জ্যোৎস্না রাত, নদীর ঢেউ, জলে অজস্র নৌকায় লম্ফের আলো, বাঁশবনে পাখির কলরব এবং স্টিমারঘাটের গ্যাসের বাতি তাকে কেমন কুহকে ফেলে দিয়েছে। অথবা তিথিও তাকে কুহকে ফেলে দিতে পারে। সে কিছুটা অন্যমনস্কভাবে তিথির খোঁজে বাড়িটায় গিয়ে দেখলে হয় সে বাড়িতে আছে, না মেলায় এখনও ঘুরে বেড়াচ্ছে। সারাটা দিন সে যে তিথিকে নিয়ে মেলায় ঘুরেছে, তার কেন যে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হচ্ছে না। কিংবা সুপারিবাগানে ঢুকে সে তিথিকে নিয়ে মজে গিয়েছিল, তাও ভাবতে তার কষ্ট হচ্ছে। খুবই একা এবং নিঃসঙ্গ সে। মনে মনে সে তিথিকে নিয়ে কত কিছু ভাবে—তিথির জন্য এই আকুলতাই তার এই ঘোরে পড়ে যাওয়ার মূলে। তিথিকে টোপ হিসাবে কে ব্যবহার করতে চায়—যদি চায়ই, তিথি ইচ্ছে করেই তাকে আজ টোপ দিল কেন, কিংবা তিথির অন্তরালে কোনও দৈব যদি তাকে তাড়া করে থাকে। কোনও দৈব যে ছলনা করেনি কে বলবে! তিথি সেজে যদি হাজির হয়, সাধ্য কি সে তাকে অবহেলা করে।
নানারকমের সংশয়ে সে ভুগছিল এবং কখন কাছারিবাড়ি ফিরে ঘরের জানালায় চুপচাপ বসে আছে, টেরই পায়নি।
জানালায় কেউ যেন তখনই উঁকি দিয়ে গেল।
কে?
সে ঠিক দেখতে পাচ্ছে না। ফ্রক গায় মেয়েটা তিথি না তুলি তাও বুঝতে পারছে না। সে কিছুটা বোকার মতো দরজা খুলে বাইরে বের হয়ে গেল। না কেউ না। তারপর ফের কাছারিঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে জানালায় বসলে সে দেখল এবারে শাড়ি পরা কোনও নারী তার দিকে এগিয়ে আসছে।
সে আর পারল না।
সে চিৎকার করে ডাকল, কে ওখানটায়। কদম গাছের নিচে কে দাঁড়িয়ে আছে।
সঙ্গে সঙ্গে সেই নারী অন্ধকারে হারিয়ে গেল।
অরণি ভালো করে চোখ কচলে দেখল, না কাউকে আর দেখা যাচ্ছে না। অরণির ভয় ভয় করছে। একবার ছুটে পড়ার ঘরে চলে গেলে হত। বাবার ফিরতে রাত হবে। অষ্টমী স্নানে বাবার একদণ্ড ফুরসত থাকে না। জমিদারবাবুদের সঙ্গে মেলায় ভলান্টিয়ার থেকে জলছত্রের সব ব্যবস্থাই তাকে দেখতে হয়। চিঁড়ে গুড় বাতাসার ব্যবস্থা করতে হয়। বেশি রাত হয়নি। স্টেশন মাস্টারের ঘরে বসে বাবা যদি পাশাখেলায় মত্ত হয়ে পড়েন—তবে ফিরতে অনেক রাত হবে। বাবা কোথায়, সে তাও জানে না। তবে বাবা আজ নাজিরখানায় যাননি, সারাদিন তাঁবুতে বসে ছিলেন—তারপর কোথায় সে জানে না। পাইক—বরকন্দাজদের কারও পাত্তা নেই। বাবুদের ছেলেরা হয় যাত্রা দেখতে গেছে। আজ যে ‘তরণী বধ’ পালা হবে তাও সে জানে। আট আনা অংশের জমিদার অম্বিকাবাবুর নাটমন্দিরে যাত্রাপালা দেখার জন্য বাড়ির ভেতরও কেউ থাকবে বলে মনে হয় না। স্কুল ছুটি, পড়া থেকে ছুটি, সামনে তার টেস্ট পরীক্ষা, অথচ সারাটা দিন তিথিকে নিয়ে ঘুরছে, কেবল মনে হচ্ছে, তিথি না, অন্য কেউ। কোনও দৈব তার সঙ্গে সারাদিন ছলনা করে গেছে। তিথি হয়তো তার সঙ্গে যায়ইনি।
