তারপর তিনি যা দেখলেন! হতবাক। পাড়ে বগলে পুঁটুলি নিয়ে কেউ দাঁড়িয়ে আছে। ঝাপসামতো অস্বচ্ছ টর্চের আলোয় কিছুই স্পষ্ট নয়। কে দাঁড়িয়ে আছে তাও বোঝা যায় না, তবু কেউ দাঁড়িয়ে আছে। চারপাশে যেন এক জলাভূমি হয়ে গেছে নদীর পাড়, গাছ সব উপড়ে পড়েছে, সুপারিগাছগুলিও আস্ত নেই—তিনি ছুটতে ছুটতে কেবল অসহায় আর্তনাদে ভেঙে পড়ছেন, অরণি, বাবা যাস না। সামনে দ্যাখ কত বড় ঢেউ এগিয়ে আসছে। সাবধান।
আর সাবধান!
কড়াৎ করে আবার বাজ পড়ল।
সারা আকাশে বিদ্যুতের ঝলকানি—মেঘ ডাকছে গুরু গুরু। অজস্র বর্ষণে নদী ভরা কোটালের চেয়েও ভয়ঙ্কর। আর দেখলেন, কারণ টর্চটাও তার হাতে নেই। কোথায় ছিটকে পড়েছে—এক কঠিন লণ্ডভণ্ড অবস্থা তার। চোখ স্থির। তিনি তারপর চোখ বুজে ফেললেন আতঙ্কে। অরণি আবছামতো এক নারীর হাত ধরে জলে ঝাঁপিয়ে পড়ল। মুহূর্তে অদৃশ্য হয়ে গেল সে। নদীর ঢেউ তাকে কোথায় যে ভাসিয়ে নিয়ে চলে গেল।
আর সকালেই খবর, তিথিও হারিয়ে গেছে। ঝড় ওঠার পর সবাই দেখেছে, তিথি বজরা থেকে লাফিয়ে ছুটে গেছে নদীর পাড়ে পাড়ে। কেউ আটকাতে পারেনি—বাঁচাও বাঁচাও, এই ছিল তার মুখে একমাত্র কথা। একবার শুধু বলেছে, আমাকে বাঁচাও অরুদা। অরুদা তুমি কোথায়।
তারপর যা খবর, নদীর বুকে কোনও চড়ায় আশরাফের স্টিমার ডুবি হয়েছে। ঝড়ে ক্ষতির শেষ নেই। মানুষজনও ডুবে মরেছে নদীতে। তবে মরার লাশ পাওয়া গেলেও অরণি কিংবা তিথির লাশ আবিষ্কার করা যায়নি,—এবং এভাবেই তিথি এবং অরণির এই কাহিনী বছর পার না হতেই কিংবদন্তির রূপ পায়।
কেউ বলে, তিথি শুশুক মাছ হয়ে গেছে। অরণিকে সঙ্গে নিয়ে নদীর জলে হারিয়ে গেছে। কেউ পূর্ণিমা রাতে ভরা কোটালে গভীর রাতে দু’জনকেই ঢেউ—এর মাথায় সাঁতার কাটতেও দেখেছে।
কেউ বলে, মোহনার কাছে চড়া জেগে উঠেছে, খুঁজলে তাদের সেখানে পাওয়া যেতে পারে।
আবার কারও সোজা কথা, ওসব বাজে কথা। আসলে অরণি উন্মাদ হয়ে গেছিল। তিথিকে ভালোবেসে সে উন্মাদ হয়ে গেছে। এটা বয়সেরই দোষ। তিথি সেই সুযোগে ওকে নিয়ে নদী পার হয়ে কোথাও চলে গেছে। মেয়েটা জলের পোকা, তাকে আটকায় কে!