তিনি টের পেলেন আকাশ বড় গুরুগম্ভীর।
তিনি কিছুটা পা চালিয়ে হাঁটছেন আবার কিছুটা গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ছেন। আকাশ যেন খুবই নিচে নেমে এসেছে। এলোমেলো হাওয়ায় গাছের ডালপালা দুলছে। শীতল হাওয়ায় দাঁড়িয়ে থাকতে আরাম বোধ করছিলেন।
নদীর দিকে তাকালেন তিনি। সুপারিবাগান পার হয়ে নদী দেখাও কঠিন। মিশকালো অন্ধকারে সব ঢেকে গেছে। মনে হল হঠাৎ হাওয়া পড়ে গেল। চরাচর কেমন থম মেরে গেছে। নদীর পাড়ে তার কাছারিবাড়ি বলে ঝোড়ো হাওয়া উঠলে বেশ জোরেই এসে কাছারিবাড়িতে আছড়ে পড়ে। ঘরের দরজা জানালা সব ঠাস ঠাস করে বন্ধ হয়, খুলেও যায়। দরজা খোলা রেখে অবশ্য আসেননি। শেকল তুলে দিয়ে এসেছেন—কিন্তু জানালাগুলি সব খোলা। জোর বৃষ্টি হলে বিছানা সব ভিজে যায়।
তিথিও নেই যে সব নজর রাখবে। গোপীবল্লভ নদীতে রাত কাটিয়ে সকালে পাল তুলে দেবেন বজরার। মানুষজন তাঁর মেলা। বজরার সঙ্গে নৌকার বহর। কোনওটায় বামুনঠাকুর, কোনওটায় গদির সরকারমশাই—সবাই সপরিবারে হাজির কর্তার সঙ্গে। এমন পুণ্যস্নানের সুযোগ কেউ ছাড়তে রাজি হয়নি। ঝি—চাকরদের আলাদা নৌকা। বজরায় শুধু তার দুই স্ত্রী, তিথি উঠে যাওয়ায় অবশ্য তিনজন। তার দুই স্ত্রী সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছে তিথিকে। শুভদিনে বিবাহ। দেশে রেখে যেতে কেউ রাজি হয়নি। মহাজনের ইচ্ছের উপর কারও কথা নেই। নবকুমারবাবু অবশ্য বলেছিলেন, কিছুদিন এখানে থেকে গেলেও অসুবিধা হবে না। আপনার যখন পছন্দ হয়েছে। দিনক্ষণও ঠিক—গোরাচাঁদের ভাঙা ঘরে না রাখেন, আমাদের বাড়িতেও তিথি থাকতে পারবে।
গোপীবল্লভ রাজি হননি।
অত্যন্ত সদাশয় মানুষটি কেবল বলেছিলেন, থাকতে পারে, তবে এটোকাঁটা খেয়ে না আবার আমার ইজ্জত নিয়ে টানাটানি করে। যা স্বভাব!
তখন সবাই একবাক্যে বিষয়টি নিয়ে মনস্থির করে ফেলে। গোঁরাচাদও রাজি। তার তো বাড়িতে পাকা দালানকোঠা হবার কথা। বাজারে মুদিখানাও খুলে দিতে পারেন। মহাজন মানুষটি কম কথা বলেন। তার পাকা গোঁফ এবং নাদুসনুদুস শরীরটি তেল মাখনে যে ডুবে আছে দেখলেই বোঝা যায়। তিথি তার সেবাযত্ন করতে পারবে, আসলে এখানে রেখে যেতে মন তাঁর সায় দেয়নি। বাবুরাও ও মহাজন ব্যক্তিটিকে খুশি রাখতে পারলে অসময়ে ধার কর্জ পেতে অসুবিধা হয় না। জমিদারির খাজনা সরকারের ঘরে জমা দেবার সময় বাবুদের মহাজনের গদিতে ছুটতেই হয়। শুধু যে গোপীবল্লভের পাটের ব্যবসা, তেজারতির কারবার নিয়ে এমন রমরমা অবস্থা তাও নয়। ইস্টিমার কোম্পানির তিনি একজন বড় অংশীদার। তিথির সৌভাগ্য এমন হবে জগদীশ স্বপ্নেও ভাবতে পারেননি। তিনি অন্ধকারে দাঁড়িয়েই মেয়েটার ভালো হোক বলে কপালে হাত ঠেকালেন।
