সবার উপরই সে ক্ষুব্ধ।
বাবার উপরও।
কেউ মানুষ না।
তিথির দুঃখ কেউ বুঝল না।
ভাবতে ভাবতে কখন সে স্টিমারঘাটে চলে এসেছে। একা দাঁড়িয়ে থাকতে তার ভয়ও করছে। নদীতে সারি সারি নৌকা। লণ্ঠন জ্বলছে। কোনও নৌকায় রান্না হচ্ছে। তিথি পাশে থাকলে তার কোনও ভয় থাকত না। সে ঠিক নৌকায় উঠে পড়তে পারত। এবং টালমাটাল নৌকায় তিথিকে নিয়ে ছোটাছুটি করতে পারত।
তার কিছুই ভালো লাগছে না।
আজ দিনটাই তার খারাপ।
সে কিছু করতেও পারে না। তবে তিথি এত সহজে ধরা দেবে, কেন যে তার বিশ্বাস হচ্ছে না।
এই ভেবেই মনে সাহস সঞ্চয় করে ফেলল অরণি। শরীরও আর দিচ্ছে না। সাহস সঞ্চয় হতেই টের পেল, সে খুবই ক্লান্ত। খিদেও পেয়েছে। রান্নাবাড়িতে খাওয়ার আজ কোনও বন্দোবস্ত হয়নি। কোথায় খাবে, কী খাবে, তাও সে জানে না। অষ্টমী স্নান উপলক্ষে উপবাসের নিয়ম যদি থাকে—তাই বা কী করে হবে, তা হলে সারাদিন না খেয়ে থাকা যে বড় কষ্টের।
এইসব সাত—পাঁচ ভাবতে ভাবতে, নদীর পাড় থেকে চালতে গাছের জঙ্গল পার হয়ে কাছারিবাড়ির মাঠে ঢুকে গেল। মাঠে কেউ নেই—দূরে বাবুদের প্রাসাদে ঢোকার মুখে হাসনুহানার জঙ্গলে কেউ হারিকেন নিয়ে ভেতর বাড়িতে ঢুকে যাচ্ছে।
সে কোনওরকমে শরীর টানতে টানতে কাছারিবাড়ির দরজায় উঠে গেল। ঠেলা দিতেই দরজা খুলে গেল। আর অবাক মেঝেতে আসন পেতে কেউ তার ভাত ডাল তরকারি মাছ ঢাকা দিয়ে রেখে গেছে একটা বগি থালায়।
থালা তুলে তো সে আরও অবাক। দই মাছ মিষ্টি সহ কিছুটা পলান্ন এবং সাদা ভাত। পলান্নের সুবাসে তার জিভে জল এসে গেল।
ক্লান্ত অবসন্ন, তার কেমন চোখ বুজে আসছে। তার হাত মুখ ধোওয়া দরকার। বালতি ভর্তি জল রেখে গেছে কেউ। সে চোখে মুখে জলের ঝাপ্টা দিয়ে কেমন এক ঘোরের মধ্যে খেতে বসে গেল। এবং লণ্ঠন জ্বলছে সামনে। টিনের চালে গাছের ডাল নড়ানড়ি করছে বাতাসে।
খস খস শব্দ, এবং এই শব্দমালায় সে আগে বড়ই ভয় পেত, এখনও এইসব শব্দমালা উচ্ছ্বল না হয়ে উঠলেই তার কেমন সব মৃতবৎ মনে হয়। কেমন স্থবির মনে হয় চরাচর। সে একা এই কাছারিবাড়িতে থাকতে থাকতে খুবই অভ্যস্ত হয়ে ওঠায়, সে সহজেই দরজার বাইরে গিয়ে কীটপতঙ্গের আওয়াজ শুনতে ভালোবাসে। পাখির কলরব, নদীর জলে ছলাত ছলাত শব্দে তার কখনও মনেই হয় না সে কাছারিবাড়িতে একা আছে। আম জাম গাছের ছায়াও তার বড় অবলম্বন। রাতের অন্ধকারে দূরের মাঠে শেয়ালেরা ডেকে গেলেও সে ভাবে, সে আর একা নয়। সবাই আছে তার আশেপাশে। মানুষই শুধু মানুষের নির্ভর এটা তার তখন আর মনে হয় না।
সে খাচ্ছিল।
আর কেমন সুস্বাদু খাবার তার জিভে স্বাদের রহস্য সৃষ্টি করতে করতে, টিনে ডালপালার শব্দ শুনতে শুনতে আবার কেন যে মনে হচ্ছে তিথি কথা বলছে।
শুনছ?
