আর তখনই কেন যে নদীর পাড়ে চিৎ হয়ে তিথির পড়ে যাওয়ার দৃশ্যটা অরণির চোখে ভেসে উঠল। মেয়েটার সেই অসহায় মুখ এবং ক্ষোভ দুই—ই তাকে যেন তাড়া করছে।—কেন আমার সব দেখে ফেললে, কেন! সব দেখে ফেলার পরও উষ্ণতায় জড়িয়ে ধরার সময় কিছুই খুঁজে পাও না কেন? বলো! বলো!
তিথি তুই কোথায়! আমি তোকে দেখতে পাচ্ছি না। তোর কথা শুনতে পাচ্ছি। সে তার চারপাশে তিথিকে খুঁজছে। কেউ নেই। চারপাশে শুধু ম্রিয়মাণ জ্যোৎস্না।
এখন তার একটাই কাজ, বাবাকে দৌড়ে গিয়ে খবরটা দেওয়া।
অরণির মনে হল বাবাকে গিয়ে খবরটা দিতে পারলে তিনি ছুটে আসতে পারেন।—আবার মহেশের কবজায় পড়ে গেল মেয়েটা! তুই কী রে, ধম্ম অধম্ম নেই! কচি মেয়েটার পেছনে সেই থেকে লেগে আছিস। অনাথ বলে কি ফ্যালনা! যার যা খুশি তাকে নিয়ে যেভাবে খুশি ফুর্তি করবে। বের করছি ফুর্তি করা। বাবা এলেই মহেশের জারিজুরি যেন ভেস্তে যাবে।
সে এই ভেবে প্রাসাদের অন্দরমহল পাড় হয়ে দিঘির পার ধরে ছুটবে ভাবল। সেই সব পেয়ারা গাছ, লিচু গাছের বাগান পার হয়ে নদীর পাড়ে চলে যাবে ভাবল—এক্ষুনি খবরটা না দিতে পারলে তিথির সমূহ সর্বনাশ।
সে তখনই দেখল তিথিদের বাড়ি থেকে কারা বের হয়ে আসছে। জঙ্গলের মধ্যে সে ঝুপ করে বসে পড়ল। শুধু জঙ্গলের ফাঁকে মাথাটা বের করে রেখেছে।
আগে গোরাকাকা—হাতে প্যাট্রোম্যাক্স।
আলোয় আলোয় ভরে গেছে তিথিদের বাড়িঘর—সুপারিবাগান।
এই কী দেখছে!
ঐ তো বাবা।
বাবা তিথিকে যেন জোর করে ধরে নিয়ে আসছেন। প্যাট্রোম্যাক্সের আলোয় দেবীর মুখ ঝলমল করছে। বেনারসি শাড়ি পরনে, তিথির হাতে বালা, কঙ্কন, কোমরে সোনার বিছেহার, তিথির শাড়ির কুঁচিতে সোনার ঝলমলে লেসের কারুকাজ, মাথায় টায়রা, চোখ বিস্ফারিত, তিথি যেন হাঁটতে পারছে না, শাড়ি আর অলঙ্কারের ভারে জবুথবু হয়ে গেছে। যেন যে—কোনও মুহূর্তে শাড়ির প্যাঁচে হোঁচট খেয়ে পড়ে যাবে।
আর তার পাশেই তুলি। বোধহয় পড়ে গেলে তুলে ধরবে। তুলির শরীরে ভর করে তিথি যেন কোনওরকমে এগিয়ে যাচ্ছে। সেই বুড়ো লোকটার কাছে যাবে, কিংবা নদীতে বজরা ভেসে আছে, সেখানে তুলে নিয়ে যেতে পারে—কী যে হবে, সে কিছুই জানে না।
তিথি জমিদারবাবুদের এঁটো খেয়ে বড় হয়েছে, তার পক্ষে বেশি আশাও করা বোধ হয় ঠিক না, তাকে যেভাবে সাজিয়ে দেওয়া হয়েছে, তাতে তিথির বলারও কিছু থাকতে পারে না। তাকে একবার দেখবেন সেই গোপীবল্লভ না কি যেন, শীর্ষ পালও হতে পারে—তার মাথা ঠিক নেই, সে ঠিক মনে করতে পারে না। মহেশ নৌকায় তুলে নিতে চেয়েছিল তিথিকে, বড়ই মহাজন ব্যক্তি মানুষটি বজরায় শুয়ে আছেন, আরাম করছেন, তিথিকে নিয়ে যেতে পারলে তিনি দেখে খুবই খুশি হবেন—এমন সব কথাবার্তা মেলাতে তিথিকে বোধ হয় বলেইছিল—তিথি লোকটাকে একদম পাত্তা দেয়নি। নৌকার পর নৌকা লাফিয়ে লাফিয়ে পার হয়ে গেছে। সে তো দেখতেই পাচ্ছে, তিথিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, বাবুদের বৈঠকখানায়। অনাথ মেয়েটির এত হেনস্থা। কেউ টের পাচ্ছে না। বাবাও না। মহেশ কচলাত বলে, তাকে দেশান্তরী করতে চেয়েছিলেন, এখন এই কালভৈরবের হাত থেকে কে উদ্ধার করবে তাকে?
