প্রাসাদের সুন্দর বউমাটিও নেই। কিংবা থাকতে পারে, ভেতরের দিকে থাকতে পারে। সে তো ঘরের সবটা দেখতে পাচ্ছে না। বিশাল জানালাগুলি প্রায় দরজা সমান। খড়খড়ির পাল্লা। জানালা বন্ধ। খড়খড়ি তোলা আছে বলে, বাইরে আলো এসে পড়ছে।
কিছুটা যেন এই বাড়িতে গোপন গম্ভীর অবস্থা, যে—কেউ ইচ্ছে করলেই এদিকটায় ঢুকতে পারে না। বৃন্দাবনদাকেও দেখা যাচ্ছে না। রান্নাবাড়িতেও কেউ নেই। আজ রাতের খাওয়া কি হবে তাও সে বুঝতে পারছে না। শুধু দাওয়ায় হারিকেন জ্বলছে একটা।
সে পাঁচিলের দিকে ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। কেন যে আছে, কীসের এক রহস্য যেন তাকে তাড়া করছে। ‘টোপ’ কথাটা তার ভালো লাগেনি। কার টোপ, কীসের টোপ, পাঁচিল সংলগ্ন অন্দরের দরজায়, তার আড়ালে নিশ্চিন্তে দাঁড়িয়ে থাকা যায়, এমন ভাববার সময়ই সে দেখল, সুপারিবাগানের ভেতর থেকে একটা আলো এসে তার পায়ের কাছে পড়ছে। সে চোখ তুলতেই টের পেল, বাগানের ভেতর দিয়ে কেউ হারিকেন হাতে এগিয়ে আসছে।
এ—জায়গাটাও নিরাপদ নয়। আসলে কি সে তিথিকে খুঁজতে এদিকটায় চলে এসেছে!
তিথি রান্নাবাড়িতেই পড়ে থাকে। যদি তিথির দেখা পাওয়া যায়। দেখা হলে সে তার মনের সংশয় খুলে বলতে পারত।
তিথি তুই কি দৈব তাড়িত?
তিথি তুই সত্যি সারাদিন আমার সঙ্গে মেলায় ছিলি?
তিথি তুই নৌকা থেকে আর এক নৌকায় লাফিয়ে পড়লি, মিসরি বাতাসা মন্দিরে দিলি, কিন্তু আমার যে কী হয়েছে, কেন যে মনে হচ্ছে সবই অলীক ঘটনা। কোনও ঘোরে পড়ে গেছি। তুই সত্যি করে বল তো…
কী বলব?
সত্যি করে বল তোর সঙ্গে আমার কিছু হয়েছে কি না!
কী হবে?
বারে তুই যে বললি, তুমি কী অরুদা, আমার কিছুই খুঁজে পাচ্ছ না।
তুমি আমার কী খুঁজছিলে?
আমি মুখ ফুটে বলতে পারব না। আমি কী খুঁজছিলাম, তুই জানিস না?
কী করে জানব, না বললে!
তারপরই অরণি ঘাবড়ে গেল।
কার সঙ্গে কথা বলছে! এ তো বাগানের ভেতর দিয়ে হারিকেন হাতে বৃন্দাবনদা পাঁচিলের দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল। কেমন একটা গোপন শলাপরামর্শ চলছে। কে কথা বলল, কার গলার স্বর? তিথির মতো অবিকল নকল করে কে কথা বলল!