সে বড়ই বিভ্রমে পড়ে যাচ্ছে।
কদম গাছের ছায়া কিংবা কলাতলায় কেউ যদি ফের আসে। আর আশ্চর্য তখনই মনে হল, ঘরে কে তবে হারিকেন জ্বালিয়ে রাখল! তিথি মেলায়, তার সঙ্গেই তো তিথি ফিরছে। তিথিই ঘরে হারিকেন জ্বালিয়ে রাখে—কখন তার ঘরে ঢুকে গেল মেয়েটা।
এতসব বিভ্রমে পড়েই সে দরজা খুলে বাইরে বের হয়ে এল। এদিকটায় এত নিরিবিলি যে একদণ্ড দাঁড়িয়ে থাকতে তার ভয় করছে। কে কখন তার সামনে ফ্রক কিংবা শাড়ি পরে হাজির হবে ঠিক কি। আসলে মাথাটাই কেমন গণ্ডগোল শুরু করে দিল।
আসলে সে সকাল থেকেই নিজের মধ্যে নেই। সে কুহকে পড়ে গেছে সকাল থেকেই।
তবু নিজের উপর চরম আস্থা বজায় রেখে সে কোনওরকমে কেয়াফুল গাছের নিচে ছুটে গেল। পড়ার ঘরে অন্ধকার। কারও সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না। ভেতর বাড়ির দিকের রাস্তায় ঢুকে বুঝল গোটা এলাকাটাই রহস্যময় হয়ে গেছে। কেবল বৈঠকখানায় একটি অতি মৃদু সেজবাতি জ্বলছে। সেখানে বাবার হুজুর নবকুমারবাবু বদরি হুঁকোয় চোখ বুজে তামাক সেবন করছেন। পাশে আরও একজন।
তিনি কে?
তাঁকে সে কখনও দেখেনি।
বয়স্ক মানুষ। গোঁফ আছে। পাকা গোঁফ। গলায় কণ্ঠি। ঘরে মৃদু সৌরভ তামাকের। লোকটার মুখ ধোঁয়ায় কিছুটা আচ্ছন্ন। তবে খুবই ধনাঢ্য ব্যক্তি বোঝাই যায়। পায়ে পাম্প সু। মোজা। সিল্কের পাঞ্জাবি গায়। হাতের আঙুলে হীরের আংটি—কারণ এই নিষ্প্রভ সেজবাতির আলোতে আঙুলের আংটি থেকে হীরের দ্যুতি উঠছে। কোনও কূট গভীর পরামর্শে তাঁরা দুজনেই যে মগ্ন ছিল, অরুর বুঝতে অসুবিধা হয়নি।
তখনই স্তিমিত গম্ভীর গলা—কে দরজায় দাঁড়িয়ে।
অরু অর্থাৎ অরণি সঙ্গে সঙ্গে সরে দাঁড়াল। সে কোনও জবাব দিল না।
এ—সময় এদিকটায় বোধহয় তার আসা উচিত হয়নি। কারণ এতবড় প্রাসাদতুল্য বাড়িতে কোথায় কে আছে বোঝাও দায়। তুলির ঘর বন্ধ। রোয়াক থেকে সে উঠোনে নেমে যাবার সময়ই মনে হল বীণাপিসির দরজা হাট করে খোলা। ঘরের ভেতর হ্যাজাক বাতি জ্বলছে।
আর অবাক, সে দেখল, জেঠিমা—বীণাপিসি এবং আরও দু—একজন অপরিচিত মহিলা ফরাসের ওপর বসে আছেন। পানের বাটা থেকে পান তুলে মুখে দিচ্ছেন কেউ। বেশ হাসিমশকরা যে চলছে তাও বোঝা যায়। রান্নাবাড়ির দিকে সরে যাওয়ায়, তাকে কেউ দেখছে না।
তুলি কোথায়?
তা যাত্রাপালা দেখতে যেতে পারে।