কেন তুমি?
কে?
বারে দেখতে পাচ্ছ না আমি তিথি। আমাকে নিয়ে যাচ্ছে, আমার দাসদাসীর অভাব থাকবে না জানো, সোনার অলঙ্কারে আমাকে মুড়ে দেওয়া হয়েছে, দেখতে পাচ্ছ না—পছন্দ হলেই বজরায় নিয়ে তোলা হবে।
তিথি তুই কোথা থেকে কথা বলছিস?
কেন এই যে দূরে, আমি যাচ্ছি, গাছপালা ভেদ করে আমাকে নিয়ে তোলা হচ্ছে বাবুদের বৈঠকখানায়, নদীর পাড়, কাশবন, জলের ঢেউ, চড়ায় পাখিদের ওড়াউড়ি থেকে আমাকে তুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, অন্ধকার প্রেতপুরীতে, তুমি অরুদা কিছুই বুঝতে পারছ না।
হঠাৎ কেউ ইচ্ছে করলেই তুলে নিয়ে যেতে পারে?
বারে আমার কর্তাটির যে ইচ্ছে হয়েছে, আমাকে চিবোবে।
তিথি আমি কিছু বুঝতে পারছি না।
আর বুঝতে হবেও না।
আমি তোকে নিয়ে কোথাও চলে যাব।
কোথায়?
যেখানে বলবি।
তবে গেলে না কেন? ঘোর উজানে তোমাকে নিয়ে সাঁতার কাটব বলে বের হলাম, নদীর জলে টেনে নামাতে চাইলাম, তুমি তো কিছুতেই রাজি হলে না। আমাকে ফেলে কতবার নদী থেকে উঠে এসেছ, মনে নেই। এখন যত কষ্টের কথা তোমার মনে পড়ছে। আমি মরে গেলে রক্ষা পাও তোমরা, আমি বুঝি না।
তিথি তুই চুপ করবি!
চুপ করব কেন? আমি তোমার খাই না পরি।
প্যাট্রোম্যাক্সের আলো, লোকজন, তিথি, বাবুদের অন্দরমহলে কখন ঢুকে গেছে! সে একাই দাঁড়িয়ে আছে ঝোপের আড়ালে। এতক্ষণ তিথির সঙ্গে কথাও বলেছে। সে আর তিথি, তিথি এত কাছ থেকে কথা বলে, অথচ সে তাকে দেখতে পায় না কেন? তিথি বলে, না সে নিজেই তিথির হয়ে কথা বলে।
এই প্রবাসে তিথি ছাড়া সেও যে বড় অনাথ।
ঝোপজঙ্গলে জোনাকি উড়ছে। ভাদ্রমাসের আকাশ—সব নক্ষত্র আকাশে যেন ফুটে আছে। নীল এবং সবুজের সমারোহে সে ডুবে যাচ্ছিল। সে কী করবে বুঝতে পারছে না। কাছারিবাড়িতে ফিরে যাওয়া ছাড়া তার গত্যন্তর নেই। খুব গোপনে কাজটা হচ্ছে, তিথিকে দেখানো হচ্ছে, তিথির বাবা অকুল পাথারে পড়ে আছে—তিথিকে পালমশাই—এর হাতে তুলে দিতে পারলেই পাকাবাড়ি, বাজারে পাকা বন্দোবস্ত এমন সব সুযোগ কে হাতছাড়া করে!