তিথিও পাশে নেই।
কোথায় গেল।
এক অতি অবধারিত লীলা দেখতে পেল তিথির। অথচ তিথি নেই।
তিথি তখনই উড়ে উড়ে হাজির।
অরুদা।
কোথায় থাকিস।
আমার সঙ্গে এসো। আশরাফ সারেঙের ঘরটা খুঁজে পেয়েছি। ঐ যে স্টিমারটা দেখছ, বালিতে ডুবে আছে, ঐ যে ডেক ছাদের ঘরটা দেখছ, ওখানটায় আশরাফ সারেঙ থাকতেন। ওর লুঙ্গি, ফতুয়া, দড়িতে ঝুলছে। একটা জানালাও আছে। চলো না, দাঁড়িয়ে থাকলে কেন?
ওরা দু’জনই এখন উড়ে যেতে পারছে। শরীর এত হালকা হয় বাতাসে উড়ে গিয়ে এই প্রথম টের পেল অরণি। তিথি পাশে থাকায় এটা হয়েছে। তিথির শরীরে তো কিছুই নেই। সে হালকা হয়ে যেতেই পারে। কিন্তু তার শরীরে জামা এবং প্যান্ট—জামাপ্যান্টে হাওয়া এসে ঢুকলেই বিপদ। জামাপ্যান্ট হাওয়ায় পত পত করে ওড়ে অথবা জামার মধ্যে হাওয়া আটকে গিয়ে নৌকার পালের মতো ফুলে ওঠে—তখন সে অবশ্য অনায়াসে হালকা হয়ে গিয়ে দূরের নক্ষত্রও ছুঁয়ে আসতে পারে, তার শরীরে জামাপ্যান্ট থাকায় কোনও অসুবিধাই হচ্ছিল না।
তখনই বালির চরে জেগে থাকা একটা ডেক ছাদের ঘরে তিথি ঝুপ করে নেমে পড়ল।
এই অরুদা কোথায় যাচ্ছ আমাকে ফেলে—
সে যেন কত শত কোটি বছর আগেকার এক ছোট্ট গ্রহাণু—তার নিজস্ব কোনও বেগ আর গতি নেই—সে এক মহাশূন্যে অখণ্ড হয়ে আছে, তিথি ডেক ছাদে দাঁড়িয়ে। আশরাফ সারেঙের একটা ভাঙা সানকি হাতে সে অপেক্ষা করছে তার অরুদা যেখানেই যাক, তার কাছে আবার ফিরে আসবে।
তখনই তাকে কে যেন ঝাঁকাচ্ছে। ডাকছে, এই অরু ওঠ। খাবি না। কত রাত হয়ে গেছে। ঘুমিয়ে পড়লি!
আমি খাইনি!
না খাওনি।
বাবা তিথি কোথায়?
ওকে মহাজন বজরায় তুলে নিয়ে গেছে।
আমি খাব না।
খাবি না কেন?
আমার একদম খেতে ইচ্ছে করছে না। এই তো কিছুক্ষণ আগে খেলাম। তারপর…
তারপর কী!
আমি আর কিছু জানি না।
মেলায় খেয়েছিস।
অরণি চুপ করে থাকল।
অরণি এই প্রথম তিথিকে স্বপ্নে দেখেছে। সত্যি দেখেছে। কিন্তু তিথিকে তার স্বপ্নের কথা আর কখনোই বলা হবে না। তিথিকে বজরায় তুলে নিয়ে গিয়েছে গোপীবল্লভ পাল। তিথি আর কখনোই নদীর গভীর জলায় শুশুক মাছ হয়ে ঘুরে বেড়াতে পারবে না।
নয়
জগদীশ কিছুতেই অরণিকে ঘুম থেকে তুলতে পারলেন না।
হাত ধরে টেনে বসিয়ে দিলেন, হাত ছেড়ে দিলেই শুয়ে পড়ছে। ঘুম জড়ানো চোখে। তার এক কথা।
আমি খেয়েছি, এই তো খেয়ে শুলাম। আমার খেতে ইচ্ছে করছে না।
অগত্যা জগদীশ আর কী করেন!
