- বইয়ের নামঃ নগ্ন ঈশ্বর
- লেখকের নামঃ অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
নগ্ন ঈশ্বর
এক
শেষ রাতে তুষারঝড়ে পড়ে জাহাজ বন্দর ধরছে।
প্রায় মাসখানেক পর জাহাজ এবং জাহাজিরা লেগুনের মুখে বন্দরের আলো দেখতে পেল।
আর তুষারঝড়ের জন্য জাহাজিরা রেনকোট গায়ে ডেকের উপর ছুটোছুটি করছে, ওরা দড়িদড়া ফেলে দিচ্ছে নিচে। জেটিবয় সেই সব দড়িদড়া অথবা হাসিলের সাহায্যে জাহাজ বন্দরে বাঁধছে। মেজ মালোমকে ক্লান্ত মনে হচ্ছে না—তিনি দু’হাত তুলে বিচিত্র এক ভঙ্গিতে ডেক—জাহাজিদের দড়িদড়া হাপিজ অথবা হাড়িয়া করতে নির্দেশ দিচ্ছিলেন।
তখন জাহাজের পাঁচ নম্বর সাব অবনীভূষণ পোর্টহোলে উঁকি দিল। শেষরাতে জাহাজ বন্দর ধরছে, জাহাজ সেই কবে পূর্ব আফ্রিকার উপকূল থেকে নোঙর তুলে সমুদ্রে ভেসেছিল, কবে কোন এক দীর্ঘ অতীতে যেন। তারা বন্দর ফেলে শুধু সমুদ্র এবং সমুদ্রে ভাসমান দ্বীপ—বালির অথবা পাথরের জনমানবহীন দ্বীপ দেখেছে। তারা সেই দ্বীপের ঝাউগাছ এবং অপরিচিত গাছগাছালি দেখে চিৎকার করার সময় মনে করত—জাহাজ বুঝি আর কোনোদিনও বন্দর ধরবে না। শুধু সমুদ্র, এবং নীল জল, নীল আকাশ আর হয়তো ক্বচিৎ কোথাও সমুদ্রের চিড়িয়াপাখি—দূরে কখনও ডলফিনের ঝাঁক….। পাঁচ নম্বর সাবের মনে হত জাহাজ ওদের নিয়ে অন্তহীন এক সমুদ্রে যাত্রা করেছে। ওরা বন্দরে কোনোদিন পৌঁছাতে পারবে না, জাহাজ ওদের সঙ্গে তঞ্চকতা করছে।
সুতরাং এই তুষারঝড়ের ভিতরও জাহাজিদের প্রাণে উল্লাসের অন্ত ছিল না। মেজ মালোম প্রায় ছুটে ছুটে কাজ করতে জাহাজিদের উৎসাহ দিচ্ছিলেন। সামনে পাহাড়, আলো, মাটি এবং মানুষের বসতি। ওখানে কোথাও রমণীদের গৃহ আছে। মেজ মালোম উত্তেজনায় রা রা করে গান গাইতে থাকলেন। তুষারঝড়ের জন্য ওঁর কণ্ঠ ভয়ংকর কঠিন মনে হচ্ছিল আর তুষারঝড়ের জন্য সব পোর্টহোল বন্ধ। কাচের ভিতর থেকে এখন অন্যান্য জাহাজিরা বন্দর দেখছে। বন্দরটা ছোট অথচ খুব সুন্দর মনে হচ্ছিল। ক্রমশ আলো ফুটছে, ক্রমশ তুষারঝড় কমে আসছিল। আর এক এক করে সব আলো পথের এবং জেটির এক সময় নিবে যেতে থাকল। দূরের গির্জায় তখন ঘণ্টা বাজছে, জাহাজিরা সকলে ডেকের উপর উঠে এল এবং সকলে রেলিঙে ঝুঁকে পড়ছে। আবেগে উত্তেজনায় জাহাজিরা বন্দরের সকল ঘাস মাটি ফুলকে ভালোবাসার কথা জানাল।
বন্দরের প্রথম দিন এবং রবিবার। জাহাজিদের ছুটির দিন। ওরা হইহই করে আকাশ পরিষ্কার হলেই বন্দরে নেমে যাবে। শুধু তুষারঝড়ের জন্য ওরা বিরক্ত। জাহাজের পাঁচ নম্বর সাব অবনীভূষণ পোর্টহোলে বারংবার হাত রেখে ঝড়ের সঙ্গে তুষারকণা পরখ করছিল। মনে হচ্ছিল সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সমুদ্র থেকে উঠে আসা ঠান্ডা বাতাস ক্রমশ কমে যাবে, যেন ওর ইচ্ছা এই ঠান্ডা বাতাস থেমে গেলেই সে তার প্রিয় তামাকের পাইপটি মুখে পুরে যুবতীর সন্ধানে বন্দরে বের হয়ে পড়বে। এইটুকু ভেবে অবনীভূষণ আয়নায় মুখ দেখল। ভয়ংকর মুখ অবনীভূষণের, কালো নিগ্রো—সুলভ চেহারা। চুল কোঁকড়ানো, ঠোঁট পুরু—জাহাজে অবনীভূষণকে বাঙালি বলে চেনাই