সে দরজায় আড়াল থেকে পা টিপে টিপে কিছুটা এগিয়ে যেতেই দেখল, বৃন্দাবনদা হারিকেন রোয়াকে রেখে করজোড়ে প্রণিপাত সারছে। তারপর যা বলল, তাতে অরণির হৃৎকম্প উপস্থিত হবার জোগাড়।
ধরে এনেছে হুজুর। সাজানো হচ্ছে। কোথায় যে থাকে। একটু চঞ্চল স্বভাবের। সাজিয়ে দিচ্ছে বউমা। গোরাচাঁদ আমাকে পাঠাল। দোষ নেবেন না। ছেলেমানুষ, বুদ্ধিসুদ্ধি পরিপক্ব নয়।
অরণি আড়াল থেকেই টের পেল এই যে আর্জি পেশ সবই ধনাঢ্য ব্যক্তিটিকে উদ্দেশ্য করে।
নবকুমারবাবু বললেন, তা ঠিক, ঐ সেদিন হল মেয়েটা। থাকার জায়গা নেই, বাগানের এক কোণায় ঘর তুলে নিতে বললাম। এখন পালমশাই আপনার দয়ার শরীর। কন্যেটিকে উদ্ধার করে নিলে, গোরাচাঁদের বড়ই কল্যাণ হয়।
বৃন্দাবনদাই বললেন, যা হোক শেষ পর্যন্ত হুজুর রাজি করানো গেছে। গোরাচাঁদ তো হুজুর কেঁদেই ফেলল। এতবড় সুযোগ হাতের কাছে, তুই অবহেলায় নষ্ট করবি। আমাদের পাকাবাড়ি হবে, বাজারে মুদির দোকান করে দেবে, সংসারে এতবড় সুখের খবর, তুই রাজি হয়ে যা।
নবকুমারবাবু গড়গড়া থেকে মুখ তুলে বললেন, মেয়েটি বড়ই শান্ত প্রকৃতির। বয়সকালে যথেষ্ট বুদ্ধিমতী হবার সম্ভাবনা আছে। গোরাচাঁদের মেয়েটিকে আপনার যখন দেখার সাধ হয়েছে তখন দেখে যাওয়াই ভালো। মেয়েটি সাক্ষাৎ দেবী দুর্গা।
অরণি দূর থেকেই দেখতে পাচ্ছে, শুনতেও পাচ্ছে সব। নদীর পাড়ে বাড়ি বলে নির্জনতা সামান্য বেশিমাত্রায়, সে কান খাড়া করে শুনছে।
অস্পষ্ট আলোতে লোকটার মুখ মাঝে মাঝে কেন যে বাঘের মতো হয়ে যাচ্ছে। অথবা শিকার ধরার লোভে চোখ চক চক করছে। হাই তুলছে, কথাও বলছে, আজ্ঞে বাবুমশাই, মহেশই বছরখানেক আগে খবরটা দিয়েছে, বাড়ছে, দেবী দুর্গার শরীর পুষ্ট হচ্ছে। সেই খবর রাখত, কখনও নদীর জলে সাঁতার কাটছে, কখনও ছুটছে নদীর চর পার হয়ে, চুল উড়ছে। সে যা দেখত, বন্দরের ঘাটে নেমে গদিতে হুবহু বর্ণনা দিত। শুনতে শুনতে কেমন আমার আবেগ সৃষ্টি হয়ে গেল। দুই পত্নীর পরামর্শ নিতে হয়। পুত্রসন্তান না থাকলে মরেও যে শান্তি পাবে না তারা। তারা রাজি হয়ে গেল। বাড়িঘরের সৌন্দর্য রক্ষার্থেই মহাঅষ্টমী স্নানে আসা—একবার দেখেও যাওয়া। এমনকি পাখনাওয়ালা কন্যা যে ফুরুত করে হাত থেকে উড়ে যাবে।
অরণি বুঝল, আসলে লোকটা টাকার গরমে সেদ্ধ হচ্ছে। তিথির মতো অনাথ বালিকার পক্ষে উড়ে যাওয়া যে কিছুতেই সম্ভব না, ‘ফুরুত করে উড়ে যাবে’ কথাটাতে সে আরও বেশি টের পেল।
অরণি এখন যে কী করে!
তার অবশ্য করবারও কিছু নেই।
সে রেগেমেগে নদীর পাড়ে গিয়ে শুধু দাঁড়িয়ে থাকতে পারে। অথবা দৌড়ে গিয়ে সে তার বাবাকে খবর দিতে পারে। মহেশ তিথিকে কচলাত, বাবা খবরটা শোনার পরই ডেকে পাঠিয়েছিলেন এবং দেশ ছাড়া করেছিলেন।
বাবা খবর পেলে ছুটে চলে আসতে পারেন, গোরাকাকাকে ধমকও দিতে পারেন, তুই কি পাগল হয়ে গেছিস! এতটুকুন মেয়েটাকে টাকার লোভে একটা পিচাশের হাতে তুলে দিচ্ছিস! টাকার পিচাশ! টাকা ছাড়া কিছু বোঝে না। বয়সের গাছ পাথর নেই, তুই কী রে! দু—দিন বাদে যমের দুয়ারে দৌড়বে, তোর এতটুকু কাণ্ডজ্ঞান নেই গোরা!