তিথি না থাকায় কাছারিবাড়িটাই শুধু খালি হয়ে গেল না, জমিদারবাবুর প্রাসাদ, সুপারির বাগান, নদীর চর, দিঘির পাড়ের ঝোপজঙ্গল সবই খালি হয়ে গেল। নদীর জলে আর যখন তখন কেউ ঝাঁপিয়ে পড়বে না। কিংবা কোঁচড়ে খই—বাতাসা নিয়েও ইস্টিমার ঘাটে কেউ দাঁড়িয়ে থাকবে না। তিথির কথা ভাবতে গিয়ে জগদীশ কেমন কাতর হয়ে পড়লেন।
তখনই ঝুপ ঝুপ করে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল।
জগদীশ দৌড়ে ঘরের সিঁড়িতে উঠেই টের পেলেন, তীরবেগে ঝড় ছুটে আসছে। হাওয়ায় যেন তাকে উড়িয়ে নেবে।
তিনি দ্রুত ঘরে ঢুকে দরজা—জানালা বন্ধ করে দিতে থাকলেন। অরণি ঘুমুচ্ছে। মশারি না টাঙিয়েই শুয়ে পড়েছে। মশার কামড়ে ছেলেটা জেরবার, কোনোই হুঁশ নেই। চালে আমের বড় ডালের ঘসটানিতে ঘরটা কাঁপছে। তিনি হারিকেনের আলো উসকে দিলেন। বৃষ্টির ছাট এত তীব্র যে টিনের চালে বড় রকমের দাপাদাপি শুরু হয়ে গেছে। তারপরই মনে হল ডাল ভেঙে পড়ার শব্দ। আমগাছের অতিকায় ডালটি কেটে ফেলা উচিত ছিল, ঝড়বৃষ্টির সময়ই এ—কথাটা তিনি ভাবেন, কিন্তু কাটা আর হয় না। সেই ডালটি ভেঙে পড়ল কি না কে জানে! সামনের দরজা খুলে বারান্দায় গিয়ে দেখতে পারেন, কিন্তু দরজা খুলতে সাহস পাচ্ছেন না—বাড়িতেই এই অবস্থা, নদীতে না জানি কী হচ্ছে—ভাদ্র—আশ্বিনের এই সময়টায় নদী মাঝে মাঝে ক্ষেপে ওঠে—অসময়ে ভরা কোটালেরও আবির্ভাব হয়। দুর্যোগ শুরু হয়ে যায়। নদীর দু—পাড় জলে প্লাবিত হয়। নদীতে কেউ নৌকা রাখতে সাহস পায় না। ইস্টিমার মাঝনদীতে থাকলে কিনারে ভিড়িয়ে দেওয়া হয়। গেরাফি ফেলে, মোটা কাছিতে বেড় দিয়ে দেওয়া হয়।
মহাজনের বজরায় কী অবস্থা, কে জানে! তবে বজরার মাঝিরা হাওয়ায় গন্ধ শুঁকে টের পায় সব। তারা যথেষ্ট সাবধানী। মহাজনের বজরা আসিনুল মাঝির হেপাজতে থাকে। সে বড় দড়িয়ার মাঝি ছিল একসময়, তার ঝড়বৃষ্টির অভিজ্ঞতা যথেষ্ট—ঘূর্ণিঝড়েও তার নাও কাত করতে পারে না। সে ঠিকই টের পেয়ে গেছে, নদীর কুহেলিকার কথা। বড় শরিকের অতিথিনিবাসের কাছে বজরা নিয়ে তুলতে পারে। ঝড়ের দাপটে কোনও অঘটন ঘটে গেলে যাতে নৌকাডুবির আশঙ্কা না থাকে, তার ব্যবস্থাও তার জানা।
জগদীশ বারান্দায় নেমে যাবার জন্য দরজা খুলতে কিছুতেই সাহস পাচ্ছেন না। ঝড়ে ডাল ভেঙে পড়ল, না বিশাল আমগাছটির গোড়া উপড়ে গেল! কী যে করেন তিনি। তখনই চারপাশে আর্ত চিৎকার, কোথাও শাঁখ বাজছে, কাঁসি—ঘণ্টার শব্দও কানে আসছে—বাবুদের প্রাসাদেও তোলপাড় শুরু হয়ে গেছে। চারপাশে শুধু শঙ্খধ্বনি। উলুধ্বনিও শোনা যাচ্ছে। আসলে দুর্যোগ যে অতিমাত্রায় আতঙ্কে ফেলে দিচ্ছে মানুষজনকে বোঝাই যায়। তিনি কী করবেন বুঝতে পারছেন না। এই দুর্যোগের রাতে ঝড়ের ছোলায় কাছারিবাড়ির টিনের চাল উড়ে গেলে অরুণিকে নিয়ে বিপদে পড়ে যাবেন। হুড়মুড় করে মাথার উপরের মুলিবাঁশের পাটাতনও ভেঙে পড়তে পারে। হরমোহন থাকলে তাঁর এত আতঙ্ক হত না। অরুণির কথা ভেবেই তিনি কাতর হয়ে পড়ছেন। ডেকে তুললে হয়—এ যে কুম্ভকর্ণের নিদ্রা, কোনও হুঁশ নেই।