যায় না। অবনীভূষণ শক্ত ধাতের মানুষ। অবনীভূষণ লম্বা আর অবনীভূষণের জন্ম দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের প্রথম দিকে। অবনীভূষণ মাকে দেখেছে, বাবাকে দেখেনি। ‘অবনীভূষণ জারজ’—আয়নায় মুখ দেখার সময় পাঁচ নম্বর সাব কথাটা উচ্চারণ করল। এত দীর্ঘ ঋজু চেহারা অবনীভূষণের, আর এতবড় চোখ এবং মুখ অবনীভূষণের আর এত লম্বা থাবা অবনীভূষণের যে যুবতীরা কোনো বন্দরেই অবনীভূষণকে পছন্দ করে না।
ডেকে সামান্য কাজ অবনীভূষণের। ফরোয়ার্ড ডেকে দু’নম্বর মাস্টের নিচে উইনচ মেসিনের লিভার প্লেট আলগা হয়ে গেছে—ওটা সারাতে হবে। রবিবার তবু ওকে এই সামান্য কাজটুকু করতে হবে। বয়লার স্যুট পরে অবনীভূষণ ডেকে বের হয়ে গেল। চারিদিকে পাহাড়। তুষারঝড় কমে গেছে বলে আকাশ পরিচ্ছন্ন, লেগুনের জল সামান্য সবুজ রঙের; আর দূরে দূরে সব পাহাড় ক্রমশ উপরে উঠে গেছে। পাহাড়ের কোলে সব পরিচ্ছন্ন লাল নীল কাঠের রঙবেরঙের বাড়ি, ইতস্তত বড় বড় প্রাসাদ এবং ঠিক সেতুর অন্য পাড়ে বড় বড় কিছু স্কাইস্ক্র্যাপার। লেগুনের দু’পারেই শহর। ঠিক লৌহ আকরিকের গুদামখানার বিপরীত দিকের সেতুর ব্যালকনিতে অবনীভূষণ মানুষের ভিড় দেখল। সূর্য আলো দিচ্ছে সামান্য—খুব নিষ্প্রভ এই আলো, কোনো উত্তাপ সৃষ্টি করতে পারছে না। অবনীভূষণ লেদার জ্যাকেটের ভিতরেও হু হু করে শীতে কাঁপছিল—সামান্য উত্তাপের জন্য পাঁচ নম্বরকে খুব দুঃখিত মনে হচ্ছে।
অবনীভূষণ হাতের কাজ খুব তাড়াতাড়ি সেরে ফেলল। তাড়াতাড়ি মধ্যাহ্নের আহার শেষ করে নিজের বাংকে শুয়ে প্রতিদিনের অভ্যাসমতো কিছু নগ্ন ছবির উপর চোখ রাখতেই শুনতে পেল এলওয়েতে কে বা কারা যেন পায়চারি করছে। মেজ মালোমের গলার স্বর পাওয়া যাচ্ছে। তিনি খুব দ্রুত এবং জোরে হাসছেন। বোধহয় খুব সকাল সকাল তিনি যুবতী—সন্ধানের জন্য বের হয়ে পড়ছেন। অবনীভূষণেরও ইচ্ছা হচ্ছিল ঠিক সেই সময়ে, যখন পোর্টহোল দিয়ে অন্য তীরে তিমি শিকারের জাহাজ ভিড়তে দেখা যাচ্ছে, যখন দূরে কোথাও এক তৈলবাহী জাহাজ বাঁধা হচ্ছিল, যখন আর কিছু হাতের সামনে করণীয় নেই অথবা ‘ট্যানি টরেন্টো’ ‘ট্যানি টরেন্টো’ এক বিশ্রী শব্দ কানের কাছে ক্রমাগত বেজে যাচ্ছে তখন মেজ মালোমের মতো টিউলিপ গাছের নিচে যুবতীর সন্ধানে বের হয়ে পড়াই ভালো। এত ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও অবনীভূষণ জাহাজ থেকে সকাল সকাল নেমে পড়তে পারল না। সে রাতের জন্য অপেক্ষা করল। কারণ দিনের বেলা এই চেহারা বড় ভয়ংকর। রাতের বেলায় অস্পষ্ট অন্ধকারে অথবা নিয়ন আলোর ভিতর, ফেল্ট ক্যাপের ভিতর আর বৃহৎ ওভারকোটের জন্য মানুষের মতো মনে হয় ওকে। সুতরাং হাত—পা শক্ত করে সে বাংকেই পড়ে থাকল। শরীরের ভিতর ভয়ংকর কষ্ট এবং উত্তেজনা। বন্দরে এলেই কষ্টটা বাড়ে। বন্দর ধরলেই এই সব জাহাজিরা অমানুষের মতো চোখ—মুখ করে ঘোরাফেরা করতে থাকে—কী যেন এক সোনার আপেল ওদের হারিয়ে গেছে—সেই আপেলের জন্য, সেই সোনার হরিণের জন্য ওরা সবসময় মাটি পেলেই দ্রুত ছুটতে চায়। অবনীভূষণ দ্রুত ছুটতে চাইল।