এই অরণি, অরণি!
সাড়া নেই। দরজা খুললে বৃষ্টির ছাটে সব ভিজে যাবে। হাওয়ায় হারিকেনও নিভে যেতে পারে। তিনি তাড়াতাড়ি মাথার উপরের পাটাতন থেকে টর্চটা নামিয়ে হাতের কাছে রেখে দিলেন। একবার মাঠ পার হয়ে প্রাসাদের দিকে যেতে পারলে ভালো হত। নিরাপদ জায়গা। কিন্তু অরণিকে যে ঘুম থেকে তোলাই যাচ্ছে না।
এই, কিরে তুই! কী ঝড় শুরু হয়েছে। ওঠ। শিগগির ওঠ।
তিনি অরণির হাত টেনে বসিয়ে দিতে চাইলেন, কিন্তু এ কি, সে তো বসে থাকছে না। হয়েছেটা কী! কেমন নেশাখোর মানুষের মতো সে বেহুঁশ।
অরু! তোর কী হয়েছে!
অরণি সাড়া দিচ্ছে না।
সারাদিন কোথায় ছিলি! মেলায় কী খেয়েছিস?
জগদীশ ভয় পেয়ে গেছেন। তাকে ডাকছেন, তাকে ঠেলে পাশ ফিরিয়ে দিচ্ছেন, অথচ অরণি চোখ খুলে তাকাচ্ছে না। বজ্রপাতের শব্দে কানে তালা লেগে যাচ্ছে, অরণি স্বাভাবিক থাকলে, কখনোই এভাবে বিছানায় পড়ে থাকতে পারত না। তিথিকে বজরায় তুলে নিয়ে গেছে শোনার পর থেকে সে যেন আরও বেহুঁশ।
এখন জগদীশ যে কী করে! ঝড়ে, নদীর প্লাবনে সবকিছু তছনছ হয়ে গেল।
একটা গাছ ভেঙে পড়ল, অরণি কিছুই টের পাচ্ছে না। লম্বা হয়ে পড়ে আছে।
অরণি বাবুদের প্রাসাদে যাবি? এখানে থাকা আমাদের উচিত হবে না। অরণি তুই ওঠ, ঘরের নিচে আমরা চাপা পড়ে থাকব। অরণি, তিথিকে বজরায় তুলে নিয়ে গেছে, এই দুর্যোগে, বজরার অবস্থা কীরকম বুঝতে পারছি না। আসিনুল যদি বাতাসের গন্ধ শুঁকে ঝড়ের আভাস টের না পায়, বজরা ডুবে যেতে কতক্ষণ!
অরণি এবার তাকাল।
তাকাল ঠিক। তবে ওর চাওনি স্বাভাবিক নয়। কোনও অতি দ্রুত ধাবমান জলরাশি পার হয়ে সে যেন নদীর পাড়ে উঠে এসেছে। চোখে কিছুটা দুঃস্বপ্ন, কিছুটা দুশ্চিন্তা এবং ক্ষোভ জ্বালাও হতে পারে—তিথির জন্য অরণির কষ্ট হওয়া স্বাভাবিক, নানা ধন্দ দেখা দিতেই জগদীশ বললেন, এখন ঘুমাতে নেই, অবস্থা বিশেষ ভালো ঠেকছে না। দেখি ভেতর বাড়িতে যাওয়ার কোনও অবস্থা করা যায় কি না।
ছাতায় যে কাজ হবে না তিনি জানেন।
বৃষ্টি মাথায় ছুটে যেতে পারেন, তবে, যা ঝড়, গাছটাছ মাথার উপর উপড়ে পড়া বিচিত্র নয়। এবং অরণি যাবে কি না, সে তো উঠেও বসল না। তার যেন জীবন নিয়ে কোনও চিন্তাই নেই। সে যেন সব সুখ দুঃখ এবং অনুভূতির বাইরে।
অরণি তোর কী হয়েছে?
অরণি এবার উঠে বসল ঠিক, তবে মাথা দু হাঁটুর ফাঁকে গোঁজ করে রাখল।
আর একটা ছোলা এত জোড়ে এসে ঘরে ধাক্কা মারল যে, মনে হয় সব এবার সত্যি উড়িয়ে নেবে। কবে থেকে তাঁর এই নদীর পাড়ে বাস, কখনও এমন ভয়ঙ্কর ঝড়ের সোঁ সোঁ আওয়াজ টের পাননি। কোথাও যেন বড় রকমের ধ্বংসকাণ্ড শুরু হয়ে গেছে।
হঠাৎ চিৎকার করে উঠল অরণি!
