দ। নীল আর্শির মতো আকাশ। আকাশে নক্ষত্র জ্বলছে। সে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আকাশ, নক্ষত্র, সমুদ্রগামী জাহাজের আলো অথবা গ্যালির পাশে ইঁদুরের ঘর দেখল। কাল ভোরে এ—জাহাজের মাল নামতে শুরু করবে। অন্ধকার রাত থেকে সব লোক উঠে আসবে ডেকে। ওরা কাজ করবে, গ্যালির আগুনে ওরা হাত—শরীর গরম করবে। আর তখন বাংকে পড়ে পড়ে দেশের কথা ভাবতে ভাবতে কাশবে সেলিম।
ভোরবেলায় বিজন এনজিন ঘরে নেমে গেল। তখন সমস্ত ফল্কায় কাজ হচ্ছে। উইঞ্চ—ড্রাইভার সিগারেট ধরাবার ফুরসত পাচ্ছে না। ক্রেন—মেশিন চালকেরা টুপি মাথায় নিচের ফল্কায় উঁকি মারছে। ফল্কায় সব কুলিদের কোলাহল। এজেন্ট—অফিস থেকে ক্লার্ক এসেছেন। তিনি ঘুরেঘুরে দেখছেন। মেজ মালোম দৌড়ে দৌড়ে যাচ্ছেন এক ফল্কা থেকে অন্য ফল্কায়। পাঁচ ফল্কায় পাঁচজন লোকের মুখে হাড়িয়া—হাপিজ শব্দ। মাল জাহাজ থেকে উঠছে, ফের বন্দরে নেমে যাচ্ছে।
এইসব দৃশ্যগুলো এখন জাহাজের ডেকে ঝুলছে।
গ্যালিতে ভাণ্ডারী নেই। বাটলারের ঘরে সে ক্রু—দের রসদ আনতে গেছে। ব্রিজে কাপ্তান পায়চারি করছেন, মেজ মিস্ত্রি নিচে নেমে গেছেন। বড় মিস্ত্রি এইমাত্র হাই তুলতে তুলতে টর্চ হাতে নিচে নামছেন। বন্দর থেকে সব কিনারার লোক উঠে আসছে। ওরা ডেক অতিক্রম করে এনজিন—রুমে নেমে গেল। বড় মিস্ত্রি ওদের নিয়ে সব এনজিন—রুমটা ঘুরলেন। বয়লারের ঘর দেখালেন। ছ’টা বয়লারের ট্যাংক—টপ, চক, টানেল পথ, কনডেনসার, এমনকি স্মোক—বক্সগুলো পর্যন্ত। তারপর ওরা বাংকারে বাংকারে ঘুরল। বিজন অন্ধকারে কোণে দাঁড়িয়ে সব দেখল। ওরা উপরে উঠে যাচ্ছে। সে ওদের দেশীয় ইংরেজি কথাগুলো কিছু কিছু ধরতে পারছে। জাহাজ এখানে বসবে অনেক দিন—এমনই ওরা যেন বলল। যেন বলল, জাহাজে অনেক কাজ, জাহাজডুবি হয়নি—জাহাজিদের সৌভাগ্য।
বিজন যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল সেটা পোর্টসাইডের বয়লারের নিচু অংশ। হাঁটু পর্যন্ত ছাই জমে আছে এখানে। নিচে কিছু পুরোনো বেলচে, শাবল, র্যাগ, স্লাইশ। কিছু ফায়ার—ব্রিজের প্লেট। ওপরের আলোটা নেই। এখানে অন্ধকার। সে এখান থেকে এনজিন—কসপের ঘরে উঠে গেল। ডেক—কসপের জন্য দুটো তামার প্লেট চাইল। তারপর সে সিঁড়ি ধরে উপরে উঠতেই বন্দরের একজন শ্রমিক বলল, গুড মর্নিং, মিস্টার।
ইয়েস, গুড মর্নিং।
বিজন বুঝল লোকটি কাজের ফাঁকে ওর সঙ্গে একটু গল্প করতে চায়। লোকটি হয়তো সস্তায় সিগারেট কিনতে চায়।
লোকটি ফের বলল, ইয়ু গ্যান্ডিম্যান?
বিজন বলল, ইয়েস।
দেবনাথ গ্যান্ডিম্যান?
বিজন বলল, ইয়েস।
দেবনাথের সঙ্গেও ওর আলাপ হয়েছে দেখে বিস্মিত হল।
লোকটি ফের বলল, অল ড্যাড়িওয়ালা পাকিস্তানি?
লোকটি তবে এইসব খবরও রাখে। সে বলল, ইয়েস।
বিজন হেঁটে যাচ্ছে ডেক ধরে। শ্রমিকটি ওর পিছু পিছু এল। এবং পকেট থেকে একটি ইউক্যালিপটাসের বোতল বের করে বলল, ইটস ফর ইউ।
বিজন এবারেও আশ্চর্য হল। দামি এই অয়েলটুকু পেয়ে বিজন খুব খুশি হল। বলল, কাম অন। কত দাম দিতে হবে?
কোনো দাম নেই। আমাকে এক শিশি সরষের তেল দেবে। দেবনাথও দেবে বলেছে। তেলটা আমি মাথায় দিচ্ছি। ইন্ডিয়া থেকে জাহাজ এলেই আমি এ—তেলের জন্য ডেকে কাজ নিয়ে উঠে আসি। তেল সংগ্রহ করি এবং তেলটা মাথায় দি। রাতে আমার ভালো ঘুম হয়।
ওরা সেলিমের কেবিন অতিক্রম করার সময় সেলিম পোর্টহোলের ভিতর থেকে কয়েদির মতো উঁকি দিল। সেলিম বাংকে বসে পোর্টহোল দিয়ে এইসব মানুষদের কাজ দেখছে। হাড়িয়া—হাপিজের শব্দ শুনছে। ড্যারিক উঠতে নামতে দেখছে। এইমাত্র এই পথ দিয়ে বড় মালোম গেলেন। দুটো মেয়ে গেল—বোধ হয় বড় মিস্ত্রির ঘরে অথবা ছোট মিস্ত্রির বাংকে। সে এখানে বসে দূরের পাইন গাছ দেখতে পেল। এবং পোর্টহোলের কাচ পেরিয়ে বিজনকেও চলে যেতে দেখল।