অরণি, তুই স্বপ্ন দেখছিস। তাই স্বপ্নে বকছিস। তোর স্বপ্ন দেখা কী শেষ হয়নি! শুয়ে শুয়ে বিড় বিড় করে সেই কখন থেকে—
স্বপ্ন কেন হবে বাবা! আমি তো দেখতে পাচ্ছি, ওর বগলে একটা পুঁটুলি, সে পাগলের মতো নদীর পাড় ধরে ছুটে আসছে। বজরাখানা নদীর পাড়ে ডিমের খোলার মতো তুফানে এসে আছড়ে পড়েছে। খান খান হয়ে গেছে বজরা। আশরাফ চাচার স্টিমার ডুবে যাচ্ছে।
মহাজন খুবই সদাশয় মানুষ—তিথিকে ফেলে তিনি কিছুতেই অতিথিনিবাসে গিয়ে উঠতে পারেন না। বজরা ডিমের খোলার মতো তছনছ হয়ে পড়ে আছে পাড়ে, জানলি কী করে!
আর তখনই কড়াৎ করে বজ্রপাতের শব্দ। চরচর কেঁপে উঠল, কোনও বৃক্ষের উপর পড়তে পারে—বজ্রপাতের সাদা গন্ধও নাকে এসে লাগল জগদীশের।
তিনি তাড়াতাড়ি দোহাই জয়মুনি বলে আত্মরক্ষার চেষ্টা করলেন। জয়মুনির দোহাই দিলে বজ্রের ধার কমে আসে—মুনিঋষিদের বাক্য কখনও বিফল হয় না। জয়মুনি সহজেই বজ্রের ব্যাপকতা নষ্ট করে দিতে পারেন। নিজের এবং পুত্রের নিরাপত্তার কথা ভেবেই তিনি জয়মুনির দোহাই না দিয়ে পারেননি।
কিন্তু অরণির কোনও ভ্রূক্ষেপ নেই। সে হাঁটুর মধ্যে মাথা গোঁজ করে বসেই আছে চারপাশের ব্যাপ্ত তাণ্ডবলীলা তাকে বিন্দুমাত্র সচকিত করছে না।
সহসাই ফের অরণি বলল, আমি যাব বাবা।
কোথায় যাবি!
তিথি নদীর পাড়ে আমার জন্য অপেক্ষা করছে।
আর পারা যায়! কেন সে অপেক্ষা করবে। সে মহাজনের এখন আশ্রিত জন, তার জন্য ভাবতে হবে না। মহাজনের লোকজনের অভাব নেই—তাদের কাছ থেকে তিথি কখনোই ছাড়া পেতে পারে না। সব মনের ভুল। হাতমুখ ধুয়ে, মাথায় মুখে ভালো করে জল দে। বায়ুচরা হয়ে গেলে লোকে ভুলভাল কথা শুনতে পায়। ভুলভাল বকে। ওঠো। মাথায় জল ঢেলে দিচ্ছি। ওঠো, বালতিতে জল আছে, হাতমুখ ধুয়ে নাও।
অরণির এক কথা, আমি যাব বাবা। নদীর জল তালগাছ সমান উঁচু হয়ে ভেসে যাচ্ছে। হাজার হাজার শুশুক মাছ সাঁতার কাটছে। ওরা তিথিকে নিতে এসেছে, আমি জানি।
তুই সব জানিস। যতসব আজগুবি চিন্তা!
আজগুবি নয়। সত্যি কথা। তিথি আর জন্মে শুশুক মাছ ছিল। সে আমাকে বলেছে।
আর কী বলেছে? জগদীশ বিরক্ত হয়ে গালে চড়ই কষাতে যাচ্ছিলেন।
ও যে বলেছে, তুমি আমাকে স্বপ্নে দ্যাখোনা অরুদা?
স্বপ্ন দেখলে কী হয়?
বারে ওর তো বিশ্বাস, স্বপ্ন দেখলে ভালোবাসা হয়। ভালোবাসলে স্বপ্ন দেখতে হয়। আমি ওকে মিছে কথা বলেছি বাবা। ওকে আমি স্বপ্নে আগে কখনও দেখিনি। তবু বলেছি, স্বপ্নে দেখেছি। ও যদি খুশি হয় তাই বলেছি।
ওতে কিছু হয় না। উঠে আয়। তুই নিজের মধ্যে নেই।
ও যে বলেছে, তুমি অরুদা তুলিকে কখনও স্বপ্ন দ্যাখো না তো?