রান্নাবাড়িতে ঢুকে গেলেন। রাত কম হয়নি। অরণির জন্য সবাই বসে আছে। মহাজন গোপীবল্লভ তার বামুন ঠাকুর দিয়ে জমিদারবাবুর বাড়িতে পেল্লাই ভোজের ব্যবস্থা করেছেন। পাত পেতে কেউ কেউ খেয়ে গেছে। অরণি না খেলে বউঠান কিংবা বাবুরা খেতে পারছেন না, অগত্যা কী করা যায়, জগদীশ বউঠানকে বললেন, অরু খাবে না। ওর খিদে নেই বলছে।
নবকুমারবাবু বারান্দায় বের হয়ে আসছেন। বাড়ির আরও সবাই, লম্বা বারান্দায় কিংবা বিশাল রান্নাঘরে আসন পাতা। জলের গেলাস থালা দিয়ে ঢাকা। সবাই একসঙ্গে বসে খাওয়ার রেয়াজ এই রান্নাবাড়িতে।
তুলিকেও তুলে আনা হয়েছে। সেও খাবে। কিছুটা বনভোজনের মতো ব্যবস্থা করেছিলেন গোপীবল্লভ পাল। তার লোকজন জঙ্গল সাফ করে নদীর পাড়ে রান্নার বন্দোবস্ত করেছিল। তার বামুন ঠাকুর অত্যন্ত নিয়ম নিষ্ঠা বজায় রেখে রান্না করেছে। বাবুরা নদীর পাড়ে যাবেন না, বাড়িতে সব পাঠিয়ে দেবার ব্যবস্থা সুচারুভাবেই করা হয়েছে। কিন্তু অরণির জন্য সবাই অপেক্ষা করছিল, সে এসে গেলেই খেতে বসা হবে, সেই অরুকেই কাছারিবাড়ি থেকে নিয়ে আসা গেল না।
বৃন্দাবন বলল, আমি একবার যাই।
জগদীশ বললেন, গিয়ে লাভ হবে না। ওতো বলছে, সে খেয়েছে।
তুলি বলল, কখন খেয়েছ?
তাতো জানি না।
বউঠান বললেন, ঘুমের ঘোরে বলছে, তুমি আর একবার যাও!
না বউঠান। ও ঘুমিয়ে পড়লে, তুলে খাওয়ানো খুবই ঝামেলা। একটা তো রাত। না খেলেও কিছু হবে না।
বউঠান সহজে ছাড়বার পাত্র নন।
ও কী খেল! রান্নাবাড়িতে ওকে কে খেতে দিল!
বড়দা বলল, আসলে, বাহানা। আমি গিয়ে দেখছি।
বড়দা মেজদা সবাই আসনে বসে গেছেন। তুলি, নবকুমারবাবু, বাড়ির কেউ বাদ নেই। জগদীশও বসে গেছেন—অরণি সারাদিন কোথায় ঘুরেছে মেলায় তিনি কিছুই জানেন না, মেলায় জলছত্র থেকে ভলান্টিয়ারদের দেখাশোনার দায়িত্ব ছিল তাঁর—সারাদিনে একবার অরণির সঙ্গে তাঁর দেখাও হয়নি, অবশ্য তাঁর টাকার থলে থেকে অরণি কিছু টাকা চেয়ে নিয়েছে, তিথিকে নিয়ে মেলায় যাবে, এমনও ভাবতে পারে অরণি, কাজেই মেলায় তারা যদিও মিঠাই মণ্ডা পেট ভরে খেয়ে থাকে, এমন সাত— পাঁচ ভাবনাই অরণিকে জোরজার করে তুলে খাওয়াবার বিষয়ে জগদীশকে কিছুটা নিস্পৃহ করে রাখতে পারে। তিনি মেজদার দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমাকে যেতে হবে না। খেয়ে নাও। কতক্ষণ তোমরা আর বসে থাকবে!
জগদীশ রান্নাবাড়ি থেকে ফেরার সময় টের পেলেন, আকাশ ভেঙে বজ্রপাত নেমে আসছে। সারা আকাশ জুড়ে বিদ্যুতের ঝলকায় ভেসে গেল চরাচর। ঝড় উঠবে। বৃষ্টিও নামতে পারে জোরে। সারাদিন যা গরম গেছে, ভ্যাপসা গরমে শরীরের সব রক্ত যেন ঘাম হয়ে বের হয়ে আসছিল—তিনি খুবই ক্লান্ত, নদী থেকে ঠান্ডা ঝোড়ো হাওয়ায় তার শরীর জুড়িয়ে গেল।