শুনতে পাচ্ছেন, আপনি শুনতে পাচ্ছেন বাবা!
তিনি অনেক কিছুই শুনতে পাচ্ছেন, মহাপ্রলয়ের মতো অবস্থা, মনে হয় নদীর জল ফুলেফেঁপে পাড় ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। কারণ জানালার ফাঁক দিয়ে বাইরের ঘাসের জমি জলে ডুবে গেছে দেখতে পেলেন। বাতাসের শব্দে নানাপ্রকার কুহক তৈরি হচ্ছে। নদীর জলে বাতাসের প্রচণ্ড চাপ, জল উথাল—পাতাল হচ্ছে নদীতে, তার শব্দও কান পাতলে শোনা যাচ্ছে—কিছু ঝড়ের পাখি বাঁশঝাড়ের ভেতর আশ্রয় নিয়েছে, বাঁশের তাণ্ডব নৃত্য শুরু হয়ে যাওয়ায় কোথাও দূরে কোঁ কোঁ আওয়াজ উঠছে। আর তার ভেতর সেই সব অসহায় পাখিরা আর্তনাদ শুরু করে দিয়েছে। কিন্তু অরণি কী বলতে চাইছে! তিনি তার কিছুই বুঝতে পারছেন না।
কোনও শব্দ কিংবা নদীর পাড়ে কোনও তরঙ্গমালার আঘাত যদি ভাসমান কিম্ভূতকিমাকার হাহাকার হয়ে ভেসে আসে, সেই সব শব্দমালার কথা কি অরণি বলতে চাইছে! সে কি কোনও হাহাকারের শব্দ শুনতে পাচ্ছে।
অরণিকে না বলে পারলেন না, তুই কী শুনতে পাচ্ছিস?
তিথি আমাকে ডাকছে?
তিথি ডাকছে! তোকে কেন ডাকবে?
ডাকছে। শুনতে পাচ্ছেন না, অরুদা, তুমি যাবে না!
তুই কোথায় যাবি তিথির সঙ্গে।
সে তো আমাকে নিয়ে যেতে চায়।
স্বভাব লাজুক অরণির এমন কথায় তিনি ঘাবড়ে গেলেন। সামনে টেস্ট পরীক্ষা, অরণি সতেরো বছরে পড়েছে। মেয়েদের সম্পর্কে সে খুবই লাজুক, কখনোই সে তুলির সঙ্গে কথা বলতে পারে না। জমিদারবাবুর মেয়েটা একটু চঞ্চল স্বভাবের, কিন্তু অরণি কখনোই তার সামনে পড়তে চায় না, তুলি এক দরজা দিয়ে ঢুকলে সে অন্য দরজা দিয়ে বের হয়ে যায়, সেই অরণিকে তুলির বয়সি তিথি এই ঘোর দুর্যোগে কোথায় নিয়ে যাবে!
তিনি কিছুটা বিষাদগ্রস্ত হয়ে পড়লেন। ছেলেটার মাথা বিগড়ে যায়নি তো! ধমকও দিতে পারেন না, ছেলেটা এমনিতেই তার ভারী কোমল স্বভাবের, তাকে বড় হতে হবে, পড়াশোনা করে মানুষ হতে হবে, তার মায়ের এমন ইচ্ছের কথা ভালোই জানে, সে কেন দুর্যোগের রাতে তিথির কণ্ঠস্বর শুনতে পাবে!
কী আজেবাজে বকছিস? তিথি কেন মরতে আসবে, সে তো বজরায় আছে, বজরা না থাকলেও, বড় শরিকের অতিথিনিবাসে গিয়ে উঠেছে। নদী যদি সত্যি খেপে যায় তবে আসিনুল আগেই তা টের পাবে। সে বজরা পাড়ে ভিড়িয়ে দিয়েছে ঠিক, সে খুব হুঁশিয়ার মাঝি, বহু ঝড়ঝঞ্ঝার সে সাক্ষী। জলে জলে তার জীবন কেটেছে, সেটা বুঝতে শেখো।
তবু যে ডাকছে তিথি! ঝড়বৃষ্টি মাথায় করে সে ছুটে আসছে!