কী শুনব?
বারে আগের জন্মে জানো আমি নদীতে ডুবে থাকতাম। ভেসে উঠতাম।
কেন ডুবে থাকতিস?
বারে আগের জন্মে আমি শুশুক মাছ ছিলাম। ভেসে উঠতাম।
যা, বাজে কথা।
তুমি কিছুই জানো না? ভরা কোটালে নদীর পাড়ে এলেই তারা আমায় ডাকে।
কে ডাকে?
বারে নদীর গর্ভে তারা যে উঠে আসে।
বাজে কথা।
তুমি আমার কিছুই বিশ্বাস করতে চাও না। কিছুই বিশ্বাস করতে চাও না। কিছুই তুমি আর আমার শরীরে খুঁজে পাও না। তুমি জানোই না কেন তুমি আমার শরীরে আঁশটে গন্ধ পাচ্ছিলে!
আঁশটে গন্ধ কোথায়? বাজে কথা? পদ্মপাতার গন্ধ পাচ্ছিলাম।
তুমি তো নিজের মধ্যে নেই অরুদা। কিছুই তুমি মনে করতে পারছ না। শরীরে আমার শ্যাওলার গন্ধ, তারপর পদ্মপাতার গন্ধ—শেষে আঁশটে গন্ধ। আমি তো ভেসে উঠেছিলাম, শ্যাওলার জঙ্গল ফুঁড়ে, পদ্মপাতার নিচে ডুব দিলাম। শরীরে পদ্মপাতার গন্ধ পেলে। আরও ভেসে উঠলে আঁশটে গন্ধ। তুমি কেমন ঘাবড়ে গিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরলে—অথচ শরীরে কিছুই খুঁজে পেলে না। মাছের শরীরে মানুষ কী করে খুঁজে পাবে সব।
তা ঠিক। তুই মাছ হয়ে গেছিলি।
শুশুক মাছ। নদীর জলে ভেসে যেতে চাইলাম, নড়লে না, দাঁড়িয়ে থাকলে। আমি যে তোমাকে নদীর জলে নিয়ে যেতে চেয়েছিলাম। নদীতে ডুবে ডুবে আমরা শুশুক মাছ হয়ে গেলে কেউ আর আমাদের খুঁজেই পেত না। আমার সঙ্গে চলো না?
কোথায়?
কেন নদীতে?
কী হবে গিয়ে?
দুজনে মাছ হয়ে থাকব।
যা, তুই একটা পাগল।
আমি পাগল, না তুমি পাগল! জলের নীচে শুশুক মাছ হয়ে থাকলে কত সুবিধে বলো তো!
কীসের সুবিধে!
তুমি যাবে কি না বলো। কেউ টের পাবে না। বলেই তিথি তার শরীর থেকে সব সায়া শাড়ি সেমিজ খুলে ফেলতে থাকল, তারপর নদীর চরে ছুটতে থাকল।
সেও নেমে গেছে তিথির পিছু পিছু।
সব চরাচর একেবারে স্তব্ধ হয়ে আছে। নীল জল এবং জলরাশি খেলা করে বেড়াচ্ছে চারপাশে। ঢেউ উঠছে। তারা দুজনেই হেঁটে হেঁটে পার হয়ে গেল নদী।
তারপরই এক বিশাল বালির চর সামনে। কেমন এক অন্য গ্রহে তাকে নিয়ে তিথি উঠে এসেছে।
ঐ যে দেখছ?
তিথি তুই আমাকে কী দেখাচ্ছিস?
ঐ যে দেখছ, নদীর চড়ায় একটা স্টিমার আটকে আছে। ওটাই আশরাফ সারেঙের স্টিমার। কবে কোন কালে নদীর গর্ভে ডুবে গিয়ে বালির চড়ায় ভেসে উঠেছে।
তিথি তাকে কোথায় নিয়ে এল! কিছুই সে চিনতে পারছে না। কেমন তেপান্তরের মাঠে নেমে আসার মতো এবং সে যেদিকে তাকাচ্ছে, সর্বত্রই সে অদ্ভুত সব দৃশ্য দেখতে পাচ্ছে। একটা বজরা দেখতে পেল। বজরটা বালির চড়ায় প্রায় সবটাই ডুবে আছে। জেগে আছে শুধু তার মাস্তুল আর গলুইর দিকটার একটা ঘর। এভাবে ভাঙা—জাহাজের কবরখানায় সে কী করে যে এসে হাজির হল বুঝতে পারছে না।