আসলে জগদীশ জানেন গোরার মেয়েটা বড় হতে হতে কিছুটা ইঁচড়ে পক্ব হয়ে গেছে। মেয়েটা এমন সব কথা বলেই অরণির মাথা বিগড়ে দিয়েছে।
তা না হলে তার স্বভাবলাজুক ছেলের এই পরিণতি হয় না। বেজায় নির্লজ্জ না হয়ে গেলে বাবাকে কেউ ভালোবাসার কথাও বলতে পারে না। এমনও হতে পারে অরণি তার অস্তিত্বের কথাই ভুলে গেছে। সে যে তার বাবার সঙ্গে কথা বলছে, তেমনও হুঁশ না থাকতে পারে। জগদীশ খুবই বিচলিত হয়ে পড়ছেন। কাউকে যে ডাকবেন, ডেকে কথা বলবেন, অরণি ধীরে ধীরে কেমন যেন হয়ে যাচ্ছে। আপনারা আসুন, কিছু তার উপর নিশ্চয়ই ভর করেছে। নদীর জলে মেয়েটা ভেসে গেল না তো! মরে গেল না তো! ভূত হয়ে অরণির মাথায় ঢুকে গেল না তো! ভূত প্রেতে জগদীশের প্রবল বিশ্বাসও আছে—তিনি ভাবলেন সকাল হলে অনাদি ওঝাকে ডেকে দেখাবেন, এখন রাতটা কাটলে হয়।
তখনই অরণি দাঁড়িয়ে গেল। চোখমুখ কেমন তার থমথম করছে।
অরণি চিৎকার করে উঠল, ডুবে গেল—স্টিমারটা ডুবে গেল। আশরাফ চাচা ডেকে ছোটাছুটি করছে। লাইফ জ্যাকেট, বয়া সব ছুঁড়ে ছুঁড়ে দিচ্ছে। সবাই নেমে না গেলে তিনি নামতে পারছেন না।
অরণি, বাবা তুই কী হয়ে যাচ্ছিস? কোথায় স্টিমার?
ঐ দ্যাখো বাবা, ডেক ছাদে তিথি চাচার ভাঙা সানকি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমি দেখতে পাচ্ছি সব। তিথিকে স্বপ্নটার কথা না বললে পাপ হবে। আজ সত্যি তিথিকে স্বপ্নে দেখেছি।
এবারে তিনি তিরস্কার না করে পারলেন না—বের করছি তোমার পাগলামি। টানতে টানতে বালতির কাছে নিয়ে যাচ্ছেন, মাথাটা ধুয়ে দিলে আরাম পেতে পারে। ওর ঘুমানো দরকার। আসলে কোনও ঘোর থেকেও এসব দেখতে পারে। মাথাটা ধুয়ে দিলে শরীর ঠান্ডা হবে। কিন্তু অরণি কিছুতেই যেতে চাইছে না। শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অরণি যে তার পুত্র এখন কিছুতেই মনে হচ্ছে না জগদীশের। যেন এক নতুন জগৎ আবিষ্কারে অরণি মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে আছে।
তারপরই অরণি কাণ্ডখানা ঘটিয়ে ফেলল। হাত ছাড়িয়ে ছুটে গেল দরজার দিকে, আমি আসছি তিথি, তুই দাঁড়া বলে দরজা খুলে দুর্যোগের মধ্যে ছুটতে থাকল।
জগদীশ হতভম্ব। মাথায় কিছু দিচ্ছে না তাঁর। তিনি কিছুটা উদভ্রান্ত। তারপর কী ভেবে যে টর্চটা হাতে নিয়ে বের হয়ে ডাকতে থাকলেন—তুই যাস না অরণি। তিনি প্রাসাদের দিকে ছুটে যেতে পারতেন, প্রবল বর্ষণে তার শরীর ভিজে যাচ্ছে, ঝোড়ো হাওয়ায় এগোতে পারছেন না। সবকিছু ঝাপসা। টর্চ জ্বেলে দেখলেন, অরণি সুপারিবাগানের মধ্যে ঢুকে গেছে। তিনিও সুপারিবাগানের মধ্যে যাবার জন্য ছুটছেন, বৃষ্টি কিংবা বন্যার জলে থইথই করছে মাঠ, তারও যেন হুঁশ নেই। টর্চ জ্বেলে কাউকেই দেখতে পেলেন না, একা অরণি নদীর পাড়ের দিকে ছুটছে। এক অতিকায় অজগরের মতো নদী ফুঁসছে, গাছপালা তছনছ করে ঝড় উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে সব, একবার কী ভেবে চিৎকার করেও ডাকলেন, কে কোথায় আছেন আপনারা, শিগগির আসুন, অরণি উন্মাদ হয়ে গেছে।